পর্ব-৩
অংকন বলেন, জীবনের দাম থাকবে না কেন? বিজ্ঞান, গণিত, ভূগোলের যতটা ভ্যালু আছে ইতিহাস, চারুকলার গুরুত্ব কম কিসের, অনেক ক্ষেত্রে বেশি। আনন্দ-বিনোদন আর জীবনবোধ না থাকলে বিজ্ঞান দিয়ে কী হবে। হুমায়ূন আহমেদের বাদশানামদার পড়ে তো মোগল বাদশা হুমায়ুনকে ঈর্ষা হয়েছে, তার সময়টাকে ধরতে ইচ্ছে করেছে। ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে সম্রাট আকবরের চরিত্রে মুগ্ধ হয়েছি। অনেক জানার আছে। সময় পেলে পাঁচ হাজার বা তারও আগ থেকে জগতের পুরো ইতিহাসটা পড়ে নিতাম। বদরের যুদ্ধ, উহুদের যুদ্ধ, মক্কা বিজয় পড়তে অসাধারণ লাগে। আপনার ফিল্ডটা তো বিশাল এবং ইন্টারেস্টিং।
-আপনার মতো করে কেউ পড়ে না স্যার। ইতিহাস বিষয়টাকে সবাই বলে মরা মানুষের কিচ্ছা। প্র্যাকটিক্যাল লাইফে এর কোনো ফাংশন নেই। শিক্ষা বোর্ড কী মনে করে এখনও বিষয়টা সিলেবাসে রাখায় জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পাচ্ছি, নাহলে আপনারা পিয়নও রাখতেন না। রাস্তায় নামতে হতো, ভিক্ষার বাসন হাতে।
-আপনি দেখছি খুবই নৈরাশ্যবাদী, বি পজেটিভ। ধর্মের আচার তো ভালোই মেনে চলেন, ধর্মের মর্মবাণীও মানা লাগে। ধর্মমতে, আল্লাহ মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীব বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, বুদ্ধিতে মানুষই সেরা। সেই বুদ্ধিটা কাজে লাগানো দরকার। পৃথিবী শাসন করছে আপনারই মতো মানুষ। আর আপনি তো আমাদের সহকর্মী, নিজেকে এত তুচ্ছ ভাবছেন কেন?
-সোবহান আল্লাহ। আপনাদের সময় নষ্ট করলাম স্যার। অনেক জানলাম, যত দেখব, তত জানব, জানার শেষ নাই। গ্রামটা অনেক সুন্দর, আমি প্রতি প্রভাতে এক চক্কর দিই, আপনারা বেড়ান স্যার।
জাফর উল্ল্যাহ গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলেন।
অংকন-রকিব ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক ধরে স্যান্ডেল মৃদু চেঁচিয়ে আয়েশে হাঁটতে থাকেন।
অংকন বলেন, জাফর উল্লাহ সহজ-সরল-নিরীহ মানুষ, নিজের বিদ্যাবুদ্ধিতে আস্থার সংকট। অযথা হীনম্মন্যতায় ভোগেন। তোর সম্পর্কে দেখি কিছুই বলল না, সম্ভবত কিছুই জানে না। তোর সিভি দেখেনি মনে হয়, যেদিন দেখবে মুহূর্তে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। না দেখাই ভালো, হার্টফেলও করতে পারে, শেষে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
-যা ভাবছিস মোটেও তা নয়। ভয়ংকর টাউট, বিরাট অভিনেতা, প্রথম পরিচয়ে ভং ধরেছে। তার নাম মীর মোহাম্মদ জাফর উল্লাহ। মোহাম্মদ আর উল্লাহ বাদ দিলে যা থাকে সে তার ক্লোন। তোর সিভি সে একনজর দেখেনি, মোবাইলে ছবি তুলে নিয়েছে। তোর নিয়োগ ঠেকাতে অন্তহীন তদবির করেছে। বেকার-অযোগ্য বন্ধুবান্ধব এনে আমি নাকি পুনর্বাসন কেন্দ্র খোলার পাঁয়তারা করছি। স্কুলের ভেতরে-বাইরে অন্তত দশজনকে বলেছে, আটজনই আমাকে তার মোবাইল মেসেজসহ ঘটনা বলেছে, বাকি দুজন বলার সুযোগ পাচ্ছে না।
-সত্যি?
-শুধু সত্যি না, চিরন্তন সত্যি। আরও আছে। সে ভালো করেই জানে, আমি না থাকলে এখানে তার চাকরি থাকে না, তবু আমার পতন প্রার্থনা করে, পুরোপুরি ধ্বংস চায়। গ্রামে বখাটে ছেলেপুলে লেলিয়ে দিয়েছে আমাকে শায়েস্তা করতে। তার কারণে দুটা বোকা ছেলে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারাও গেছে। ওই ছেলেরা আমাকে হত্যার উদ্যোগ নিয়েছিল, মাস্টারমাইন্ড তোর এই নিরীহ জাফর উল্লাহ। সেই রাতেই ছেলে দুইটা অহেতুক মারা গেল। অবশ্য রহস্যঘেরা এই ঘটনা না ঘটলে আমার এখানে টিকে থাকা কঠিন হতো। জাফর যেখানে যা করে বা বলে সবাই এসে আমাকে বলে দেয়। সামনে আমি তার ঈশ^র, পেছনে এই আমিই ইবলিশ শয়তান।
স্কুলের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ে মহাব্যস্ত অংকন। রকিব দিনরাত ল্যাবে। দুই বন্ধুর দেখা হয় গভীর রাতে।
-আশ্চর্য ক্যারেকটার দেখি!
-আশ্চর্য ঘটনা আরও আছে।
-আরও আছে?
-হুম। অত্যন্ত গোপনে ভয়ংকর কর্মকাণ্ড করে বেড়ায় জাফর। সে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে, স্কুলের ল্যাবে নাকি বোমা বানানো হয়। ছাত্রদের নাকি মারণাস্ত্র বানাবার ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে।
-এটা কোন প্রসঙ্গে বললো?
-ক্লাসে একবার আলফ্রেড নোবেলের ডিনামাইটের প্রসঙ্গ উঠেছিল। ডিনামাইটের গঠন নিয়ে বলছিলাম, সে যেকোনোভাবে শুনেছে। আরেক দিন সম্ভবত আইনস্টাইনের নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশন নিয়ে বলছিলাম, জাফর ওইসব ক্লাসের আলোচনা ইস্যু করেছে। তার চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে টেকনোলজি মিনিস্ট্রির অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি এসেছিলেন। তার আগে এসেছিল হোমের এক জয়েন্ট সেক্রেটারির নেতৃত্বে পরিদর্শক টিম।
-এসব করে জাফরের লাভ কী? তাকে রেখেছিস কেন? সে তো দেখছি বিপজ্জনক ইলিমেন্ট। টার্মিনেট করে দে।
-তুই সত্যিই গণিতের যথার্থ মাস্টার, শর্টকাট সমাধানে ওস্তাদ। বুদ্ধি করে সমাধান বের কর। সকল দুর্যোগে কিছু ইতিবাচক দিক থাকে। মানুষ তো সাপের মতো প্রাণীকেও মেনে নিয়েছে। সাপ দেখলেই তো মেরে ফেলা নয়। প্রকৃতিতে মানুষের পাশাপাশি সাপ, বিচ্ছু, শিয়াল, কুকুর, চিতাবাঘও থাকবে। তাই না?
-কিন্তু ঘরে পুষছিস কেন? ছোবল খাওয়ার জন্য?
-তাও না হয় খেলাম, তারপর আছে অন্য হিসাব।
-আচ্ছা বাদ দে, সাপ-ব্যাঙ-জাফরবিষয়ক ফালতু আলাপ বাদ। আমাকে নিয়ে তোর প্ল্যান কী?
-আমি এত দিন ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল ছিলাম, আগামী সোমবার ভারমুক্ত হব। প্রিন্সিপাল হিসেবে তোর নামে নিয়োগপত্র ইস্যু করেছি, আজ পাবি। ওই পদে ক্লারিক্যাল কাজের যন্ত্রণায় আমি গবেষণায় মন দিতে পারছিলাম না। আমি তোর সহকারী হিসেবে নেপথ্যে থাকব।
-বেশি হয়ে গেল না?
-একটু বেশি হয়েছে, কারণ অঙ্ক করানোর পাশাপাশি তোকে কেরানিগিরি করতে হবে। কিছু করার নেই, অনেক ভেবেছি, বিকল্প পাইনি। আর কথা নয়, চল স্নান সেরে স্কুলে যাই।
-তুই কি ফিজিক্সবাদ দিয়ে প্রাণিবিদ্যা নিয়ে কিছু করছিস?
-হুম। কীভাবে বুঝলি?
-বিছানা-টেবিলে ম্যান্ডেলিজম ভরে আছে। সাইকোলজির রেয়ার কিছু বইপত্রও দেখলাম। জাক লাকাঁ, ফ্রয়েড, মিশেল ফুকোকে দেখলাম, এদের কাজ কী?
-জীবন তো এরাই ঘিরে রেখেছেন। সব বলব। এখানে আর দাঁড়াতে পারছি না, পা ব্যথা হয়ে গেছে। রুমে চল।
স্কুলের অফিসকক্ষে গিয়ে বসেন দুজন। নিয়োগপত্র নেন অংকন। খুলে পড়ে দেখারও প্রয়োজনবোধ করেন না। দুদিন পর জয়েন করেন। রকিব ব্যস্ত হয়ে পড়েন ল্যাব নিয়ে। ড. অংকনের নির্দেশে নিয়মকানুনের কঠোর কড়াকড়িতে পড়ে স্কুল। মিলিটারি মার্শল ল’র আদলে জারি হয় বিধিনিষেধ। এতে সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েন জাফর উল্লাহ। সারা গ্রাম চরে বেড়ানো বন্ধ। তাকে হোস্টেল পরিদর্শক পদ দিয়ে বাড়তি দায়িত্ব দেয়া হলো।
আগে দু-এক ওয়াক্ত পড়লেও নজিরবিহীন কড়াকড়ির মধ্যে তিনি পাঞ্জেগানা নামাজ ধরেছেন। এর উদ্দেশ্য দুটি- প্রথমত কাজে ফাঁকি, দ্বিতীয়ত রকিব ও অংকনের পতন চেয়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ। কোনো এক মাওলানার ওয়াজে নাকি শুনেছেন, খাস নিয়তে চাইলে আল্লাহ সব ইচ্ছা পূরণ করেন। জাফর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শেষে দীর্ঘ সময় জায়নামাজে বসে কান্নাকাটি করেন, আল্লাহর কাছে দুই নাস্তিকের কারাগার থেকে মুক্তি চান। বলেন, হে আল্লাহ, এই মুমিন মোসলমানকে তুমি দুই জালিমের হাত থেকে রেহাই দাও। এরা ল্যাবরেটরির অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে বিজ্ঞানচর্চার নামে বেদাত কাজ করছে, তোমার বান্দাদের ইসলামের পথ থেকে সরায়ে নিচ্ছে। এদেরকে হেদায়েত করে ফল নাই, শাস্তি দিয়েও লাভ নাই, তুমি এদেরকে সরায়ে দাও। এদেরকে তুমি ছাড়া কেউ শায়েস্তা করতে পারবে না। এরা নাফরমান, এরা কুফরি করে।
নামাজের নামে জাফরের ফাঁকি নতুন প্রিন্সিপালের নজরে এলে রুল জারি হয়। স্কুল চলাকালে নামাজবাবদ সময় নির্ধারণের ঘটনায় নড়াচড়া দিয়ে ওঠেন জাফর। ভেতরে-বাইরে রকিব-অংকনের বিরুদ্ধে ইসলামবিরোধী জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। সে চেষ্টাও মাঠে মারা যায়, কেউ তার কথায় কান দেয় না, এমনকি মসজিদ কমিটির সভাপতিও না। কোথাও পাত্তা না পেয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করে জাফরের।
স্কুলের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ে মহাব্যস্ত অংকন। রকিব দিনরাত ল্যাবে। দুই বন্ধুর দেখা হয় গভীর রাতে। তখন আর কথা বলার শক্তি থাকে না। রকিব মাঝে মাঝে ল্যাবেই ঘুমিয়ে পড়েন, নাওয়া-খাওয়ার শৃঙ্খলা নেই।
চলবে…
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-২॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন