[পর্ব-১১]
অরুন্ধতীর পরীক্ষা শেষ হতেই ভীষণ চেঁচামেচি শুরু করলো, অতিষ্ঠ করে তুললো তিতলি-বাদলকে। বাদল ছুটি নিয়ে নিলো দিন পাঁচেকের। তিতলিও আগেই বলে রেখেছিল অফিসে, ছুটি পেতে তারও সমস্যা হলো না তেমন। কিন্তু কোথায় যাবে, তা নিয়ে শুরু হলো দ্বন্দ্ব। অরুন্ধতী সমুদ্র দেখবে। বাদলের ইচ্ছে সিলেটে যায়। বাদলের ইচ্ছের পেছনে অবশ্য অন্য একটা কারণও আছে, জানে তিতলি। সে দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছে সিলেট যাবে, শাহজালালের মাজার জিয়ারত করবে। মা মারা যাওয়ায় ইদানীং তার ধর্মভাব প্রবল হয়েছে আরও। নিয়ম করে নামাজ পড়ছে পাঁচওয়াক্ত, অরুন্ধতীকেও পড়তে বলছে, সুযোগ পেলে তিতলিকে কটাক্ষ করতেও ছাড়ছে না। বাদলের ধর্মভাবে তিতলির এলার্জি নেই কোনো। কিন্তু তাকে অকারণে কটাক্ষ করাটাকে মোটেই ভালভাবে নিতে পারে না সে। ফলে লেগে যায় তুলকালাম। কিন্তু বেড়ানোর ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকলো সে। সিলেট বা কক্সবাজার দুই-ই সমান তার কাছে। কোনো একজায়গায় গেলেই হয়। পারলে দুই জায়গায়ই যায় সে। বাবা-মেয়ের লড়াইয়ে কে জেতে, দেখার অপেক্ষায় থাকলো। অনিবার্যভাবেই পরাজয় বরণ করতে হলো বাবাকে।
তুমি বরং পরে আবার কখনো সিলেট থেকে ঘুরে এসো।—বাদলকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলো তিতলি।
হ্যাঁ, আমি তো তোমার মতো ঝিমুনি ধরা অফিসে চাকরি করি! চাইলেই ছুটি মিলবে আবার!—বিরক্ত, ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে বাদল।
তো? তোমার মেয়েকে বলো, আমাকে কেন মেজাজ দেখাচ্ছ শুনি? আমি তো কোথাও যেতেও চাইছি না, যাব না তাও বলছি না! আমি হলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকার!
কটমটে চোখে তাকাল বাদল। তাকে আর একটু উসকে দিতে ফোড়ন কাটলো তিতলি, ও আমি ঝিমুনি ধরা অফিসে চাকরি করি? মন্দ কী! হাঁপানি রোগের চে’ ঝিমুনি রোগ ঢের ভালো!
হাঁপানি রোগ কার?—রেগে গিয়ে প্রশ্ন করে বাদল।
তোমার আর তোমার অফিসের। সারাক্ষণ তো এজমারোগীর মতো হাঁপাচ্ছ! একটুও অবসর নাই তোমাদের। আজ এই প্রোগ্রাম, কাল সেই মিটিং, পরশু ওই কচুর এসাইনমেন্ট! লেগেই আছে!
তাহলে কি তোমাদের মতো রাণীক্ষেত রোগী হয়ে ঝিমোব?
না, হাঁপানি রোগী হয়ে হাঁপাও মহানন্দে!
বাদল রেগে আগুন হয়ে উঠলো এবার। তিতলির মতো বাচাল মেয়ে আর জীবনে দেখেনি এমন বক্তব্যে অকাট্য সব যুক্তি দেখাতে শুরু করল। হাসি চেপে সরে এলো তিতলি। কক্সবাজার যাওয়াই স্থির হল শেষে। হাতে সময় বিশেষ নেই। মাঝে দিন মাত্র সময় আছে হাতে। অরুন্ধতীকে নিয়ে অফিসের ফাঁকে ফাঁকে শপিং সেরে নিল তিতলি। দীপনকে একবার জানান দরকার। একফাঁকে ফোন দিলো তিতলি। ফোন ব্যস্ত। আবার দিলো কিছুক্ষণ বাদে। সেই একই। ব্যস্ত। ভুরু কুঁচকে উঠলো তার। তিতলি ফোন করলে কত না ব্যস্ততা থাকে তার, ফোন রাখার জন্য! আর এখন? মনের কোণে মেঘ জমে যায় তিতলির। দীপন বরাবর তাকে এড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু কেন! সে তো তেমন কিছুই চায় না দীপনের কাছে। তবু কিসের এত ভয় তার কে জানে!
শেষপর্যন্ত পাওয়া গেল দীপনকে। মহাব্যস্ত। মিটিং।
ঘোড়ার ডিমের মিটিং তোমার! যখনই কথা বলতে চাই, শুধু মিটিং আর মিটিং! ভণ্ডামির আর জায়গা পাও না, না? বললেই হয় কথা বলতে চাও না! শুধু শুধু মিটিংয়ের অজুহাত দেখাও কেন?
মানে কী? তোমার কাছে অজুহাত কেন দেখাতে হবে আমার? তুমি তেমন কেউ নও!
দীপন!—ভীষণভাবে কঁকিয়ে ওঠে তিতলি। ব্যথিত, বিস্মিত।
হ্যাঁ, তুমি তেমন কেউ নও, যাকে অজুহাত দেখিয়ে সম্পর্ক ঠিক রাখতে হবে আমার!
আমি তোমাকে ভালোবাসি দীপন! খুব!—কাঙালের মতো বলে ওঠে তিতলি।
জানি। সব জানি। তার মানে তো এই নয় যে তোমার কাছে বাঁধা পড়ে গেছি আমি! তার মানে তো এই নয় যে তোমার কাছে কোনো দায় আছে আমার!
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-১০॥ শিল্পী নাজনীন
আমাকে একটু বুঝতে চেষ্টা কর দীপন! প্লিজ!
তোমাকে বোঝার কোনো দায় নেই আমার। সময়ও নেই। বিরক্ত করো না এখন। কাজ করছি। রাখছি।
ফোন রেখে দিল দীপন। ভীষণ নীরব, নিঝুম হয়ে গেলো পৃথিবীটা হঠাৎ। মাথাটা ফাঁকা। ভীষণ অস্থিরতা ঘিরে ধরল আচমকা তিতলিকে। জাপটে ধরলো সর্বশক্তিতে। যন্ত্রণা খুবলে নিতে চায় হৃৎপিণ্ড। তিতলি লক্ষ করলো তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। কান্না উপচে পড়ছে দু চোখ বেয়ে। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে তিতলি। দীপন! কী করে পারে! এই দীপনকে সে চেনে না। ভীষণ অচেনা, অপরিচিত এক মানুষ এখন দীপন তার কাছে। দীপনকে জানান হল না কক্সবাজার যাচ্ছে সে। তার কক্সবাজার যাবার আনন্দ পুরোটাই মাটি করে দিলো দীপন। ভীষণরকম অসহায়, অসার লাগলো নিজেকে হঠাৎ। দীপনের ওপর অভিমানে বুকের মধ্যে কান্না দলা পাকাতে থাকলো অবিরাম। ব্যথা। তীব্র, তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণা শুধু দীপনই দিতে পারে তাকে। অন্য কেউ নয়।
পানসে হয়ে গেলো সব। যন্ত্রের মতো ব্যাগ গোছালো তিতলি। অরুন্ধতীর সাতটা প্রশ্নের একটা উত্তর দিলো কী দিলো না। বিরক্ত, বিস্মিত অরুন্ধতী বাবার কাছে গিয়ে আশ্রয় নিলো। শেষে বলেই ফেললো, মা, কী হয়েছে তোমার?
কী হবে?—চমকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো তিতলি। তাহলে আমার কথা শুনছ না যে?
ভালো লাগছে না। যা এখান থেকে।
অরুন্ধতী সরে গেলো। তিতলির খেতে ইচ্ছে করে না, গা গুলিয়ে আসে। ঘুম হয় না রাতে। সারাক্ষণ ভীষণ অস্থিরতা বুকের মধ্যে দাপড়ে বেড়ায়। ঘুমের মধ্যেও এসে হানা দেয় দীপন। অসহ্য। যেন কিশোরী মেয়ে সে, প্রেমে পড়েছে সদ্য। অথচ দীপন! সেই যে ফোন রাখলো, আর তার কোনো সাড়াশব্দ পর্যন্ত নেই। বেহায়ার মতো, আর থাকতে না পেরে নিজেই একবার ফোন দিলো তিতলি। ধরল না দীপন। কেটে দিলো ফোন। তারপর যতবার ফোন দেয় তিতলি, ব্যস্ত দেখায়। তার মানে, তিতলির নাম্বারটা ব্লক করে দিয়েছে দীপন! আর সামলাতে পারে না সে, বাচ্চা মেয়ের মতো কেঁদে ওঠে ডুকরে। অরুন্ধতী দৌড়ে আসে। তিতলিকে জড়িয়ে ধরে বলে, তোমার কী হয়েছে আম্মু? কাঁদছ কেন?
মেয়েকে জড়িয়ে কান্নার বেগ আরও বেড়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে বলে, কিছু হয় নাই মা।
বাবা বকেছে?
না।
তাহলে?
বললাম তো কিছু হয়নি!—বিরক্ত, অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে তিতলি।
বুঝেছি। তোমার বাবাকে আর আম্মুকে মনে পড়ছে তোমার, তাই না আম্মু?
হ্যাঁ! মনে পড়ছে!—বলে আবার হাউমাউ কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। তাকে জড়িয়ে অসহায়, অবাক মুখে দাঁড়িয়ে থাকে অরুন্ধতী। আম্মুকে এভাবে কখনো কাঁদতে দেখেনি সে।
চলবে…