পর্ব-১৬
জেলা শহরের সবচেয়ে সুন্দর ভবন সার্কিট হাউস। কাশ্মীরের আদলে ফুলের বাগানের মাঝে মনোরম অট্টালিকা, দক্ষিণের বারান্দা। রুম সাজানো-গোছানো, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের মতো। সামনে বিশাল দীঘি, কাকের চোখের মতো টলমলে পানি। বারান্দায় বিকেলের নরম রোদ লেগেছে মর্জিনার গালে। এই দৃশ্য কখনো মিস করতে চান না রকিব। অদ্ভুত এই আলোয় মেয়েদের অনেক সুন্দর দেখায়। রকিবের আরাম বোধ লক্ষ করে মর্জিনা বলেন, পাগলের মতো কি দেখো?
– এই সময়ের রোদ বেশ মিষ্টি।
– মিষ্টি? খেতে ইচ্ছে করছে?
– না না, সেই মিষ্টি না।
– সত্যি করে বলো, মিষ্টি রোদের ঠোঁট-গাল তোমার ছুঁতে ইচ্ছে করছে না?
– ঠিক সেভাবে নয়, ধরলে কোমলতা হারাবে, হাতের ছায়ায় বাধা পড়বে রোদ। মিষ্টি ব্যাপারটা আর থাকবে না।
– তুমি আসলে ঋষি না, ঋষি সেজে থাকো।
– আমি ঋষি হতে যাব কেন, যার বউ ছিল, বাচ্চা আছে, অর্থ যার প্রয়োজন সে আবার কিসের ঋষি। বাদ দিন এসব কথা, এত সব ঝুঁকি নিয়ে আমাকে রক্ষা করতে চান কেন? আপনি জব হারাতে পারেন।
দীর্ঘশ্বাসের পর মর্জিনা বলেন, কিসের জব? আমি এই জব চাইনি, সিআইএ আমাকে খুঁজে নিয়েছে। আমার কোনো শপথ নেই, আমি স্বাধীন। তোমার সাহস আমাকে অবাক করেছে, কিচ্ছুু ভয় পাও না, কিছুতেই বিচলিত হও না, কেন? যন্ত্রমানবের মতো চলাফেরা করো, কীভাবে?
পদার্থ, রসায়ন, জীববিদ্যার বহুমুখী খেলা খেলে চলেছো। মানুষ তো একটা, এত সবের আদ্যপান্ত জানতে চাই, বুঝতে চাই। এর মধ্যে সারাক্ষণ উদাসীন, সময় কাটে ঘোরের মধ্যে, কিসের ঘোর?
– প্রশ্নবাণে নিজেই ক্লান্ত হলেন। এসব কিছু না, আমার আসলে কিছু করার নেই, সব ফাঁকা। অথৈ সাগরে পড়া মানুষ অস্থির হলে ডুবতে হবে, তাই চুপ থাকি।
– তোমাকে ঝামেলায় ফেলব না, আমি এখানে সিআইএ পরিচয়ে আসিনি, ডিসির প্রটোকল পাচ্ছি শিল্পী হিসেবে, সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে তাকে ফোন করা হয়েছে। চলো, তোমাদের শহরটা রিকশায় ঘুরে দেখি, আপত্তি নেই তো?
– আপত্তি আছে। শহর বিষয়টা ভালোভাবে নেবে না।
– তবে ডিসির কালো গ্লাসের পাজেরোতে?
– হুম।
শহর ঘুরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তারা মেঘনা নদীর পাড়ে যান। জোয়ার শুরু হয়েছে, তীব্র বাতাস। পানি আঁছড়ে পড়ছে বাঁধাই করা বাঁধে। উঁচু পাকা বাঁধ, কয়েক গজ পর পর বসার ব্যবস্থা। মর্জিনা বলেন, সুন্দর জায়গায় নিয়ে এলে। এই পরিবেশেও তুমি স্বস্তিতে নেই। কেমন যেন একটা চাপের মধ্যে আছো। আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারছো না। আমি যত সহজ-স্বাভাবিক হতে চাইছি, তুমি ততই দূরে সরে যাচ্ছ। আমার সব পরিচয় মাঝে মাঝে ভুলে যাও না কেন, গোয়েন্দা হলেও আমি তো মানুষ। বেশ্যা হলেও মানুষ তো। আমাকে কখনো বউ বানাতে হবে না, প্রেমিকার স্বীকৃতিও চাই না।
তুমি আমাকে নিয়ে ভেবো না, কখনো বিরক্তির কারণ হব না। যখন যা-ই করি পাজেরোর কালো গ্লাস থাকবে, কেউ দেখবে না।
– তার কি প্রয়োজন আছে?
– আছে। অবশ্যই আছে। ঘরে-বাইরে তোমার অনেক বিপদ। চারদিকে মৃত্যুর জাল। তুমি উদাসীন থাকলে চলবে না। তোমার থিসিসটা ভয়ংকর। তোমাকে ছায়ার মতো কেউ একজন অনুসরণ করছে। থিসিস প্রকাশ পেলে লাখ লাখ জন্তু-জানোয়ার ধেয়ে আসবে। জুরাসিক পার্ক দেখেছো, তেমন অবস্থা হবে। এই সময় বউ পাশে থাকলে ভালো হতো।
কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি, থিসিসটা মানবসভ্যতাকে দ্বিধাবিভক্ত করবে। মানবজাতিতে মিশে থাকা প্রাণীরা যখনই নিজেদের আত্মপরিচয়ের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও প্রমাণ পাবে, তখনই তাদের জাতীয়তাবাদ জাগ্রত হবে, সেই পরিস্থিতি ভয়াবহ। অবধারিতভাবেই মানবজাতি তাদের প্রত্যাখ্যান করবে। পরিস্থিতি কি হবে বুঝতে পারছো? আমেরিকা-চীন-ভারত-ফ্রান্স বিষয়টা কীভাবে নেয় তার ওপর নির্ভর করছে আরও অনেক কিছু। ভূ-রাজনীতির দৃশ্যপট পাল্টে যাবে নিশ্চিতভাবে। বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও দার্শনিক যুক্তি-প্রমাণে থিসিস এমনভাবে দাঁড় করিয়েছো- ত্রুটি ধরা বা অস্বীকার করার জো নেই। বিভক্ত পৃথিবী না পারবে ফেলতে, না পারবে গিলতে।
কোত্থেকে এলো, অতীত কি কিছুই জানতে চাইল না। এটাই তো ভালোবাসার শক্তি। অংকন পেরেছে- ধন্যবাদ ডক্টর অংকন।
সিচুয়েশন বলছে, রমিজ-জাফর শিগগিরই তোমাকে শেষ করে দেয়ার চেষ্টায় নেমেছে। তুমি যে রমিজকে দেখো-জানো সে প্রকৃতপক্ষে তা নয়। তোমার সামনে জলো কৌতুক, অশ্লীল গালাগাল করে সং সেজে থাকে। সে গভীর ধূর্ত। তোমাকে কোপানোর এক সেকেন্ডের সুযোগ পেলে সে হাতছাড়া করবে না। আপনা মাংস হরিনা বৈরী- রকিবের এক্সট্রা ট্যালেন্ট তার বিপদের কারণ।
– আমি নিজ থেকে বানিয়ে কিছু বলছি না, থিসিস স্টাবলিস্টমেন্টে টেস্ট, স্ট্যাটিসটিক্স, সার্ভে, সাইকোলজি, হিস্ট্রি, ম্যান্ডেলিজম সব সাপোর্ট করেছে। এটা কোনো আবিষ্কার নয়, অলরেডি এক্সিস্ট। যা কারও ধারণায় ছিল না, আমি শুধু নতুন ধারণাটা দাঁড় করি, এরপর হিসাব মিলিয়ে দিয়েছি।
– তুমি অকারণে কথা বলছো, থিসিসের যৌক্তিকতা, প্রাসঙ্গিকতা, সত্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, সমস্যা শুধু এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে। সেখানে তুমি নিঃসঙ্গ। কাজটা নিঃসন্দেহে মানবজাতির কল্যাণে, কিন্তু বিরোধীরা তোমার বিনাশে মরিয়া হয়ে উঠবে। সে সময় মানবসভ্যতা তোমার পক্ষে দাঁড়াবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়। তুমি ছাইপাঁশ যা-ই বোঝো আর বলো, তোমাকে একলা ছাড়ছি না। প্রেম নয়, দায়বদ্ধতা থেকে। দয়া করে মোবাইলটা খোলা রেখো।
ব্যাংক থেকে অনটেস্ট তোলা ২ লাখ টাকাসহ রাত সাড়ে ১০টার দিকে রকিবকে স্কুলে নামিয়ে সার্কিট হাউসে ফেরেন মর্জিনা। পরদিন স্কুলে মন্ত্রণালয় থেকে লোক আসায় রকিব আটকা পড়েন, উপকূল একা ঘুরে খলিশাপুর ফিরে যান তিনি।
রকিব বিশ্বাস করতে পারছেন না, অংকন এমন একটা অদ্ভুত কাণ্ড করতে পারেন। এমন ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে আন্দাজও করতে পারেননি। মানুষই দুনিয়ার সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় প্রাণী, সবচেয়ে আনপ্রেডিকটেবল। জীবন এত অদ্ভুত কেন? কিছুই ভাবতে পারছেন না রকিব।
বিয়ে করে অংকন-কেয়া সোজা রকিবের রুমে উঠেছেন। কোনো যুক্তি-ব্যাখা দাঁড় করাতে পারেন না রকিব। ঠায় দাঁড়িয়ে দেখছেন। কথা বলতেও ভুলে গেছেন।
অংকন জড়িয়ে ধরে বলেন, এত অবাক হওয়ার কী আছে? পারস্পরিক সমঝোতায় এক জোড়া নারী-পুরুষ যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে, যেকোনো অবস্থায় বৈধ-অবৈধ যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই বাক্যটা তোর কাছ থেকে শিখেছিলাম। বিয়ে তো বৈধ সিদ্ধান্ত। বিয়ে না করলে নিজের প্রতি অবিচার করা হতো। আর অবিচার মানে পাপ। এই কথাটাও তোর।
– আমি কিছুই জানলাম না?
– শোন, তোকে জানানো মানে হলো অনুমতি নেয়া, তা ইচ্ছে করেনি। কেমন যেন অস্থির লাগছিল। চিন্তাভবনা-আলোচনায় অযথা সময়ক্ষেপণ। তুই কি বিরক্ত?
– হুম।
– কেন?
– ঘুমোনোর জায়গা ঠিক না করে বলদের বিবাহ, বিরক্ত হব না?
– গাধার মতো না জেনে কথা বললে তো হবে না, সব ঠিক করে রেখেছি। কাল থেকে পুজোর ছুটি। এই সুযোগে আমরা ঘুরে আসি, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে এর মধ্যে। কিছু না করা গেলে কেয়া তার বাবা-বোনের সঙ্গে থাকবে।
– কোথাও যেতে হবে না, এখানেই থাকবি। আমি টিচার্স ডরমেটরিতে তোর রুমে গেলাম। দেখি কী করা যায়। পেছনে ফাঁকা জায়গা আছে, প্রিন্সিপালের বাসা বানাতে হবে। এর মধ্যে সমস্যা মনে হলে স্কুলের পেছনে বট দীঘির ওপারে ফুপু থাকেন, কেয়া সেখানে থাকবেন। বিশাল বাড়িতে ফুপু একা থাকেন, কেয়ার বাবা-বোনকেও আনা যাবে।
– বাহ্। সব সমাধান তো তোর কাছেই আছে।
– হুম। টোটকা সমাধান। কেয়ার সঙ্গে আমার কথা আছে, তুই বাইরে যা।
ওকে বলে বেরিয়ে যান অংকন।
– শোনেন কেয়া, অংকনকে বিয়ে করে ভালো করেছেন। তাকে বিয়েতে রাজি করাতে পারছিল না কেউ, বয়স ধেই ধেই করে বেড়েই চলছিল। তার মা বেঁচে থাকলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। কাজের কথা বলি, স্কুলের চাকরিটা চালিয়ে যাবেন কিনা, নিজে ভেবে সিদ্ধান্ত নেবেন। যতটা বুঝি, এ নিয়ে অংকনের কোনো মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। আরেকটা কথা, ঘটনা জাফর উল্লাহ জানলে ঝামেলা করতে পারেন, সেটা আমি দেখব। তিনি এ যাবৎ আপনাকে কত টাকা দিয়েছেন হিসাব করে আমাকে জানাবেন, আমি তাকে পরিশোধ করে দেব। মনে রাখবেন, টাকাটা আমি পরিশোধ করব, অংকন বা আপনি না। জাফর বিষয়ে অংকন তত কিছু জানে না, বলবার দরকারও নেই। অংকন একাডেমিশিয়ান, জাস্ট একজন গণিতবিদ, সমাজ-সংসার-রাজনীতির কানাকড়িও বোঝে না। জীবনে কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলেনি, বলতে জানেও না।
– মনে থাকবে।
– কাল আমার সাবেক কলিগ ফাহমিদা আসবে। অনেক বিষয়ে উৎসাহ তার, অন্তহীন প্রশ্ন করবে। কী বলবেন জানি না, তবে…। আচ্ছা থাক। বিষয়টা আপনার জানা রইল।
বইপত্র নিয়ে টিচার্স ডরমেটরিতে অংকনের রুমের দিকে যান রকিব। দীর্ঘ বারান্দা পেরোতে অংকনকাণ্ডে গভীর ভাবনায় পড়েন। ভালোবাসা বিধাতার অদ্ভুত সৃষ্টি। প্রেম মানুষকে অন্য জগতে নিয়ে যেতে পারে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে দেয়। শুধু মানুষ নয়, সম্ভবত জগতের সব প্রাণী ভালোবাসা ইস্যুতে অভিন্ন। কঠোর শৃঙ্খলা ও আইন মেনে চলা- অংকন সব ভুলে গেল। মেয়েটা কে, কোত্থেকে এলো, অতীত কি কিছুই জানতে চাইল না। এটাই তো ভালোবাসার শক্তি। অংকন পেরেছে- ধন্যবাদ ডক্টর অংকন।
ইদানীং অবশ্য ক্লোনিং এসেছে, বাট সভ্যতা এ পর্যায়ে আনতে মেয়েদের প্রয়োজন ছিল।
বাসররাতে প্রবেশ করেন কেয়া-অংকন। অন্যরকম বাসরঘর। ফুল নেই, ঘ্রাণ নেই, নতুন শাড়ি নেই, শেরোয়ানি নেই- ঘরজুড়ে এলোমেলো বই আর বই। তবু, কি যে মায়া, কেমন যেন মন মাতানো ভালো লাগা। শরীরজুড়ে অদ্ভুত রোমাঞ্চ। চোখে অনন্ত বিস্ময়। অংকন তোতলানোর ভয়ে কথা বলছেন না। আর কেয়া জড়তায়। দীর্ঘ সময় কাটল শব্দহীন। অংকন সাহস করে বলেন, প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে আজকের ক্ষতি পুষিয়ে দেব।
– মানে কী?
– হুড়োহুড়িতে বাসররাতের কোনো আয়োজন করতে পারিনি। আত্মীয়স্বজনের বিয়েতে দেখেছি, বিয়ে-বাসরে কত আয়োজন, হুলুস্থূল, অথচ আপনার সম্মানে কোনো ব্যবস্থা করা গেল না। ভুলত্রুটি মার্জনা করতে যদি আপনার সহৃদয় মর্জি হয়, কৃতজ্ঞ থাকব।
– আপনি দেখি প্রিন্সিপাল বরাবর দরখাস্তের মতো কথা বলতেছেন।
– কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। দুঃখিত। আমি খুবই লজ্জিত। বিবাহের প্রস্তাবে আপনি রাজি হবেন ভাবতেই পারি নাই। দুপুরে কিছু না ভেবে হুট করে বলে ফেলে ভালো করেছি, তাই না? এভাবে না বললে কখনোই বলা হতো না। বিয়ে জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর, বিষয়টা আরও আগে অনুধাবন জরুরি ছিল, অধিক বিলম্ব হয়ে গেছে। বিয়ে একটি বেসিক ইকুয়েশন, এ প্লাস বি হোল স্কয়ার ফর্মুলার মতো, এটা এলজাব্রারার প্রথম সূত্র। অবশ্য অঙ্ক করতে গেলে ফান্ডামেন্টাল আরও কিছু সূত্র লাগে। একধরনের অঙ্ক আছে ঐকিক নিয়ম, ছোটবেলায় শিখেছিলাম, অঙ্কটা জনসাধারণের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক কাজে লাগে।
– আপনি যা মুখে আসছে তাই বলতেছেন। পানি খান বেশি করে, মাথা শান্ত করেন। অঙ্ক ছাড়া কোনো কথা নাই? আমাকে আপনি আপনি করছেন ক্যান? বউকে কেউ আপনি ডাকে? ‘তুমি’ করে বলেন।
– তাই তো, এত সময় আপনি করে বলেছি, বিষয়টা মাথায় আসেনি। আপনিও আমাকে তুমি বলতে পারেন, তাই না?
– একট গান শুনবা? বাঙালি মেয়েদের প্রাণের গান। প্রতিটা মেয়ে সারাজীবন মনে মনে ব্যাকুল হয়ে এই গানটা গায়-
ও বন্ধুরে প্রাণ বন্ধুরে
কবে যাব তোমার বাড়ি
পিন্দিয়া গোলাপি শাড়ি
টিকলি মাথায় ঘুমটা দিয়া রে।
আমি বধূ সেজে বসে আছি
তোমার পথ চেয়ে
তুমি আসবে কবে বাজবে সানাই
যাবে আমায় নিয়ে।
সয়না আমার সয়না যে আর
পারি না পারি না যে আর
থাকতে একা ঘরে।
আমি স্বপ্ন দেখি ফুল সজ্জা
লজ্জাতে যাই মরে
তুমি জড়িয়ে আছ বুকে আমায়
সারাটি রাত ধরে।
দিন কাটে না রাত কাটে না
কোন কাজে মন লাগে না
বাঁচবো কেমন করে।
– অনেক সুন্দর ভালোবাসার গান। কাজী নজরুল ইসলাম অনেক সুন্দর গান লিখেছেন, আগে শুনিনি। আমাদের জাতীয় কবি। বিদ্রোহী নামে তার একটা কবিতা আছে, ইউনিভার্সিটির অনুষ্ঠানে একবার শুনেছিলাম, শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেছে।
– সমস্যা কি তোমার? এটা নজরুলগীতি হতে যাবে কোন দুঃখে? বাংলা সিনেমার গান। রুনা লায়লা গাইছেন, অভিনয় করছেন সুচরিতা। তোমার আজ কি হয়েছে? অন্যদের সঙ্গে বাংলা-ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলতে দেখেছি, এখন এমন করছ কেন? আমি তো তোমার বউ, নাকি? সহজ হও।
– অবশ্যই, অবশ্যই শতভাগ সহজ-স্বাভাবিক হওয়া উচিত। এক সপ্তাহে মধ্যে সহজ হতে হবে।
– কোর্স আকারে নিচ্ছো কেন? এক সপ্তাহ লাগবে কেন, এখনই স্বাভাবিক আচরণ করবে। ‘তুমি’ করে বলো।
– হ্যাঁ, ‘তুমি’ করেই তো বলা দরকার। এই শব্দটার মধ্যে একজাতের ঘনিষ্ঠতা আছে, মানে কাছাকাছি যাবার সেতুর মতো। তবে সেতুটা অপটিকেল ফাইবারের মতো, ভেরি সেনসিটিভ। ইলেকট্রনের প্রবাহও বলা যেতে পারে। ফিজিক্সে কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে স্রোডিংগারের বিড়ালের সঙ্গে তুলনা করা হয়। একটু ব্যাখ্যা করার সুযোগ পেলে ভালো হতো, সেতুর ব্যাপারটা আরেকটু ক্লিয়ার করা যায়।
– থামো প্লিজ। ‘তুমি’ বলা এড়াতে এবার ভাববাচ্যে শুরু করলে। মেয়ে মানুষ কোনোদিন চোখে দেখোনি? এমন নার্ভাস হলে কেন?
– নার্ভাস হইনি তো। কেন যেন কাছাকাছি যেতে পারছি না। ওই যে একটা সেতুর কথা বললাম, খুবই সূক্ষ্ম সেতু। মুসলিম সাহিত্যে একটা সেতুর উল্লেখ আছে, নাম পুলসিরাতের পুল। সেই সেতু থেকে পড়ার অর্থ নরকে নিমজ্জিত হওয়া। তেমন একটা সেতুর মুখে পড়েছি, কিছুতেই উঠতে পারছি না, পায়ে পা জড়িয়ে পড়ে যাচ্ছি। আগেও এমন হয়েছে।
– তার মানে আগেও মেয়েদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছো।
– না, ঠিক সেভাবে নয়। তবে মেয়েরা অনেক ভালো মানুষ। মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ রোল। ইদানীং অবশ্য ক্লোনিং এসেছে, বাট সভ্যতা এ পর্যায়ে আনতে মেয়েদের প্রয়োজন ছিল।
– শুধু প্রজননের জন্য মেয়ে? আর কিছু নয়?
– শুধু তা হবে কেন, প্রজননে তো ছেলে-মেয়ে দুই-ই দরকার।
– এই রাতে অন্তত বিজ্ঞান-গণিত বাদ দাও।
চলবে…
আরও পড়ুন: খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-১৫॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন