[পর্ব-৪৩]
হিরোদের বাড়ি থেকে বিদায় নিতে নিতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তখন ধীরে ধীরে পাতলা-শুভ্র শাড়ির আঁচলের মতো কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে রাস্তার দুই পাশের গাছপালা। চরবাটার সীমানা শেষ হয়ে এলে যেখানে চর আমানুল্লা শুরু, সেখানে রাস্তার দুই পাশে বাবলার সারি। ডালে-ডালে দুলছে নাটাইফলের মতো বাঁকা বাবলার ছড়া। নাটাইয়ের ওপরের খোলস ছিঁড়ে ফেললে ভেতরে সাদা-হালকা লালচে রসালো ফল মেলে। ফলের ভেতর থাকে কালো কালো বিচি। কিন্তু বাবলার ছড়ার ভেতরে বিচি ছাড়া কিছু থাকে না। অর্থাৎ খাওয়ার মতো কিছুই মেলে না।
গায়ে হালকা শীত শীত লাগছে। সাইকেলের গতি যতই বাড়ছে, ঠাণ্ডাও তত বেশি লাগছে। গায়ের চাদরমুড়িতে ঠাণ্ডা মোকাবিলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া চাদর গায়ে সাইকেল চালানো কিছুটা ঝুঁকিরও। যদিও গ্রামের রাস্তা বলে এখানে কোনো বাহনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সড়ক দুর্ঘটনার কোনো আশঙ্কা এখানো নেই। শুনেছি শহরে নাকি মুহূর্তের অসতর্কতায় ঘটে যায় দুর্ঘটনা। চোখের পলকেই ঢলে পড়ে মানুষ। হারায় স্রষ্টার দেওয়া প্রাণ। কিন্তু গ্রামে সেই আশঙ্কা নেই, আতঙ্কও না।
তবে, অন্য আশঙ্কা আছে। রাস্তার ওপর অনেকেই ধান শুকাতে দেন। সেই ধানের লোভে নেমে আসে আশেপাশের বাড়ির মুরগি কিংবা পোষা কবুতর। সাইকেলের বেল দিলেও এসব গবাদি পশুপাখি সরে না। কেমন নির্বিকার ধান খুঁটেই চলে। মাঝেমাঝে নড়াচড়া করলেও উড়ে যায় না। উল্টো চাকার নিচে এসে পড়তে চায়। তাই এমন পরিস্থিতিতে সাইকেল চালাতে গেলে চোখ-কান খোলা না রেখে উপায় থাকে না।
গুচ্ছগ্রাম বাংলাবাজারের কাছাকাছি এসেছি। রাস্তায় কারা যেন ধান শুকোতে দিয়েছেন। তারই লোভে ঝাঁক-ঝাঁক কবুতর নেমেছে। যতটা ধান খুঁটে খাচ্ছে পাখিগুলো, তারও বেশি করছে বাকুম-বাকুম। কোনোটা নিরীহ ভাব নিয়ে, কোনোটা কেশর ফুলিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে। এত কবুতর একসঙ্গে রাস্তায় আর কখনো দেখিনি। খোকনদের বাড়িতে, তাদের উঠোনে দেখেছি। কিন্তু রাস্তায়? মনে পড়ে না। তাই এত কবুতর দেখে আমি কিছু আনমনা হয়ে যায়। কিন্তু সাইকেলের গতি কমে না। হঠাৎই একটি কবুতর সামনে পড়েছে দেখতে পেয়েই ব্রেক কষতে গেছি, কিন্তু না। ব্রেক ফেল। কবুতরটির ডানা থেঁতলে গেছে। আর যাই কই। রাস্তার দুই পাশ থেকে আমারই বয়সী তিন চারটি ছেলে এসে হাজির। একজনের হাতে আহত কবুতর। দুই জন দাঁড়িয়ে আছে। একজন আমার চাদর ধরে টানাটানি শুরু করে। তাদের দাবি, কবুতরের দাম দিতে হবে। আমিও ত্যাদড়—কেন দেব? আমি তো আর ইচ্ছে করেই কবুতরকে মারিনি। এছাড়া, ডানা একটু থেঁতলে গেছে। ওই জখমের ওপর একটুখানি হলুদ লাগিয়ে তার ওপর কাঁচি কিংবা খুন্তি গরম করে সেঁক দিলে দুদিনেই ভালো হয়ে যাবে। তাদের এই টোটকাও বাতলে দিলাম। কিন্তু ছেলেগুলো আমার কোনো যুক্তিই মানতে রাজি না।
সে আমার হাতে কবুতর তুলে দিয়ে সরে পড়লো। এখন আমি পড়েছি ধন্দে। এই কবুতর নিয়ে কী করবো? এতদূর একটা আহত কবুতর নিয়ে কিভাবে যাবো?
হই-হট্টোগোলে পাশের বাড়ি থেকে একজন বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। যেই ছেলেটি আমার চাদর ধরে টানাটানি করলো, বৃদ্ধকে দেখামাত্রই সে যেন ভেল্কিবাজির মতো উধাও।
এদিকে, মাঝ নদীতে নৌকাডুবির পর একটুকরো খড় দেখলে ডুবন্তপ্রায় যাত্রী যেমন তা ধরে বেঁচে উঠতে চায়, আমিও তেমনি এই বৃদ্ধের দিকে তাকাই করুণ চোখে। বলি, ‘দাদা, দেখেন, এরা কী করছে আমার লগে। আমি তো ইচ্ছা করে মারিনি। তাছাড়া তেমন কিছুই হয়নি। ডানায় একটু আঘাত লেগেছে…। বৃদ্ধ আমার কথা থামিয়ে ছেলেগুলোর দিকে তাকালেন। বললেন, ‘তোরা কী চাস?’ ছেলেগুলোর সমস্বরে জবাব—‘কইতরের পুরো দাম।’ এবার বৃদ্ধের প্রশ্ন, ‘কয় টেঁয়া?’ এবার যেন ছেলেগুলো ধন্দে পড়ে গেলো। বেশি চাইলে যদি না পায়, আবার কম চাইলে যদি ঠকে যায়! মিনিট কয়েকের দোলাচাল শেষে তারা বললো, ‘তিরিশ টেঁয়া।’ বৃদ্ধ আইচ্ছা বলেই আমার দিকে তাকালেন, ‘কোনো ঝামেলা করিও না। দিয়া দেও।’
ভেবেছিলাম, বৃদ্ধ আমাকে ছাড় দেবেন। কিন্তু না। তিনি তার রায় ঘোষণা করেই দিলেন। সেখানে আমার প্রতি কোনো রকম মমত্ব দেখালেন না। আমি ভিনগাঁয়ের ছেলে। এখানে আমার সাক্ষীসাবুদ-সমর্থক কেউ নেই। আমি একা। কিন্তু একা হলেও আমার যুক্তিবোধ, জিদ আমাকে ভেতর থেকে ক্ষেপিয়ে তুললো। বললাম, ‘ঠিক আছে।’ এরপর ত্রিশ টাকা পকেট থেকে বের করে বৃদ্ধের হাতে দিয়ে বললাম, ‘দাদা, কইতর যারা, তারে এই তিরিশ টেঁয়া আম্নে দিয়া দেন।’ বৃদ্ধ টাকা বুঝে নিয়ে একজনকে দিয়ে বললেন, ‘যাহ! এবার ভাগ। আর ঝামিলা করিছ না।’ ছেলেগুলো টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি বললাম, ‘ও দাদা। এইট কী অইলো? কইতরের দাম দিয়া দিলাম। ওরা টেঁয়াও নিলো, কইতরও নিয়া যাইবো? এইটা কেমন বিচার অইলো। বাজারে তো একজোড়া কইতরই পাওয়া যায় চল্লিশ টেঁয়ায়। তাইলে তিরিশ টেঁয়া দেওয়ার পরও কইতর আমার অইবো না?’
এবার বৃদ্ধ যেন বিষম খেলেন। হাত তুলে ছেলেগুলোকে থামালেন। বললেন, ‘এই পোলার কথা তো ঠিকই আছে। তোরা টেঁয়া নিবি, আবার কইতরও নিবি। এইটা তো অইতে হারে না! অয়তো টেঁয়া নিয়া কইতর দে, নয় তো টেঁয়া ফিরায় দে।’
ছেলেগুলো আমাকে ছেড়ে এবার বৃদ্ধের সঙ্গে তর্কে নামলো। বৃদ্ধ যতই যুক্তি দেন, ছেলেগুলো ততই বৃদ্ধকে পাল্টা যুক্তি দেখায়। শেষপর্যন্ত বৃদ্ধ ক্ষেপে উঠলেন, ‘মায়-মুরব্বি কিচ্ছু মানছ না তোরা। বেদ্দপের ঘরের বেদ্দপ। আইজ তোগো বাপরে কমু। এমুন বেদ্দপ-বেত্তমিজ পোলা জন্ম দিছে ক্যামনে?’ বৃদ্ধের হুমকিতে তাদের মনে ভয় ঢুকলো বলে মনে হলো। একজন আমার কাছে এগিয়ে এলো। বললো, ‘তুই কইতর নিবি?’ কড়মড় করে তার চোখে দিকে তাকালাম, ‘হু’। সে আমার হাতে কবুতর তুলে দিয়ে সরে পড়লো। এখন আমি পড়েছি ধন্দে। এই কবুতর নিয়ে কী করবো? এতদূর একটা আহত কবুতর নিয়ে কিভাবে যাবো?
ভেবে ভেবে কোনো কূলকিনারা পাই না। শেষে বৃদ্ধের কাছে যাই, ‘দাদা, আমার বাড়ি অনেক দূরে। এই কইতর, নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আম্নে যদি নিয়া যাইতেন, খুশি হইতাম।’ বৃদ্ধের চোখে বিস্ময়, ‘কী কছ তুই! তিরিশ টেঁয়া দিয়া কইতর কিনি, তুই নিতি ন-অ?’ বলি, ‘এত দূর নেওয়া সম্ভব না। আম্নে নিয়ে যান।’ আমার কথায় বৃদ্ধ কী বুঝলেন, জানি না। গলার স্বর নরম করে, আমার মাথায় হাত রাখলেন, ‘তুই কার পোলা? কার নাতি রে?’ তার নরম গলার সুরে আমিও কেমন যেন অবশ হয়ে যাচ্ছি। চোখ ছলছল হয়ে উঠেছে আমার। কণ্ঠ যেন বাষ্পরুদ্ধ। তবু, নিজেকে সংবরণ করি। বলি, ‘আমি হানিফ সওদাগরের ছেলে। এই বাংলাবাজারে আমাদের দোকান ছিল।’
আমার কথা শেষ না হতেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘ওরে চোরা। তুই তো আর নাতি হোস রে। চল চল, তোর দাদিরে লগে দেখা কইরবি। তোর বাপের দোকানে বাকিতে কত চা খাইছি। তোর বাপ যে আঁর কাছে কত টেঁয়া পাইবো, হেই মিয়া নিজেও জানেন না।’ বৃদ্ধের আকস্মিক পরিবর্তনে আমিও বিস্মিত। তার অনুরোধ উপেক্ষা করার মতো মানসিক শক্তি আর আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। তাই চললাম, তার পেছন পেছন। বাড়িতে ঢুকেই সাইকেলটা একটা নারকেল গাছের লগে ঠেক দিয়ে রাখি। বৃদ্ধ ঘর থেকে দুটি মোড়া নিয়ে আসেন, একটিতে নিজে বসে, অন্যটিতে আমাকে বসতে বললেন। তারপর হাঁক ছাড়লেন মৃদুস্বরে, ‘কই হুইনছেননি। কোন আইছে দেখি যান।’ ভেতর থেকে কাঁপাকাঁপা গলায় মিহি সুরে বৃদ্ধার জবাব এলো, ‘কোন আছে ব্যাডা না পোলা? ব্যাডা অইলে আঁই হেতেনের সামনে যাওন ঠিক অইবোনি? কবিরা গুনাহ অইতো ন-অ?’
জবাবে বৃদ্ধ হাহা করে হেসে ওঠেন, ‘আরে বেক্কেল বুড়ি। ব্যাডা অইলে আন্নেরে হেতেনের সামনে আইতে কইতামনি? মাসুম বাইচ্ছা। আঙ্গো নাতি অয়। বাংলাবাজারে হানিফ সদাগর আছিলেন না? হেতেনের পোলা।’ বুড়ি এবার হাতের লাঠি ঠুকতে ঠুকতে আমার সামনে এসে কুঁজো হয়ে দাঁড়ালেন। চোখ গোল গোল করে তাকালেন আমার দিকে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘এ রে চোরা, তুই আঁরে চিনছতনি? তোরা গুচ্ছগ্রামে থাইকতে আঁই তো কতদিন তোগো বাড়িত গেছি। যাইবার সময় তোগো দুই ভাইয়ের লাই গবিয়া নিতাম। মনে আছেনি?’
রাস্তায় উঠেই রুদ্ধশ্বাসে চাপ দেই প্যাডেলে। সাইকেল যেন পঙ্খিরাজ। আর তখনই পেছন থেকে অল্পবয়সী কারও মিহি কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘চলি যান ক্যা? রাইতে খাওয়া-দাওয়া করি যাইয়েন।’
বৃদ্ধার কথায় আমি চমকে উঠি। আরে,এই বুড়িরে তো আমাদের বাড়িতে বহুদিন দেখেছি। আমাদের বাড়িতে যাওয়ার সময় দুই ভায়ের জন্য শাড়ির খুঁটে বেঁধে দুটি করে পেয়ারা নিয়ে যেতেন। আমরা দুই ভাই মিলে পেয়ারা খেতাম। আর বৃদ্ধা বসে বসে দেখতেন। আর পোকলা দাঁতে হাসতেন। তখন অবশ্যই এত বৃদ্ধ ছিলেন না, লাঠিতে ভর দিয়েও চলতেন না।
কথাগুলো মনে পড়তেই দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম। মাথা নুয়ে কদমবুছি করতেই বৃদ্ধা বললেন, ‘তুই তো অনেক বড় অই গেছস। দে, তোর দাদার লগে গল্পগুজব কর। রাত্রে থাইকবি। ভোরে উঠে চলি যাবি। অন আঁই নাতিনগোরে দিয়ে তোর লাইন পিঠা বানামু। চিতল পিঠা খাইবিনি? রাব দিয়া?’
কী বলবো, বুঝতে পারছি না। বাড়ির বাইরে আছি দুদিন হয়ে গেলো। মা-বাবা দুশ্চিন্তা করছেন। হবে, ভরসার কথা এই যে, দিদার নিশ্চয় বাবাকে বলেছে, আমি যে তার নানার বাড়িতে রয়ে গেছি, সে কথা। ভাবনা আমার শেষ হয় না। বৃদ্ধের গলায় দৃঢ়তা, ‘আরে নাতি থাইকবো। তুঁই পিঠা বানাও। এখন পিঠা খামু। রাইতে কইতরের মাংসা রাইনবা।’ তাদের কথার মাঝখানে আর কথা বলি না। চুপ করে থাকি। কিন্তু কোথাও গেলে, সমবয়সী কাউকে না পেলে মনের ভেতর কেমন যেন খুঁত-খুঁত করতে থাকে। গলা নিচু করে বলি, ‘দাদা, বাড়িতে আর কেউ নাই? আমনের নাতি-টাতি কেউ নাই?’ বৃদ্ধ হেসে ওঠেন, ‘ক্যা? আঁর লগে কথা কইতে ভালা লাগে না? নাতি আছে আছে। বাজারে গেছে। বাজারতুন আইবো আছরের মাগরিবের সময়। হেই সময় দেখিও।’
আমরা উঠোনে বসে গল্প করছি। কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধার সঙ্গে আমার বয়সী দুটি মেয়ে এলো। তারা মাটির বাসনে চিতই পিঠা, দুধমাখানো খেজুরের গুড় এনে রাখলো। মেয়ে দুটি চলে যেতেই বৃদ্ধের হুকুম, ‘নে নাতি। শুরু কর। খুব মজা রাব-দুধে চিতল পিঠা।’
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলো। মাগরিবের আজান দিতেই কে যেন বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকলো। তাকিয়ে দেখি আমার বয়সী একটা ছেলে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। সে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে ঘরে ঢুকে যাচ্ছিল, বৃদ্ধের ডাকে পেছন ফিরলো। আরে এ কী দেখছি! এ তো সেই ছেলে, কবুতরের ডানা ভেঙে গেলো বলে, যে আমার চাদর ধরে টেনে-হিঁচড়ে অপদস্ত করেছিল। তাকে দেখেই প্রমাদ গুনতে শুরু করি। না। আর একমুহূর্তও এই বাড়িতে নয়। বৃদ্ধ পরিচয় করিয়ে দেন, ‘নাতি রফিক।’ আমি চেয়ে থাকি হা করে। আর ভেতরে ভেতরে ঘামতে থাকি। একসময় বৃদ্ধ আর তার নাতি মাগরিবের নামাজ পড়তে দাঁড়ান। আমি এই সুযোগে সাইকেল নিয়ে সোজা রাস্তায় উঠি। রাস্তায় উঠেই রুদ্ধশ্বাসে চাপ দেই প্যাডেলে। সাইকেল যেন পঙ্খিরাজ। আর তখনই পেছন থেকে অল্পবয়সী কারও মিহি কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘চলি যান ক্যা? রাইতে খাওয়া-দাওয়া করি যাইয়েন।’
চলবে…
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-৪২॥ মোহাম্মদ নূরুল হক