পর্ব-৭
ফলন শব্দটা ইচ্ছে করে বললাম, কারণ উন্নত বীজ ছাড়া আর উন্নত ফলন হবে না। ভালো জাতের স্পার্ম লাগবে। বছরের পর বছর স্যাঁতসেঁতে একই গুদামের সব বীজ আলো-বাতাসের অভাবে অকার্যকর হয়ে গেছে। এসব বীজে চারা হয়, তবে সব বনসাই, সব বামন। উচ্চতায়, চিন্তায়, কর্মে বামন। জোহান ম্যান্ডেলের তত্ত্বমতে, বামনের প্রোডাকশন বামনই হয়।
– উন্নত বীজ মানে স্পার্ম পাব কোথায়? ইমপোর্ট করতে হবে দেখছি।
– সত্যিই তাই। এ নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভাবতে হবে। রাষ্ট্র সব যে ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্যে করবে তা নয়। সব যে সংবিধানে লিপিবদ্ধ করতে হবে তা-ও নয়। সব সিদ্ধান্ত গণশুনানি করে নিতে হবে না। প্রয়োজনে ইমপোর্টের ব্যবস্থাও করতে হতে পারে। কথা হলো, মেধাশূন্য একটি অর্থহীন জাতি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। অবাক বিষয়- কোটি কোটি মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই, এরা জীবনের অর্থ জানে না। এদের কোনো উপলব্ধি নেই। এরা মাতৃভাষায় ঠিকমতো কথাও বলতে জানে না। অর্থহীন এরা পিটাপিটি করতে করতে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
– তুমি যা বলছ সব থিউরি, প্র্যাকটিক্যাল নয়। কারণ, তুমি নিজেই এসব কথার বাস্তবতা মানো না বা বিশ^াস করো না।
– উদাহরণ দিতে পারবে?
– অবশ্যই। ওয়াসার কলের পানির মতো অপচয় হওয়া স্পার্মের একটি কনা আঠারো বছর ধরে ভিক্ষা করেও পেলাম না। সেই তুমি স্পার্ম ইমপোর্টের টেন্ডারের দরপত্র দিচ্ছ, খুবই অদ্ভুত মজা পাচ্ছি কিন্তু।
– তুমি সব সময় থাকো ঘোর আর জেদের মধ্যে, আর মানুষ পাওনি। আমি নিজেই নিম্নশ্রেণির গড়পড়তা ভবঘুরে। কী আছে আমার- না বুদ্ধি, না বিদ্যা। না জানি গণিত, না জানি দর্শন, না লিখতে পারি এক লাইন কাব্য। মাথাভর্তি অযথা যন্ত্রণা নিয়ে অকারণে ঘুরে বেড়াই। এর মধ্যে তোমার অযথা আক্ষেপ। এর চেয়ে বরং মন্দের ভালো কিছু লোক আছেন, যারা কথাবার্তা ভালো বলতে পারেন, কথা বলে হিপনোটাইজ করতে পারেন, দু-চারটা ভালো কবিতা-উপন্যাস লিখে জনপ্রিয় হয়েছেন। এ ছাড়াও আমাদের কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন, তারা আলোচিত ও উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়। তারা দেশের ভেতর স্বীকৃত বুদ্ধিজীবী এবং মেধাবী হিসেবেই পরিচিত। তারা কারা বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই।
– মানে কী? স্পার্মের জন্য তোমার ওই বিখ্যাত স্যারদের সঙ্গে শুতে বলছ?
– তুমি তো দেখছি খুবই উঁচু দরের বোকা। শুক্রাণু ইস্যুতে জগৎজোড়া খ্যাতিমান স্যারদের যেখানে হিসাবে ধরছ না, সেখানে আমার মতো বখাটে মাথায় আসে কিভাবে?
– তোমার অবজারভেশনের বিষয়টা ভালো ছিল, কিন্তু আজেবাজে কথা বলে মূল ইস্যু উড়িয়ে মুড অফ করে দিলে। স্টপ। জাস্ট স্টপ। অন্য কথা বলো, চা খাবে?
– ওকে অ্যান্ড ওকে। চা, ভদকা সব নিয়ে এসো। যেকোনো থিউরির সঙ্গে দ্বিমত পোষণের পূর্ণ অধিকার তোমার আছে, কিন্তু রিঅ্যাক্ট করার কী দরকার। তুমি অগুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আপত্তি তুলেছ, মূল ইস্যু ছিল স্পার্ম ইমপোর্ট। এতে সরকারি অকশনে টেন্ডার ড্রপের মাধ্যমে লাইসেন্সধারী ঢেন্ডররা অংশ নিতে পারে, তবে এ ক্ষেত্রে চোরাচালান কঠোরভাবে ঠেকাতে হবে। অকশনে বিউটি কনটেস্টের মাধমে ভেন্ডর নির্বাচন করতে হবে। ধরো, কেউ চাইল লিওনেল মেসি, জিনেদিন জিদান, আর্নল্ড শোয়াটর্জনিগার, বারাক ওবামা অথবা জুকারবার্গের স্পার্ম, ভেন্ডর দিয়ে দিলো দাউদ ইব্রাহিম অথবা ডোনাল্ড ট্রাম্পেরটা। এই দুর্নীতি করলে ফল উল্টো হবে। কিছু দেশও ব্লক করতে হবে, যেমন কলম্বিয়া। এশিয়া থাকবে পুরোপুরি নিষিদ্ধ, এই অঞ্চল থেকে উন্নত মস্তিষ্ক পাওয়ার প্রোবাবিলিটি শূন্য। যে অঞ্চলে মীর জাফর, খোন্দকার মোশতাক ও ইয়াহিয়া খান জন্মেছে, সেখানে কিলবিল করছে তাদের বংশধররা।
– স্পার্ম ব্যাংক গঠন করতে হবে, তাই না?
– হুম। সরকারের পোলিও, বিসিজি টিকা কার্যক্রমের আদলে ফ্রি স্পার্ম ব্যাংক কর্মসূচি চালু হবে। ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ থাকবে না, পছন্দমতো ব্যক্তির শুক্রাণু পাবার অধিকার নিশ্চিত হবে। এ ক্ষেত্রে গঠন হবে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন স্বাধীন কমিশন। তারা স্পার্ম ব্যাংক নীতিমালা তৈরি, সুরক্ষা এবং চাহিদামতো শুক্রাণু সংগ্রহে বিশ^ব্যাপী কূটনৈতিক লিয়াজোঁ করবে। স্পার্মপ্রাপ্তি দুভাবে হতে পারে। প্রথমত, ব্যাংক থেকে সংগ্রহ এবং দ্বিতীয়ত- বিদেশে গিয়ে নির্বাচিত ব্যক্তির সঙ্গে ফিজিক্যাল ইউনিয়নের মাধ্যমে। উভয় পক্ষের স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ যাবতীয় প্রক্রিয়া কমিশনের মাধ্যমে সম্পাদন হবে। বিদেশে গিয়ে দলে দলে এইচআইভি নিয়ে ফিরলে তো আরেক বিপদ। এ কারণে মেডিকেল ফিটনেস সার্টিফিকেট খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্পার্ম দাতা নির্বাচনেও কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে, এ ক্ষেত্রে তদবির বা কোনো ধরনের ওজর-আপত্তি অগ্রাহ্য হবে।
অবাক হয়ে দেখেছেন, মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি করতে পারে এমন কোষ দিয়ে শুয়োরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গড়ে উঠেছে, শুয়োরের ভ্রূণেই।
২০২০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন যুক্তরাজ্যের রজার পেনরোস, জার্মানির রাইনহার্ড গেনজেল এবং যুক্তরাষ্ট্রের আন্দ্রেয়া ঘেজ। তিনজনের গবেষণার বিষয় ছিল মহাকাশ। তাদের একজন কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা করেছেন, অন্য দুজনের বিষয় ছিল গ্যালাক্সি। কেউ যদি তাদের একজনকে নির্বাচন করেন, কমিশনের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালানো হবে। এ ক্ষেত্রে আন্দ্রেয়াকে ম্যানেজ করা দুরূহ হতে পারে, কিন্তু প্রক্রিয়া চলবে। উনি কনসিভ করতে না চাইলে টেস্টটিউবে যেতে হতে পারে।
– এ ক্ষেত্রে কি টাইম ফ্রেম থাকবে? ধরো এই প্রক্রিয়া তিন বছর বা পাঁচ বছর চলবে। ম্যান্ডেলের মতবাদ অনুযায়ী এগোলে স্ট্যাটিসকস কী বলে? এক বছরে কত নারী স্পার্ম ব্যাংক থেকে শুক্রাণু নিয়ে বা ট্যালেন্টদের সঙ্গে শুয়ে বাচ্চা উৎপাদন করলে টোটাল পপুলেশনের অন্তত সিকিভাগ টার্গেট পূরণ হবে?
– তুমি ফান করছ নাকি তাড়াহুড়ো করছ বুঝতে পারছি না। ম্যান্ডেলের দুইটা ইকোয়েশন আগে বোঝার চেষ্টা করো। কাগজকলম লাগবে, লিখে দিই। এই দুই সমীকরণ আমার পুরো থিসিসটা লিড করেছে। প্রথম সূত্র অনুযায়ী সংকর জীবে বিপরীত বৈশিষ্ট্যের ফ্যাক্টর মানে জিনগুলি মিশ্রিত বা পরিবর্তিত না হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে এবং জননকোষ সৃষ্টির সময় পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যায়। এই সূত্রানুসারে দ্বিতীয় শংকর পুরুষের (F2) এক জোড়া বিপরীতমুখী বৈশিষ্ট্যের (বিদেশি, TT x wk, tt) ফেনোটাইপের অনুপাত পাওয়া যায় বিদেশি: দেশি = ৩:১ এবং জেনোটাইপের অনুপাত পাওয়া যায় TT:Tt:tt=1:2:1। এই সূত্র মনোহাইব্রিড ক্রসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; কারণ এখানে এক জোড়া বিপরীতমুখী বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় নিয়ে সংকরায়ণ ঘটানো হয়।
তুমি কি গ্রোথটা বুঝতে পারছ? মানে সংকটের সমাধান ঝটপট চলে আসবে না। অন্তত দশ বছর পর্যাপ্ত ফ্যাক্টর নিয়ে কাজ করতে হবে। বিষয়টা স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। দেশে যেমন তেল, পেঁয়াজ, পেট্রোলিয়াম আমদানি করতে হয়, তেমনি স্পার্মও রেগুলার ইমপোর্ট হবে। সরকারকে বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি দিতে হবে। এটা বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। আগেই বলেছি, হাড্ডিসার মেধাহীন গরু-গাধা নিয়ে দেশ কোনো দিন বিশে^র দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। সত্যি বলছি- ক্রিস গেইল, উসাইন বোল্ট, বিল গেটস, ভ্লাদিমির পুতিনের শুক্রাণু সংগ্রহ করতে হবে। গেব্রিয়াল গার্সিয়া মার্কেজ মারা গিয়ে সর্বনাশ করেছেন, একমাত্র কলম্বিয়ান- যার শুক্রাণু ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্টিফেন হকিংয়ের স্পার্ম সংরক্ষণ করা আছে কিনা খোঁজ নিতে হবে।
– ম্যান্ডেলের সেকেন্ড ইকোয়েশনে কী আছে?
– দ্বিতীয় সূত্রটা একটু জটিল। মানে দুই বা ততোধিক জোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ক্রসের ফলে প্রথম সংকর পুরুষে (F1) কেবল প্রকট বৈশিষ্ট্যগুলিই প্রকাশিত হয় কিন্তু জননকোষ সৃষ্টির সময় বৈশিষ্ট্যগুলির জোড়া ভেঙে একে অপর থেকে স্বাধীন বা স্বতন্ত্রভাবে বিন্যস্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জননকোষে প্রবেশ করে।
এই সূত্র অনুসারে দ্বিতীয় সংকর পুরুষের (F2) দুই জোড়া বিপরীতমুখী বৈশিষ্ট্যের (বিদেশি, TT ও মেধাবী, BB x দেশি, tt ও মেধাহীন, নন) ফেনোটাইপের অনুপাত পাওয়া যায়, বিদেশি ও মেধাবী: বিদেশি ও মেধাহীন: দেশি ও মেধাবী: দেশি ও মেধাহীন = ৯:৩:৩:১।
অন্তত দুই জোড়া বিপরীতমুখী বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় নিয়ে সংকরায়ন ঘটানো হলে তাকে ডাইহাইব্রিড ক্রস বলে।
ইকোয়েশনটা নিজের মতো করে গুছিয়ে নাও প্লিজ। ম্যান্ডেলিজম আসলে গণিতের সমাবেশ-বিন্যাসের সূত্র ধরে এগোতে হয়। অনেকটা চেইন বিক্রিয়ার মতো। নোটেশনটা মনে রেখো প্লিজ, আমার থিসিস এই নোটেশনে দাঁড়িয়েছে।
– তুমি কিন্তু জটিল সূত্র এনে পাগল করে তুলছ। মূল গবেষণায় আরও অবজারভেশন আছে?
– হুম। তবে একটু সেনসেটিভ ইস্যু।
– যা বললে তার চেয়েও সেনসেটিভ?
– জি জনাব। শুধু সংবেদনশীল নয়, ঝুঁকিপূর্ণ এবং আতঙ্কের। মানুষের হাতে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ মনে হচ্ছে বেশি দিন আর নেই। শঙ্কা নিয়ে যে থিসিস শুরু করেছিলাম, নাজুক পরিস্থিতিতে ফোকাসটা টার্ন করছে অন্যদিকে।
মানবসভ্যতা কীভাবে এবং কবে ধ্বংসের মুখোমুখি হবে, সে বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন স্টিফেন হকিং। বলেছেন, ছয় শ বছরের কম সময়ের মধ্যেই আমরা সবাই মারা যাব। কারণ, পৃথিবীতে মানুষ বেড়ে যে পরিমাণ বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে, তাতে পুরো পৃথিবী পুড়ে লাল হয়ে যাবে। তিনি মৃত্যুর আগের বছর চীনের বেইজিংয়ে টেনসেন্ট উই সামিটে এ তত্ত্ব দেন। তিনি ভিনগ্রহে দ্রুত জায়গা খুঁজতে বলেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন, আলোর গতিতে যোগাযোগ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের।
কৃত্রিম বুদ্ধিমানরা মানুষকে হটিয়ে দেবে- এমন শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক হকিং। উইয়ার্ড ম্যাগাজিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে হকিং বলেছিলেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের উন্নয়নে আমাদের যেমন সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত, তেমনি এটা মনে রাখতে হবে যে, তারা হবে বিপজ্জনক। তারা সত্যিই মানুষকে হটিয়ে দেবে। মানুষ যদি কম্পিউটার ভাইরাস তৈরি করতে পারে, তবে কেউ এমন কৃত্রিম বুদ্ধিমান তৈরি করে বসবে, যে তাকেই সরিয়ে দেবে। এটা জীবনের আরেকটি রূপ হবে এবং বুদ্ধির দিক থেকে মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে।
হকিং সেই সম্মেলনে সহসাই পৃথিবী ধ্বংসের সাতটি কারণ দেখিয়েছিলেন। আমি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে থেমেছি। কারণ, আমার কাছে তথ্য আছে, ম্যান্ডেলের মতবাদ অনুসরণে মানুষের মতো দেখতে নতুন প্রাণী প্রোডিউস হচ্ছে দেদার।
মানুষ ও শুয়োরের সংকর প্রাণী এরই মধ্যে জন্ম নিয়েছে। মানুষের কোষ দিয়ে বানানো সম্ভব হয়েছে শুয়োরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। মানুষের অবয়বে সংকর প্রাণীটির নামকরণ হয়েছে-শিমেরা। ভ্রƒণটি বানাতে পারলেন বিজ্ঞানীরা, যার কোষের অনেকটা শুয়োরের হলেও, বাকিটা মানুষের! শুয়োরের ভ্রƒণে বাইরে থেকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল মানুষের শরীরের প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেল। যে স্টেম সেল থেকে মানব শরীরের যেকোনো এলাকা বা অঙ্গের কোষ, কলা তৈরি করা যায়।
বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে দেখেছেন, মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি করতে পারে এমন কোষ দিয়ে শুয়োরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গড়ে উঠেছে, শুয়োরের ভ্রূণেই।
প্ল্যান ছিল, তোমার কাছ থেকে তোমাকে পেয়ে চিরতরে বিদেশে চলে যাব, সে আর হলো না। তবে পাশে আছি সবসময়।
বায়োলজিস্ট ইঝপিসুয়া বেলমতের নেতৃত্বে আমেরিকার সান দিয়েগোর ‘সাল্ক ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল স্টাডিজ’ ও স্পেনের ‘ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব মার্সিয়া’র একটি গবেষক দল গবেষণাটি করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের ভ্রূণের চেয়ে তিনগুণ দ্রুত হারে বাড়ে শুয়োরের ভ্রূণ।
সব ভালো ভালো নয়, সব নিরীক্ষা সিদ্ধ নয়। গবেষণাটি জন্ম দিয়েছে বিপুল বিতর্কের। শঙ্কা হলো- যদি অনেক বেশি পরিমাণে মানুষের শরীরের ডিএনএ শুয়োরের ভ্রূণে ঢোকে, তবে এমন শুয়োরের জন্ম হতে পারে, যার মস্তিষ্ক হবে ঠিক মানুষের মতোই উন্নত। মানুষ আর শুয়োরে কোনো পার্থক্য থাকছে না। এ ঘটনায় হিউম্যান জেনেটিক্স অ্যালাট অধিকর্তা ডেভিড কিং বলেই ফেলেছেন, শিমেরা গবেষণার ফল খুবই বিব্রতকর। উদ্বিগ্নবোধ করছি। অশনিসংকেত দেখতে পাচ্ছি।
তাহলে কী দাঁড়াল ড. ফাহমিদা, মানব জাতির বিলোপ ঘটাতে কেউ বসে নেই। পদার্থবিজ্ঞানীরা বানাচ্ছেন পারমাণবিক বোমা, আত্মঘাতী রোবট আর প্রাণিবিজ্ঞানীরা জন্ম দিচ্ছেন মানুষের চেহারার ভয়ংকর প্রাণী। এসব প্রাণী উচ্চ উৎপাদনশীল এবং বুদ্ধি ও শক্তিতে এগিয়ে।
– তুমি গ্রামে গিয়ে ল্যাবের ভেতর নিরিবিলি কী বানাচ্ছো? আমরা আমজনতা তোমাদের মতো ভয়ংকর সাইন্টিস্টদের গিনিপিগে পরিণত হলাম, তাই না?
– নারে সোনা, আমি সাইন্টিস্ট নই, সামান্য ডেটা অ্যানালিস্ট, সার্ভেয়ার বলতে পারো। আমি চারপাশে অদ্ভুত কিছু প্রাণী দেখি, যারা দেখতে অবিকল মানুষ, কিন্তু আচরণ জানোয়ারের মতো। এসব প্রাণী কোনো ল্যাবে জন্মায়নি, সম্ভবত সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। এরা কীভাবে এলো, কোথা থেকে এলো, এদের জন্মসূত্র, ক্ষমতা, শক্তি এবং ক্রোমোজোম সংখ্যা, ডিএনএ সংখ্যা ও ধরন নিয়ে কাজ করছি। এদের বংশবৃদ্ধি ও ধারা ধরার চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে আমার কাছে জমা হয়েছে বেশ কিছু স্ট্যাটিসটিক্স। একটা জায়গায় দাঁড়িয়েছি, কিন্তু স্থির হতে পারছি না। ট্রায়াল চলছে, অনুসিদ্ধান্ত দাঁড়িয়েছে, সমীকরণ দাঁড়াতে সময় লাগছে। যদিও সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমি নিরানব্বই ভাগ নিশ্চিত। তবু, শতভাগ সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগে থামছি না। যদিও রাশিয়ার ফাইনান্সার বলছে, ফাইভ পারসেন্ট এরর কনসিডার করবে, বাট আমি নিজেই ওয়ান পারসেন্টও কনসিডার করব না। তুমি তো আমার খুঁতখুঁতে স্বভাবটা ভালোই জানো।
– কেমন প্রাণীর কথা বললে, আমি কখনো দেখেছি?
– দেখে চেনার উপায় নেই; তবে কথা বা আচার, আচরণ ও কাজ একটু লক্ষ্য করলেই ধরা পড়ে। প্রাণীটার স্বভাব অনেকটা ভাদ্র মাসের কুকুরের মতো। কুকুরের প্রধান ত্রুটি তো জানো, স্বজাতিবিরোধ। এ কারণে মানুষ মানুষকে কুকুর বলে গালি দেয়। আমার দেখা এই প্রাণীগুলো হোমোজিনিয়াস, এরা খুব সম্ভবত গভীর সংকর প্রজাতি। তবে কীভাবে এদের উদ্ভব তা যেদিন জানবে, বিস্ময়ের অন্ত থাকবে না। শুধু তুমি না, দুনিয়াজুড়ে বেশ ঝামেলা তৈরি হবে, সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে।
– যা করছো, তোমার বন্ধু ড. অংকন জানেন?
– আরে না। সে ভয়ংকর ভিতু, জানলে আমাকে এগোতে দেবে না। তবে থিসিস রিপোর্ট প্রকাশ হলে ঝামেলা হতে পারে, তা বলে রেখেছি। তাতেই ভয় পেয়েছে, ঠোঁট কাঁপছিল, তোতলাচ্ছিল।
– আমি তো ভয় পাচ্ছি।
– মিথ্যে কথা। তুমি মজা পাচ্ছো, গবেষণার শেষ বিন্দু জানতে ঔৎসুক্য তৈরি হয়েছে। মেয়েরা এত অল্পতে, অত সহজে ভয় পায় না। আমার মেজো বোন, তুমি আর ইলোরাকে লক্ষ করলেই বোঝা যায়, মেয়ে জাতি সাহসী প্রজাতি। কেউ বেশি, কেউ অল্প বেশি, তবে কম সাহসী কেউ না।
ড. ফাহমিদা, শোনো মন দিয়ে, আমার থিসিসটা থরো চেক করবে, ভুলত্রুটি কারেকশন এবং যেখানেই খটকা লাগবে প্রশ্ন করবে।
আরেকটা কথা, শঙ্কা কিন্তু সত্যি হবে, সামনে আমার কঠিন বিপদ। পাশে থাকবে জানি, তবে পাশে থাকার সুযোগ পাবে কিনা, বলা যাচ্ছে না, আমাকে নিরাপত্তা দিতেই সরকার অ্যারেস্ট করে ফেলবে। তুমি একটা কাজ করবে, আমার আইনজীবী নিয়োগ করবে যে বিজ্ঞানটা মোটামুটি বোঝে, অন্তত থিসিসটা। যদিও এমন আইনজীবী পাওয়া কঠিন হবে, তুমি আগে তাকে আদ্যোপান্ত বোঝোবে। অবশ্য মামলা চলবে আইন ধরে, এ বিষয়ে আইনে কী আছে কে জানে।
রাত পেহাতেই আমি গাড়িতে উঠব। পৌঁছে ফোন দেব, আর থিসিসের খসড়ার আশি ভাগ ই-মেইল করব।
– তুমি একটা বিষয় ভুল বুঝে আছো, মীমাংসা দরকার। সবসময় তোমার বেবি চেয়েছি ভালোবাসার অনুভূতি থেকে, অন্য কিছু নয়। জীবনে তোমাকে পাব না জানি, কিন্তু তোমার একটা স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছি। শুরুতে তোমার এক্সট্রা ট্যালেন্টে মুগ্ধ হয়েছি সত্য, তবে একপর্যায়ে তা ম্লান হয়ে মানুষটাই মুখ্য হয়ে উঠেছো। তুমি চাষি হলেও তোমাকে চেয়েছি, মজুর, কামার, তাঁতি, রিকশাচালক হলেও তোমাকেই চেয়েছি। সাইন্টিস্ট রকিব অধরা জানি, তাই সাধারণ রকিবকে চেয়েছি। তোমার চুল, চোখ, ঠোঁট আরাধ্য কিংবা গ্রীবা, কপাল, বাহু ছুঁয়ে থাকতে চেয়েছি বছরের পর বছর। অথচ তুমি ফিরেও চাওনি। সারা দুনিয়া তোমাকে দুর্ধর্ষ ট্যালেন্ট হিসেবে চেনে, আমার ভালো লাগে। তোমার সমীকরণ, সূত্র, থিসিস, বইপত্র দেশ-বিদেশের ইউনিভার্সিটিতে সিলেবাসভুক্ত, আমার কেমন যে লাগে গুছিয়ে বলতে পারব না। প্ল্যান ছিল, তোমার কাছ থেকে তোমাকে পেয়ে চিরতরে বিদেশে চলে যাব, সে আর হলো না। তবে পাশে আছি সবসময়।
চলবে…
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-৬॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন