পর্ব-৮
– ফ্রয়েডের বেশ কিছু দর্শনের সঙ্গে আমি একমত হতে পারিনি। তা আমার না বোঝার ব্যর্থতা হতে পারে। তা-ও বলি কেমনে, এমন কোনো রকেট সায়েন্স তো তিনি বলেননি। যেমন- তার মতবাদের অন্যতম অনুষঙ্গ, মানুষের যৌনবাসনা ভালোভাবে পূর্ণ না হলে ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সেজন্য ব্যক্তিত্বের বিকাশের স্তরগুলোকে মনোযৌন বিকাশ নামকরণ করেন। ফ্রয়েড মনোযৌনবিকাশ তত্ত্বে প্রমাণ করেন, প্রাপ্তবয়স্কদের মতো শিশুদেরও যৌন অনুভূতি থাকে। গুরুজির এই পুরো তত্ত্বের সঙ্গে আমার দীর্ঘ বিরোধ। যৌনবাসনার সঙ্গে ব্যক্তিত্ব বিকাশের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনেই করি না।
আমার বদ্ধমূল ধারণা, বিকৃত যৌন রোগীরা তত্ত্বটি লুফে নিয়ে প্রমোট করেছেন। যৌনবাসনা অত্যন্ত তাৎক্ষণিক ব্যাপার, আর যৌনবিকৃতি ক্রনিক ডিজিজ, অনেকটা সিরিয়াল কিলিংয়ের মতো। ফ্রয়েড মৃগী রোগী, সিরিজ কিলারদের আদলে সিরিয়াল রেপিস্টদের চিকিৎসায় ডেটা সংগ্রহ করেছেন, তার স্যাম্পলিং স্ট্র্যাটেজি নিয়েও আমার আপত্তি আছে। রোগীর ট্রিটমেন্ট চলাকালে তার জীবনধারা, চিন্তা, আচরণ একধরনের আর সাধারণ সুস্থদের ধারা আরেক জাতের। সব গুলিয়ে একাকার করে মতবাদ দেবেন, তা না হওয়াই মঙ্গল ছিল। আর শিশুদের যৌনতা নিয়ে যা বলেছেন, তা তার একেবারেই নিজস্ব মন্তব্য, একে সর্বজনীন মতবাদ বলতে দ্বিধা নয়, তা আমি পুরোটাই নাকচ করার পক্ষে।
তবে ফ্রয়েডের সাইকো-অ্যানালিসিস আমার মনে ধরেছে। তিনি মানুষের নিজের সাইকো-অ্যানালিসিস মানে মনোসমীক্ষণ নিজেকেই করতে বলেছেন। ফ্রয়েড মনে করতেন, প্রতিটি মনোসমীক্ষকের উচিত নিজের মনোসমীক্ষণ করা। নিজের মনোসমীক্ষণ করতে পারলেই অন্যেরটা করা যাবে। অসাধারণ বলেছেন। যদিও এ প্রসঙ্গেও ভালো ঝামেলা আছে। কোনো থিসিস বা সার্ভে নয়, তিনি তার মনোসমীক্ষণের ধারণাটি পেয়েছিলেন সাহিত্য ও দর্শন থেকে। আবার তারই উদ্ভাবিত পদ্ধতি দিয়ে সাহিত্যকে বিশ্লেষণ করা যায়, আজ পর্যন্ত তা-ই হয়ে আসছে।
অ্যাই, শুনছো? ফাহমিদা। তোমার দেখি তন্দ্রা চলে এলো। কথাগুলো তোমার জন্য বলছি।
– বলে যাও, শুনছি।
– ফ্রয়েড ঠিকই বলেছেন, অবচেতনের নেগেটিভ প্রভাব, জীবনে নানা সমস্যা তৈরি করে। তিনি এ থেকে বের হওয়ার থেরাপির নাম দেন- সাইকো-অ্যানালিসিস বা মনোসমীক্ষণ। মানুষ নানা জটিলতায় ভোগে, ভুগতে ভুগতে সে বুঝতে পারে না যে কেন ভুগছে। যেমন, কারণ ছাড়াই কেন সে সব সময় ভয়ে থাকে, কেন সে সেক্স করতে পারছে না ইত্যাদি। যখন মাত্রাতিরিক্ত হয় তখন সাইকোথেরাপিস্টের কাছে যায়।
– আমাকে সাইকোথেরাপিস্টের কাছে যেতে বলছো?
– নো। কথাটা শোনো আগে। কোন সমস্যার ভেতরে, গভীরে কী কারণ লুকিয়ে আছে তা বের করাই সাইকোথেরাপি এবং সাইকো-অ্যানালিসিসের কাজ।
– আমার কি কোনো সমস্যা আছে?
– অবশ্যই আছে। সমস্যা ছাড়া কোনো মানুষ নেই। কারও নিগূঢ়, কারও প্রকাশ্যে। যেমন- আমার ছেলেবেলার বান্ধবি পেনসিলভেনিয়া- এটা আমার দেয়া নাম, তার নাম পেন্সিল। সে সারাক্ষণ হাত ধুতে থাকে। ধুতে ধুতে হাতের অবস্থা খারাপ করে ফেলে। এরপর শুরু হয় ঘর পরিষ্কার করা। ঘরদোর মুছতে মুছতে পাগলের মতো হয়ে যায়। পরিবারের লোকজন বুঝল, এটা সমস্যা। সে নিজেও বুঝল। কিন্তু এর কারণ কী? কেউই ধরতে পারল না।
ওদিকে রাশান সরকার চাপ দিচ্ছে, এ দিয়ে তারা কী করবে কে জানে। মার্কিনদের ধরতে রুশরা কত কী যে করে, কত টাকা যে কত দিকে ঢালে কে রাখে হিসাব।
সাইকোথেরাপিস্টের সঙ্গে অনেক কথার পর বেরিয়ে আসে তার শিশুকালের একটি ঘটনা। ঘটনাটি ছিল, এক রাতে তাদের বাসার টয়লেটের পানি উপচে সারা ঘর ভেসে যায়। সারা রাত তারা এর মধ্যেই ছিল, ভোররাতে মেথর গিয়ে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করে। সেই সমস্যা তার অবচেতনে রয়ে গেছে এবং কাজ করছে। এরই প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী সময়ে ধোয়ামোছা রোগ।
ফ্রয়েড ছিলেন ডাক্তার। মেডিক্যাল সায়েন্সের মতে, শরীরের এক অংশে ব্যথা হলে মূল কারণ অন্য অংশে থাকতে পারে। এই ধারণাটি ফ্রয়েড মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করেন। তিনি ধরে নেন, মানসিক যেসব সমস্যা আমরা দেখছি, তার কারণ অবচেতনের দূরের কোনো ঘটনার মধ্যে নিহিত থাকা অস্বাভাবিক নয়।
সাইকোথেরাপি ব্যক্তিকে মূল জায়গায় নিয়ে যায়। সেই দুঃসহ অতীতের ঘটনায়। নিয়ে যায় মূল কারণটি তাকে বোঝাতে। মূল কারণ ও ব্যাখ্যা পেলে মানুষ সমস্যার জটিলতা থেকে মুক্ত হতেও পারে।
– আমার সাইকো-অ্যানালিসিস কে করবে?
– ফাহমিদা, আমাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। নিজের সাইকো-অ্যানালিসিস নিজে করো। ট্রমা থেকে বেরিয়ে এসো। তোমার জীবনটা শুধুই তোমার, জীবনের চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। রকিব একটা ঘোর, একটা বিভ্রান্তি, রকিব ফানুস ওড়ানো খেলা- রকিব কেউ না। ইলোরা বিভ্রান্ত হয়ে জোর করে বিয়ে করেছিল, বিভ্রাট কেটে গেছে, চলেও গেছে। তার জীবনে আলো ফিরেছে। সাইকোথেরাপি করো, মোহের কারণ টেনে সামনে আনো, ঘোর কেটে যাবে। যৌনতা আমার কর্ম নয়। একশ দশ ঘণ্টা টানা ল্যাবে কাটানো রকিবের বউ থাকা যৌক্তিক নয়। পেনসিলভেনিয়ার মতো রকিবও ট্রমাগ্রস্ত। পেন্সিল সাবান নিয়ে দিনভর যুদ্ধ করে আর রকিব মাইক্রোস্কোপের সঙ্গে, ঘটনা একই।
সাইকো-অ্যানালিসিসের অন্যতম ভিত্তি চাইল্ডহুড ট্রমা। এই ট্রমায় সব সময় মারাত্মক কিছু হতে হবে এমন নয়। দেখতে সাধারণ এমন ট্রমাও মানুষের বড় জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে সক্ষম। ফ্রয়েডিয়ান ধারার এক সাইকোথেরাপিস্ট তার বইতে দেখিয়েছিলেন, কীভাবে চার্লি চ্যাপলিনসহ অনেক ব্যক্তির জীবন ও কাজ নির্ধারিত হয়েছিল তাদের চাইল্ডহুড ট্রমার প্রভাবে। তুমি, আমি, চার্লি চ্যাপলিন, পেন্সিল একই সুতোয় গাঁথা।
ভোরের আলো ফুটতেই গ্রামের পথে রওনা দেন রকিব। কী ভেবে মাথায় ওড়না তুলে হাত নেড়ে বিদায় দেন ফাহমিদা। অনেক সুন্দর দেখাচ্ছিল তাকে, বউ বউ লাগছিল।
ব্যক্তিগত দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অভিহিত করে ওই নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের স্পর্ধা দেখাতে পারেন একজনই, তিনি জাঁ পল সার্ত্রে। দর্শনের ইতিহাসে ‘বিং অ্যান্ড নাথিংনেস’ পৃথিবীর প্রভাবশালী বইগুলোর একটি। এ বইয়ের জন্য নোবেল পুরস্কার পেতে যাচ্ছিলেন তিনি। অর্থহীন পৃথিবীর অর্থহীনতার অস্তিত্ববাদ দর্শনের জন্য পৃথিবীর মরণ পর্যন্ত মানুষটি বিখ্যাত হয়ে থাকবেন।
জীবনের অর্থ বলতে কেউ বলে প্রেম, কেউ বলবে ঈশ্বর, আবার কেউ বলবে মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে আসাটাই জীবনের অর্থ। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উত্তরটা কেউ জানে না। প্রতিটি জীবের নির্দিষ্ট পরিচয় ও সত্তা রয়েছে, যা তার অস্তিত্বের অর্থ বহন করে। একটি ছুরির হাতল কাঠের বা লোহার হতে পারে। হাতলের সঙ্গে কোনো ব্লেড না থাকলে সেটিকে কেউ ছুরি বলবে না। ব্লেড হচ্ছে ছুরির পরিচায়ক নির্যাস। আবার মানুষ বুদ্ধি, বিবেক নিয়ে পৃথিবীতে আসে বলে সে মানুষ। বুদ্ধি না থাকলে দর্শনের ভাষায় বলা যায়, মানুষ হিসেবে তার এসেন্স নেই। তাকে সাধারণত বলা হয়- লোকটি অন্তঃসারশূন্য।
ফাহমিদার বাসা থেকে বের হয়ে বাড়ির পথে গাড়িতে দীর্ঘ পথ, রকিবের চিন্তায় দোল খায় জাঁ পল সার্ত্রে। মনে মনে বলেন, জেনুইন ফিলোসফার, সার্ত্রের অন্তঃসারশূন্যদের ভিড়ে ভরে গেছে দেশ-দুনিয়া। অ্যাসেনশিয়ালিজমের প্রবর্তকের নাম মনে আসছে না। সম্ভবত প্লেটো। মানুষ আমৃত্যু জীবনের অর্থ খুঁজতে থাকে এবং ব্যর্থতা নিয়েই পৃথিবী ত্যাগ করে। যতদূর জানা যায়, আড়াই হাজার বছর আগে অ্যাসেনশিয়ালিজম নামের এই দার্শনিক মতবাদ প্রবর্তন করেন প্লেটো ও তার শিষ্য অ্যারিস্টটল। এই তত্ত্ব বলে, শুধু জীব নয়, প্রতিটি বস্তুকে নিজের অস্তিত্ব অর্থবহ করতে হলে কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য বহন করতে হয়। প্লেটোর মতে, মানুষের জীবনের অর্থ এই যে, সে মানুষ। মানুষের মাঝে মানবিক গুণাবলি তার অস্তিত্বকে সার্থক করে। যারা এই গুণাবলির সদ্ব্যবহার করে, তারা সৎ মানুষ। বিপরীত দিকে রয়েছে অসৎ মানুষ।
নিজের থিসিস নিয়ে চিন্তিত রকিব। কাজটা ডালপালা মেলছে। ফোকাসের অবজারভেশন মুখ্য হয়ে উঠছে। মেন্ডেলিজমের মধ্যে ঢুকে পড়ছে ফ্রয়েড-লাকাঁ-সার্ত্রে। অবশ্য থিসিসে এদের সংযোগও প্রসঙ্গিক। মানুষের সন্দেহজনক আচরণ জন্মগত হতে পারে আবার নিজের বা পরিবেশের সৃষ্ট হতে পারে। ফ্রয়েডের সাইকো-অ্যানালিসিস ফর্মুলা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রমিজ ও জাফর উল্লাহর সাইকো-অ্যানালিসিস প্রতিবেদন আরও নিরীক্ষা করতে হবে, এরপর পরবর্তী ধাপের সিদ্ধান্ত। হান্ড্রেড পারসেন্ট লেভেল অব কনফিডেন্সের ওপর দাঁড়াতে হবে। কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে মিশে আছে জন্তু-জানোয়ার, একসঙ্গে খায়, ঘুমায়, চাকরি করে। ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতিসহ সব কিছুতে তারা আছে, কিন্তু ওরা মানুষ নয়। রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের নীতিনির্ধারক ওরা অথচ ব্যাপারটা কেউ অনুমানও করতে পারছে না।
রকিবের আরও দাবি, ঘটনা সত্য, কিন্তু প্রমাণ জটিল। এই প্রমাণ দর্শনশাস্ত্র দিয়েও করা যায়, তবে তা হবে আপেক্ষিক, কেউ কেউ অহেতুক ভিন্ন যুক্তি দাঁড় করাতে চাইবে। সে ক্ষেত্রে ম্যান্ডেলের সূত্র গণিতের হিসাব, অযথা তর্কের কোনো সুযোগ নেই। তার ওপর আছে ডিএনএ টেস্ট। সমাবেশ-বিন্যাসের মাধ্যমে সংখ্যাও বলে দেয়া যাবে। ওদিকে রাশান সরকার চাপ দিচ্ছে, এ দিয়ে তারা কী করবে কে জানে। মার্কিনদের ধরতে রুশরা কত কী যে করে, কত টাকা যে কত দিকে ঢালে কে রাখে হিসাব।
কেয়া একটি পট খুলে দেখান, তলানিতে এক কেজির মতো চাল পড়ে আছে, তার মধ্যে নড়ছে কয়েকটি উকুনের মতো কালো পোকা।
বিক্ষিপ্ত ভাবনায় ক্লান্ত রকিব গোধূলি-অন্তে স্কুলে নামেন। নিজের চিলেকোঠায় ঢুকে স্নান সেরে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত এগারোটায় জাগিয়ে তোলেন অংকন। রেগে বলেন, তোর হলোটা কী? কাণ্ডজ্ঞান সব ধুয়ে খেলি নাকি? স্কুলের খবর কিছু রাখিস? ঝামেলার পর ঝামেলা।
– কী এবং কেন? বড় কোনো সমস্যা? আমাকে না জানিয়ে ভালো করেছিস। প্রিন্সিপাল যেখানে স্টেশনে উপস্থিত, সেখানে আমি কিরে?
– আমার পক্ষে এসব ঝামেলা সামলানো সম্ভব না, বুঝিস না কেন, এটা তোর গ্রাম।
– আমার গ্রাম-তোর গ্রাম এসব কী শব্দ? পুরো দেশটাই আমাদের। সমস্যা কী বল?
– তোর জাফর উল্লাহকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। ধর্ষণ মামলা। গ্রামসুদ্ধ লোক হামলা চালাতে স্কুলের দিকে ধেয়ে আসছিল, গেটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম সমস্যা কী? তারা জাফরকে তাদের হাতে তুলে দিতে বলল।
– তুলে দেসনি কেন? শয়তানটাকে তুলে দিতি, শক্ত মার খেত কিছুক্ষণ।
– তোর কি মাথা খারাপ? সেটা ছিল মব, তাকে মেরেই ফেলত।
– পরে কী করলি?
– থানায় জানালাম, পুলিশ এসে নিয়ে গেল।
– বিরাট সমস্য হলো। আমার থিসিসের বারোটা বাজল। পিছিয়ে গেল সবকিছু।
– মানে কী? তোর থিসিসের সঙ্গে ওই ইডিয়টের রিলেশন কী?
– সে কি সত্যিই রেপ করেছে?
– মেয়েটি নিজে থানায় গিয়ে ধর্ষণ মামলা করেছেন। সকালে মামলা, দুপুরে গ্রেপ্তার, বিকেলে কোর্টে চালান, সন্ধ্যায় শুনানি, রাতে কারাগারে। কাল পুলিশ রিমান্ডের আবেদন করবে।
– মেয়েটার সঙ্গে তোর দেখা বা কথা হয়েছে? ওর কি মেডিকেল টেস্ট হয়েছে?
– কী আশ্চর্য। আমার দেখা হবে কেন, আমি কী পুলিশ? পুলিশ কী করছে জানি না।
– মেয়েটার সঙ্গে আমার দ্রুত কথা বলেতে হবে। ঘটনার পুরো জানতে হবে।
– দেখ রকিব, ঝামেলায় জড়াসনে, পুলিশের কাজ তাদের করতে দে।
– কাজটা শুধু পুলিশের না, এর সঙ্গে স্কুলের রেপুটেশন জড়িত। ঘটনা শুধু রেপ নয়, মনে হচ্ছে আরও কিছু।
রাতেই মেয়েটার বিষয়ে খোঁজখবর নেয় রকিব। অতি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে। দারিদ্র্যের কারণে বিয়ে হচ্ছে না। উত্তর পাড়ার কালি দীঘির দক্ষিণ পাড়ে রিকশাচালক বাবা দুই মেয়ে নিয়ে ঝুপড়িতে থাকেন। তাদের মা নেই। ১৫ বছর বয়সী ছোট বোন পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তাদের বাবা দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টে ভুগছেন, এখন আর রিকশা চালাতে পারেন না। আয়-উপার্জনের পথ বন্ধ।
রকিব জানতে পারেন, জাফর অনেক দিন ধরে পরিবারটিকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছিলেন। এর বেশি কিছু জানা যায়নি। পরদিন জাফরকে তিন দিনের রিমান্ডে পায় পুলিশ। আদালত সূত্রে জানা গেছে, একশ চৌষট্টি ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ধর্ষণের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন জাফর। এখন রিমান্ড শেষ হলে কী হয় জানার অপেক্ষা।
পত্রপত্রিকায় ফলাও করে নিউজ হয়েছে, যথারীতি স্কুলের নাম দিয়েই শিরোনাম। নিউজে প্রিন্সিপালের বক্তব্য গেছে। এডিসি জেনারেলকে প্রধান করে জেলা প্রশাসন থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি হয়েছে। জেলা শিক্ষা অফিসার ও ইউএনও কমিটির সদস্য। দুই-একদিন পর পর তদন্ত কমিটি, পুলিশ প্রশাসনের লোকজন স্কুলে আসা-যাওয়া করছেন। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক-এলাকাবাসী উদ্বিগ্ন। স্কুলের মানসম্মান মিশে গেছে ধুলোয়।
রকিব ভেবে পান না, জটিলতার সমাধান কী হতে পারে। তার হাতে দুটি পয়েন্ট আছে- প্রথমত ওই পরিবারকে জাফরের সহায়তা, দ্বিতীয়ত নেগেটিভ মেডিকেল রিপোর্ট। তাতে কী, জাফর তো রেপের দায় স্বীকার করেছে। মামলার বাদীও অনড়। জটিল প্যারাডস্কের ফাঁদ। এ ক্ষেত্রে আইন কী, আদালত কী রায় দেন, জানা নেই রকিবের। মেডিকেল রিপোর্ট চ্যালেঞ্জের বিষয়ে বাদী-বিবাদীর আইনজীবীর কোনো কথা নেই। কারণ, বিবাদী সর্বত্র দোষ স্বীকার করে গেছেন। যেকোনো দিন রায় হয়ে যাবে।
এরই মধ্যে তিন মাস পার। আদালত প্রসিডিউর অনুযায়ী এগোতে থাকে। চলতে থাকে রকিবের নিজস্ব তদন্ত। স্কুলের সম্মান বাঁচাতে হবে, রেপের বিচার হতে হবে এবং ধর্ষিতার সম্মানজনক সন্তুষ্টি নিশ্চিত হতে হবে। এই তিন হবের নিশ্চয়তা তাকেই দিতে হবে। বাড়ি গিয়ে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করেন রকিব। তখন বিকেল। আসরের নামাজ পড়ে মেয়েটি উঠানে রোদে চুল শুকাচ্ছিলেন। রকিব পাতার বেড়া শব্দ করে নাড়ছিলেন, মেয়েটি এগিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কে?
– আমি রকিব। ব্রহ্মপুর স্কুলের টিচার।
– কারে চান?
– আপনার সঙ্গে খানিক কথা আছে, ভেতরে আসব?
– বাবা তো বাড়িতে নাই, বাজারে কেরোসিন আনতে গেছেন, আচ্ছা তবু আসেন?
– আমি ঘরে যাব না, উঠানেই কথা বলব।
– কী কথা, বলেন।
– আপনি কি কেবলই নামাজ পড়ে উঠলেন?
– জি¦, কেমনে বুঝলেন?
-অনুমান করে বললাম। নিশ্চিত নই, তাই জিজ্ঞাসা করলাম। নামাজের শাড়ি পরে আছেন, এ কারণে মনে হয়েছে। আমি কথা বেশি বলব না। দুইটা বিষয়ে জানতে এসেছি, আপনি বলতে পারেন আবার না-ও বলতে পারেন। না চাইলে না বলবেন, তবে একটা অনুরোধ, মিথ্যে বলার দরকার নেই। দুই প্রশ্নের একটার উত্তর আমি নিশ্চিতভাবে জানি, তবু আপনার মুখে শুনতে চাই।
– কী জানতে চান, বলেন।
– দেখুন, যা ঘটার তা নির্মমভাবে ঘটে গেছে। পরিকল্পনার চৌদ্দআনা বাস্তবায়ন হয়েছে, দুআনা বাকি। আপনার সর্বনাশের কোনো সীমা নেই। জাফরের যা হওয়ার হয়েছে, এখন রায় বাকি- হয় ফাঁসির দড়ি, নয় তো যাবজ্জীবন জেল। স্কুলের ত্রিশজন শিক্ষকের সম্মান রসাতলে গেছে। এখন পাঁচশ ছাত্রের শিক্ষাজীবন নির্ভর করছে আপনার ওপর। স্কুলে সরকারের বরাদ্দ ও অনুদান পাওয়া ঝুলছে আপনার সিদ্ধান্তের ওপর। আর বরাদ্দ ও অনুদানের ওপর নির্ভর করছে এখানে স্কুল থাকা না থাকা।
– কী কন এই সব। আমরা গরিব, রাইতে খামু কী জানি না। আমরা এইসব কিছু বুঝি না স্যার।
এই বলে কান্না জুড়ে দেন মোসাম্মৎ রেবেকা সুলতানা কেয়া।
– কেয়া, কান্না থামান। জগতে চোখের জল সবচেয়ে দামি, তবে ক্রেতা নেই। চোখের পানি মোছেন। মূল দুই প্রশ্নের আগে আরেকটা প্রশ্ন করি। জাফর কি প্রতি মাসে আপনাকে টাকা দিতেন? কত দিতেন?
– আড়াই হাজার টাকা। স্কুলের বেতন তুলে সোজা এখানে আসতেন, টাকা দিয়ে চলে যেতেন।
– ঠিক আছে, আপনি আদালতেও তাই বলেছেন। এবার বলেন, জাফর রেপ করেননি, এটা আপনি জানেন, জাফর জানেন, আদালত জানেন, মেডিকেল রিপোর্টও তাই বলে এবং আমি শতভাগ নিশ্চিত। তবে কেন তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করলেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন, আপনি কি এই মিথ্যে মামলার পরিণতিটা জানেন?
– আমি কিছু জানি না স্যার, আমি কিছু বুঝি না।
– জাফর যে আপনাকে ভালোবাসে তা কি জানতেন?
– জি স্যার।
– যে মানুষটা আপনাকে এক বছর ধরে প্রতি মাসে আড়াই হাজার করে টাকা দিয়ে যাচ্ছে, বিনিময়ে কিছু চায়নি, আপনার হাতটাও স্পর্শ করেনি- তার ফাঁসির সাজা হতে পারে তেমন মামলা আপনি করতে পারলেন? এর কারণটা কী? মাত্র কুড়ি হাজার টাকা একসঙ্গে পাবার জন্য এই জঘন্য কাজটার পেছনে আর কী আছে কেয়া?
– কুড়ি হাজার না স্যার, পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। এই টাকারে মাত্র টাকা বলতেছেন স্যার? আমাদের জীবনটা বুঝতে চাইতেছেন না কেউ। ঘরে আসেন স্যার।
কেয়া জোর করে রকিবের হাত ধরে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে যান। মাঝে পাটকাঠির পার্টিশন দেয়া দুটি কক্ষ। একপাশে কাঠের সিন্দুকের ওপর শুয়ে চেয়ে আছে হাড্ডিসার এক কিশোরী, মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। ওপরে টিনের ছাউনি, শত শত ফুটো দিয়ে আকাশ দেখা যায়। চারপাশের গোবরে মাখা বেড়া ঘুণে খেয়েছে অনেক আগে, ভেতর থেকে কাঁথা ও সিমেন্টের বস্তা ঝুলিয়ে শুধু দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। পাশের কামরায় তাদের বাবা ঘুমান মেঝেতে চটের বস্তা বিছিয়ে।
কেয়া একটি পট খুলে দেখান, তলানিতে এক কেজির মতো চাল পড়ে আছে, তার মধ্যে নড়ছে কয়েকটি উকুনের মতো কালো পোকা।
চলবে…
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-৭॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন