[পর্ব-৪১]
স্যারের বেত আমার পিঠে পড়ার পর বেশকিছু দিন বিছানায় ছিলাম। বিছানা থেকে ওঠার পর শুনলাম চরবাটা খাসেরহাট হাইস্কুল মাঠে রামগোবিন্দ হাইস্কুলের সঙ্গে আমাদের স্কুলের ফুটবল টুর্নামেন্ট। সুতরাং যথাসময়ে খেলতে যেতে হবে। আমাদের দলের প্রধান গোলকিপার নুর আলম জিকো, আর রিজার্ভ গোলকিপার আমি। আমরা খেলতে যাওয়ার আগের দিন গেলাম স্কুল কমিটির সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সোলায়মান মিয়ার বাড়ি। উঠোনে দাঁড়াতেই তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, ‘কী চাও আমার বাবারা?’ জবাবে সমস্বরে বলি, ‘খাসেরহাটে ফুটবল খেলতে যাবো। আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’ তিনি আমাদের কথা শুনে কিছুক্ষণ ভাবলেন। এরপরই ঘরে ঢুকলেন। বের হয়ে এলেন কিছুক্ষণ পর। আমাদের হাতে ৫০০ টাকার দুটি নোট দিয়ে বললেন, ‘তোমরা কিছু খাবে। যাও। দোয়া করি তোমরা ভালো করবে।’ এক হাজার টাকা পেয়ে আমরা একপ্রকার লাফাতে লাফাতে স্কুলের মাঠে এসে হাজির। এক হাজার টাকা রাখলাম ব্রজলাল স্যারের কাছে। কারণ স্যার আমাদের স্পোর্টস টিচারও।
পরদিন খুব ভোরে উঠে গোসল করে জামাকাপড় পরে রেডি। ফুটবল টিমের সবাই এসে চৌরাস্তাবাজারে হাজির। কেউ যাবে হেঁটে, কেউ যাবে বাইসাইকেলে। আমি, দিদার ও বেলাল (আমিন মাঝির নাতি) বাইসাইকেলে রওনা দেই। আমরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে খাসেরহাট এসে হাজির। কিন্তু পদাতিক দল আসতে আরও ঘণ্টা তিনেক লাগবে। এতক্ষণ আমরা কী করবো? দিদারকে বলতেই সে বললো, চল আমার নানার বাড়ি যাই। আমরা দুজন তার কথায় সঙ্গে সঙ্গে রাজি। দুপুরে দিদারের নানার বাড়িতে খাওয়া। সেখানে গিয়ে পরিচয় হলো দিদারের তিন মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে। বড় জনের নাম গোলাম সারওয়ার হিরো। সে পড়ছে ক্লাস ফাইভে। কবিতা পড়তে খুব পছন্দ করে। কিভাবে কিভাবে যেন জেনে গেছে, আমি কবিতা লিখি। হিরো আমাকে পাকড়াও করলো, ‘হক ভাই আমাকে কবিতা লেখা শেখাবেন?’ আমি হেসে বলি, ‘কবিতা লেখা কেউ কাউকে শেখাতে পারে না। তবে, কবিতার কিছু অনুষঙ্গ তোমাকে শিখিয়ে দিতে পারি। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো ছন্দ।’
আর আমি একজন নিতান্তই দস্যি ছেলে মেধাহীন ছাত্র। অথচ কী আশ্চর্য আমারই ছাত্র হলো দুই মেধাবী!
হিরো বলে, ‘তাই শেখান।’ সে রীতিমতো কাগজকলম দিয়ে বসে গেলো সামনে। ওই দিকে হিরোর দুই ভাইয়ের সঙ্গে লুডু খেলায় মগ্ন বেলাল-দিদার। এদিকে হিরোকে স্বরবৃত্তের সরল নিয়ম শেখাচ্ছি আমি। আমাদের এই লুডু-কবিতা চর্চার মধ্যে হঠাৎ হিরোর আম্মা খাবার নিয়ে হাজির, ‘বাবারা অনেক বেলা হলো। নাও খেয়ে নাও। আবার তোমাদের খেলার সময় হয়ে এলো।’ দুপুরের খাওয়াপর্ব শেষ করে খাসেরহাটে দিকে যাত্রা আমাদের। বাজারে এসে দেখি সবাই এসে গেছে। বাজারের দক্ষিণ কোণে কাদের মিয়ার রেস্টুরেন্টে সবাই খেতে বসেছে। ব্রজলাল স্যার আমাদের বললেন, ‘নাও তোমরাও খেতে বসো।’ আমরা চারজনেই ‘না-সূচক’ মাথা নাড়াই। বলি, ‘আমরা খেয়ে এসেছি।’ আমরা না খেলেও খাবার টেবিলে বসে অন্যদের খাবার দেখছি। আমাদের মধ্যে অনেকেরই জীবনে রেস্টুরেন্টে এই প্রথম খাওয়া। তাই বাড়ির খাওয়ার আদব আর রেস্টুরেন্টের খাওয়ার আদবের মৌলিক পার্থক্য ধরতে পারিনি। তাই আমাদের দপ্তরি আবুল কালাম একের পর এক ভাতের অর্ডার দিয়ে যাচ্ছেন, আর ওয়েটার ভাত দিয়ে যাচ্ছেন। খাবার শেষে হিসাব করে দেখা গেলো কালাম একাই খেয়েছেন ১১ প্লেট ভাত, আর সাত প্লেট মাছ-সবজি-মাংস। সবাই খেয়ে উঠে বের হয়ে যাচ্ছে, তখনো কালাম বলছেন, ‘ভাত তো পেটের এককোণে পড়ে আছে। পেট তো ভরেনি। আর দুই প্লেট ভাত হবে না?’ তার কথা শুনে ওয়েটার বললেন, ‘আর ভাত নেই। বিল দেওয়া হয়ে গেছে।’কালামের মুখ কালো হয়ে গেলো। তাই দেখে ব্রজলাল স্যারসহ সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন।
খাওয়া শেষে বিকাল ৫টার দিকে ফুটবল খেলা শুরু। কিন্তু আমাদের প্রতিপক্ষ দল খেলতে আসেনি। তাই মাঠে এলোমেলো দুই গ্রুপে বল খেলছে। তাই দেখতেই শত শত দর্শকের ভিড়। সবাই খেলা দেখছে, ঘামে ভিজে আমার শার্ট জবজবে দশা। হঠাৎ টের পেলাম, আমার মেরুদণ্ড বরাবর শার্ট সোজা ছিঁড়ে দুই ভাগ হয়ে গেছে। বিষয়টি হিরোকে বলতেই সে বললো, ‘আমাদের বাড়িতে চলেন। আমার একটা ঢোলা শার্ট আছে। আপনি পরবেন। আর আমাকে কবিতা লেখার কলাকৌশলগুলো শিখিয়ে দেবেন।’ একনিষ্ঠ ছাত্র পেয়ে আমি তো আবেগে গদগদ। হিরোর পিছুপিছু তাদের বাড়িতে এসে আবারও হাজির। আমাদের দেখে কেউ বিরক্ত হলো কি না, খেয়াল করারও ফুসরত নেই। কবিতার আলোচনায় আমরা গভীরভাবে মগ্ন। দিদার-বেলার এসে হাজির একটু পরই। বললো, ‘চল এবার যাই।’ বলি, ‘তোরা যা। আমি কাল যাবো।’ বেলাল-দিদার তাদের সাইকেল নিয়ে চলে গেলো। হিরোদের কাছারি ঘরে থেকে গেলাম আমি।
সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি হিরো খাতা নিয়ে হাজির। সে আমার আগে ঘুম থেকে উঠেছিল। তার খাতাভর্তি ছড়া। আমাকে দেখাবে বলে লিখে নিয়ে এসেছে। তার খাতা দেখে আমি তো তাজ্জব। প্রথমবারেই পরিপূর্ণ ছড়া। একজন নিবিষ্ট ছাত্র পেয়ে আমি খুশি যতটা, তারও বেশি হিরো, সে ছড়া লেখা লিখে ফেলেছে। তার হস্তাক্ষর যেন কোনো শিল্পীর হাতে আঁকা চিত্র। অসম্ভব সুন্দর হস্তাক্ষর তার। এমন নিখুঁত সুন্দর হস্তাক্ষর এর আগে কখনোই দেখিনি। আমি মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছি তার হস্তাক্ষরের দিকে। তারও আনন্দে চোখ ছলছল করছে। আসাদের পর আমার সাহিত্যের দ্বিতীয় ছাত্র হিরো। দুজনেই মেধাবী, দুজনেই স্ব-স্ব ক্লাসের ফার্স্টবয়। আর আমি একজন নিতান্তই দস্যি ছেলে মেধাহীন ছাত্র। অথচ কী আশ্চর্য আমারই ছাত্র হলো দুই মেধাবী!
চলবে…
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-৪০॥ মোহাম্মদ নূরুল হক