পর্ব-৪
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। স্কুল ছুটি। প্রাণিবিদ্যা ল্যাবে ঢোকেন অংকন। তিন দিন ধরে এই ল্যাবে রকিব। অংকন বিরক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, ল্যাবের মধ্যে টানা কী কাজ তোর?
-তেমন কিছু না, একট ট্রায়াল।
-কিসের ট্রায়াল? আজ তোকে বলতেই হবে, তোর সমস্যাটা কী? জীবন থেকে পালিয়ে গ্রামের ভেতর অন্ধকার ল্যাবে কী খুঁজিস? স্কুলজুড়ে বিশাল বিশাল ল্যাব কেন? শতকোটি টাকার কেন এই বিনিয়োগ? কার অ্যাসাইনমেন্ট?
-এবার থাম। আজ আংশিক বলব। পরে নিজেই সব বুঝবি।
-বুঝতে পারব না, তুই মুখে বল।
ল্যাবে ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও রকিবের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বলেন, তোর এত প্রশ্নে হাবুডুবু লাগছে। শোন, একটি অত্যন্ত নিষিদ্ধ পরীক্ষা চালানোর জন্য এই বিশাল বিনিয়োগ। পরীক্ষার জন্য ল্যাব প্রয়োজন, তবে পরীক্ষা ব্যর্থ হলেও বিনিয়োগ বিফলে যাবে না, কারণ দেশ এমন একটি স্কুল পেল, শিশুরা পেল বিজ্ঞান পড়ার অবারিত সুযোগ। হিগস-বোসন কনা ও ফিল্ড বিষয়ে গবেষণায়প্রাপ্ত হাইপোথিসিসের বিনিময়ে রাশিয়ার পরমাণু শক্তি কমিশন যে টাকা দিয়েছে তা দিয়ে এই স্কুল বানানো ছাড়া হাতে আর অপশন ছিল না। এত টাকা দিয়ে কী করব? শেয়ার বাজারে যেতে পারতাম বা সোডিয়াম স্টিয়ারেট মানে সাবান কারখানা বসাতে পারতাম, সেসব ভালো হতো? আচ্ছা সাবানের সংকেত মনে আছে তো? সি সেভেনটিন এইচ থার্টিফাইভ সিওওএনএ, ঠিক বলেছি?
-দুষ্টামি করিস না প্লিজ। স্কুল বসানো নিয়ে আমার প্রশ্ন তেমন নেই। কিন্তু পদার্থ ল্যাব বাদ দিয়ে রসায়ন ও জীববিদ্যা ল্যাবে তোর এত কিসের কাজ? এত লুকোছাপা কেন? সোজা করে বল, পরীক্ষাটা নিষিদ্ধ কেন?
-কারণ, এটি মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে যাবে। পরীক্ষাটি সফল হলে মানুষ কঠিন এক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াবে। অস্তিত্বসংকটে পড়বে হাজার বছর আঁকড়ে রাখা বিশ্বাস। বাড়বে অবিশ্বাস, ডালপালা মেলবে সংঘাত। মুখ থুবড়ে পড়বে প্রচলিত রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা।
-ভয়ংকর এই খেলা না খেললে কী হয়?
-দেখ, দুনিয়ার কিছুই কিন্তু অবধারিত নয়। তবে কোনো প্রশ্ন মাথায় এলে উত্তরটাও যখন নিউরনে বিক্ষিপ্ত ছোটাছুটি করতে থাকে, তখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে সিদ্ধান্ত বা অন্তত অনুসিদ্ধান্তে না পৌঁছালে অস্থিরতা থামে না।
-পরীক্ষার সাফল্যের ফল বা অনুসিদ্ধান্ত প্রকাশ হলে কী হবে?
-তুমুল ঝামেলা হবে। প্রথম ধাক্কায় একটা শ্রেণি আমার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামবে। তারা আমার ফাঁসি চাইবে। জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদের সামনে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যাবে। আমার মাথার দরদাম উঠবে। মোল্লারা আমাকে পেলে প্রথমে আমের মোরব্বা বানাবে, এরপর কাঁটা চামচ দিয়ে খাবে, আয়েশ করে খাবে। থিউরি নিষিদ্ধের দাবিতে দেশজুড়ে হরতাল ডাকবে ডানপন্থিরা। বামপন্থিরা ভুগবে সিদ্ধান্তহীনতায়। বুদ্ধিজীবীরা পড়বে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায়। কারণ, প্রায় শতভাগ বুদ্ধিজীবী আর্টস ফ্যাকাল্টির, তারা বিজ্ঞান অত বুঝেটুঝে না। মোটাদাগে জনগণ ও সরকার কী বলে বা কী চায়, তারা তা তা বুঝতে বুঝতে সময় পার করতে থাকবে। এসবের মধ্যে গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে আমি গ্রেপ্তার।
-গ্রেপ্তার হয়ে গেলে আর এসব থিউরি দিয়ে কী হবে? তোর টেস্টের রেজাল্ট কি ধর্মের বিরুদ্ধে যাবে মনে করছিস?
-আমার মনে করায় কিছু যাবে আসবে না সোনা, তারা কিছু না বুঝেই কিছু একটা বুঝে নেবে। আমার এই টেস্টে ধর্মের কোনো ইস্যুই নেই, তবে প্রচলিত বিশ্বাস আর ব্যবস্থায় প্রচণ্ড ধাক্কা আছে। সেই ধাক্কা সামাল দেয়া জটিল এবং কঠিন। একটু লক্ষ কর, এ দেশে ডারউইনবাদের সঙ্গে মোল্লারা ধর্ম জুড়ে দিয়েছে, আমি নিজে ওয়াজ মাহফিলে চার্লস ডারউইনকে অকথ্য বকাবকি করতে শুনেছি, ইউটিউবে ওয়াজ সার্চ দে, এখনই পাবি।
-তোর টেস্টের বেইজ কী?
-ম্যান্ডেলিজম। মানে গ্রেগর জোহান ম্যান্ডেলের মতবাদ। চার্লস ডারউইনের মতবাদের সংযোগও আছে। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে মনোবিজ্ঞান ও নিউরাল অ্যানাটমির আশ্রয় নিতে হবে হয়তো।
-এই চরম ঝুঁকিপূর্ণ পরীক্ষালব্ধ ইকোয়েশনের অর্জনটা কী? তত্ত্ব যে দাঁড়াবে, সে ব্যাপারে তুই নিশ্চিত?
-তত্ত্বটা আমার নিউরনে দাঁড়িয়ে আছে, তবে স্থির নয়। মানে ইকোয়েশনের বাম পাশটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে তবে ডানপক্ষ একদম গোছানো। জটিলতা একমুখী করে পরীক্ষাটা শেষ করতে দে। তবে ট্রায়ালে দীর্ঘ সময় লাগবে না। কারণ, স্কুলের প্রায় অর্ধেক ছাত্র মানে আড়াইশজনই টানা এই টেস্টে অংশ নিচ্ছে। জাস্ট ঐকিক নিয়মের পুকুর খননের অঙ্ক। কম লোকের বেশিদিন আর বেশি লোকের কম দিন। কয়েকশ ছাত্র এরই মধ্যে ডারউইনবাদ ও ম্যান্ডেলতত্ত্বের পণ্ডিত হয়ে গেছে। আমার মতে, ম্যান্ডেলিজমের চেয়ে ইন্টারেস্টিং মতবাদ দুনিয়ায় আর কিছু নেই। গাধা ও ঘোড়া মিলিয়ে দিলি, পেয়ে গেলি নয়া প্রাণী খচ্চর। তেমনি বাঘ আর সিংহ মিলিয়ে পাবি আরেক নয়া প্রাণী। তুই হতে পারিস নতুন নতুন প্রাণীর সৃষ্টিকর্তা। এর মধ্যে ডারউইনের সূত্র ধরে এগোনো গেলে জমে যায় জম্পেশ খেলা। বিবর্তনবাদের অন্য প্যারামিটার ঠিক রেখে শুধু দীর্ঘ সময়টাকে ধরে কনডেন্সড করতে পারলে চোখের সামনেই পরিবর্তনের আনন্দটা মিলত। তাতে সমস্যাও আছে অদ্ভুত কিছু ঘটে যেতে পারে, তখন ফিরতে হবে আগের জায়গায়, মাঝে সময় নষ্ট। তাই সেদিকে যাচ্ছি না আপাতত।
সচিবালয়ের কাজ শেষে সোজা মিরপুর সাড়ে এগারো নম্বরে চলে আসবি। এই নে কার্ড, বাসার নম্বর দেয়া আছে।
-পরীক্ষায় সমস্যা কী? ঝুঁকি কোথায়? পরীক্ষা নিষিদ্ধ কেন?
-সব তো বলেই দিলাম। তবু কী, কোথায়, কেন-এত প্রশ্ন কেন? অঙ্কের মাস্টার সাহেব, বুদ্ধি করে উত্তর খুঁজে নেন। মুখে বলা যাবে না, দেয়ালেরও কান আছে। দীর্ঘ পরীক্ষা, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সবার সামনে সবাইকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে পারে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ল্যাবে বসে থাকতে পারেন। কিন্তু ইনটেনশনটা শুধু মুখে বলা যাবে না। তত্ত্ব গোপনে লিখিত আকারে রাশিয়ান বিজ্ঞান একাডেমি-আরএএস এ জমা দিলেই আমার কাজ শেষ। তারা দুবছর আগে আমার প্রজেক্ট প্রোপোজাল গ্রহণ করেছিল। সেই থেকে বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। এই পরীক্ষার রেজাল্টে শুধু সাইন্টিস্ট হিসেবে আমার নাম যাবে, স্বত্ব তাদের। অবশ্য এই তথ্যটাও গোপনীয়।
-তোর গোপনীয়তা নিয়ে আমার কোনো ঔৎসুক্য নেই, কোনো বিপদ না হলেই হলো।
-বিপদ তো আছেই, পায়ে পায়ে মহাবিপদ। সংকটটা একান্ত আমার। অন্য কারও বিপদ নেই। গ্রেপ্তার হওয়াই আপাতত বড় সমস্যা। অবশ্য এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন নেই, মামলার ধারা নেই। শুধু সামাজিক অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির অভিযোগ এনে মামলা হতে পারে। রিমান্ড টাইপের ঘটনায়ও সমস্যা আছে। কারণ, রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ কী জিজ্ঞেস করবে, সেই প্রশ্ন কি তারা জানে? না জানে প্রশ্ন, না বুঝবে জবাব। বিপত্তি ঘটবে সেখানে, উল্টাপাল্টা মারবে। প্রথম ধাক্কায় কানপট্টি ফাটিয়ে ফেলবে, এরপর আর কানে শুনবো না-পুরা সাপের জীবন। আর ভিন্ন মতাদর্শের পিটানেওয়ালা পুলিশ বাগে পেলে তো শরীরের চামড়া আলগা করে ফেলবে, ভেঙে দিবে পাঁজর; বাকি জীবন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারব বলে মনে হয় না। বিরাট শঙ্কায় আছি।
-আগাম এসব ভাবনার দরকার কী?
-ভাবছি না, ঘটনা সত্যি হবে, তোকে রোডম্যাপটা জানিয়ে রাখছি।
-জানা রইল, এবার অন্ধকার কক্ষে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ লাগা। গেলাম।
-যাওয়ার আগে আরেকটুশুনে যা। পঞ্চাশের মন্বন্তর বিষয়ে কি কোনো ধারণা আছে তোর?
-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুর্ভিক্ষ?
-হুম। বাহ, ভালোই তো জানিস। ভয়াবহতা কেমন ছিল বলতে পারবি?
-অত জানি না, মোটা দাগে যতটা দরকার ততটুকুই।
-তাতেই চলবে।
-এসব ঘটনা তো কমবেশি সবই জানা। নতুন কথা কী?
-নতুন কথা হলো সেই পঞ্চাশের মন্বন্তরের রেশ আজও বয়ে বেড়াচ্ছে এদেশ।
-মানে কী? প্র্যাকটিক্যালি নাকি থিউরিটিক্যালি?
-শতভাগ প্র্যাকটিক্যালি। জোর দিয়ে বলছি-হাতেনাতে বাস্তবে। খুবই ভয়ংকর এবং কুৎসিতভাবে।
-প্রায় একশ বছর আগের ইতিহাস বায়োলজি ল্যাবে প্রমাণ করতে হবে?
-হুম। বিজ্ঞান ধারণা আর শুধু ডেটায় চলে না, প্রমাণ ও ডকুমেন্ট লাগে। ইকুয়েশনে ডানপক্ষ সমান বামপক্ষ মিলিয়ে দিতে হয়। তাই করছি। একই ঘটনা দুনিয়ায় নানা জায়গায় নানা সময় ঘটেছে। তবে সার্ভেটা হচ্ছে এ দেশের একটি বিশেষ এলাকার পপুলেশন ধরে।
-ফল মিললে ভালো, না মিললে আরও ভালো। অপেক্ষায় রইলাম।
তিন
জাতীয় প্রেসক্লাব প্রান্তে সচিবালয়ের ৩ নম্বর গেটে রকিবকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেন রমিজউদ্দিন খোনকার। প্রায় সাড়ে চার বছর পর দেখা। রমিজ রুদ্ধশ^াসে বলতে থাকেন, দোস্ত রে, কোথায় হারিয়ে গেলি? কত খুঁজলাম, কেউ তোর মোবাইল নম্বরটাও দিতে পারে নাই।
-গ্রামে চলে গেছি।
-খুব ভালো করছিস। এই ঢাকা বদের শহর। অসৎদের চিড়িয়াখানা।
-সমস্যাকী তোর, এত ক্ষ্যাপা ক্যান?
-আর কইস না, চোর-বাটপারের ঠাপাঠাপিতে কোনো কাজ করা যায় না। সচিবালয়ের বারান্দায় বারান্দায় জীবন গেল।
-তুই তো সম্পাদক হয়ে গেলি, ট্রিট বাকি রয়ে গেছে কিন্তু।
-কত খাবি তুই, পুরা বাসা খালি, আইজ রাইত গলা ভরে খাওয়ামু চল।
-তোর শয়তানি দেখি আরও বাড়ছে।
-উপায় আছে? ফকিন্নি শহরে ভালো মানুষ সেজে লাভ আছে? টাকা ছাড়া কোনো কাম হয় না। কইলজা ভরে টাকা দিলেও হয় না, আরও চায়, শেষ পর্যন্ত কাপড় ধরে টানাটানি। এদের সঙ্গে খেলতে খেলতে সব শেষ।
-পত্রিকার দোকান খুলে কি এখন সমানে সমান?
-কী আর করা, ইজ্জতটা তো অন্তত সেভ করতে হবে।
-সচিবালয়ে কী কাজ?
-আরে বলিস না, ডিএফপির লিস্ট নিয়া ঝামেলায় আছি, আমার পত্রিকার সিরিয়ালটা কয়েক ধাপ আগাইতে চাই। বুঝিস তো, সিরিয়াল যত সামনে বিজ্ঞাপন তত বেশি, রেটও বেশি। তদবিরে কাজ হইতাছে না। কথায় আছে না, অভাগা যেদিকে যায়, বঙ্গোপোসাগরও শুকায়ে যায়। সচিবালয়ে তোর কাজ কী?
-স্কুলের কাজে এলাম।
-মাস্টারি শুরু করলি নাকি?
-হুম। একটা স্কুল বানিয়েছি। শিক্ষাসচিব ডাকছেন।
-কছ কী? ইশকুল খুইলাছে রে মাওলা ইশকুল খুইলাছে। কত বড় স্কুল? ছাত্র-ছাত্রী কত? মাইয়াপান কয়টা? গেরামে ডাঙ্গর ডাঙ্গর মাইয়ারা ইশকুলে পড়ে, তুমি মামু মৌজে আছো। পোলাপান বেতন দেয় ঠিকমতো? নাকি বার্ষিক পরীক্ষার আগের দিন বাপ-মা মওকুফের দরখাস্ত নিয়া হাজির? গেরামের পোলাপান কিন্তু বিচ্ছু। শক্ত বেত রাখবি, হাটের দিন ভালো বেত পাওয়া যায়, পিটায়ে পাছা লাল করে দিবি, এরপর দেখবি ইংরেজি ওয়ানের মতো সিধা।
-কী যে আবোলতাবোল বকছিস। মেয়েটেয়ে নাই, বয়েজ স্কুল। ধানমন্ডি বয়েজের মতো সব ছেলে। এটা ল্যাবরেটরি স্কুল, এলিফ্যান্ট রোডের সায়েন্স ল্যাবরেটরির মতো পুরা স্কুল একটি বড় ল্যাবরেটরি। ফিজিক্স, কেমেস্ট্রি ও বায়োলজি ল্যাব। এমন সব ইকুইপমেন্ট ও ডিভাইস আছে যা বুয়েট বা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়েও নাই।
-বলিসকী? ফাটাফাটি অবস্থা দেখি।
-এই তো সেদিন ডয়েচে ভেলে স্কুলটা নিয়ে সুন্দর একটা প্রতিবেদন করেছে।
-তোর স্কুলের নাম কি ব্রহ্মপুত্র বিজ্ঞান স্কুল বা এরকম কিছু? আমার পত্রিকায় শিক্ষা পাতায় এমন কী একটা দেখলাম।
-ব্রহ্মপুত্র না গাধা, ব্রহ্মপুর ল্যাবরেটরি স্কুল।
-ইয়েস। শিক্ষা পাতার বদমাশটা মনে হয় ডয়েচে ভেলে থেকে নিয়া মেরে দিছে।
-নিজের কর্মীকে বকা দিচ্ছিস কেন?
-আরে বলিস না, নটির পোলা ফাঁকিবাজ। চোরচোট্টা নিয়া জীবন তেজপাতা, এদিক-সেদিক থেকে মাল নিয়া পাতা ভরায়, সব কপি-পেস্ট, একটা লাইন লেখে না। আচ্ছা বাদ দে। সচিবালয়ের কাজ শেষে সোজা মিরপুর সাড়ে এগারো নম্বরে চলে আসবি। এই নে কার্ড, বাসার নম্বর দেয়া আছে।
বিদায় নেন রকিব।
সে এমন জাল বিছিয়ে রেখেছিল, আমি যেন সর্বোচ্চ ছয় মাস টিকতে পারি, এর মধ্যে সে ভারতীয় দূতাবাসসহ যা যা দরকার আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে।
কয়েক বছরে বিত্তবৈভবে বিশাল অবস্থা রমিজের। তার গাড়ির দাম সাড়ে তিন কোটি টাকা। মিরপুরে সাততলা বাড়ি। পাসপোর্টে আমেরিকা, কানাডা, লন্ডনসহ অন্তত দেড় ডজন দেশের ভিসা লেপ্টানো। রাষ্ট্রীয় সব অনুষ্ঠানে দাওয়াত কার্ড পান। দুই ছেলে এক মেয়ে, ঢাকার নামকরা স্কুলে পড়ে। অবশ্য একটা ছেলে অটিস্টিক। সব মিলিয়ে রমিজের ঢাকা মিশন সফল। জীবনযুদ্ধে বিজয়ী সৈনিক।
সচিবালয়ের লিচুতলায় রকিবের তৎকালীন সহকর্মী, এখন ডাকসাইটে রিপোর্টার শংকর ত্রিবেদি বলছিলেন রমিজের উত্থানের গল্প। রকিব শুনতে না চাইলেও তিনি ভেতরকার অনেক কথাই বলেন। বেরিয়ে আসে ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর কিছু অপরাধের বর্ণনা। শংকর ওইসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং রমিজের নিপীড়নের শিকার। শুরুতেই বলেন, রমিজ মানুষের জন্ম কি না, এ বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে ভাই। স্বভাব, আচরণ সব কুত্তার মতো। লজ্জা-শরম-পাপবোধ কিছুই নাই।
রকিব আড়ষ্টবোধ করে বলেন, মানুষকে আর বেশি দিন কুকুর বলে গালি দেয়া যাবে না। প্রাণীকুলে কুকুরের স্থান কিন্তু খুব বেশি নিচের দিকে নয়। কুকুরের বিবেচনা, দায়িত্বজ্ঞান, প্রভুত্ববোধ ও নিষ্ঠা অনেক ক্ষেত্রে মানুষের চেয়ে অনেক উঁচু স্তরের।
-ভাই, র্যাবের ট্রেনিং দেয়া কুকুরের কথা বলে লাভ নাই। আমি বাজাইরা পাগলা কুত্তার কথা বলতেছি। আপনি মনে হয় ভাদ্র মাসের পাগলা কুত্তা দেখেন নাই। আর সব কুত্তাই কুত্তা। স্বভাব কাছাকাছি, উনিশ-বিশ কিন্তু উনিশ একানব্বই না। রমিজ্জারে সুযোগমতো পাইলে গুলি করতে এক সেকেন্ডও দেরি করব না। শুধু আমি না, এই মাইন্ডে ডজনখানেক লোক আছে।
-সমস্যাটা কী? এত ক্ষিপ্ত ক্যানো রে ভাই?
-তার স্বভাব হলো, মই বেয়ে ওপরে উঠে সেই মই লাথি মেরে ফেলে দেয়া। সে একসময় রাজাকারদের এজেন্ট ছিল, তাদের সুবিধাও নিয়েছে অঢেল, সবাই তাকে সেই হিসেবে ট্রিট করত। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যে সে রং বদলে ফেলে। মিশে যেতে শুরু করে সরকার দলীয়দের সঙ্গে। মিশতে মিশতে পুরা বদলে গেল, এখন সে অতিরিক্ত মুক্তিযোদ্ধা। তবু গায়ের রাজাকারি গন্ধ দূর করতে পারে নাই, পেছনে সবাই রাজাকার বলেই ডাকে। এই গন্ধ দূর করতে কৌশল খুঁজতে থাকে। সেই কুটকৌশলের অংশ হিসেবে শুধু হিন্দু বলে আমাকে পিক করে। কমিউনিটিতে নিজেকে সেক্যুলার প্রমাণের জন্য আমাকে বিশেষ প্রতিনিধি পদে নিয়োগ দেয়।
-বাহ্, ভালো তো। ভালোই তো করেছে।
-আরে ভাই, আপনি আজো সব সাদাচোখে দেখেন, ব্যাপারটা অত সাদা নয়। ব্ল্যাকবোর্ডের চেয়েও কালো। একেবারে অমাবস্যার অন্ধকার, জোনাকি পোকাও নেই সেখানে। সব পাতানো খেলা। ইন্ডিয়ান হাইকমিশনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য আমার নিয়োগপত্র ছিল তুরুপের তাশ। বছরের পর বছর আপনি তার বন্ধু ক্যান তা আপনি জানেন না, কিন্তু আমি জানি। কারণ একটাই, ছাত্রজীবন থেকে আপনার রাশিয়া কানেকশন।
-কিন্তু আমি তো সেভাবে কখনো তার কাজে লাগি নাই।
-কোন ফাঁকে সে আপনাকে কাজে লাগিয়েছে আপনি বুঝতে পারেননি। যেমন-আমাকে সে কাছে পেয়েছে আপনার কারণে। এমন অনেক সুবিধা সে কৌশলে নিয়েছে। সে এমন জাল বিছিয়ে রেখেছিল, আমি যেন সর্বোচ্চ ছয় মাস টিকতে পারি, এর মধ্যে সে ভারতীয় দূতাবাসসহ যা যা দরকার আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে।
চলবে…
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-৩॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন