পর্ব-২১
আপনি অত দলিলপত্র টানলেন কেন, ওসব দিয়ে আমি কী করব? স্কুলের প্রশাসনিক দিক আপনারা সামলাবেন, আমি শুধু একাডেমিক বিষয় নাড়াচাড়া করব। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রাজি হয়েছি। অত শত কোটি টাকার চেকবই আমাকে দিচ্ছেন কেন? দু’চার হাজার টাকার হিসাব করতেই ঘাম ঝরে, আপনি আনলেন গোটা স্কুলের লেনদেন, কী যে করেন। এসব বিষয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করা শুধুই সময় নষ্ট।
– মেম, আপনি সব বুঝে নেন, আমি নিজের ভাঙা চালায় ফিরব। বানরের কপালে কখনো সিঁদুর ওঠে না। আমার জীবন আপনার ধারণার চেয়ে বহুগুণ নিচে, চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই। রকিব স্যারের মর্যাদা ফেরেশতার কাছাকাছি, তার কাজের লোক দরকার ছিল, আমি সে কারণে এসেছিলাম। অংকন স্যারও একই পর্যায়ের। তারা দুজনই নারীবিমুখ। অংকন স্যার কিছু না ভেবে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন, আমি ভড়কে গিয়ে রাজি হয়ে গেলাম। তখন তাকে না বলার অনেক কারণ ছিল, কিন্তু সুযোগ ছিল না। আমি অত বড় মাপের মানুষের কাছ থেকে সম্মান কেড়ে নিইনি, বাধ্য হয়েছি। আপনারা সারা দুনিয়ায় সাড়াজাগানো আলোচিত, আপনাদের নখের যোগ্যও আমরা নই। নিজেকে সবসময় সেবাদাসী জ্ঞান করেছি, এর বেশি কিছু নয়।
মেম, আমরা গরিব ও মহামূর্খ। তবে আপনাদের বিদ্যাবুদ্ধি ও মর্যাদা বুঝি, আবার নিজে কতটা তুচ্ছ তাও জানি।
– শোনেন কেয়া, রকিব-অংকন এক্সট্রা ট্যালেন্ট, ওরা ব্যতিক্রম কিন্তু আপনি-আমি একই বৃত্তের। আমি পড়ার সুযোগ পেয়েছি, আপনি পান নাই, এর চেয়ে বেশি কিছু না। বরং আপনি কয়েক ধাপ এগিয়ে। ভোটাভুটি হলে আপনি বিপুল ভোটে জিতবেন আর আমি জামানত হারাব। দু-চারটা সার্টিফিকেট দিয়ে কী হয় বলেন। চাকরির ইন্টাভিউতে সনদপ্রথা শুধু শুধু টিকে আছে। রকিবকে দেখেন, টেনেটুনে মাস্টার্সের পর কোনো ডিগ্রি নেয়নি অথচ দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ফিজিক্স-ম্যাথে সে যেসব সমীকরণ দিয়েছে, দেখলে মাথা ঘোরে। জীববিদ্যার শুধু ম্যান্ডেলিজম স্পর্শেই জগৎ কেঁপে গেছে। শুনেছি দূরবর্তী বস্তুর স্পর্শের অনুভূতি নিয়ে কাজ করেছে, প্রকল্প নাকি ফাইনাল স্টেজে। এই প্রকল্পের বাণিজ্যিক মূল্য কত ভাবতে পারেন? দুই-তিনটা বাংলাদেশের জিডিপির সমান। গুগল-ইনটেল হা করে বসে আছে কেনার জন্য।
তাদের অর্থের পরিমাণ সরকারের দশগুণ বেশি। কেয়াকে ডেকে তুলে বলেন, প্রলয়ের মধ্যে কোত্থেকে এত ঘুম আসে। গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে দেশ।
আপনি মাথা থেকে ওসব বাদ দেন প্লিজ। ধনি-দরিদ্র স্থায়ী কোনো বিষয় নয়। সার্টিফিকেটধারীরা দুনিয়া জয় করবে তা-ও ঠিক নয়। জীবনে যার যেখানে কাজ করার সুযোগ সেখানেই বসে পড়তে হবে।
– মেম, এরই মধ্যে আমি কনসিভ করেছি। খুবই লজ্জার বিষয়।
– অভিনন্দন। এতে লজ্জা কিসের, কার কাছে লজ্জা? রকিবের থিসিসের অবজারভেশন অনুযায়ী দেশ অংকনের আদলে একটা ট্যালেন্ট পেতে যাচ্ছে। জীবন উৎপাদনের চেয়ে আনন্দের ঘটনা ভূপৃষ্ঠে আর কিছু হতে পারে না। অংকন-রকিব লাখে জন্মে না, শত বছরে কয়েক কোটিতে একটা। ওই একটার বংশধর বহন করছেন, অত্যন্ত বড় ঘটনা। ট্যালেন্টদের স্পার্ম চড়া দামে সংরক্ষণ করা উচিত- রকিবের থিসিসের এই অংশটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। অবশ্য গবেষণার জন্য রমিজের নমুনাও গুরুত্বপূর্ণ।
কেয়া শোনেন, অনেক কারণে রকিবের ওপর আমি ভয়ংকর ক্ষুব্ধ, তার সারা জীবনের সব কাজের মধ্যে থিসিসটা সেরা হয়েছে। ধৈর্য ধরে কাজটা শেষ করায় তাকে ধন্যবাদ। সাইন্টিফিক ওয়েতে মুখোশ খুলে পড়ায় কুকুরশ্রেণির গায়ে আগুন ধরে গেছে। দেশে-বিদেশে তারাই হইচই করছে। অস্বীকার করার জো নেই, সব শ্রেণি-পেশায় ওরা ঢুকে পড়েছে, ডিএনএ টেস্ট করলেই ধরা, খলিশাপুরের কুকুরের সঙ্গে মিলে যাবে। জরুরিভিত্তিতে এই এলাকার এমপি সাহেবের ডিএনএ পরীক্ষা করা দরকার। অবশ্য অচিরেই আইন পাস হবে, সব পেশায় ডিএনএ টেস্ট বাধ্যতামূলক।
মেয়েকে ঢাকায় রেখে ফিরে নজিরবিহীন নিরাপত্তার মধ্যে ব্রহ্মপুর ল্যাবরেটরি স্কুলে প্রিন্সিপাল পদে জয়েন করেন অধ্যাপক ড. ইলোরা চৌধুরী। সার্কিট হাউসে কেয়া তার সঙ্গে থাকেন।
স্কুল বন্ধ, রাজধানীসহ জেলা শহরগুলোতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা হয়েছে। মিছিল, সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা। হার্ড লাইনে সরকার। রাজশাহী, পটুয়াখালী, ভৈরব ও হবিগঞ্জে বিক্ষোভে পুলিশ গুলি ছুড়েছে। গণমাধ্যমে মৃতের সঠিক সংখ্যা আসছে না, যে যার মতো হিসাব দিচ্ছে। ওইসব জায়গায় কারফিউ চলছে। একেবারে হট কারফিউ, দেখামাত্র গুলি। সারা দেশে একযোগে কারফিউ আসছে। বাজারে খাদ্যসহ সব পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে, সবকিছুর আগে শেষ হয়েছে দেশলাই ও মোমবাতি; কেরোসিন শেষ হওয়ার পথে। মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেনাকাটায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
মাঠ ছাড়েনি আন্দোলনকারীরা। এক দফা এক দাবি- রকিবের ফাঁসি। বিক্ষোভে লোক বেড়ে চলেছে, গুলি করেও ঠেকানো যাচ্ছে না। কূটনৈতিক সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ। নেতাবিহীন আন্দোলন, সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন। রাত যত গভীর হয়, গোলাগুলির শব্দ বাড়ে। রাত ঠিক দুইটায় টিভি স্ক্রলে লম্বা ব্রেকিং- ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কয়েদিদের মধ্যে দাঙ্গা চলছে, হতাহত অনেক; নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন কারারক্ষীরা; অনেক বন্দি নিখোঁজ, পদার্থবিজ্ঞানী রকিব জোয়ারদারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না; সারা দেশে কারফিউ জারি করেছে সরকার, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত চলবে; ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সব বিভাগীয় শহরে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রামের বারইয়ারহাট এলাকায় মহাসড়কে জমায়েত হয়েছে হাজার হাজার রকিববিরোধী। তারা ‘জাতীয় মূল্যবোধ রক্ষা’ কমিটি গঠন করেছে। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনে বরাবর সোচ্চার একজনকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। লম্বা কমিটিতে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে কওমি মাদ্রাসার লোকজনও আছেন। আহ্বায়ক সাহেব আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
কারাগারে দাঙ্গার ঘটনায় সরকারের ওপর চাপ অনেকটা কমে গেছে। ওই দাঙ্গায় অন্তত পাঁচশ কয়েদি মারা পড়েছেন, সব বডি যথাযথ শনাক্ত করা যায়নি, ওই সুযোগে জেল থেকে পালিয়েছেন অনেকে, সেই সংখ্যাও সঠিক জানাতে পারেনি কারা কর্তৃপক্ষ। রকিব জোয়ারদার ইস্যুতে দাঙ্গা, তিনি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, কেউ জানে না। জেলের ভেতর কয়েদিরা ছিলেন দ্বিধাবিভক্ত, এক গ্রুপ রকিবের পক্ষে, তাদের সংখ্যা কম আর বিশাল অপর গ্রুপ তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ষড়যন্ত্র ফাঁস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাধে দাঙ্গা। বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত এই পদার্থবিজ্ঞানীর প্রাণের সবশেষ অবস্থা জানা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
‘জাতীয় মূল্যবোধ রক্ষা’ কমিটি রকিবের জীবিত বা মৃতদেহের মূল্য দশ কোটি টাকা ঘোষণা করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একই সময় জারি করে প্রেসনোট। তাতে বলা হয়, বিজ্ঞানী রকিব জোয়ারদারের সঠিক সন্ধানদাতাকে এক কোটি টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। ইলোরা দেখেন, দরদামে একটি বিষয় পরিষ্কার- রকিবের দাম রাষ্ট্রের চেয়ে আন্দোলনকারীদের কাছে বেশি। তাদের অর্থের পরিমাণ সরকারের দশগুণ বেশি। কেয়াকে ডেকে তুলে বলেন, প্রলয়ের মধ্যে কোত্থেকে এত ঘুম আসে। গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে দেশ।
ফাহমিদা ম্যাডাম ঢাকা ছাড়তে চাইলেন না, তাই স্কুলে জয়েনের বিষয়ে অপারগতা জানিয়েছেন। হয়তো এ নিয়ে তার বিশেষ ভাবনা আছে, তবে স্যারের প্রতি মমতা বা আন্তরিকতার ঘাটতি নেই।
রাতের ঘটনা সব শুনে কেয়া বলেন, আপনি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে কতটুকুন চেনেন মেম? উনি পলিটিক্স করে এই পর্যায়ে এসেছেন, এখন বিশ^নেতা। জেলখানায় রকিব স্যার সাধারণ কোনো কয়েদি নন, স্যারকে আদৌ জেলখানায় রাখা হয়েছে কিনা, তা-ও বলা যায় না। যখন বললেন স্যারকে পাওয়া যাচ্ছে না, তখনই ঘটনা পরিষ্কার। এই দাঙ্গা পাতানো এবং সুপরিকল্পিত। আন্দোলনের মোড় ঘোরানোর দাঙ্গা।
– জেলখানায় এত লোক মারা পড়লো যে?
– এর নাম রাজনীতি। প্রধানমন্ত্রীর সামনে তিনটি অবজেক্ট- দেশ রক্ষা, সরকার টেকানো এবং রকিব স্যারের জীবন বাঁচানো। এজন্য যা যা করার তিনি করবেন। পাঁচশ তো কমের ওপর দিয়ে গেছে পাঁচ লাখের বিনিময়ে হলেও তিনি স্যারকে বাঁচিয়ে রাখবেন। স্যারের মূল্যটা প্রধানমন্ত্রী জানেন। দাঙ্গায় রকিব স্যার হাওয়া, ফাঁসির দাবি ওরা কার কাছে করবে? প্রথম ধাক্কায় সরকার টিকে গেছে। দ্বিতীয়ত- আন্দোলনে ভাটা পড়ায় রাষ্ট্রের জানমালের ক্ষতি কমল আপাতত এবং তৃতীয়ত- স্যারের বিষয়ে ভাবার সময় পেলেন প্রধানমন্ত্রী।
– অসাধরণ এসব পয়েন্ট আমার মাথায় এলো না কেন? দেখলেন তো, গাদা গাদা সনদে কিছু হয় না, আপনার বুদ্ধি অনেক। এরপর কী হবে?
– স্যার থাকবেন সরকারের কোলে; মন্ত্রীরা বেসামাল কথাবার্তা বলবেন স্যারের বিরুদ্ধে। আন্দোলনকারীরা আরও কিছুদিন হইচই করবে, সরকারের সমালোচনায় মুখর হবে, সংশয় প্রকাশ করবে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে গালাগাল দেবে, কিন্তু হাওয়ার বিরুদ্ধে আর কত। এর মধ্যে একদিন রাশিয়া চলে যাবেন স্যার।
– অসাধারণ আইডিয়া আপনার। নাইস সায়েন্স। প্রধানমন্ত্রী-আপনি-রকিব সব একই সুতোয় গাঁথা। থ্যাংকস।
– থ্যাংকস আমাকে দিয়েন না মেম, সব শঙ্কা ও প্ল্যান মর্জিনা ম্যাডামের। আমাকে জেলহত্যার শঙ্কা রকিব স্যার মর্জিনা ম্যাডামকে শুধু মনে করিয়ে দিতে বলেছিলেন। তাতেই কাজ হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন মনে হচ্ছে, দুনিয়াটা সিআইএর হাতের খেলনা।
– এমন দুর্দিনে রকিবের প্রাণের বান্ধবী ফাহমিদা নেই কেন জানেন?
– ম্যাডাম তো আছেন, থিসিস প্রকাশের পর থেকে রাশান অ্যাম্বাসি পুরোটাই উনি সামলাচ্ছেন। ফাহমিদা ম্যাডাম ঢাকা ছাড়তে চাইলেন না, তাই স্কুলে জয়েনের বিষয়ে অপারগতা জানিয়েছেন। হয়তো এ নিয়ে তার বিশেষ ভাবনা আছে, তবে স্যারের প্রতি মমতা বা আন্তরিকতার ঘাটতি নেই।
চলবে…
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-২০॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন