পর্ব-২৪
আমি হিন্দুর ছেলে, নিজের ধর্মকর্মেও জ্ঞান সীমিত। কিন্তু ব্যারিস্টার কুতুবউদ্দিন শুধু ওকালতিই করে না, উৎপত্তি থেকে শুরু করে মানব বিবর্তন, উত্থান, সভ্যতার ক্রমবিকাশ এবং মনোজাগতিক বিষয়াদি নিয়ে বিস্তর পড়েছে এবং কাজ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞান ও ধর্মের সংশ্লেষ। মানব সম্প্রদায়কে সবার ওপরে স্থান দিয়েছে আপনাদের ধর্ম। ড. কুতুবের বর্ণনা অনুযায়ী, ধর্মেই নাকি উল্লেখ রয়েছে, মানবজাতির কল্যাণে প্রাণী ও উদ্ভিদজগৎ এমনকি চাঁদ-সূর্য পর্যন্ত সৃষ্টি করা হয়েছে। কুতুব অবশ্য ধর্মগ্রন্থের পৃষ্ঠা নম্বরসহ মনে রেখেছে। তবু, এ দেশের উগ্রবাদীরা রকিবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে, থিসিস তো তাদের পক্ষে গেছে। তাদের বিরোধটা কোথায়, কিছুই বুঝলাম না।
ব্যারিস্টার কুতুবউদ্দিন মাথা নেড়ে বলেন, তোমাদের বুঝতে ভুল আছে, ইসলাম ধর্ম মানুষকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিলেও নৃবিজ্ঞান ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছে, সেদিকে যাচ্ছি না আপাতত।
ধর্মীয় পণ্ডিতদের মতে, আল্লাহ জড় ও জীব মিলে মোট ৮০ হাজার বস্তু সৃষ্টি করেছেন। ভূভাগে ৪০ হাজার আর পানিতে ৪০ হাজার। এসব সৃষ্টির মধ্যে জিন, ফেরেশতা ও মানুষ সেরা; তবে মানুষই সৃষ্টির সেরা জীব, ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ আছে- আশরাফুল মাখলুকাত। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই আমি আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং তাদের পানিতে ও স্থলে প্রতিষ্ঠিত করেছি, তাদের উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদের অনেক সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ সুরা ইসরা : ৭০।
কোরআন ও হাদিসের বর্ণনা দ্বারা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব সাব্যস্ত হয়েছে। মহানবী ইরশাদ করেন, ‘যখন আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করেন, তখন তা দুলতে থাকে। অতঃপর তিনি পর্বতমালা সৃষ্টি করে তার ওপর তা স্থাপন করেন। ফলে পৃথিবী স্থির হয়ে যায়। ফেরেশতারা পর্বতমালা দেখে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করেন, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার সৃষ্টির মধ্যে পর্বত থেকে মজবুত কি কিছু আছে? আল্লাহ বলেন, হ্যাঁ, তা হলো লোহা। ফেরেশতারা আবার প্রশ্ন করল, আপনার সৃষ্টির মধ্যে লোহা থেকে মজবুত কি কিছু আছে? আল্লাহ বলেন, হ্যাঁ আছে, তা হলো আগুন। ফেরশতারা আবার প্রশ্ন করেন, আপনার সৃষ্টির মধ্যে আগুনের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী কি কোনো কিছু আছে? আল্লাহ বলেন, হ্যাঁ আছে, তা হলো বাতাস। ফেরেশতারা প্রশ্ন করেন, হে আমাদের রব! বাতাসের চেয়ে অধিক প্রবল কি কিছু আছে? আল্লাহ বলেন, ‘হ্যাঁ আছে, তা হলো আদম সন্তান।’ মুসনাদ আহমদ, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭৬।
মহানবী বলেন, ‘শেষ বিচার দিবসে আল্লাহর কাছে মানুষ অপেক্ষা অন্য কোনো সৃষ্টি অধিক সম্মানের হবে না।’ জিজ্ঞেস করা হয়, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর নিকটবর্তী ফেরেশতাদের ক্ষেত্রেও কি এটা প্রযোজ্য হবে? অর্থাৎ নিকটবর্তী ফেরেশতাদের চেয়েও কি মানুষের মর্যাদা বেশি? মহানবী প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘নিকটবর্তী ফেরেশতারাও একশ্রেণির মানুষের চেয়ে অধিক মর্যাদাবান হবে না।’ বায়হাকি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭৪।
এই অ্যাবসোলিউট শ্রেষ্ঠত্বের মধ্যে দূষণ ঘটেছে। রকিবের থিসিসের সূত্র ধরেই বলছি, মানুষের ঐতিহাসিক রক্তে ভিন্ন প্রাণীর সংযোগে এমন অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। মাত্র দুই-তিনটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে।
মানবের একটি সত্তা জীবের, অপরটি মনুষ্যত্ব। মানুষ দেখলে চেনা যায়- মনুষ্যত্ব আচরণে। মানুষের খোদা প্রদত্ত অন্তরের পবিত্রতা অর্জন করলে মনুষ্যত্ব অর্জিত হয়। পৃথিবী প্রকৃতির নিয়মে পরিচালিত হয়। কোথাও অনিয়ম নেই। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে মানুষ মনুষ্যত্ব হারায় এবং সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দুনিয়াজুড়ে কোথাও নিয়মের ব্যত্যয় অবশ্যই ঘটেছে, যে কারণে মনুষ্যত্ব দ্রুতগতিতে ধসে পড়ছে।
দেশে দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও মনুষ্যত্ব বাড়ছে না। জাতি-গোষ্ঠীতে, মানুষে মানুষে হিংসা-বিবাদ-বিদ্বেষ-সংঘাতে ছেয়ে আছে পৃথিবী। মানুষ লোভ সামলাতে পারছে না।
দাম্পত্য, পারিবারিক ও সামাজিক কলহে স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, পিতা-মাতা, ছাত্র-শিক্ষক একে অপরের হাতে নির্মমভাবে খুন হচ্ছে। সমাজ ও পরিবারের কেউ যেন কারও আপন নয়। এখন বনের পশু-পাখি মায়ের কোলে নিরাপদে আছে, কিন্তু মায়ের কোলে মানব শিশুর কোনো নিরাপত্তা নেই। হঠাৎ কী ঘটল যে মানব জাতির হাজার হাজার বছরের নৃ-তাত্ত্বিক শৃঙ্খলা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে? রকিব তো টু দ্যা পয়েন্ট ধরেছে। তার সার্ভে এবং থিসিস মোর দ্যান রাইট। রমিজ-জাফরের মতো কুকুরমানবে দুনিয়া ভরে গেছে।
গণমাধ্যমে প্রতিদিন সামাজিক মূল্যবোধ ও মানুষের নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়ের কাহিনি প্রচার হচ্ছে। গত কয়েক দিনের খবরের কাগজ থেকে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজমির সুলতানা গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তিনি খুলনা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে ছিলেন। তার দেহরক্ষী শাহ মহসীন মাথায় শটগান ঠেকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। দুজনের আত্মহত্যার কারণ জানা গেল না, কিন্তু ঘটনা এক সুতায় গাঁথা। পুলিশ প্রশাসন শুধু হতবাকই হলো। টেকনাফের ইউএনও এক সাংবাদিককে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করায় হাইকোর্ট তাকে মাস্তানের চেয়েও খারাপ বলে মন্তব্য করেছেন। মানিকগঞ্জে এক আনসার সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করল দুর্বৃত্তরা। নারায়ণগঞ্জের রসুলপুরে ছেলেরা দল বেঁধে বাবাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। নোয়াখালীর চাটখিল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি রোগীকে ধর্ষণ করে রনি নামের এক বখাটে। কিশোরগঞ্জে তিন সন্তানের জননীকে গলা কেটে হত্যা। গলাচিপায় তরুণীকে চাকরি দেয়ার কথা বলে ঢাকায় নিয়ে ধর্ষণ করে দুই যুবক। নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞানশিক্ষককে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর জখম করেছে সন্ত্রাসীরা। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে দুই শিশুকে বেচে দিয়েছেন পিতা।
অসহিষ্ণুতার চূড়ান্ত পরিক্রমায় দেশজুড়ে এমন নৃশংস ঘটনার ঘনঘটা। মানবসভ্যতা চরম বিপর্যয়ের মুখে। সমাজবিজ্ঞানীদের ভাষ্য, মনুষ্যত্বে পচন ধরেছে, মানবসত্তা চরম সংকটে।
আপনারা বলেন, শত শত বছর একই সঙ্গে বসবাস করা মানুষগুলো কীভাবে হিংস্র দানবে রূপান্তরিত হলো। বর্বরতার এই উৎসাহতরঙ্গ রোধিবে কে? মানুষের তো এমন আচরণ করার কথা নয়। মানুষ মানুষকে হত্যা করে চল্লিশ টুকরা করার কথা নয়। এমন আচরণ মানব চরিত্রের সঙ্গে যায় না, মস্তিষ্কের নিউরন এলাও করার কথা না। মানব মস্তিষ্কের গঠনই তেমন নয়।
এতক্ষণ যে ধর্মের কথা বললাম, এমনি এমনি বলিনি। এই ধর্ম হিংস্রতা পারমিট করে না, কোনো ধর্মই করে না। মানবের এমন অস্বাভাবিক আচরণ বিবর্তনের ধারাবাহিতায় বিগত পাঁচ হাজার বছরেও ঘটেনি। মানুষের জঘন্য আচরণ বন্য হিংস্র প্রাণীদেরও ছাড়িয়ে গেছে। রমিজ স্কুলে ঢুকে যা করেছে, তা কি কোনো মানুষের কর্ম? সে এই হিংস্রতা পুষে রেখেছে। একটি স্কুল ধ্বংস করতে জাফর উল্লাহ ধর্ষণের যে নাটক সাজিয়েছে, তা কোনো মানুষের পক্ষে করা সম্ভব?
রকিবের থিসিস অবাস্তব কিছু নয়, জটিল কোনো রকেট সায়েন্সও নয়। জেনারেল সেন্স অ্যান্ড সায়েন্স। সে মনগড়া কিছু বলেনি, বিজ্ঞান এবং পরিসংখ্যানের ডেটা ও সার্ভের মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছে। মানব সম্প্রদায়ের বাপ-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠীর উপকার করেছে। এ নিয়ে জেনারেল অ্যাসেম্বলির জুডিশিয়াল বোর্ড বসানোর কী আছে? তারা পারলে প্রমাণ করুক, থিসিস ভুল অর মোর দ্যান ফাইভ পারসেন্ট এরর আছে। কুত্তার বাচ্চাকে কুত্তার বাচ্চার মর্যাদাই দিতে হবে, মানুষের নয়।
সরি টু সে। অশালীন শব্দ বলে ফেললাম। বেয়াদবি মাফ করবেন। রকিবকে গুন্ডা-মাস্তান যাই বলি, কুকুরমানব নিধনে ওস্তাদ। ছাত্রজীবনে বুঝতাম না এখন বুঝি, সে ক্যাম্পাসে যে কয়টাকে গুলি করে মেরেছে- সব কটা কুকুরমানব ছিল। তখন ওর লোয়েস্ট অস্ত্র ছিল রাইফেল- স্যালুট রকিব।
মনোজ বলেন, সারা দুনিয়া জানে রকিব হয় জেলখানায় মারা গেছে, নয়তো পালিয়েছে। সে যে দুদিন আগেও সরকারের হেফাজতে ছিল তা দু-চারজন ছাড়া কেউ জানে না।
কেয়া জানতে চান, দুদিন আগে মানে? স্যার এখন কোথায়?
– রকিব সাবজেল থেকে পালিয়েছে? আমরা কেউ জানি না সে কোথায়। গত পরশু রাত তিনটা থেকে উধাও। তার রুমে টেবিলে চিরকুটে লিখে গেছে, রমিজ আমার মেয়ের ক্ষতি করতে পারে, আর ঘরে থাকব কীভাবে?
রকিব খবরের কাগজে সম্ভবত রমিজের বেঁচে থাকা এবং চিঠির তথ্য জেনেছে। এর পরপরই পালিয়েছে। পরিস্থিতি হঠাৎ ঘোলাটে হয়ে গেল। সরকার নতুন ঝামেলায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘুম হারাম।
– কড়া নিরাপত্তায় স্যার পালালেন কীভাবে?
– তাকে আটকে রাখায় অত কড়াকড়ি ছিল না। রকিব রাশিয়ার কমান্ডো, জেল পালাতে তার ইচ্ছাই যথেষ্ট। সে নিরাপত্তারক্ষীর অত্যাধুনিক রাইফেল নিয়ে চলে গেছে। সরকারপ্রধান এ কথা জেনে হালকা বিরক্ত হয়েছেন। দেখা যাক কী হয়।
– ফাহমিদা মেম কোথায়?
– ভালো কথা মনে করেছেন। ফাহমিদা আপা সাবজেলে রকিবের সঙ্গে এক দিন পর পর দেখা করতেন। রকিব উধাও হওয়ার পর থেকে আপার খোঁজও মিলছে না, মোবাইল বন্ধ। দুজন একসঙ্গে পালাল কিনা বোঝা যাচ্ছে না।
চলবে…
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-২৩॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন