পর্ব-২০
এডিসি জেনারেল নাজমা আলী বলেন, স্যার আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। রকিব স্যারের থিসিস ইস্যুতে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মামলা হতে পারে, সেই ইস্যুতে অফিশিয়ালি কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা আছে। আমরা স্কুল পরিচালনা ইস্যুতেই থাকতে চাই। আপনার অভিযোগ জেলা প্রশাসককে জানাতে পারেন। স্যারের থিসিস নিয়ে সারা দুনিয়ায় তোলপাড় হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আমেরিকা-রাশিয়া-বৃটেন কেউ প্রত্যাখান করেনি। থিসিসটা আন্তর্জাতিক।
বিরক্তি নিয়ে ইলোরা বলেন, এমপি সাহেব ক্ষেপে আছেন কেন জানি না, রকিবের থিসিস উনি কতটা বুঝে কথা বলছেন তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। তবে আজ এখানে রকিব ইস্যু নিয়ে আমরা আলোচনায় বসিনি, সেটা রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক আদালতের বিষয়। আলোচনা স্কুল ইস্যুতে হলে বসব, নইলে না। এমপি সাহেবের ব্যক্তিগত অনুযোগ শুনব না।
প্রসঙ্গ পাল্টে এডিসি বলেন, প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত হলো ড. ইলোরাকে স্কুলের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নিতে হবে। উচ্চপর্যায় বলতে পিএমওর নির্দেশনা। এই মিটিং শুরুর দশ মিনিট আগে নির্দেশনা এসেছে। ডিসি স্যার জানিয়েছেন। স্কুল ঘিরে তিন স্তরের নিরাপত্তা চৌকি বসাতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ডিসি স্যার ও এমপি মহোদয়কে ঢাকায় তলব করেছেন। স্কুলে সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়ে পিএমওর সঙ্গে কানেক্ট করতে বলা হয়েছে।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই বলে উঠে দাঁড়ান এমপি। বলেন, ইলোরা ম্যাডাম দায়িত্ব নিলে তো আর কথা থাকে না। তার আরও আগেই এগিয়ে আসা উচিত ছিল। যদিও মহিলা মানুষ তাতে কী, আমি সর্বাত্মক সহায়তা দেব। আমি নিজে পাহারা বসামু। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয় সরাসরি মনিটর করছেন, আর কোনো বাইনচোতের বাইচ্চা কিছু করতে পারবে না।
প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে গেছেন, এবার বাঁচা যাবে তাই তো, এমপি সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন মর্জিনা।
হাসি চেপে এডিসি নাজমা বলেন, রকিব স্যারকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো মামলা দাঁড় করানো যায়নি। কারণ, স্যারের থিসিস প্রকাশ করেছে রাশিয়া সরকার। থিসিস ভুল প্রমাণ হলে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হবে। এ নিয়ে কেউ কোনো ভুল তথ্য ছড়াবেন না দয়া করে।
জনগণ সেই পর্যন্ত ধৈর্য রাখবে কিনা, হতাশা ব্যক্ত করেন এমপি। আল্লাহ আল্লাহ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমি সামান্য জনপ্রতিনিধি, আমার অনুরোধ কে শুনবে? দেখা যাক কী করা যায়।
আপনি শুধু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘুরে আসেন, সেখানে আপনাকে কি বলা হয় তা হয়তো কেউ কোনোদিন জানবে না। আর শুনুন স্যার, আপনি স্কুলের নিরাপত্তায় কিছু করবেন না যেন। এরই মধ্যে নেমেছে আর্মড পুলিশ, তারা স্কুলগেটে ক্যাম্প বসিয়েছে, মিটিং শেষে দেখতে পাবেন, বলেন এডিসি। ইলোরাকে জানান, আপনি থাকবেন সার্কিট হাউসে।
সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে মিটিং শেষ করেন এডিসি নাজমা আলী।
একে একে সবাই বেরিয়ে যান। ইলোরার কাছে এগিয়ে গিয়ে কেয়া বলেন, মেম আমি রেবেকা সুলতানা কেয়া। রকিব স্যারের বেশ কিছু কাগজপত্র আছে আমার কাছে।
– আপনি সার্কিট হাউসে আসেন, রাতে থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আসবেন।
– জি¦ আচ্ছা।
ইলোরা স্কুল ঘুরে দেখেলেন। রকিবের চিলেকোঠা ঘিরে ডিবি পুলিশের হলুদ ফিতা ধরে অনেকটা সময় দাঁড়িয়েছিলেন। এই ঘরে রকিব থাকত, অংকন-কেয়ার বাসরঘর। বাসরঘরে বাসররাত। বাসর দিন বলে কিছু নেই। অদ্ভুত একটি রাত, সারা জীবন মনে থাকে। সেই রাতে রকিব কথা বলেনি দীর্ঘ সময়। হঠাৎ গুন গুন গেয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্বের-
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই,
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু,
কোথা বিচ্ছেদ নাই।
মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ
দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ,
তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ
আপনার পানে চাই।
হে পূর্ণ তব চরণের কাছে
যাহা কিছু সব আছে, আছে, আছে,
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই,
নিশিদিন কাঁদি তাই…
তাকে আর কখনো গাইতে শোনা যায়নি। অস্বাভাবিক ওই রাতে বোবাও গান গেয়ে ওঠে।
লাবণ্য দাশের স্বামী কালো ও চাপা স্বভাবের জীবনানন্দ দাশ বাসররাতে অদ্ভুত আবদার করেছিলেন। বললেন- রবিঠাকুরের ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে’ গাইতে পারবে আমার জন্য?
মানে বাসররাতেও অমন দুঃখী, ডিপ্রেসিভ গানের অবতারণা। ওই রাতে এরা এমন অস্বাভাবিক আচরণ করবে- এটাই হয়তো প্রকৃতির নিয়ম।
তার নির্মোহতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম, একই কারণে তিক্ত। নিজেই হারিয়ে গেছি, জীবন দীর্ঘ মেয়াদে একা। সচিবের মেয়ে ছিলাম, ওকে ভালোবেসে বাবা-মায়ের ঘর চিরদিনের জন্য খুইয়েছি।
রকিব তখন ইউনিভার্সিটি থেকে কেবল বেরিয়েছে, ছাত্রজীবনের উদ্ভ্রান্তি কাটেনি। বিয়ে করেছে কেন জানে না। তখনো গুন্ডা, প্রেম-ভালোবাসা বোঝে-টোঝে না। ওর ক্যাম্পাসে গিয়ে দেয়ালে দেয়ালে দেখেছি, খুনি রকিবের ফাঁসি চাই।
আজব কারেকটার ওর। এর মধ্যেই জীবনানন্দ। একান্ত দুঃখবোধ। হুট করে মন খারাপ। কেমন খালি খালি লাগা শূন্যতা। বিং অ্যান্ড নাথিংনেস ফিলিংস। নিজের জীবনের প্রতি বিবমিষা। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মাঝে অস্থিরতা। সেন্স অব মরবিডিটি। এর মধ্যেই ইলিয়টের ‘ওড অন মেলাঙ্কোলি’ অথবা সিলভিয়া প্লাথের ‘ডাইং ইজ এন আর্ট’ পড়ে-টড়ে সন্ধ্যাবেলা মন খারাপ করে বসে থাকা।
ইন ফ্যাক্ট, জীবনে কি চেয়েছিল রকিব? আরবি-ফার্সিসহ বারোটা ভাষা জানত। চর্যাপদ অবিরাম বলে যেত। সব বাক্য আরবিতে বলে আবার লিখে দেখাত। ভয়ংকর নাস্তিক ছিল, জেনে-বুঝে নাস্তিক। অত বড় নাস্তিক সচরাচর দেখা যায় না। বলত, আমরা দীর্ঘায়ু, দাদা নব্বই বছর, তার বাবা এক শ পাঁচ বছর বেঁচেছিলেন। আমি আজও আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে আছি, ইনজুরি টাইম কাটাচ্ছি বলতে পারো। ক্যাম্পাসে আমাকে টার্গেট করে বৃষ্টির মতো গুলি হয়েছে, ডানে-বামে মরে পড়েছিল, আমি ধোঁয়ার ভেতর থেকে বেরিয়েছি। নিজেকে চিমটি কেটে দেখতাম, বেঁচে আছি কিনা।
সে প্রায়ই বলত, অরুচিকর মানুষ দেখলে গুলি করে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। সুন্দর প্রকৃতিতে আনস্মার্টদের বাঁচার অধিকার নেই।
সেই বিশেষ রাত থেকে দেখে আসছি, নিম্নরুচির মানুষের প্রতি রকিবের সীমাহীন বিরক্তি। আজকের দুনিয়া কাঁপানো থিসিস হয়তো সেই ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ।
ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করে সার্কিট হাউসে ফেরেন ইলোরা। রাত নয়টার দিকে সেখানে কেয়াকে স্বাগত জানান। বলেন- শোনো মেয়ে, অনেক হয়েছে, এবার থামো। নিজের রূপটা ভালোই কাজে লাগিয়েছ। সুন্দরী হলেই সর্বগ্রাসী হতে হবে কে শিখিয়েছে। এক বন্ধুকে বিয়ে, আরেকজনের সঙ্গে প্রেম। অঢেল সম্পত্তি ভোগদখল। বাহ্, দুর্ধর্ষ খোলোয়াড়। লজ্জা করে না?
– লজ্জা করে ম্যাডাম। ভয়ংকর লজ্জার মধ্যে আছি। খুব কান্না পাচ্ছে। আপনি এভাবে অপমান করবেন জানতাম, এখানে আসার আগে অনেক কেঁদে চোখের পানি শেষ করেছি, নয়তো এতক্ষণ থাকতে পারতাম না। আমার জন্ম হয়েছে জীবনভর অপদস্থ হওয়ার জন্য, সম্মান পাব কোথায়, প্রত্যাশাও নেই। মানুষের চেহারা নিয়ে জন্মেছি সেই তো যথেষ্ট, শুয়োপোকা, মাজরা পোকা হয়ে জন্মানোর কথা ছিল, মেরুদণ্ডবিহীন প্রাণী।
রকিব স্যারের দেয়া সব কাগজপত্র নিয়ে এসেছি, এতে চেক বইসহ সব আছে। আমাকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি করেছিলেন, পর্যাপ্ত সাদা স্ট্যাম্পে সই করে এনেছি, আপনি ট্রান্সফার নিয়ে নেবেন। আমি কি এবার যেতে পরি?
কেয়াকে জড়িয়ে ধরে ইলোরা বলেন, নারে সোনা আর যাওয়া-যাওয়ী নেই, সারা রাতের কথা বাকি। ঢং করে এসব বলেছি, বিখ্যাত বিজ্ঞানী রকিব জোয়ারদারের এক্স এই ইলোরা অত খারাপ মানুষ না। কেয়া সর্বগ্রাসী হতে পারে না, শুধুই হৃদয়গ্রাসী, দুর্ধর্ষ বুদ্ধিমতী। এই অতি সুন্দর মানুষটা কাঁদলে কেমন দেখায়, তাই দেখতে চেয়েছিলাম, হলো না। কেয়া একা যা পারেন, গণ্ডা গণ্ডা ইলোরা তা পারে না। আমিও সারাজীবন অনেক কেঁদেছি, রকিব ফিরেও দেখেনি। বিয়ের রাত ছাড়া তাকে আর পাওয়া যায়নি। সব সময় ঘোর, কী যেন খোঁজে, অথচ পায় না। কী চায় নিজেই জানে না। বিয়ের পরদিন লক্ষ করলাম, কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই, বোঝে না ভালোবাসা। তার নির্মোহতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম, একই কারণে তিক্ত। নিজেই হারিয়ে গেছি, জীবন দীর্ঘ মেয়াদে একা। সচিবের মেয়ে ছিলাম, ওকে ভালোবেসে বাবা-মায়ের ঘর চিরদিনের জন্য খুইয়েছি।
চলবে…
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-১৯॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন