[পর্ব-২৬। জুনিয়র হাইস্কুল পর্ব]
ভর্তির কদিন পরই ক্লাস শুরু। নিয়মিত স্কুলে যাই। গণিত-ইংরেজি ছাড়া বাকি পাঠ্যবই এক সপ্তাহেই আদ্যোপান্ত পড়া শেষ। সবচেয়ে ভালো লাগলো বাংলা দ্রুতপঠন। বইটির নাম এখন মনে নেই। এছাড়া বাংলা বইটিও ভালো লেগেছিল। কারণ, ক্লাসের পড়া হলেও এখানে লেখার সঙ্গে লেখক পরিচিতিও আছে। যা এতদিন পাইনি। ফলে বই দুটি টানা দুই দিনে পড়েই শেষ। বিশেষত কবিতাগুলো, অন্যরকম। তখন আবার মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি, আল মাহমুদের ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’র ছন্দের সূত্র। পাঠ্যবইয়ের কবিতাগুলো পড়তে যেমন মনে দাগ কাটে, তেমনি কানেও এক ধরনের মধুর ধ্বনি বাজে। কিন্তু ছন্দের ৪+৪+৪+৪-৩-২-১ মেলাতে পারি না।
কতজনকে জিজ্ঞাসা করি, কেউ বলে না। উল্টো কেউ কেউ তিরস্কার করে, কেউ কেউ ধমকও দেয়। তখন ক্লাসে গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ এসব পড়াতেন বাংলার নুর নবী স্যার। একদিন বাংলার স্যারের কাছে ছন্দ ও মাত্রার বিষয়ে জানতে চাইলাম। স্যার চোখ বড় বড় তাকালেন। তারপর টেবিলের ওপর বেত রেখে বললেন, ‘বাংলা বইয়ের কোন পাতায় এই বিষয়ে আছে? পরীক্ষায় আসবে এসব?’ আমি ভয়ে ‘না’-সূচক মাথা নাড়ি। স্যার এবার বলেন, ‘উদ্ভট উদ্ভট প্রশ্ন করে ক্লাসের পরিবেশ খারাপ করবি না। এই বেত দেখেছিস? পিঠের ওপর ভাঙবো পুরো বেত। পড়ায় মন দে।’ স্যারের ধমকে আমি যতটা না ভয় পেয়েছি, তারও বেশি পেয়েছি লজ্জা। ক্লাসসুদ্ধ অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিল সেদিন। যেন আমি মহা কোনো অপরাধ করে ফেলেছি। যেন আমি ভিনগ্রহের কোনো জীব। যেন পাঠ্যবইয়ে যা নেই, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে নেই। তা নিয়ে থাকতে নেই কোনো কৌতূহল। পুরো ক্লাসে মন খারাপ করে বসেছিলাম।
টিফিন পিরিয়ডে ঘণ্টা পড়তেই স্যার আবারও সামনে এসে দাঁড়ান। মাথায় হাত রেখে বলেন, ‘আশীর্বাদ করি। তুই সত্যি কবি হবি। লিখতে পারবি। তবে, আগে পড়াশোনা, পরে লেখালেখি। কথাটা মনে রাখিস।’
ঘণ্টা পড়তেই বাংলার স্যার বেরিয়ে গেলেন। সবাই হই হট্টোগোলে মেতে উঠলো। কিন্তু আমরা এতটাই খারাপ লাগছিল যে, সেই হট্টোগোলে আর যোগ দিলাম না। কিছুক্ষণ পর এলেন জাফর উল্লাহ স্যার। তিনি আমাদের গণিত ও বিজ্ঞান পড়াতেন। বিজ্ঞানের ক্লাসে বেশ মনোযোগ দিলেও গণিতের ক্লাসে আমার ভীতি ছিল কিংবদন্তিতুল্য। সেদিন স্যার এলেন, কয়েকটি অঙ্ক বোর্ডে কষে বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ির কাজ দিয়ে চলে গেলেন। অন্যান্য স্যারের ক্লাসে মাঝে-মাঝে ফিস-ফিস করে কথা বলা যায়। কিন্তু জাফর উল্লাহ স্যারের ক্লাসে কখনোই না। যেন সাক্ষাৎ যমদূত। সিংহের মতো গর্জে ওঠেন। ডাস্টার ছুড়ে মারার ভয় দেখান। মাঝেমাঝে ছুড়ে মারেনও, কিন্তু গিয়ে পড়ে দেয়ালে। তাতেই আমাদের অন্তরাত্মা খাঁচাছাড়া।
যতক্ষণ গণিতের ক্লাস চলে, ততক্ষণ আমি হয় স্যারের দিকে, নয় বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকি। ফলে স্যার মনে করেন, তার ক্লাসের সবচেয়ে মনোযোগী ছাত্র আমি। কিন্তু আমি জানি, ওই মুহূর্তে আমি ভাবতে থাকি—ছন্দ আসলেই কী জিনিস, কত প্রকার ও কী কী; এর সূত্রই বা কী? আবার ঘণ্টা পড়ে। শুরু হয় কিছুক্ষণের জন্য কোলাহল। এবার ইংরেজি। এসেছেন হেড স্যার—মানে সন্তোষ স্যার। এই স্যার যেমন চুপচাপ, তেমনি বরফের মতো ঠাণ্ডা। যথারীতি বাড়ির কাজ আদায় করেন আগে। এরপর বাংলা অনুবাদসহ আগের দিনের দেওয়া এসাইনমেন্ট পড়তে বলেন। আমি যথারীতি বেঞ্চের মাঝখানে। ডানে দুজন। বামে দুজন। সন্তোষ স্যারও প্রাইমারি স্কুলের হেড স্যারের মতোই। সবসময় একদিক থেকেই জিজ্ঞাসা করেন। তবে, কেউ না পারলে বেত অবশ্যই খেতে হবে।
এদিন আমার রিডিং শেষ হলে আমার পরের জনের পালা। সে যখন পড়ায় মগ্ন, তখন আমি খাতা খুলে বসেছি। গ্রাম-স্কুল-বাড়ি এসব নিয়ে অন্ত্যমিল দিয়ে লেখার চেষ্টা করছি। হেডস্যারের স্বভাব ততদিনে আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। তিনি কখনোই জাফর উল্লাহ স্যারের মতো পুরো ক্লাসে হেঁটে হেঁটে ক্লাস নেন না। এসেই যেভাবে চেয়ারে বসেন, ক্লাস শেষ পর্যন্ত মূর্তির মতো স্থির বসে থাকেন। তার ঠোঁট নড়ে, হাত নড়ে, কিন্তু পুরো শরীর কিংবা মাথা সাধারণত নড়ে না। ফলে আমি অনেকটা নিশ্চিত হয়ে নিজের লেখায় মগ্ন। এভাবে মগ্ন থাকারও আরেকটা কারণ আছে। আমার পাঠ তো শেষ। সুতরাং আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসাও করবেন না। সবার পড়া শেষ হলে, নতুন পাঠ ও বাড়ির কাজ দিয়ে স্যার চলে যাবেন। কিন্তু না। আজ ব্যতিক্রমই ঘটলো। কখন যে স্যার এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছেন, টেরই পেলাম না। হঠাৎ ছোঁ মেরে খাতটা টেনে নিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলাম। ভয়ে থত্থর করে কাঁপছি। কী বলবো, বুঝতে পারছি না। স্যার নীরবে লেখাটা পড়ে শেষ করলেন। এরপর খাতা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বেশ। তোর মধ্যে কবিত্ব আছে। তবে, ক্লাসে কবিতা লেখা যাবে না। কবিতা লিখবি বাড়িতে। অবসরে। মনে থাকবে?’ ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো আমার। ম্লানমুখে বলি, ‘জি স্যার।’ টিফিন পিরিয়ডে ঘণ্টা পড়তেই স্যার আবারও সামনে এসে দাঁড়ান। মাথায় হাত রেখে বলেন, ‘আশীর্বাদ করি। তুই সত্যি কবি হবি। লিখতে পারবি। তবে, আগে পড়াশোনা, পরে লেখালেখি। কথাটা মনে রাখিস।’
অনেকেই তো পেটব্যথার কথা বলে টিফিন পিরিয়ডের ছুটির দরখাস্ত দেয়। আমিও যদি দেই, স্যার মঞ্জুর করবেন? ভাবতে ভাবতে খাতার একটি পাতা ছিঁড়ে দরখাস্তও লিখে ফেলি।
হেড স্যার চলে যাওয়ার পর সবাই ক্লাস ছেড়ে মাঠে এসে পড়ি। যাদের বাড়ি স্কুলের কাছে, তারা দুপুরের খাবার খেতে বাড়িতে চলে গেলো। বাকিরা দপ্তরি আবুল কালামের দোকান থেকে পাউরুটি, বেলা বিস্কুট ও কলা খেয়েই ক্ষুধা নিবারণ করলো। কেউ কেউ চলে গেলো কাছের বাজার আক্তার মিয়ার হাটে। বাজারে ঢোকার পথে রাস্তার পশ্চিম পাশে ‘নিজেরা করি’র একটি অফিস ছিল তখন। সেখানে একটি বইয়ের সেলফও ছিল। মাঝেমাঝে সেখানে গিয়ে বসি। দুলাল নামে একজন মধ্যবয়সী লোক বসে থাকতেন। আমরা তাকে দুলাল ভাই সম্বোধন করতাম। ছোটদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেন। বাবা কী করেন, বাড়িতে কী রান্না হয়েছে, কী খেয়েছে, এসব জিজ্ঞাসা করতেন। আর জিজ্ঞাসা করতেন, ক্লাসের বইয়ের বাইরে কোনো কিছু পড়ার আগ্রহ আছে কি না। প্রায় ছাত্রই বলতো ‘না’।
সেদিন হেড স্যারের আশীর্বাদে ভেতরে ভেতরে আমি পুলকিত। আবুল কালামের দোকানের পাউরুটি-কলা না খেয়ে বাজারে চলে গেলাম হোটেলের বাসি পরোটা-ভাজি খেতে। সকালের বানানো। যাওয়ার পথেই দুলাল ভাইয়ের ডাক—এই দিকে এসো। তিনি তখন কারও বাড়ি থেকে আনা চালের রুটি-সবজি খাচ্ছিলেন। বললেন, ‘এসো একসঙ্গে খাই।’ তার ডাকে অফিসে গেলাম। কিন্তু খাওয়ার প্রতি আগ্রহ দেখালাম না। অনেক্ষণ ধরে তার বুকসেল্ফ দেখছিলাম। বললেন, ‘কী দেখো? এগুলো সব বড়দের বই। তুমি পড়ে বুঝবে?’ বলি, ‘বুঝতেও তো পারি। বাড়িতে নিয়ে পড়তে দেবেন?’ বললেন, নিতো পারো। তবে, ‘একসপ্তাহের মধ্যে ফেরত দিতে হবে।’ আমি তাতেই রাজি হয়ে যাই। বললেন, ‘কোন বইটি নিতে চাও?’ ছাইরঙা কাপড়ে বাঁধানো প্রচ্ছদের বই ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ দেখিয়ে বলি, ‘এই বইটি দিন।’ তিনি উঠে এলেন চেয়ার ছেড়ে। তার সঙ্গে যারা ছিলেন, তারা হা করে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। একজন বিদ্রূপের সুরে বলেই বসলেন, ‘জানো এটি কার বই? কার লেখা?’ আমি দৃঢ়তার সঙ্গে অথচ খুব নিচু গলায় বলি, ‘‘জি। জানি। এটি কমরেড মুজফফর আহমদের লেখা। ইনি আমাদের জাতী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বন্ধু ছিলেন। দুজনে মিলে ‘নবযুগ’ নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন।’’ আমার জবাবে বিদ্রূপকারী চুপসে গেলেন। দুলাল ভাই বললেন, ‘কারও বয়স দিয়ে তার পড়াশোনা মাপা যায় না। ওকে আমি চিনি। ছোট বলে কাউকে বিদ্রূপ করা ঠিক না।’ এরপর দৈনিক পত্রিকার একটি ছেঁড়া পাতা দিয়ে তিনি বইটিকে মুড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘নিয়ে যাও। খোলা দেখলে একেকজন একেক কথা বলবে। শেষে তুমি বইটি বাড়ি পর্যন্ত নিতেই পারবে না।’
দুলাল ভাইয়ের হাত থেকে বইটি নিয়ে স্কুলের পথ ধরি। খাওয়ার কথা ভুলে গেলাম। তখন আমার ভেতের চাপা উত্তেজনা—কখন বইটি পড়বো। এখন দুই ক্লাস আছে। কী করি, কী করি! বুদ্ধি আঁটতে থাকি। হঠাৎ বিদ্যুতের মতো খেলে গেলো দুষ্টুবুদ্ধি। অনেকেই তো পেটব্যথার কথা বলে টিফিন পিরিয়ডের ছুটির দরখাস্ত দেয়। আমিও যদি দেই, স্যার মঞ্জুর করবেন? ভাবতে ভাবতে খাতার একটি পাতা ছিঁড়ে দরখাস্তও লিখে ফেলি। সোজা গিয়ে দাঁড়াই হেডস্যারের সামনে। ডানহাতে দরখাস্ত বাড়িয়ে দেই তার দিকে, বাম হাতে পেট চেপে ধরে রাখি। মুখে এমন অভিব্যক্তি ধরে রাখি—যেন প্রচণ্ড যন্ত্রণায় নাড়িভুড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছে। স্যার একবার দরখাস্তের দিকে তাকান, আরেকবার মুখের দিকে। শেষে বলেন, ‘যাও। সোজা বাড়ি যাও।’ যেভাবে কাঁচুমাচু মুখে অফিস রুমে গেলাম, অবিকল সেভাবেই বেরিয়ে এলাম। ক্লাসরুম থেকে বইপত্র নিয়ে সোজা নেমে এলাম মাঠে। তারপর বাম বগলের নিচে বইগুলো চেপে ধরে লাঠিতে ভর দেই। এরপর ডান হাতে তলপেট চেপে ধরি এমনভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকি যেন, প্রচণ্ড পেটের ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছি। মাঠ পেরেয়ি রাস্তায় উঠেছি মাত্র, দেখি রাসেলের বাবা দক্ষিণ দিক থেকে খালি গরুর গাড়ি নিয়ে আসছেন। দেখে বললেন, ‘কী রে কী হইছে? পেট কামড়াইনি? উঠ। উঠ। গাড়িতে উঠ।’ বাড়িতে পৌঁছে খাওয়া-দাওয়া দূরে থাকা, জামাকাপড় বদলানোর কথাও ভুলে গেলাম। কাছারিতে ঢুকেই বইয়ের ওপর থেকে কাগজটার ভাঁজ না খুলেই টেনে ছিঁড়ে ফেললাম। টেবিলের ওপর দুই টুকরো কাগজ। হঠাৎ চোখ পড়লো ‘বাংলা ছন্দ পরিচয়’ শিরোনামে একটি নিবন্ধের দিকে। দ্রুত কাগজ দুটি আবার টেনে নিলাম। দেখি—এতদিন ধরে আমি যা খুঁজে চলেছি, আজ তাই এসে ধরা দিয়েছে। কমরেড মুজফফর আহমদের ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ পরেও পড়া যাবে। আগে পড়তে হবে এই অতি দরকারি লেখাটি। তার আগে ভাত খেতে হবে। বাড়ি থেকে ভাত নিয়ে এলাম কাছারিতে। খাওয়ার সময়ও কাগজটি চোখের সামনে খোলা। এক মুহূর্তের জন্যও এই মহামূল্যবান-অমূল্য সম্পদ চোখের আড়াল করার ইচ্ছা নেই। আমাকে জানতেই হবে, ছন্দ কী, কত প্রকার ও কী কী।
আমি কিন্তু হেডস্যারকে বলে দেবো তুই মিছামিছি পেটব্যথার কথা বলে ছুটি নিছিস।’ বলতে বলতে সে রাস্তা ছেড়ে নেমে পড়ে আলে। পশ্চিম আকাশে তখনো সূর্যের লাল আভা মেঘমালাকে রাঙিয়ে রেখেছে।
পুরো নিবন্ধটি অন্তত ৫ বার পড়লাম। পড়তে পড়তে কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে, টেরই পেলাম না। সন্ধ্যা হতে হতেই আত্মস্থ হয়ে গেলো স্বরবৃত্ত কী। সঙ্গে সঙ্গে এও জানা হয়ে গেলো—স্বরবৃত্তে লেখা কবিতা-ছড়ার চরণ, পর্ব-সংখ্যা। আরও শিখলাম অক্ষর, মাত্রা গণনার হিসাবও। এক ফাঁকে হারিকেন জ্বালিয়ে নিলাম। এবার ড্রয়ার খুলে বের কলাম, আল মাহমুদের ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’। যেখানে ছন্দের কথা আছে, সে পাতা খুঁজে বের করি। এরপর পত্রিকার নিবন্ধটির সঙ্গে মিলিয়ে দেখি। আরে একদম মিলে গেলো।
হঠাৎ মনে হলো, মাঠ থেকে গরু আনা হয়নি। বই, পত্রিকার ছেঁড়া পাতা ড্রয়ারে রেখে তালি দিয়ে দিলাম। কাছারির দরোজায় তালা দিতে যাবো, এমন সময় এসে হাজির ইসমাইল ও রাসেল। তারা স্কুল ছুটির পর বল খেলেছে, এখন ফিরেছে। রাসেল আমাদের কাছারিতে বই রেখে বাড়িতে যাবে। জামা-কাপড় বদল করে খাওয়া-দাওয়া সেরে সন্ধ্যার পর পড়তে আসবে। তাদের দুজনকে দেখে দরোজায় তালা না দিয়েই বেরিয়ে গেলাম মাঠের দিকে। গরু এনে গোয়াল ঘরে বেঁধে, ঘাসপাতি দিয়ে নামলাম পুকুরে। হাতমুখ ধুয়ে কাছারিতে ঢুকে দেখি—বেলাল এসে হাজির। হাতে ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’। তার হাতে বইটি দেখে আমার অন্তরাত্ম কেঁপে উঠলো। বলি, ‘কী রে তুই? স্কুল থেকে ফিরতে এত দেরি? বাড়ি যাসনি?’ বেলাল প্রশ্নের উত্তর দেয় না। উল্টো বিদ্রূপের হাসি দিয়ে বলে, ‘তোর না পেটে ব্যথা! তুই স্যারের কাছে মিথ্যা দরখাস্ত দিলি। তুই কি মনে করেছিস আমি কিছুই বুঝিনি? ‘নিজেরা করি’ অফিস থেকে এই বই পাওয়ার পর তোর আর ক্লাসে মন বসছিল না। ক্যামনে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসবি, সেই ফন্দি করছিলি। তোর হাবভাব দেখেই কিন্তু বুঝেছি।’
ধরা পড়ে গেছি বেলালের কাছে। কথা ঘুরিয়ে লাভ নেই। তাতে ঝামেলা বাড়বে। এর চেয়ে নিজেকে সমর্পণ করি—‘শোন বন্ধু। বইটা না পড়ে শান্তি পাচ্ছিলাম না। ক্লাসে এই বই যে দেখবে সেই প্রশ্ন করবে। আর স্যারদের খবর তো জানিস। আউট বই দেখলেই বেত নিয়ে হাজির হবেন। এ কারণে পেটব্যথার নাটক করেছি। তুই না বন্ধু আমার? তুই তো আমার কথা বুঝবি।’ বেলাল ছাড়ার পাত্র নয়। বলে, ‘ঠিক আছে। তোর পড়া শেষ হলে আমাকে দিবি। কথা যেন ঠিক থাকে।’ বেলাল তো আর জানে না, ওই মুহূর্তে আমার কাছে ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’র চেয়ে আরও মূল্যবান জিনিস আছে। তাই সে যদি এখনই নিতে চায়, তাতেও ‘না’ করবো না। কিন্তু মুখে তা বলি না। বলি, ‘আচ্ছা দোস্ত। নিস তুই।’ বেলাল এবার দুই চোখ গোল গোল করে আমার দিকে তাকায়। তার চোখে গভীর সন্দেহ। সত্যি বই দেবো? তার কাঁধে হাত রাখি—‘বিশ্বাস হচ্ছে না?’ হাঁটতে হাঁটতে তাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেই। এবার সে বলে, ‘শোন। বই যদি না দিস, তোরই লস। আমি কিন্তু হেডস্যারকে বলে দেবো তুই মিছামিছি পেটব্যথার কথা বলে ছুটি নিছিস।’ বলতে বলতে সে রাস্তা ছেড়ে নেমে পড়ে আলে। পশ্চিম আকাশে তখনো সূর্যের লাল আভা মেঘমালাকে রাঙিয়ে রেখেছে। তারাই অপার্থিব আলো এসে মাঠভরা সোনালি ধানের ওপর বাতাসের তালে তালে ঢেউ তুলে যাচ্ছে। আমি সেদিকেই তাকিয়ে থাকি।
চলবে…
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-২৫॥ মোহাম্মদ নূরুল হক