পর্ব-৬
গণমাধ্যম ছেড়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে ভালো লাগছে? পড়াবেই যখন পাবলিক ইউনিভার্সিটি নয় কেন?
রকিবকে থামিয়ে ড. ফাহমিদা বলেন, আমার কথা বাদ দাও, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি, সরকারি-বেসরকারি সব একই, উদ্দেশ্য ছাত্র পড়ানো। এক জীবনে কত শত ঘটনা। তবে কোন আকালের মুখে তুমি গ্রামে গেলে? জীবন থেকে পালানোর নেপথ্যে আসলে কী?
-বাহ্, তোমার রুমটা বেশ সুন্দর তো, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি প্রফেসরদের জন্য ক্যাম্পাসে এমন সুন্দর সাজানো-গোছানো স্বচ্ছ কাচের আলাদা রুম বানিয়ে রাখে জানা ছিল না। খুবই অবাক হইলাম। চৌদ্দতলায় উঠলাম, তাই না? এখান থেকে ঢাকার সিকি ভাগ দেখা যাচ্ছে। তোমার শহর, অপরূপ শহরটা আমার হলো না। কেন জানি না, তাড়িয়ে দিলো।
-গ্রামে যা করছ, তা এখানেও করা যেত। তুমি অবশ্য অন্য কারণে গেছ। সত্যি কথাটা বলবে না জানি, তবু বেহায়ার মতো জানতে ইচ্ছে করে। খুব গোপনীয় হলে বলার দরকার নেই।
-প্রথমত, যা করছি তার জন্য বিশাল জমি প্রয়োজন ছিল, গ্রামে সেটা পৈতৃকভাবে পেয়েছি। দ্বিতীয়ত, গোপনীয় কিছু নয়, তবে সেনসেটিভ। তোমাকে বলা যায় এবং বলব। কাজটার ভুল-ত্রুটি কেউ চেক করে দিতে হবে, বিজ্ঞানের মানুষ হতে হবে, সেই পরীক্ষক তুমি।
-আজও আমাকে এতটা বিশ্বাস করো?
-হুম। বিশ্বাস ব্যাপারটাই এমন, কোনো ঘটনায় বিশ্বাস না ভাঙলে জনম জনম রয়ে যায়।
-আমি তো বিশ্বাস ভঙ্গ করেছি। তোমার সঙ্গে শুয়ে আরেকজনকে বিয়ে করলাম। সেটা কন্টিনিউ না করলেও তোমাকে ভোলার চেষ্টা করেছি।
রকিব বিরক্ত হয়ে বলেন, বাদ দাও এসব কথা।
ড. ফাহমিদা আক্তার। ঢাকার নামকরা বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক। অনেক আগে রকিবের সহকর্মী ছিলেন, তবে একই অফিসে নয়। ফাহমিদা প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে কাজ করতেন, ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক ইনচার্জ ও প্রেজেন্টার ছিলেন। রকিব তখন অন্য এক টিভিতে যুগ্ম বার্তা সম্পাদক। ইউনিভার্সিটিতে ফাহমিদা ছিলেন রকিবের তিন বছরের সিনিয়র। ক্যাম্পাসে তেমন নিবিড় সম্পর্ক ছিল না, কথাবার্তাও সাধারণ ধরনের, সিনিয়র-জুনিয়র যেমন হয়। একদিন ঢাকার প্রেসক্লাবে দুজনের দেখা, এরপর যোগাযোগ বাড়তে থাকে। রাশিয়ার এক প্রজেক্ট নিয়ে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়েন রকিব, টেলিভিশনের চাকরিটা ছেড়ে দেন। অস্বস্তিতে পড়েন ফাহমিদা। রকিবের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ প্রায় বন্ধ, অস্বস্তি থেকে অন্যরকম অনুভূতি। রকিবের জন্য তার পরাণ পুড়তে থাকে। ভালোবাসার টান অনুভব।
তারও অনেক দিন পর রকিবের সঙ্গে দেখা করেন ফাহমিদা, অনুভূতির বার্তাকথা খোলামেলা বলেন। এরপর রকিব আর বেশি দিন মৌন থাকতে পারেন না, ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। প্রেম-ভালোবাসা কিছু নয়, তবে গোপনে সম্পর্কটা তুমি-তুমি পর্যায়ে ঠেকে।
বেশি করে পানি খাও আর সকালে হাত-পা নেড়ে ব্যায়াম করবে, দেখবে সুস্থবোধ করছো।
ফাহমিদা তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামের ছাত্রী। চাকরির মাঝে পড়তে পড়তে জীবনের অনেকটা পেরিয়ে গেছে। অনূঢ়া জীবনের সমাপ্তি ঘটানোর তগিদ টের পাননি। রকিবের বেবি যখন স্কুলে যায়, ফাহমিদা তখনও এমফিলের থিসিস সাজাতে ব্যস্ত। এরই মধ্যে ক্যাম্পাসের সেই ডানপিটে রকিব মনোযোগ কেড়েছে কখন, টের পেল না।
ড. ইলোরা চৌধুরী স্ত্রী ছিলেন রকিবের। নিউজিল্যান্ড থাকেন, ইউনিভার্সিটিতে পড়ান, গণিতের সহযোগী অধ্যাপক। ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছেন। কন্যা রুহিন জোয়ারদারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন শুধু। ভয়ংকর জেদি এই গণিতের শিক্ষক।
ইলোরা দেশে থাকা অবস্থায়ই রকিবকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন ফাহমিদা। তখনও রকিবদের ডিভোর্স হয়নি। রকিবের স্বভাবজাত উদাসীনতায় শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গেছে ফাহমিদার চাওয়া। ক্ষেপে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন, বছর না ঘুরতে তা ভেঙে গেছে। কারণ নপুংশকতা। এর মধ্যে রকিবেরও বিবাহবিচ্ছেদসহ বহু ঘটনা।
দীর্ঘ বিরতির পর ফাহমিদার আমন্ত্রণে রমিজের সোহাগী মহল থেকে সোজা চৌদ্দতলায়।
-তুমি কি শুধু আমার ডাকে ঢাকায় এলে?
-এটা কেমন প্রশ্ন?
ফাহমিদা রেগে বলেন, বলোনা, প্রশ্ন করো না।
-হুম। কালই আসতাম, সচিবালয়ের কাজটাও কম জরুরি ছিল না। শিক্ষাসচিব রাতে লন্ডন চলে যাবেন বলে দুপুরেই দেখা করতে হয়েছে।
-এমনি বললাম। কাল এলে রেখে দিতাম। সারা রাত গল্প করতাম। আজ থাকো।
-আমাদের বন্ধু অংকনকে মনে আছে? বিরাট গণিতবিদ। লিনিয়ার অ্যালজেব্রায় ইকোয়েশন আছে। ক্যালকুলাসের অনেক প্যারাডক্সের সমাধান দিয়েছে সে। গণিতের দুনিয়ার ছাত্র-শিক্ষক তাকে বাই নেমে চেনেন। এখন আমার প্রিন্সিপাল। বদমেজাজিটা ভিতুর ডিম, আমার অনুপস্থিতি সহ্য করতে পারে না, আজ না গেলে মাথা ফাটিয়ে ফেলবে।
-আমাকে এড়িয়ে চলার অজুহাত তৈরি রাখো সব সময়, তাই না?
-বিষয়টা সে রকম নয়, তবে জটিলতা বাড়িয়ে ফল কি? রসায়নের প্রফেসর হিসেবে সম্পর্কের রসায়নটা তো বুঝতে হবে।
-তুমি তো রসায়নের ছাত্র না, তবু রিয়েকশন এত বুঝতে যাও কেন?
-না জেনে জৈব যৌগের রিয়েকশন বিপদ ঘটাতে পারে, আগুন ধরে যেতে পারে, বিস্ফোরণও হতে পারে। আবার সব যৌগ পরস্পরের সঙ্গে বিক্রিয়া করে না, শুধু দ্রবণ হয়।
-যেমন?
-ভাইভা নিচ্ছ?
-বলোনা।
-অম্ল ও ক্ষারের রিয়েকশন কিন্তু উভয়মুখী নয়।
-মানে?
-মানে লবণ ও পানি বিক্রিয়া করে না। তারা শুধু মিশে যায়।
-লবণ কে?
-আমি।
-লবণ কি পানিতে মিশে আছে?
-আরে না। সংস্পর্শে বিলীন হয়ে যাবে।
-রাতের পর রাত একসঙ্গে শুয়েও আমাদের ফিজিক্যাল ইউনিয়ন হয়নি এ কারণে?
-না। তুমি কনসিভ করে ফেলতে পারো, তা আমি চাইনি, তাতে আমার ভয় আছে। তুমি বুঝবে না।
-না বললে জানব কেমনে?
-জানাতে চাই না।
-বলো, প্লিজ।
-এরই মধ্যে বলে ফেলেছি, দুজনের ভিন্ন রসায়নের কারণে।
-ইলোরা ম্যাডামের সঙ্গে বুঝি খুব ইতিবাচক ফল পেয়েছো?
-না। উল্টা হয়েছে। সে কিন্তু থাকেনি, চলে গেছে। তার কোনো দোষ ছিল না, অনেক চেষ্টা করেছিল সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে। অনেক কম্প্রোমাইজ করেছে, তবু একসঙ্গে থাকা হয়নি।
-তোমার সমস্যাটা কী?
-জানলে তো সমাধান হয়েই যেত। তোমার-আমার বেবি এত দিনে ঢাকা ইউনিভার্সিটি বা বুয়েটে পড়ত। অথবা ইলোরা চলে যেত না।
-বাদ দাও, ওর কথা। আমার কনসিভ করাকে ভয় পাও কেন? তাতে তোমার সমস্যা কী? বাচ্চা পেটে নিয়ে তোমাকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়া মানুষ আমি না, তা তুমি ভালো করেই জানো। তবে সমস্যা কোথায়?
-সমস্যা স্পার্ম। আমি ভালো করেই জানি এবং হলফ করে বলতে পারি, আমার শুক্রাণু অত্যন্ত দুর্বল। এ দিয়ে দুর্বল বাচ্চা তৈরি হবে। তাই সতর্ক থাকি। বিষয়টি নিয়ে আমার দীর্ঘ গবেষণা আছে, অনেক বলারও আছে, যা শুনতে অধিকাংশ মানুষ অভ্যস্ত নয়, বিরক্ত লাগবে, দর্শনটা মানবসভ্যতার বিরুদ্ধেও যায়।
-তোমার প্রোডাকশন তো হলিক্রসে পড়ছে। জেনেছি তোমার পর্যায়ে ট্যালেন্ট, গণিত অলিম্পিয়াডে চ্যাম্পিয়ন। গান জানে, বাইকও চালাতে পারে। এই বয়সে স্যুটিং ক্লাবের মেম্বারও। ফেসবুকে এই অত্যন্ত ফুটফুটে কিশোরীকে নিয়মিত ফলো করি। নাক-মুখ-ঠোঁট সব তোমার কার্বন কপি, কালার পেয়েছে মায়ের। বাবা-মায়ের অপূর্ব সৃষ্টি। এমন একটা বেবি পেলে জীবনে আর কিছু চাওয়ার থাকে না, তাকে নিয়ে দূর দেশে চলে যেতাম; বুকের ভেতর নিয়ে ঘুরতাম। শুধু এই পয়েন্টে ইলোরাকে খুব ঈর্ষা হয়।
-হুম। জীবনের সবকিছু তো আর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরেও ঘটনা ঘটছে। আমার কন্যা রুহিন দেশের ১৬-১৭ কোটি মানুষের একজন, একটি গড়পড়তা জাতির ক্ষুদ্রতম সংযোজন, এর চেয়ে বিশেষ কিছু না। এরপর যা বলব, তা শুনতে তোমরা কেউ অভ্যস্ত নও।
-তবু বলো।
-এই জাতিতে উর্বর মস্তিষ্কের মানুষ নেই বললেই চলে, দুচারটা ব্যতিক্রম। কী হয়েছে বা ভবিষ্যতে হবে ঝঁকে ঝাঁকে গড়পড়তা অনুর্বর মস্তিষ্ক দিয়ে। কৃষক-শ্রমিক-মজুরের জাতি হিসেবে পরিচয় আর কতকাল? নর-নারী একসঙ্গে ঘুমোলে তো বাচ্চা জন্মাবেই, কুকুর-কুকুরি থেকেও একই কায়দায় বাচ্চা আসে। খাদ্য ঘাটতি বাড়ানো ছাড়া এতে ফলটা কী?
-তোমার পরামর্শ কী?
-প্রক্রিয়াটা জটিল এবং তথাকথিত সমাজবিরোধী। তবে মগ-ঠগ-বর্গী-ওলন্দাজদের সমন্বিত এই সংকর জাতির বিরাজমান প্রথার অবসান অত্যন্ত জরুরি।
-আমাদের উঠতে হবে, ক্যাম্পাস ছুটি হয়ে গেছে। আজ থাকবে, বাসায় চলো, আলাদা ঘরে শুবো, এক বিছানায় ডাকব না-কথা দিলাম। বাসায় গিয়ে রাতভর হবে গল্পের বাকি অংশ।
-আজ থেকে গেলে অংকনের মার খেতে হবে, তবু চলো, যা আছে কপালে।
ফাহমিদা ব্যাগ গুছিয়ে রকিবকে নিয়ে লিফটে ওঠেন। এরপর গাড়িতে নয়, দুজনে ওঠেন রিকশায়। রকিব নিবিড়ভাবে দেখছেন ফাহমিদাকে। শেষ বিকেলের নরম রোদে তার গাল চিকচিক করছে। অনেক বছর পর খুব কাছে থেকে সেই রূপবতীর চিকচিক দেখছেন। মানুষটি আরও সুন্দর হয়েছে, পরিপূর্ণতা এসেছে। নাকফুলটাও ঝিলিক দিচ্ছে। রিকশার ঝাঁকিতে কানের দুল দুলছে, শরীর দুলছে। ফাহমিদার সংক্ষিপ্ত বিবর্তনে ভালোবোধ করছেন রকিব।
ফাহমিদার চোখে রকিব একটুও বদলায়নি। আলাভোলা চোয়াল ভাঙা, চোখে হাই পাওয়ার চশমা। চুল এলোমেলো, ইন করা কুঁচকানো শার্ট উঠে পড়েছে অধিকাংশ। ধুলোমাখা জুতো। মাঝে মাঝে ফাহমিদার গাল ও চোখের দিকে তাকান, টলমলে বুকের দিকে অনিচ্ছায়ও দৃষ্টি যায়, রিকশার ঝাঁকিতে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছড়িয়ে অবৈধভাবে কাঁপছে অনবরত। রকিবকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে ফাহমিদার। এই ইচ্ছেটা ফাহমিদার প্রায়ই করে, বিশেষ করে নগ্ন শরীরও যখন রকিবকে জাগিয়ে তোলেন না। নির্বিকার মানুষটাকে জীবনে বহুবার জাপটে ধরে চুমু খেয়ে ফাহমিদা বলেছেন, একটু তাকাও। রকিবের জবাব, হঠাৎ হলো কী তোমার? এমন করছো কেন? বেশি করে পানি খাও আর সকালে হাত-পা নেড়ে ব্যায়াম করবে, দেখবে সুস্থবোধ করছো।
চারদিকে কুরুচির মহামারি। ভারতেরও একই হাল, একশ কোটি মানুষের দেশে একশ বছরে উন্নত জাতের কোনো মানুষের ফলন হয়নি।
ফাহমিদা ভাবে, রকিবের কাছে যৌনতা হয়তো একধরনের ব্যাধি।
রকিবকে নিয়ে ইস্কাটনের ফ্ল্যাটে ঢোকেন ফাহমিদা। রাঁধতে গিয়ে গল্পে বিঘ্ন ঠেকাতে রাতের খাবার আনিয়ে নেন হোম সার্ভিস থেকে। শাড়ি খুলে সাদা ব্লাউজ আর লাল পেটিকোটে রকিবের সামনেই এ-ঘর ও-ঘর করেন ফাহমিদা। রকিব টেলিভিশনের খবরে ব্যস্ত, খাবারের জন্য অপেক্ষা। ডিনার শেষে গল্পে বসতে তাদের রাত সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। রকিব বলেন, এবার ছোটাছুটি থামিয়ে বসো, কথা বলি।
-তুমি কি ড্রিংকস কিছু নেবে?
-কী আছে?
-তোমারটাই আছে, ভদকা।
-তুমিও কি এটা খাও?
-আরে না, তোমার জন্য আনিয়েছি গতকাল।
-তার মানে তুমি জানতে আজ আমি রয়ে যাব?
-তোমাকে যেতে দিলে তো।
-তোমার হাইট কি বেড়েছে? বেশ লম্বা লাগছে।
-না। পাঁচ-পাঁচই আছি। ব্যায়াম করে পেট কমিয়েছি, তাই লম্বা লাগছে। তবে অকারণে বুক বেড়ে গেছে। কেমন ঢাউস হয়ে গেছে, দেখছো না?
-কই, তেমন বাড়েনি তো?
-তুমি কি কখনো বুকের দিকে তাকিয়েছ যে বুঝবে?
-না তাকালে আগে-পরে তুলনা করলাম কেমনে? আচ্ছা বাদ দাও, মূল কথায় ফিরি।
-আগে বলো তোমার পরীক্ষাটা নিষিদ্ধ কেন?
-পরীক্ষার বিষয়টা আগে শোনো, এরপর তুমিই বলবে নিষিদ্ধ কি না।
ফাহমিদা বুকের দেরাজ মেলে বসেছেন রকিবের সামনের সোফায়। উন্মুক্ত তলপেট আর এক-তৃতীয়াংশ খোলা বুকের সামনে বসে তার কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে, আড়ষ্টে গল্পের খেই হারিয়ে ফেলছেন রকিব। তবু ফাহমিদাকে থিসিসে কাজে লাগাতে হলে আজই বিস্তারিত জানাতে হচ্ছে।
রকিব বলেন, মানব জাতির আচরণ ক্রমনিম্নমুখী, বিষয়টা কি তোমার নজরে পড়েছে?
-প্রশ্ন না করে গল্প বলতে থাকো।
-দেখো-ফ্রয়েড, লাকাঁ বা দেরিদাকে সাধারণত আমি এড়িয়ে চলি, ওদের থিউরি নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। কারণ একটাই-আমি তাদের বুঝি না। তবে সিগমুন্ড ফ্রয়েড সাহেবের দর্শনের এক জায়গায় একটু থেমেছিলাম। তিনি বলেছেন, সজ্ঞানতা আমাদের আমির কাছে পৌঁছে দেয়। যে আমির ভেতরে বাস করে ইচ্ছের দৈত্যরা, যাদের আমরা ভালোভাবে চিনি না, অথচ আমরা ভাবি-তাদের আমরা চিনি। তারা আমাদের কাছে পৃথিবী ভুলভাবে উত্থাপন করে। আমরা সুন্দর পোশাকেই আমাকে আমি মনে করি। পোশাকটা পছন্দ না হলে, আমাকে মনে হয় আমি নই। ফরসা না হলে নিজেকে ঠিক মানুষ মনে হয় না। নিজেকে মনে হয় হীনতর কোনো প্রাণী।
জাক লাকাঁ একে বলেছেন-ভুল জানা। এ থেকে পরিত্রাণের পথ নিয়ে ভেবেছিলেন লাকাঁ সাহেব, করেছেন মন্তব্য। তিনি বলেছেন, যে ইমেজগুলো আমাদের পরিচালনা করছে, উচিত হবে তা নিয়ে চিন্তা করা।
-সব পড়েটড়ে বুঝি না বললে তো হবে না। না বুঝলে ফ্রয়েডের তত্ত্বে থেমেছ কেন? তোমার থিউরি কি সেখানে ধাক্কা খেয়েছে?
-আমার থিসিস না, ধাক্কা খেয়েছে ম্যান্ডেলের তত্ত্ব।
-প্লিজ রকিব, আর তালগোল পাকিও না, অনেক হয়েছে। ফ্রয়েড, আইনস্টাইন, ম্যান্ডেল, লাকাঁ-এরা সব আলাদা জগতের মানুষ; এদের ল্যাবে ব্যবচ্ছেদ করো না। একজনের সঙ্গে আরেকজনকে সম্পর্কিত করার ক্ষীণ সম্ভাবনা থাকলেও করতে যেও না।
-কেন? সবাইকে তো বিজ্ঞান মানতে হবে, ভাবনা আলাদা হতে পারে, কিন্তু লজিক তো এক রেখায় থাকতে হবে।
-তুমি যেকোনো একটা বেজ করো, আমার তো মনে হয় ম্যান্ডেলে থাকাই ভালো-মোস্ট সাইন্টিফিক। লাকাঁর থিসিস অনেকটা সার্ভে থেকে পাওয়া। মানসিক রোগী ডিল করতে গিয়ে উনি বিশাল একটা ডেটাবেস পেয়েছিলেন, অনেকটা তার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়েছে বিশ^বিখ্যাত দর্শন। লাকাঁ সাহেবের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি, তিনি ছিলেন বিখ্যাত মনোসমীক্ষক এবং মনোরোগ চিকিৎসক। তবে ফ্রয়েড উত্তরকালে তিনিই সবচেয়ে বিতর্কিত মনোসমীক্ষক। প্লিজ, রাগ করো না। তোমার প্রিয় মানুষটারে নিয়ে উল্টাপাল্টা বলছি, মাফ করে দিও। আচ্ছা ফ্রয়েড-লাকাঁ-দেরিদা সব বাদ, তুমি কি করছো বলো।
তবে ফ্রয়েড যে ইচ্ছের দৈত্যের কথা বলেছেন, যাদের আমরা ভালোভাবে চিনি না, অথচ আমরা ভাবি-তাদের আমরা চিনি। তারা আমাদের কাছে পৃথিবী ভুলভাবে উত্থাপন করে। এর প্রমাণ আমি হাতেনাতে পেয়েছি। আমার সেই দৈত্যটা হলো তুমি।
-ফ্রয়েডের দর্শন নিয়ে উল্টাপাল্টা উদাহরণ না দেয়াই ভালো।
-তুমি কিন্তু রাগ করলে। স্যরি সোনা, গুরুজিকে নিয়ে আর দুষ্টামি নয়। নিজের থিসিস নিয়ে বলো। আমার অফিস থেকে বের হবার আগমুহূর্তে সংকর জাতির সংকট নিয়ে কি যেন বলছিলে?
-হুম। এই অঞ্চলের মানুষ অত্যন্ত মেধাহীন। এর মধ্যে রূচিবোধ, মানসিকতা, ব্যক্তিত্ব, ভাষার প্রয়োগবোধ হতাশাজনক। দিন দিন ক্রমনিম্নমুখী। এদের মধ্যে বিশেষ একটি শ্রেণি তৈরি হয়েছে যাদের আচরণ জানোয়ারের মতো। অবিকল মানুষ, মুখে ভাষা আছে, কিন্তু অন্য সব আচরণ ও কর্মসূচি কুকুরের মতো। দেখো, এটা কিন্তু কথার কথা না, আমি বিজ্ঞান, জরিপ ও ডেটার ভিত্তিতে বলছি, আমার কাছে স্ট্যাটিসটিকস আছে। সার্ভের শুরুতে ওই শ্রেণির সদস্য সংখ্যা কম এবং দেশের একটি এলাকার মানুষের মধ্যে সীমিত ছিল। জরিপের স্যাম্পল যত বাড়ছে, অঞ্চল অনেকটা একই থাকছে, তবে পরীক্ষাটা ততই জমে উঠছে। পপুলেশন সাইজ সম্পর্কে এখনো ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছি না। মনে হচ্ছে অনেক বড় হবে। থিসিসের কমেন্ট যাই হোক, পরীক্ষার অবজারভেশন ডালপালা মেলছে, হয়তো সারা দুনিয়া কাভার করবে।
-তোমার মূল থিসিস গোপনীয় বুঝতে পারছি, কারণ মূল কথায় আসতেই পারছো না। দু-একটা অবজারভেশন বলো।
-গাণিতিক হারে ক্রমবর্ধমান মেধাহীন এই জাতি আর বেশি দূর এগোতে পারবে না। উন্নত মস্তিষ্কের মানুষ লাগবে। ট্যালেন্ট বাবা-মা লাগবে। ম্যান্ডেলের সূত্র অনুযায়ী, মেধায় এই জাতি দিনে দিনে পেছনের দিকে যাচ্ছে। ফিরে দেখো, বিগত একশ বছরে এই অঞ্চলে একটি মেধাবী মানুষও জন্মায়নি। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, খেলা, সাহিত্য, রাজনীতি, দর্শন-কোথাও কোনো মেধাবী মানুষ নেই। গণ্ডায় গণ্ডায় জন্মেছে কূপমণ্ডূক, নির্বোধ, গণ্ডমূর্খ, মিথ্যাবাদী, প্রতারক, ধান্ধাবাজ, ঠগ। তুমি সারা দেশে একজন মেধাবী শিক্ষক পাবে না। কোটি কোটি মানুষের মাঝে একটা বিজ্ঞানী দূরের কথা, বিজ্ঞান বোঝে বা বিশ্বাস করে একজনও খুঁজে পাবে না। দর্শন বোঝে এমন এক পিস পাবে না। এক কথায়, এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে অন্তত একজন মিলবে, যার আন্তর্জাতিক মান আছে। চারদিকে কুরুচির মহামারি। ভারতেরও একই হাল, একশ কোটি মানুষের দেশে একশ বছরে উন্নত জাতের কোনো মানুষের ফলন হয়নি।
চলবে…
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-৫॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন