[পর্ব-৩৩: জুনিয়র হাইস্কুল পর্ব]
স্কুল থেকে ফিরেছি মাত্র, মা বললেন খেয়ে তাড়াতাড়ি দোকানে যেতে। বাবার নাকি মেজাজ খারাপ। দোকানে এসে দেখি সত্যিই বাবার মেজাজ খারাপ। ঘটনা কী? মহিউদ্দিনও সেখানে বসা। বাবা কিছু বলছেন না। মহিউদ্দিনের কাছে জানতে চাইতেই, তিনি আদ্যোপান্ত জানালেন। মহিউদ্দিনের খালাতো ভাই মাসুম দুদিন আগে একটি সাইকেল ভাড়া নিয়েছে। আজও ফেরত দেয়নি। মহিউদ্দিন তার সেই খালাতো ভাইদের বাড়িতেও গেছেন খবর জানতে। জানা গেলো, দুই দিন ধরে মাসুম উধাও। বাড়িতে যায়নি। কোথায় যেতে পারে? মাসুমের মায়ের ধারণা, ফেনীর সোনগাজীর সোনাপুর তার এক বোনের বাড়ি আছে। বাপমরা মাসুম মাঝেমাঝেই সেই বাড়িতে চলে যায়। এবারও হয়তো সেখানেই গেছে।
এবার আমরা পরিকল্পনায় বসি। সিদ্ধান্ত হলো মহিউদ্দিনের সঙ্গে আমিও যাবো। মহিউদ্দিন ও আমি এক সাইকেলে সোনাপুর পর্যন্ত যাবো। সেখান থেকে ফেনীর বাস। বাসের ছাদে থাকবে সাইকেল। ফেনী থেকে সোনাগাজীর বাস। আবারও সাইকেল থাকবে বাসের ছাদে। সোনাগাজী থেকে সাইকেল চালিয়ে যাবো সোনাপুর। যে বাড়িতে মাসুম থাকতে পারে। পরদিনই আমাদের যাত্রা। তার আগে বাবা তার মামাতো ভাই জালাল মাঝির বাড়ির ঠিকানা দিলেন। সঙ্গে দিলেন একটি চিঠি। বললেন, অবশ্যই যেন ওই বাড়িতে যাই।
চৌরাস্তা বাজার থেকে সোনাপুর, পুরো রাস্তাই মাটির। এবড়োখেবড়ো। কখনো মহিউদ্দিন সাইকেল চালান, আমি পেছনে; কখনো আমি চালাই, মহিউদ্দিন পেছনে। এভাবে সাইকেল চালিয়ে সকাল দশটার মধ্যে সোনাপুর পৌঁছলাম দুজনে। ফেনী রুটের গাড়ি কোন জায়গা থেকে ছাড়ে, জানি না। মহিউদ্দিন জানেন। আমি কেবল তার পদাঙ্ক অনুসরণ করি। একসময় পেয়েও গেলাম বাস। দরদাম সবই মহিউদ্দিন করলেন, আমি কেবল সাক্ষীগোপাল। কোথায় কত টাকা লাগবে, তা দিচ্ছি, কিন্তু কোনো দর কষাকষির প্রশ্ন এলেই চুপ থাকি।
‘চোর’ শব্দটি শোনার পর আমার মেজাজ গেলো গরম হয়ে। কী বলতে কী বলবো, ভেবে পাচ্ছিলাম না। কেবল তো তো করছি। মহিউদ্দিন হেকিম বাড়ির পরিচয় দিলো। বললো, সে বাড়িতেই বেড়াতে এসেছি। ভদ্রলোক তার কথা বিশ্বাস করলেন বলে মনে হলো না। তিনি আরও ক্ষেপে গেলেন।
দুই বাস পরিবর্তন করে আমরা এসে পৌঁছে গেলাম সোনাগাজী। এবার কোন দিকে যাবো। মহিউদ্দিন বলেন, ‘মামা এক কাজ করবি নাকি? আগে হেকিম বাড়িতে যাই।’ হেকিম বাড়ি আমার দূর সম্পর্কে খালার বাড়ি আর তার নানির বাড়ি। কিন্তু তার নানি অর্থাৎ আমার খালা জীবিত নেই। তাই যাওয়ার আগ্রহ দেখাই না। বরং যুক্তি দেখাই, মাসুম যে বাড়িতে আছে, সে বাড়িতে আগে যাওয়া উচিত। এই যুক্তি মেনে নেন মহিউদ্দিন। বলেন, ‘তাহলে আর কী? উঠে বোস সাইকেলে।’ ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা মহিউদ্দিনের সেই খালার বাড়িতে হাজির। উঠোনে দাঁড়াতেই দেখি, আমাদের সাইকেল হাস-মুরগির খোয়াড়ের সঙ্গে হেলান দিয়ে রাখা। সাইকেল দেখেই দৌড়ে গেলাম সেদিকে। মহিউদ্দিন সঙ্গে আনা সাইকেলখানাও সেদিকে নিলেন। এসময় আমি দুটি সাইকেলকে একই চেইন দিয়ে পেঁচিয়ে তালা দিচ্ছি, আর মহিউদ্দিন ‘খালা-খালা’ বলে চিৎকার করছেন। চিৎকার শুনে বেরিয়ে এলেন ৩৫/৩৬ বয়সী একজন নারী। মহিউদ্দিন তাকে পায়ে ছুঁয়ে সালাম করলেন। ওই নারী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই ছেলেটা কেরে?’ মহিউদ্দিন আমার পরিচয় দিতেই তিনি প্রায় দৌড়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘তুই আমার ভাই। তোরে এত্তটুকুন দেখেছিলাম। সবাই বলেছিল, তুই বাঁচবি না। তোর মাথায় বড় বড় ফোঁড়া উঠেছিল, সেই ফোঁড়ায় গরম পানের সেঁক দিতে গিয়ে মাথাই পুড়ে গেছিল একবার। তখন তো সবাই ধরেই নিয়েছি তুই আর বাঁচবি না।’ একনাগাড়ে এই নারী অথার্ৎ আমার খালাতো বোন কথাগুলো বলে থামলেন।
এরপর মহিউদ্দিনের দিকে তাকালেন, ‘তোদের দেখে তো মনে হয় না, দুপুরে কিছু খেয়েছিস। যা কলে যা। দুজনে গোসল করে আয়। আগে ভাত খা। পরে কথাবার্তা বলবো। আমি রান্নাবান্না করি। ও ভালো কথা, তোরা কী মনে করে এলি? হঠাৎ কোনো চিঠিপত্র না দিয়ে? কদিন আগে মাসুম এসেছে। সাইকেল নিয়ে। আজ তোরাও এলি সাইকেল নিয়ে। ব্যাপার কী রে?’ মাসুমের কীর্তি খুলে বললেন মহিউদ্দিন। শুনে আপা তো তাজ্জব। বলেন, ‘আসুক আজ মাসুম। তার একদিন কী আমার একদিন।’
আমরা দুজনের গোসল করে জামাকাপড় চেঞ্জ করে খেতে বসেছি, এমন সময় মাসুম এসে হাজির। আমাদের দেখেই ভূত দেখার মতো আঁৎকে উঠলো। দৌড় দিয়ে পালাবে, প্রস্তুতি নিচ্ছিল মাত্র, অমনি দুলা ভাই তার হাত ধরে ফেললেন। বললেন, ‘কী ব্যাপার পালাতে চাও কেন? এরা কেন এসেছে, তুমি কেন এসেছ, সব বলো।’ মাসুম কিছু বলে না।
রাতটা পার হলো। সকালে উঠে তিনজনে নাস্তা করে ঠিক করি, প্রথমে মুহুরি প্রজেক্ট দেখতে যাবো। তারপর জালালা মাঝির বাড়ি, সবশেষে হেকিম বাড়ি। মুহুরি প্রজেক্টে যাওয়ার উপায় দুটি। প্রথমত বাস। দ্বিতীয়ত সাইকেল। দুই সাইকেলে তিন জন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো সাইকেলেই যাবো। মুহুরি প্রজেক্টে এসে স্লুইস গেট দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। উত্তর পাশে ভরাট পানি। দক্ষিণ পাশে খুবই কম। তবে পাথর আর পাথর। প্রজেক্টের প্রতিটি গেটের পাল্লার ওপর শখানেক কবুতরের বাসা। মাসুম বলে, এগুলো সব জালালি কবুতর। কেউ ধরে না। এখানে এভাবেই থাকে।
আমরা সাইকেল বাঁধের ঢালুতে রাখি। তালা দেই। এরপর অবাক বিস্ময়ে তাকাই। যত উত্তরে তাকাই পানি আর পানি, ওপরে নীল আকাশ। পানি ও নীল আকাশের মাঝখানে আর কিছু নেই। মাঝেমাঝে জালালি কবুতরগুলো দল বেঁধে উড়াল দেয়। কোনো কোনোটি শূন্যে ডিগবাজি খায়। আবার শা করে নেমে আসে গেটের ওপর। আমরা তিনটি কিশোর যে তাদের উড়াল দেখছি, তা যেন এই শুভ্রবসনারা গ্রাহ্যই করছে না। কবুতরের উড়াল দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। প্রবল তৃষ্ণা আর ক্ষুধায় প্রায় কাতর। মাসুম জানালো, নদীর পশ্চিম পাড়ে কোনো খাবারের দোকানপাট নেই। কিন্তু পূর্বপাড়ে আছে। আমরা সাইকেলে চড়ে পূর্বপাড়ে যেতেই আরও বিস্ময় অপেক্ষা করে। সেখানে একজন মাঝবয়সী মানুষের সঙ্গে দেখা। আমাদের দেখামাত্রই রীতিমতো জেরা শুরু করলেন। আমরা কারা, কোত্থেকে এসেছি। আমাদের তো এর আগে এখানে কখনো দেখেননি। আমাদের স্থানীয় বলেও মনে হয় না। সাইকেল চোরও হতে পারি। ‘চোর’ শব্দটি শোনার পর আমার মেজাজ গেলো গরম হয়ে। কী বলতে কী বলবো, ভেবে পাচ্ছিলাম না। কেবল তো তো করছি। মহিউদ্দিন হেকিম বাড়ির পরিচয় দিলো। বললো, সে বাড়িতেই বেড়াতে এসেছি। ভদ্রলোক তার কথা বিশ্বাস করলেন বলে মনে হলো না। তিনি আরও ক্ষেপে গেলেন।
আমি তখন দিশাহারা। মুখ ফসকে বলে ফেললাম, ‘এখানে আমার এক চাচার বাড়ি আছে। আপনি চাইলেই আমাদের সঙ্গে যেতে পারেন। কিন্তু এভাবে অপমান করতে পারেন না। আমরা ভদ্রঘরের ছেলে। বেড়াতে এসেছি ওই চাচার বাড়ি।’ ভদ্রলোক এবার একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন। বললেন, ‘কো্ত্থেকে এসেছিস তোরা? বাড়ি কই? তোর চাচার বাড়ি কই? কে তোর চাচা?’ ততক্ষণে আমাদের চারপাশে প্রায় অর্ধশত লোক জড়ো হয়ে গেছে। যেন আমরা চিড়িয়াখানার জন্তু। আমাদের দেখতে দশর্নার্থীদের ভিড় জমেছে। তবে, এই ভদ্রলোকের তাচ্ছিল্যে আমি ভড়কে যাই না। বরং মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বলি, ‘আমার চাচার নাম জালাল মাঝি। আমার বাবা হাফিন সওদাগর। আমরা নোয়াখালী সদরের চরলক্ষ্মী থেকে এসেছে।’ আমার দ্রুতলয়ে উচ্চারিত কথাগুলো শেষ না হতেই লোকটির কঠিন চেহারা কেমন নরম হয়ে গেলো। ছিলেন প্রায় দুই গজ দূরে। এবার একদম নিশ্বাসের কাছাকাছি দাঁড়ালেন, ‘তোর নাম নূরুল হক? তোর বাপ কতবার বলেছে তোকে আনবে। সঙ্গে করে তো আনলো না, একলা পাঠালো! আমিই তোর জালাল চাচা। আয় বেটা বুকে আয়।’ মুহূর্তে আমি যেন আকাশ হাতে পেলাম। মহিউদ্দিন, মাসুমের দিকে তাকিয়ে দেখি, তাদের মনের ভয়-ডর কেটে গেছে। আমি চাচাকে পা ছুঁয়ে সালাম দিতেই তিনি আমাকে বুকে টেনে নিলেন। জানতে চাইলেন, বাড়ির দিকে না গিয়ে এখানে কেন। ঘটনা খুলে বলতেই হো হো করে হেসে উঠলেন। পাশের দোকানদারকে বললেন, ‘এই বিস্কুট কলা কী কী আছে সব নিয়ে আয়।’ পাশ থেকে একজন ফোঁড়ন কাটে, ‘জালাল মাঝির মুখে মুখে তর্ক করে এত্তটুকু পোলা, দেখেই সন্দেহ হয়েছিল, এই পোলা যেনতেন পোলা না।’ জবাবে জালাল চাচা বলেন, ‘বুঝলি এইটারে কয় বংশের আগুন। চাচা যত গরম, ভাতিজা তার চেয়েও গরম। দেখলি না, ভাতিজা আমাকে জালাল মাঝির হুমকি দিলো?’ তার এই কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
যুক্তি শুনে অগ্নিশর্মা বাবা আমার কেমন যেন মিইয়ে গেলেন। আমার দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তার মুখে দিয়ে কোনো কথা সরছে না। ধীরে ধীরে কাছে এলেন। এবার আমি ভয়ে অস্থির! বুক কাঁপছে। রাগের মাথায় থাপ্পড়ও দিতে পারেন। কিন্তু না। বাবা এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘জ্ঞানী মানুষের মতো কথা কইলি। মাসুম যত দোষ করেছে, তার চেয়ে বেশি তো আমি করেছি।
রাতে তিন জনই জালাল চাচার বাড়িতে। মুরগি-তিন চার পদের মাছের আয়োজন। খাওয়া দাওয়া শেষে, চাচাতো বোন এলো একজন। আমারই বয়সী। বলে, ‘ভাইয়া তোমার না আমাদের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করার কথা? চাচা বলে গেছিলেন সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন। এখানে ভর্তি করাবেন। চাচি নাকি তোমাকে আসতে দেন না?’ তার কথায় আমি হাসি। কিছু বলি না। সে আবারও বলে, ‘কথা সত্যি কি না বলো?’ এবার বলি, ‘হ্যাঁ। সত্যি। মা দূরে কোথাও দিতে চান না। এখনো তো আসতাম না। এসেছি তো…।’ বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। সব কথা বলে দিলে মাসুমকে ছোট করা হয়। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলি, ‘তুই কোন ক্লাসে পড়িস।’ সে ঝটপট উত্তর দেয়, ‘সেভেনে।’ বলি, ‘তাহলে তো তুই আমার চেয়ে বড়। আমি তো সিক্সে পড়ি। তুই আমাকে ভাইয়া বললি কেন? আমিই না তোকে আপু বলবো।’ আমাদের কথোপকথনের মাঝখানে এসে হাজির চাচি। বলেন, ‘না, বাবা। সে তোমার ছোট। তুমি তো মাদ্রাসায় পড়েছ অনেক বছর। সেখানে সময় গেছে না? তুমি নিয়মিত স্কুলে পড়লে তো এখন এইট বা নাইনে থাকতে।’ চাচির কথায় আমি ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ’ মাথা নাড়ি।
পরদিন সকাল হতেই নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়ি। উদ্দেশ্য হেকিম বাড়ি। হেকিম বাড়িতে এলাহি কাণ্ড! বাড়ির দরোজায় কোনো কাছারি ঘর নেই। বিশাল পাকা মসজিদ। মসজিদের বারান্দায়-ভেতরে কেউ বসে আছে, কেউ ঘুমুচ্ছে। আমরা পাশের পুকুরে নেমে হাত-পা-মুখ ধুয়ে নেই। ভেতর বাড়িতে ঢুকতেই পুরনো জমিদার আমলের বাড়ি। একতলা বাড়ি। কিন্তু উঁচু দোতলার সমান। ঘরের দেয়াল এতটাই পুরো যে, দেখলে ঘর নয়, দুর্গের দেয়াল বলেই মনে হয়। সামনের রুমেই হেকিম সাহেব। সম্পর্কে আমার খালু। ঢুকেই তাকে সালাম দিয়ে মহিউদ্দিন আমার পরিচয় দিলেন। মাসুমকে আগে থেকেই চিনতেন। আমরা তার সামনে বসি, দেখি ঘরের ভেতরে নানা রকমের লতাপাতা, বিশাল বিশাল কাচের জার। সেই জারে লতাপাতার রস। বাইরে তাকিয়ে দেখি, উঠোনোর উত্তর পাশে বিশাল চুলায় আগুন জ্বলছে। তার ওপর বিশাল আকারের পেতলের ডেকচি। ধোঁয়া উঠছে সবুজ-নীল। হেকিম সাহেব বললেন, ‘ওই ডেকচিতে ওষুধ তৈরি হচ্ছে।’ তিনি হেঁটে হেঁটে বাড়ির বিভিন্ন রুম দেখালেন। সারাবাড়ি ঘুরে ঘুরে ঔষধি যত গাছ আছে, সব দেখালেন। কোন গাছের রস কী কাজে লাগে, কোন গাছের ছাল কী রোগের ওষুধ—বিশদে বলছেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনেই চলেছি। দুপুর হতেই খাওয়ার ডাক পড়লো।
খাওয়া শেষে বিদায় নিয়ে বের হলাম সোনাগাজীর উদ্দেশে। যেভাবে সোনাপুর থেকে সোনাগাজী এলাম, সেভাবেই ফিরতি যাত্রা শুরু। সন্ধ্যা হয় হয়, এসে পৌঁছলাম চৌরাস্তা বাজার। তবে, বাজারে ঢোকার আগেই মাসুমকে তাদের বাড়ির দিকে পাঠিয়ে দিলাম। বাবা সাইকেল ফিরে পেয়ে খুব খুশি। কিন্তু মাসুমকে কেন বেঁধে আনলাম না, তা নিয়ে রেগে গেলেন। মহিউদ্দিন বললেন, ‘আম্নের পোলাই তো মাসুমকে ছেড়ে দিলো। আমার কী দোষ?’ বাবা তখন অগ্নিশর্মা। আমিও কম যাই না। বাবার রাগকে তখন ভয় পাই না, আমি এক এতিম ছেলের পক্ষ নিতে পারায় রীতিমতো গর্ববোধ করি মনে মনে। তাই বাবাকে বলি, ‘মাসুমকে আনলে কী করতেন? মারতেন? একটা এতিম ছেলের গায়ে হাত তুলতে পারতেন? সে তো আপনার নাতি। ওই ছেলে কী দোষ করেছে? সাইকেল তো বেচে দেয়নি। দোষ যদি মাসুম করে, আমরাও করেছি। এতটুকুন ছেলেকে এভাবে সাইকেল ভাড়া দিলাম কেন? তাছাড়া সাইকেল তো ফিরে পাইলেন। এত রাগ করার কী আছে?’
যুক্তি শুনে অগ্নিশর্মা বাবা আমার কেমন যেন মিইয়ে গেলেন। আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তার মুখে দিয়ে কোনো কথা সরছে না। ধীরে ধীরে কাছে এলেন। এবার আমি ভয়ে অস্থির! বুক কাঁপছে। রাগের মাথায় থাপ্পড়ও দিতে পারেন। কিন্তু না। বাবা এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘জ্ঞানী মানুষের মতো কথা কইলি। মাসুম যত দোষ করেছে, তার চেয়ে বেশি তো আমি করেছি। এতটুকুন পোলারে এভাবে সাইকেল দেওয়া তো ঠিক হয় নাই। যা বাবা, বাড়ি যা। তোর মা আবার কান্নাকাটি করতেছে দুদিন ধরে।’ বাবার কথা শেষ হতেই মহি উদ্দিনকে নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম।
চলবে…
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-৩২॥ মোহাম্মদ নূরুল হক