পর্ব-১৭
আঠারো ডিগ্রি সেলসিয়াসের এসি রুমে দর দর করে ঘামতে থাকেন অংকন। বাতি নেভানো দরকার, ইচ্ছে করে জ্বালিয়ে রাখেন কেয়া। অংকনের লজ্জা-জড়তা রাতে রাতেই তাড়াতে হবে। বলেন, সারা জীবন কিসের এত গণিত, কিসের কোয়ান্টাম মেকানিক্স। বাসররাতে স্রোডিংগারের বিড়াল-কুকুর, এসবের অর্থ কী? জীবনের গল্প বলো।
– জীবনে কোনো গল্প নেই, সব অন্ধকার এবং বিশাদে ভরা। আমার দুই বোন ছিল, তাদের কয়েক বছরের ছোট আমি। আমরা বরিশালে থাকতাম, কীর্তনখোলার চরে প্রত্যন্ত গ্রাম। সারা বছর পানি আর পানি। বছরে একবার ধান হতো, কী ধান মনে নেই, তখন ইরি আবিষ্কার হয়নি। বাবা হাটে ওষুধ বিক্রি করতেন, ইঁদুরের ওষুধ, রাসায়নিক নাম জিঙ্ক সালফাইড। আমাদের জীবন ছিল স্থবির, সংসার হামাগুড়ি দিয়ে চলত। খাবারের সংকট ছিল তীব্র, রাতে ক্ষিধে লাগার শঙ্কায় মা সন্ধ্যায় মুড়ি-চিড়ে খাইয়ে চেরাগ নিভিয়ে দিতেন, যেন ঘুমিয়ে পড়ি। তিন ভাই-বোনের পোশাক ছিল গায়ে গায়ে। স্যান্ডেল থাকত না। বর্ষায় মাঝে মাঝে পাঠশালায় যেতাম পালা করে। শুকনো মৌসুমে আমি মায়ের সঙ্গে ঘরে থাকতাম, দুই বোন সারা দিন থাকত মাঠে। ওই এলাকায় ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব ছিল প্রকট, তারা বিপুল পরিমাণে ফসলের ক্ষতি করত। ইঁদুর ধান কেটে ক্ষেতের মধ্যে গর্তে নিয়ে জমা করত। ব্যাপারটা ছিল আমাদের জন্য আশীর্বাদ। আমার দুই বোন সারাদিন ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ধান সংগ্রহ করে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরত। মা সেই ধান কিছু কিছু করে বর্ষা মৌসুমের জন্য সঞ্চয় করতেন।
বাবার ব্যবসা ছিল একধরনের প্যারাডক্স, মানে উভয়সংকট। কৃষকরা তার কাছ থেকে ওষুধ কিনে ধানক্ষেতে ছিটাত, এতে ইঁদুর মরত। বেশি ইঁদুর মরলে আমাদের ক্ষতি, গর্তে ধান মিলত কম। ইঁদুরের ওষুধ বেশি বেচা হলে নগদ লাভ তবে পরোক্ষ ক্ষতি। বড়ই অদ্ভুত সমীকরণ, ইঁদুরের ওষুধ বিক্রি আমাদের জীবন মানের সমানুপাত এবং ইঁদুরের মৃত্যু হার দুই বোনের ধান অর্জনের ব্যস্তানুপাত।
– বিন্দু ও রেখা কিভাবে মারা গেছে?
– ওদের নাম এবং মৃত্যু কিভাবে জানেন?
– সেটা পরে বলব? আগে বলো ওদের মৃত্যু হলো কিভাবে?
– সাপে কেটে। সম্ভবত ইঁদুরের গর্তে হাত দিতেই সাপে কাটে। তবে দুজনকে একসঙ্গে কিভাবে কাটেছে কেউ বলতে পারেনি। এলাকার লোকজন সন্ধ্যার দিকে ধানক্ষেত থেকে তাদের সাপে কাটা দেহ বাড়ি দিয়ে গেছে। তখন তাদের বয়স দশ-বারো।
– তোমার টেবিলে দুই ফ্রেমে ওদের ছবির নিচে নাম ও জন্ম-মৃত্যুর তারিখ লেখা আছে। ধরে নিয়েছি, বিন্দু ও রেখা অংকনের দুই বোন।
– ওদের মৃত্যুর পর মা ও আমাকে নিয়ে বাবা ঢাকায় চলে যান। পুরান ঢাকার ইসলামপুরা থেকে কম দামে বাহারি রঙের কাপড় কিনে ফেরি করতেন বাবা। আমাকে স্কুলে সরাসরি ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করে দেন। এরপর থেকে নানা জাতের বৃত্তি পেতে থাকি। ক্লাস ফাইভের পর থেকে বাবা আর আমাকে টাকা দিতে হয়নি। কলেজ-ইউনিভার্সিটি-পিএইচডি সবই বৃত্তির টাকায়। আমার পড়ায় সরকারের মানে জনগণের বিপুল ব্যয়, এ কারণে লন্ডনে পিএইচডি শেষে কিছুদিন চাকরি করে দেশে ফিরি। গণিত যা শিখেছি, এ দেশের ছেলে-মেয়েদের পড়ানোর চেষ্টা করি। রকিবের স্কুলের চাকরির অফারটা বেশ মনে ধরেছে। শিশুদের পড়িয়ে ঋণ পরিশোধের সুযোগ পাই, এই আর-কি জীবন। এর মধ্যেই বাবা-মা মারা গেছেন জটিল অসুখে।
– আমাকে ‘তুমি’ বলতে দ্বিধা কেন।
– দ্বিধা নেই, অনভ্যাস। দুই বোনের মরদেহ উঠানে পড়ে ছিল, দেড় দিন তাদের সামনে বসে পাহারা দিয়েছি, বাবা বেরিয়েছিলেন কাফনের কাপড় জোগাড় করতে। আমি তখন আট বছরের শিশু। এরপর থেকে ট্রমার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। কল্পনায় আমার সঙ্গে বিন্দু-রেখাও বড় হয়েছে। মেয়েদের দেখলেই মনে হয়, বিন্দু বা রেখা। অন্য কিছু ভাবতে পারি না। ওরা দুজন আমাকে আগলে রাখত, খাইয়ে দিত, দিনরাত কোলে নিয়ে ঘুরত। আজও ভুলতে পারি না।
ভাই ফোন রাখলাম, পিএমও থেকে অনবরত ফোন আসছে। আপনি সামনে না গিয়ে উল্টাপথে নিউমার্কেটের দিকে চলে যান, পরে কথা হবে।
– বন্ধু হলেও রকিব স্যার ঠিক তোমার উল্টা, মাথা ঠাণ্ডা বরফের মতো, সব জানেন, হুঁশ ঠিকঠাক।
– হুম। ইউনিভার্সিটির হলে রকিব আমার রুমমেট ছিল। ওকে দেখার পর থেকে আমার জীবন বদলে গেছে। রকিব প্রেরণার উৎস। অবিশ্বাস্য জীবনীশক্তি তার। বিজ্ঞান যেমন বোঝে, সমাজ ও রাজনীতি সমান তালে জানে। কোষের নিউক্লিয়াস থেকে শুরু করে মহাকাশের কসমিক রেডিয়েশন পর্যন্ত জানা। ছুটতে পারে আলোর বেগে। পারমাণবিক বোমা বোঝে, সবচেয়ে বেশি বোঝে মানুষ। তবে নিজের জীবনের প্রতি প্রত্যাশা নেই, আশা নেই, আকাক্সক্ষা নেই। রকিবের ভবিষ্যৎ ভাবনা নেই, ভয়ংকর স্বেচ্ছাচারী। ম্যানেজ করার ঐশ^রিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে। কখনো কাউকে অনুরোধ করতে দেখিনি। যেকোনো ফরমেটে রকিব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ওর মনস্তাত্ত্বিক প্যারাডক্স জটিল।
ইউনিভার্সিটির রেজাল্টের পর আমরা হইচই করে দলে দলে বিদেশ চলে গেলাম, সে যায়নি। ওর বাবা নাকি বিদেশে যেতে নিষেধ করেছেন। অবশ্য তার বিমানভীতিও প্রকট। ডক্টরেট করল না, যদিও হিগস-বোসন পার্টিক্যাল বিষয়ে তার থিউরি নিয়ে এমফিল-পিএইচডি শুরু হয়েছে। সেই থিউরি এখন মাস্টার্সে মেজর কোর্স, ফোর ক্রেডিট। ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাসেও রকিবের বেশ কয়েকটা শর্টকাট মেথড রয়েছে, সেসব ফিজিক্সের বহু জটিলতা, বিশেষ করে ন্যানো টেক অনেকটা সহজ করে দিয়েছে।
জেনারেল থিউরি অব রিলেটিভিটি বেইজ ওর একটা গবেষণা ফাইনাল স্টেজে আছে। চিন্তায় নতুন অন্তত একটি ডাইমেনশন সংযোজন, তা হলো স্পর্শের অনুভূতি। অর্থাৎ স্পর্শ করলে মানে বস্তুকে ধরলে যে অনুভূতি মেলে, চিন্তা বা কল্পনায়ও একই অনুভূতি পাওয়া। রকিবের থিসিস মতে, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের এক্সটেনশনে এটা ম্যাথমেটিক্যালি প্রমাণ করা যাচ্ছে, প্যাকটিক্যালি চিন্তার গতিতে লেয়ার স্থাপন করতে পারলেই ইকোয়েশনটা মিলে যাবে। ম্যান্ডেলিজম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে না উঠলে চিন্তায় স্পর্শের অনুভূতি প্রাপ্তির থিসিসটা এত দিনে শেষ হয়ে যেতো।
– রকিব স্যারবিষয়ক রচনা আরও দীর্ঘ হবে? রাত পোহাবার আর বেশি বাকি নেই। তুমি মনে হয় অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছো। এবার আমার হাতটা ধরতে ইচ্ছা করছে না? ধরবে?
অংকনকে স্বাভাবিক করতে রাতভর চেষ্টা চলতে থাকে কেয়ার।
মধ্যরাতে একই সময় কাশিমপুর কারাগার থেকে জামিনে ছাড়া পান মতিঝিলের ক্যাসিনো বাদশা। গাজীপুর থেকে হাজারো নেতা-কর্মীর শত শত গাড়ি-বাইকের বহর তাকে নিয়ে রওনা দিয়েছে ঢাকার দিকে। বিরাট শোডাউনের ভেতর থেকে একটি শব্দে মুখোর মহাসড়ক- বাদশা, বাদশা। গাড়ির আলোয় ঝলমল গভীর রাতের রাজধানী। সবাই ব্যস্ত বাদশাকে নিয়ে, বাদশা খোঁজে একজনকে- নাম তার রমিজউদ্দিন খোনকার।
বাদশার আনন্দ মিছিল তোপখানায় প্রেসক্লাব পার হতেই সচিবালয়ের সামনে আটকা পড়ে। বায়তুল মোকাররম মসজিদ ঘিরে হাজার হাজার লোক বিক্ষোভ করছে। স্লোগানের ভাষা ঠিক স্পষ্ট নয়। সম্ভবত বলছে- মুরতাদ রকিবের ফাঁসি চাই। বাদশা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না, ঘটনা কি ঘটেছে। শুধু বাদশা নন, কেউই বিক্ষোভের কারণ পরিষ্কার বলতে পারছে না। এদিকে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবির সংখ্যা বাড়ছে। রাস্তায় গিজগিজ করছে র্যাব-পুলিশ। নেমেছে টেলিভিশন ক্যামেরা। দেখতে দেখতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাদশা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে বিক্ষোভের কারণ জানার চেষ্টা করেন, তারাও যথাযথ বলতে পারছে না।
মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে ফোন করে জানতে চান, ব্যাপারটা কী? কমিশনার সাহেব বলেন, রকিব গ্রামের এক স্কুলশিক্ষক। উনি নাকি বলেছেন, মানুষের জন্ম কুকুর থেকে হয়েছে। বাদশা ক্ষেপে বলেন, ওই হারামজাদা বললেই হবে? হারামখোর কি বলল আর অমনি মৌলানারা রাস্তায় নেমে পড়ল? আজব কাণ্ড। টাউট রকিব কোথায় বলেছে, ইউটিউবে?
– নারে ভাই, জায়গামতো বলেছে। বলেনি শুধু, সাইন্টিফিকেলি প্রুফ করেছে। ডারউইন সাহেবের মতো মতবাদ দিয়েছে।
– হুজুররা কিভাবে জানল?
-বিবিসি সন্ধ্যা সাতটার খবরে বিশাল রিপোর্ট করেছে। সেখান থেকে তথ্য নিয়ে দেশের টিভি চ্যানেলগুলা ঘণ্টায় ঘণ্টায় বুলেটিন দিতেছে। এর আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। প্রথম উনিই থিসিস উপস্থাপন করে বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। শুনেছি ওই ভাষণের পরপরই ল্যাটিন আমেরিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকা বিশেষ করে বতসোয়ানা, কেপটাউনের মতো বৃহৎ শহরগুলোতে দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। মেক্সিকোতে এখন পর্যন্ত আটজন মারা গেছে। পুড়ছে গোটা ফ্রান্স, সেখানে পাতাল ট্রেনে বিস্ফোরণে দুই-আড়াই শ প্রাণহানি। একটু আগে জানলাম জার্মানিতে কার্ফু জারি।
-হারামজাদা রকিবের বাচ্চা এখন কোথায়?
-তাকে পাওয়া যাচ্ছে না, মোবাইল বন্ধ। গোয়েন্দারা হন্যে হয়ে খুঁজছে। শিগগিরই ধরা পড়বে আশা করি। ভাই ফোন রাখলাম, পিএমও থেকে অনবরত ফোন আসছে। আপনি সামনে না গিয়ে উল্টাপথে নিউমার্কেটের দিকে চলে যান, পরে কথা হবে।
চলবে…
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-১৬॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন