পর্ব-১৪
অধ্যাপক ফাহমিদা ক্যাম্পাসে নিজ কক্ষে ল্যাপটপে মেইল খুলে দেখেন, থিসিসের খসড়া পাঠিয়েছেন রকিব। বিশাল লেখা, স্ক্রল করতে থাকেন। কেইস থ্রিতে চোখ আটকা পড়ে, কুকুরের সবচেয়ে ঘৃণিত স্বভাব হলো স্বজাতির প্রতি হিংসাত্মক আচরণ। একই চেহারার বলে রমিজ মানুষকে তার স্বজাতি ধরে নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে রমিজের স্বভাব প্রচ্ছন্ন এবং অন্তর্গত, কিছুতেই প্রকাশ পায় না। কুকুরের অন্যসব গুণাবলি তার প্রকট এবং প্রকাশ্য, যেমন বন্ধুবাৎসল্য। উদারহণ- সঙ্গে কুকুর থাকলে জীবনে ডিপ্রেশন কী জিনিস কেউ টের পাবে না। বিষণ্নতা প্রকাশ না করলেও তারা বুঝে যাবে, আপনি বিষণ্ন। তখন তারা বিচিত্র কিছু কাণ্ড করে, সেসব খুবই মজার। কুকুরের এমন কর্মকাণ্ড সঙ্গীকে বিষণ্ন হতে দেয় না। এ কারণে আমার (রকিব) মতো নিঃসঙ্গ রোগী অনায়াসে তার (রমিজ) বন্ধু হয়ে ওঠে।
পৃথিবীতে মানুষের প্রথম বন্ধু প্রাণী হয়েছিল কুকুর। গুহা যুগ থেকে মানুষের সঙ্গে কুকুরের বন্ধুত্ব। হাজার বছর ধরে মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করেও কুকুর মানুষের ভাষাটা শিখতে পারেনি। তবে মানুষের মনের কথা টেলিপ্যাথির মাধ্যমে বোঝার সক্ষমতা অর্জন করেছে। এই ক্ষমতা রমিজের প্রকট। এই ইস্যুতে তার সঙ্গে আমার বন্ডিং তৈরি হয়ে গেছে।
মানুষের রোজকার ব্যবহার ও আচরণ দেখে দেখে কুকুর চিন্তা করে। মানুষ স্বতন্ত্রভাবে চিন্তা করে, কুকুর সেভাবে পারে না। আলাদাভাবে চিন্তা করে কিছু আবিষ্কার করতে পারে না। কুকুর শুধু মানুষের জীবন অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করে থাকে। কুকুর স্বপ্ন দেখে। গবেষণায় শক্ত প্রমাণ মিলেছে, কুকুর শুধু স্বপ্নই দেখে না, তারা হাঁটা-চলার মতো কাজের স্বপ্ন দেখে, ঠিক মানুষের মতো। কলম্বিয়ার মনোবিজ্ঞানী স্ট্যানলি কোরেন জোর দিয়ে বলেছেন, কুকুর অবশ্যই স্বপ্ন দেখে।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গবেষক ম্যাথিউ উইলসন বলেন, ঘুমের মধ্যে কিছু বিষয় থাকে যা শেখা ও স্মৃতি ধরে রাখার কাজ করে। কুকুরদের আরইএম স্তরের ঘুম হয় ২০ মিনিট ধরে, যা ঝিমোনোর মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়। এই স্তরে দুই-তিন মিনিট পর্যন্ত স্বপ্ন দেখতে পারে কুকুর। এ সময়ের মধ্যে কেউ কুকুরটাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বুঝতে পারবে। এ সময় তাদের নিশ্বাস এলোমেলো হবে। কুকুর ও মানুষের মস্তিষ্কে পনস নামে একটি অংশ রয়েছে, যা ঘুমের সময় দেহের পেশির বড় একটি অংশকে অসাড় করে দেয়। সময়টা স্বপ্ন দেখার আদর্শ অবস্থা।
গবেষণায় দেখা গেছে, পনস অফলাইনে চলে গেলেই কুকুর স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কুকুর দুঃস্বপ্নও দেখে। হঠাৎ মস্তিষ্কের ঘুমিয়ে পড়ার সমস্যাও হয় তাদের। এ অবস্থাকে বলা হয় নারকোলপসি। রমিজের সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে বসবাসের অভিজ্ঞতা বিস্তৃত। এর মধ্যেই মানুষ, রমিজ ও কুকুরের মধ্যকার মধ্যমিল এবং অন্তমিল স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে।
ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড সংক্ষেপে ডিএনএ একটি নিউক্লিক অ্যাসিড, যা জীবদেহের গঠন ও ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণের জিনগত নির্দেশ ধারণ করে। সব জীবের ডিএনএ জিনোম থাকে। কোষে ডিএনএর প্রধান কাজ দীর্ঘকালের জন্য তথ্য সংরক্ষণ। জিনোমকে নীলনকশার সঙ্গে তুলনা করা হয়। কারণ, এতে কোষের বিভিন্ন অংশে যেমন- প্রোটিন ও আরএনএ অণু গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি থাকে। ডিএনএর যে অংশ এ জিনগত তথ্য বহন করে তাদের বলে জিন।
রমিজের ডিএনএ পরীক্ষায় মিলেছে জটিল তথ্যের সিরিজ।
আধুনিক বিশ্বের অন্যতম চমক প্রাণিজগতের সংকরায়ন। একই গোত্রের দুটি আলাদা প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে সংকরায়নের ফলে উভয় প্রাণীর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নতুন একটি প্রাণীর সৃষ্টি হয়। রমিজের পূর্বপুরুষ অর্থাৎ মাত্র তিন পুরুষ আগে ঘটেছে বিস্ময়কর ঘটনা। একই গোত্রের না হয়েও সংকর প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে। অর্থাৎ রমিজের দাদার বাবা ছিলেন সংকর প্রাণী। তার উদ্ভব মানুষ ও কুকুরের সংকরায়নে। অনেক সময় সংকরায়িত প্রাণীর এমন সব নতুন বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, যা তার পিতা-মাতা থেকে স্বতন্ত্র। এ ক্ষেত্রে তাও ঘটেনি। সংকরায়িত প্রাণীটি একপাক্ষিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ বজায় রেখেছে। তবে কথা আছে, এ ক্ষেত্রে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কিছু প্রাণীর উদ্ভব হয়ে থাকতে পারে, যাদের মানুষ বাঁচতে দেয়নি। কারণ, মানুষের গর্ভ থেকে মানুষ আকৃতির প্রাণী ছাড়া অন্য কিছু মানবসভ্যতা আজও অনুমোদন দেয়নি। এখনো হয়তো হচ্ছে, কিন্তু টিকে থাকতে পারছে না। যে কারণে বাণিজ্যিকভাবে বন্য প্রাণীর সংকরায়ন সম্পূর্ণ অবৈধ। কারণ, তা প্রাকৃতির স্বাভাবিক খাদ্যশৃঙ্খল ও বাস্তুসংস্থানের ওপরে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। প্রাণীর মূল জাত বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়।
বেশ্যা চরিত্রে পারফেক্ট। তদন্তে বেরিয়েছে, তিনি দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন বেশ্যাপল্লিতে। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় শুয়েছেন অনেক খদ্দেরের সঙ্গে। সেখানে অভিনয় ছিল না, অন্যদের মতো স্বাভাবিক ও প্রাঞ্জল, পল্লির অন্য বেশ্যারা যেভাবে উপার্জন করেন।
রমিজের জলাবদ্ধ জন্মস্থানে জন্মানো কুকুরের ডিএনএ পরীক্ষায় এসেছে আরও বিচিত্র তথ্য। সেসব কুকুরের বংশাণুক্রমিক ইতিহাস অন্য এলাকার কুকুরের সঙ্গে মেলে না। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্রিয়তা বিদ্যমান। যা রমিজের জিনের রিপোর্টের সঙ্গে হুবহু মিল। এখানে মেন্ডেলের তত্ত্বের একটু ব্যাখ্যা না দিলে ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ থাকবে, পার্টিকুলেট থিওরি বা মেন্ডেলতত্ত্ব অনুযায়ী জীবে বংশগতির একক বিদ্যমান থাকে বা মিশ্রিত হয় না, শুধু সুপ্ত থাকে। মেন্ডেলের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, মূল প্রাণীর প্রতিটি চরিত্রের জন্য একজোড়া ফ্যাক্টর থাকে, যার একটি আসে পিতা থেকে এবং অপর একটি আসে মাতা থেকে। গ্যামিটে শুধু একটি একক উপস্থিত থাকে এবং পরবর্তী জনুতে সঞ্চারিত হয়। মেন্ডেল বর্ণিত পার্টিকল বা ফ্যাক্টর অবশ্যই জিন। আর একটি মাত্র জিন দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত বৈশিষ্ট্য মেন্ডেলিয়ান বৈশিষ্ট্য। মেন্ডেলিয়ান বৈশিষ্ট্যর সঞ্চায়ন মেন্ডেলিয়ান বংশগতির সূত্র অনুসরণ করে।
প্রথমত সংকর জীবে বিপরীত বৈশিষ্টের জিনগুলো মিশ্রিত বা পরিবর্তিত না হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে এবং জননকোষ সৃষ্টির সময় পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত দুই বা ততোধিক জোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্যের জীবের মধ্যে সংকর ঘটলে প্রথম সংকর পুরুষে শুধু প্রকট বৈশিষ্ট্যগুলোই প্রকাশিত হবে, কিন্তু জননকোষ উৎপাদনের সময় বৈশিষ্ট্যগুলো জোড়া ভেঙে পরস্পর থেকে স্বতন্ত্র বা স্বাধীনভাবে বিন্যস্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জননকোষে প্রবেশ করে।
এক জোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবে সংকরায়ন ঘটালে প্রথম অপত্য বংশে সংকর জীবে ওই বৈশিষ্ট্য দুটির যেটি প্রকাশিত হয় তাকে প্রকট বৈশিষ্ট্য এবং যে বৈশিষ্ট্য সুপ্ত থাকে তাকে প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য বলে। আর যখন কোনো ক্রসে মাত্র একজোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জিন বিবেচনা করা হয় তাকে এক সংকর ক্রস বলে। অপরদিকে কোনো ক্রসে দুই জোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জিন থাকে তখন তাকে দ্বি-সংকর ক্রস বলা হয়।
রমিজের ব্যাপারটা খুবই চমকপ্রদ। অবয়বে তার মাতৃতান্ত্রিক বৈশিষ্ট প্রকট অথচ মনোজাগতিক এবং নিউরাল স্ট্রাকচারে প্রচ্ছন্ন। প্রকারান্তরে, বাহ্যিক আকারে আদি পিতৃতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রচ্ছন্ন অথচ নিউরোলজিক্যাল প্যাটার্ন অত্যন্ত প্রকট। এ কারণে রমিজ আকৃতিগত দিক দিয়ে সম্পূর্ণ মানবসদৃশ কিন্তু আসলে সে একটি ভিন্ন প্রাণী। সে না কুকুর না মানব। ডিএনএ রিপোর্ট বলে, রমিজের তিন ধাপ আগের উৎপাদক সৃষ্টির জাইগোট গঠনের শুক্রাণু কুকুরের আর ডিম্বানু মানুষের। তার গ্রামের কুকুরের ডিএনএ টেস্টে প্রাপ্ত প্রতিবেদন একই। রমিজের আত্মীয় জাফর উল্লাহর ব্লাড স্যাস্পলের রিপোর্টও অভিন্ন। সিম্পল র্যানডম স্যাম্পলিং সংক্ষেপে এসআরএস থেকে প্রাপ্ত ওই গ্রামের দুই শ মানুষের রক্তের নমুনা জরিপে দেখা গেছে, ৮ শতাংশ মানুষ রমিজ ও জাফরের আদলে সংকর প্রাণী। স্যাম্পলিংয়ে পপুলেশন ধরা হয়েছে ওই গ্রামে অবস্থানকারী এবং দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকাদের।
খলিশাপুর রমিজ-জাফরের গ্রাম। সরেজমিনে সেখানকার ভূপ্রকৃতি, জনজীবন, মানবাচার, চরিত্র বিশ্লেষণে প্রাপ্ত ডেটার সঙ্গে রক্তের নমুনার ল্যাব থেকে প্রাপ্ত রিপোর্টে বেসাদৃশ্য ৫ শতাংশ, যা পরিসংখ্যানের এসআরএস পদ্ধতিসংশ্লিষ্ট বিন্যাস ফর্মুলা সফল জরিপ বলে অনুমোদন দিয়েছে। গ্রাম থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তমতে, দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময়টা রেডমার্ক। তখনই সেখানে মানবিক বিপর্যয় ঘটে।
অবিভক্ত বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তর নামের বীভৎস দুর্ভিক্ষটা শুরু হয় ১৯৪৩ সালে। বাংলা বছরের হিসাবে ১৩৫০ বঙ্গাব্দে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকারের তীব্র অর্থনৈতিক শোষণে এই মন্বন্তর বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করেছিল। একটি যুদ্ধ অনন্তকালের জন্য দুনিয়াটাকে শেষ করে দিয়েছিল। দুনিয়ায় যারা বেঁচে আছে তারা প্রতিদিন মরছে।
পঞ্চাশের মন্বন্তরে মৃতের সংখ্যা প্রকাশ করেনি ব্রিটিশ সরকার। ইচ্ছা করে করেনি। তবে দুর্ভিক্ষে ন্তত ৪০ থেকে ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। মৃতদেহ সৎকারের লোক ছিল না। মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মাংসে শকুন, শিয়াল, কুকুরেরও অরুচি ধরে। মন্বন্তরের একপর্যায় চূড়ান্ত মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে। কুকুরের সঙ্গে লড়াই করে ডাস্টবিন থেকে মানুষ উচ্ছিষ্ট খেতে শুরু করেছিল। মানুষ তার প্রিয়জনকে মৃত্যুদশায় ফেলে বাঁচার তাগিদে বাড়ি ছাড়ে। অভাবের জ্বালায় অনেকে স্ত্রী-সন্তান বিক্রি করেছিল।
ওই দুর্ভিক্ষের মধ্যে খলিশাপুর গ্রামে বিশেষ জাতের কুকুরের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন অসংখ্য নারী। রমিজ-জাফরের ডিএনএ টেস্ট রিপোর্ট সময়সংক্রান্ত একই তথ্য দিয়েছে।
ফাহমিদা থিসিসে মাউস স্ক্রল করতে থাকেন। অবজারভেশনের পর অবজারভেশন। কমেন্টের দিকে নামেন। আবার চোখ আটকা পড়ে, রমিজ-জাফরদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। এদের প্রজননক্ষমতা উচ্চ। বিশ্বে প্রথম মানুষ ও শুয়োরের সংকর প্রাণীর জন্মের ঘটনায় আঁতকে উঠেছিলেন বিজ্ঞানীরা।
বায়োলজিস্ট ইঝপিসুয়া বেলমঁতের নেতৃত্বে আমেরিকার সান দিয়েগোর সাল্ক ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল স্টাডিজ এবং স্পেনের ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব মার্সিয়ার গবেষক দল গবেষণাটি করেছিল। পরীক্ষাটি জন্ম দিয়েছে বহু বিতর্কের। তখন শঙ্কা ছিল-অদূরভবিষ্যতে তো এমন শুয়োরের জন্ম হতে পারে, যার মগজ বা মস্তিষ্কটা হবে ঠিক মানুষের মতোই উন্নত। হয়তো একদিন ওইভাবে শুয়োর জন্মাবে মানুষের মুখের আদল নিয়েই। হিউম্যান জেনেটিক্স অ্যালার্টের বস ডেভিড কিং বলেছিলেন, এই গবেষণার ফলে খুবই বিব্রতবোধ করছি। উদ্বিগ্নও বটে। অশনিসংকেত দেখতে পাচ্ছি।
ঘটনাটি আর শঙ্কা পর্যায়ে রইল না, অশনিসংকেতের বিপর্যয় ঘটে গেছে। এরা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে বহু আগ থেকে। এখন এরা মানবসভ্যতার পক্ষে যাবতীয় উপকরণের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল যুদ্ধটা বাঁধবে মানুষের সঙ্গে সংখ্যায় যেদিন এরা সমান হবে। যথাশিগগির এদের কোয়ারিনটিন অনিবার্য হলেও আপাত দৃষ্টিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন ইস্যু প্রধান অন্তরায়। রাষ্ট্রব্যবস্থা পড়তে যাচ্ছে জটিল উভয়সংকটে, সেই দিনের আর বেশি বাকি নেই।
থিসিসের অবজারভেশনে রয়েছে কয়েকটি অমীমাংসিত ইস্যু। মর্জিনা ইস্যুটি উল্লেখযোগ্য। তার প্রকৃত নাম মেরি জেনিফার। বাংলাদেশে নাম মর্জিনা বেগম আর ভারতে কুসুম বালা। মর্জিনা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পদস্থ কর্মকর্তা। তবে তার জন্মস্থানের সন্ধান মেলেনি। তিনি দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা। বাংলা, হিন্দি, তেলেগুসহ সাতটি ভাষা জানেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা।
মার্কিন স্যাটেলাইটে প্রথম ধরা পড়েছিল, খলিশাপুর একটি বিশেষ গ্রাম। গ্রামটি মাঝে মাঝে স্যাটেলাইট থেকে উধাও হয়ে যায়, আবার ফিরে আসে। এই গ্রাম ঘিরে আকাশে অবিরাম ঘূর্ণায়মান থাকে ঘণপুঞ্জিভূত মেঘমালা। গ্রামের ভূ-অভ্যন্তরে গোপন অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে তেলের বিশাল মজুত। একই তথ্য রাশিয়া-চীন জানে। জানে না শুধু গ্রামবাসী। সেখানে ভূগর্ভস্থ শিলাস্তর বেশ ভালনারেবল, তিনটি প্লেটের ওপর গ্রামটি অনেকটা লাটিমের মতো, যা সবসময় দুলতে থাকে। এই দোলা গগন শিরীষতলায় বেশি অনুভূত হয়। ভূ-অভ্যন্তরে কুড়ি-ত্রিশ কয়েক গজ নামলেই মিথেন গ্যাসের সন্ধান মেলে। জলাশয়ে মিশতে থাকে মিথেন, এ কারণে মাছ, সাপসহ জলজ প্রাণী টিকতে পারে না। বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইডের আধিক্য, বিষাক্ত এই পদার্থের উৎপত্তি কোথায় জানা গেলো না।
মর্জিনা জীবন-যৌবন পার করে দিলেন বিপন্ন এই অজপাড়াগাঁয়। মর্জিনার মতোই অদ্ভুত মার্কিন সিআইএর কার্যক্রম। বাংলাদেশের তেলের খনি নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। একটি মেয়েকে বছরের পর বছর বসিয়ে রেখেছে; কে জানে, এমন হয়তো আরও আছে। চীনও হয়তো একই কাজ করছে। যদি তাই হয়, রাশিয়াও সক্রিয় হওয়া উচিত। মর্জিনা সিআইএর পারফেক্ট সিলেকশন। পেশার প্রতি তার ত্যাগ ও দক্ষতা দেখে মার্কিন গোয়েন্দাদের প্রতি সম্মান বাড়ে বৈকি। পৃথিবী শাসনের শতভাগ অধিকার এই জাতির, তাতে কোনো সংশয় নেই।
মর্জিনা রহস্য শেষ পর্যন্ত অভেদ্য। তার গল্পের সত্যতা মিলেছে, তবে উৎপত্তির হিসেব মেলেনি। যেকোনো বাঙালির চেয়ে বাংলা তিনি ভালো জানেন। শাড়ি পরায় সুনিপুণ। সে ভারতীয় সীমানাদ্ভূত, তবে ঔরষত্ব নিশ্চিত করা কঠিন। অভিনয়ে দক্ষ, যা গোয়েন্দাগিরির প্রধানতম শর্ত। অভিযোজন ক্ষমতা অসীম। বেশ্যা চরিত্রে পারফেক্ট। তদন্তে বেরিয়েছে, তিনি দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন বেশ্যাপল্লিতে। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় শুয়েছেন অনেক খদ্দেরের সঙ্গে। সেখানে অভিনয় ছিল না, অন্যদের মতো স্বাভাবিক ও প্রাঞ্জল, পল্লির অন্য বেশ্যারা যেভাবে উপার্জন করেন।
থিসিসের নামে প্রেম-প্রেম খেলার মানেটা কী। নারী শরীরের প্রতি উন্ন্যাসিকতা ওর ভণ্ডামি। মর্জিনার মতো উঁচুদরের রঙিলা পেলে আর হুশ থাকে না। নিশ্চয়ই প্রেম হয়েছে।
যতদূর জানা যায়, সিআইএ তাকে নাগরপাড়া থেকেই পিক করেছে, সেই কিশোরীকালে। পরে শক্ত ট্রেনিং-কোর্স শেষে ফিরিয়ে দিয়েছে। কত দিনের কোর্স জানা যায়নি, তবে মহাকাশের স্যাটেলাইট থেকে শুরু করে কোষের ক্রোমোজোম, ডিএনএ হয়ে জিন পর্যন্ত পড়িয়েছে। মর্জিনাকে ডিল না করলে সিআইএর গভীরতম কার্যক্রম অজানা রয়ে যেত। শুধু রাশিয়াকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র যত জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করে, জেনে স্তম্ভিত হতে হয়। সিআইএ কর্মীদের জাদুবিদ্যা পর্যন্ত শেখায়, মর্জিনা তা-ও জানেন।
এই পর্যয়ে ফাহমিদা থামেন। রাশিয়ার এজেন্ট রকিব এত সব জানল কীভাবে? সিআইএর ফার্স্ট প্রায়োরিটি সিক্রেসি, তেমনটাই দুনিয়াজুড়ে সিদ্ধ। তবে কি মর্জিনা তাকে এসব বলেছেন? সেধে সেধে বলার কথা নয়। রকিব তো থিসিসের কোণে কোণে সিআইএর হাঁড়ির খবর জানিয়ে দিচ্ছে রাশিয়াকে। এমন ঘটবে, মর্জিনা জেনেও তাকে এসব বলেছেন? অবিশ^াস্য ঠেকছে। তাদের প্রেমট্রেম হয়ে যায়নি তো? প্রেম হলেও সিআইএ এজেন্টের মুখ দিয়ে গোপনীয়তা ফাঁস হওয়ার কথা না। পুরো ব্যাপারটা বেশ ঘোলাটে। তবে কি সিআইএর চেয়ে মস্কোর এফএসবি এজেন্ট রকিব অধিক শক্তিশালী ও চৌকস? আমেরিকা-রাশিয়ার জটিল কূটনীতি মেলাতে বসলে পাগল হয়ে যেতে হবে।
ওর থিসিসে তেমন কারেকশন নেই, কোথাও খটকা লাগেনি, নিখুঁত কাজ। তবে এই থিসিস বিস্তৃত ঝামেলা বাঁধাবে। মিলিত মানুষ এবং প্রত্যেক মানুষ বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়বে। থিসিসের এক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মানবসংশ্লিষ্ট নয়া প্রাণীর উদ্ভব শুধু খলিশাপুরে নয়, আফ্রিকা মহাদেশের অনেক অঞ্চলে ঘটেছে। দক্ষিণ আমেরিকায়ও আছে। তবে সময়টা ধরা জটিল হয়ে পড়েছে, কয়েক শতাব্দী ধরে চলতে পারে। হতে পারে বিশেষ ধরণের ক্রোমোজোম সম্পন্ন কুকুর প্রজাতি উদ্ভবের পর থেকে। চীন, উত্তর কোরিয়া ও উত্তর আমেরিকা ল্যাবে পরিকল্পিতভাবে এই নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে।
রাশিয়ার জন্য এই থিসিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিআইএ দুনিয়াজুড়ে এ নিয়ে কাজ করছে। রাশান এফএসবি বসে নেই। থিসিসটা পেলে রাশিয়া কি করবে বোঝা যাচ্ছে না, তবে সংবাদ সম্মেলন করে দুনিয়াকে ফলাও করে জানান দেবে, মার্কিনিসহ অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠী পলিউটেড। তাদের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ মানুষ নয় সংকর প্রাণী। আরও মতলব থাকতে পারে।
থিসিস প্রকাশ পেলে ডিএনএ টেস্ট নিষিদ্ধ হয়ে নিয়ন্ত্রণ নেবে সরকার। আরও ঘটনা ঘটবে, বাড়বে অবিশ^াস, অস্থিরতা। সরকার কী করবে তা-ই দেখার বিষয়। পুরো বিষয়টা অনুধাবন করে নিয়ন্ত্রণে নিলে ভালো করবে। আমজনতা বুঝে-না বুঝে লাফাবে।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা ও পরামর্শ উল্লেখ আছে থিসিসে। অবশ্যই মানবাকৃতির সংকর প্রাণী শনাক্ত করে মূল জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করে কোয়ারেনটিনে নিতে হবে। তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করলে হিতে বিপরীত ঘটনা ঘটতে পারে। তাদের ক্ষেত্রে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন মানতে হবে মানব জাতিকে। সেসব সংকর প্রাণীর সঙ্গে মানুষের যৌনক্রিয়া তাৎক্ষণিক রোধ অনিবার্য। পাশাপাশি সেই সব সংকর প্রাণীর উচ্চ প্রজনন ক্ষমতা হ্রাসে উদ্যোগ নিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। মোটকথা তাদের উৎপাদনের লাগাম টেনে ধরতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা বিশ্বব্যাংক কী পদক্ষেপ নেয় তাও দেখতে হবে। তবে তাদের নিজস্ব সুবিধামতো সিদ্ধান্তের দিকে চেয়ে বসে থাকলে ক্ষতি বাড়তে থাকবে।
থিসিসের রেজাল্টের ওপর ত্বরিত সিদ্ধান্ত না নিয়ে রকিব কেন এই কাজ করতে গেল তা নিয়ে মাতামাতি করে সময়ক্ষেপণ হবে নির্বুদ্ধিতা। থিসিস যাদের বিরুদ্ধে যাবে তারা নির্ঘাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠবে, রাস্তায় নামবে। সেই ক্ষেত্রে রকিবকে দ্রুত পুলিশের হেফাজতে নেয়াই হবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের প্রথম ধাপ। এতে একটি লাভ হবে, প্রথম ধাক্কায় অনেক লোক ডিএনএ টেস্ট ছাড়াই শনাক্ত হবে। তাদের বিনা বাক্যব্যয়ে মাঠ থেকে তুলে সেফহোমে নিতে হবে। পরে লিস্ট ধরে তাদের স্বজনদের ডিএনএ টেস্ট চলবে।
থিসিসের একপর্যায়ে মর্জিনার পরিচয়ের প্রমাণ মেলে। উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া সিআইএর গোপন নথিতে মর্জিনার নাম-পরিচয় ছবিসহ আছে। তিনি প্রথম দিকে সিআইএর এজেন্ট ছিলেন, পরে কর্মদক্ষতায় কর্মকর্তা হয়েছেন।
মর্জিনার বিস্তারিত জেনে জ্বালা ধরে ফাহমিদার। ক্ষুব্ধ হয় রকিবের ওপর। বেশ্যার নাম-পরিচয় জানার এত ব্যাকুলতা কেন। সিআইএর গোপন নথি খুঁজে বের করার দরকারটা কী? তাকে হাইপ্রোফাইল প্রমাণ করতে হবে কেন? থিসিসের নামে প্রেম-প্রেম খেলার মানেটা কী। নারী শরীরের প্রতি উন্ন্যাসিকতা ওর ভণ্ডামি। মর্জিনার মতো উঁচুদরের রঙিলা পেলে আর হুশ থাকে না। নিশ্চয়ই প্রেম হয়েছে।
চলবে…
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-১৩॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন