পর্ব- ১৩
ভোরে স্কুলে ফেরেন রকিব। সুপার সাইক্লোনে ব্রহ্মপুর গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ঘরবাড়ি-গাছপালা বিধ্বস্ত। স্কুলে ঝুলছে সাত দিনের ছুটির নোটিশ। অংকন ঝড়ের রাতের বর্ণনা দেন। রকিব বলেন, বাতাস প্রবল ছিল তাই না?
– শুধু প্রবল বাতাস নয়, ঘণ্টায় আড়াইশ-তিন শ কিলোমিটার বেগের তুফান। একপর্যায় মনে হয়েছে স্কুল ভবন টিকছে না, বিপুল প্রাণহানি ঘটতে যাচ্ছে। বাচ্চাদের খোঁজখবর নিতে রুম থেকে বের হওয়ার সুযোগ পাইনি।
– আমি তো জানি, তুফান দেখেছি। বাচ্চারা সবাই ভালো আছে?
– হুম। গণিত ভবন ফাঁকা করে দিয়েছি, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে দুর্গতরা উঠেছে।
– ভালো করেছিস।
– কোথায় ছিলি তুই, মোবাইল ফোন বন্ধ কেন?
-লম্বা কথা। ক্লান্তি লাগছে, পরে বলব।
ক্লান্তি অজুহাত, রকিব খলিশাপুরের ঘটনা অংকনকে কী বলবেন, কতটা বলবেন, আদৌ বলবেন কিনা, ভেবে নেয়ার সময় নিলেন। জাফর উল্লাহর সঙ্গে কথা বলা দরকার। সব বিষয় ঝাপসা হয়ে ঝুলে আছে। থিসিস দ্রুত শেষ করে জমা দিতে হবে, রাশিয়ায় বিশাল ফান্ড আটকে আছে। রেবেকা সুলতানা কেয়ার নিয়োগপত্র তৈরি করতে হবে। রহস্যময়ী মর্জিনা বেগমের বিষয়ে একা একা সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না, অংকনকে বলতেই হবে। ফাহমিদাকে থিসিসের চূড়ান্ত খসড়া দ্রুত পাঠানো লাগবে। ডিএনএ টেস্ট, ক্রোমোজোমের ট্রায়াল আরও হাজারো কাজ জমেছে। নিজের মেয়েটার সঙ্গেও সাক্ষৎ দরকার, সামনে তার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। বহুমুখী চাপে অস্থির বোধ করে রকিব। কাজের শিডিউল ঠিক করেন, প্রথমেই জাফর ইস্যু।
সন্ধ্যায় শহরে মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান রকিব। ডেকে পাঠান জাফরকে। কেন্দ্রের কর্মকর্তাকে বলে তাকে নিয়ে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে নদীর বেড়িবাঁধে যান রকিব। বলেন, কী জাফর সাহেব, ভালো? শরীরের অবস্থা কী? নামাজ-কালাম পড়েন ঠিকমতো?
– আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি স্যার। আল্লাহর রহমতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাতে শরিক হই। সবই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। মানুষের কোনো ক্ষমতা নাই। রাব্বুল আলামিন যা চান, তাই হয়। সবই উছিলা।
– বলেন কী? ধর্ষণ করেন নাই, তবু ধর্ষণের আসামি হইলেন কার ইচ্ছায়?
– আল্লাহ পাকের ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না।
– এই কথা বিশ^াস করেন, নাকি ওয়াজ শুনে বলেন। বুঝে জবাব দিয়েন।
– নাউজুবিল্লাহ। পরম করুণাময়ের একত্ববাদে বিশ^াস স্থাপন ঈমানের প্রথম ধাপ। অবিশ^াস কুফরি।
– খুবই ভালো শপথ। আপনার সঙ্গে নাকি খারাপ জিন আছে? ওই জিন মানুষ মারায় ওস্তাদ?
– আস্তাগফিরুল্লাহ। হত্যাকারী কোনো দিন বেহেশতে যাবে না।
– কোথায় পেলেন এই কথা? নিজের সুবিধামতো হাদিস বানালে তো হবে না। কাফের হত্যার বৈধতা আছে। রফিকরে মারছে কে? আপনি নাকি আপনার সঙ্গের জিনে?
– কোন রফিক?
– মাঝিপাড়ার রফিক মাতবর। তারে পানিতে চুবিয়ে মারা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড আপনি ঘটিয়েছেন। অবশ্য অস্বীকার করতে চাইলে আপনার হাতে একটা অপশন আছে, বলতে পারেন আপনার সঙ্গের জিনে মেরেছে।
চুপসে গেলেন জাফর উল্লাহ। এই হত্যার বিষয়ে রকিব জানলেন কীভাবে, কূল পাচ্ছেন না ভেবে। বেরোবার দরজা-জানালা খোলা রেখে ধর্ষণ মামলা সাজিয়েছিলেন, এবার কী হবে। রকিবের সঙ্গে জিন আছে কিনা, ভাবছেন। সেই জিন অত্যন্ত ভালো বংশের হওয়ার কথা, বিজ্ঞান ও গণিত এক্সপার্টের সঙ্গে বদ জিন থাকার কথা না। এই জিন প্রযুক্তিএক্সপার্ট। সে কোহকাফ থেকে আসে নাই, অন্য জায়গার হবে। জিন কি তবে অন্ধকারে হত্যার দৃশ্য নিজ চোখে দেখল? কাক-পক্ষীজানে না, অথচ স্যারে জানে, কেমনে কী?
– কী ভাবছেন জাফর সাহেব? কিছু একটা বলেন। বুঝব কীভাবে হত্যাকারী আপনি কি-না?
– আপনাকে সব বলব স্যার। আমাকে কয়টা দিন সময় দেন, সব বলমু ইনশাল্লাহ। আপনার কাছে প্রাণভিক্ষা চাই।
– এবার ধর্মের সত্যটা শোনেন, মানুষ প্রাণ দিতে পারে না, নেয়ার অধিকারও নেই। মানুষ মানুষকে হত্যা করার কোনো অনুমোদন নেই। তাই হত্যার বিচার মৃত্যুদণ্ড। আমি প্রাণ দেয়ার কেউ না। নিজের বিচার নিজেকেই করতে হবে। যদিও আপনাকে এখানে ধর্মের অমিয় বাণী শোনাতে আনা হয়নি। আপনার বিচার কী হবে আমি জানি না, সেই রায় আদালত দেবে। আমি শুধু একটি কথা জানতে চাই, আপনি সত্যি বলতে পারেন, মিথ্যার আশ্রয়ে চলে যেতে পারেন। যাই বলবেন, পরিণতি ভেবে নেবেন অত্যন্ত ভালোভাবে। কারণ, বন্দুকের গুলি আর কথা ফিরিয়ে নেয়ার উপায় নেই।
– অবশ্যই স্যার। অবশ্যই। সব সত্যি বলব স্যার। যা হওয়ার হবে, সত্যি বলেই মরব স্যার। আজই সব সত্য বলা দরকার স্যার। অত্যন্ত সত্য কথা বলা ফরজ। অনেক মিথ্যা বলে অনেক গুনাহ করেছি। অনেক গুনাহ, গুনাহর পাহাড়। এবার অনেক সত্য বলব, সত্য বলা ফরজে আইন।
আবোলতাবোল বলে তোতলাতে থাকেন জাফর।
– থামুন। অকারণে কথা বলছেন কেন? প্রশ্নটা শুনুন, ধর্ষণের মিথ্যা মামলা কেন সাজিয়েছেন? জবাব দিতে না চাইলে চুপ থাকবেন, মিথ্যা নয় প্লিজ।
– আমি স্যার গরিব ঘরের সন্তান, আল্লাহ পাক বুদ্ধিসুদ্ধি দেন নাই। দারিদ্র মানুষকে পিশাচ করে তুলে। আপনার স্কুলে চাকরির বিজ্ঞাপন আমাকে রমিজ দিছে। আমাকে এখানে পাঠিয়েছে সে। আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের বিষয় আপনাকে জানাতে নিষেধ করছে। তার কাছে আমার অনেক ঋণ, তবু কিছু কথা বলতে হচ্ছে। আমি বিরাট পাপের মধ্যে আছি। উভয়সংকট বলতে পারেন- তার বিষয়ে কথা বললে পাপ, না বললেও পাপ।
ধর্ষণের মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে দিছেন রমিজ। তিনি বলছেন, স্কুল যেন কখনো দাঁড়াইতে না পারে, সে জন্য টাকা যা লাগে তিনি দেবেন। কেয়ার সঙ্গে ভাব জমাইতে যত টাকা গেছে, মামলায় যা লাগছে সব সে দিছেন। সে ছাত্রদের খাবারে বিষ মিশাইতে বলছিল, আমি রাজি হই নাই। তারে বলছি, অত বড় পাপ আমারে দিয়ে না করাইতে। ছোট মুখে বড় কথা, তবু বলি- আপনাকে বাঁচতে দিবে না রমিজ। কারণ জানি না, কেমনে কি করবে তা-ও জানি না। আপনার সাবধান হওয়া দরকার। আজ আমার সামনে ফাঁসির দড়ি ঝুলতেছে তার কারণে।
– আপনি যে এসব বলছেন, তা কি রমিজ জানে বা জানবে?
– আপনি না বললে জানবে না।
– দেখুন জাফর সাহেব, আমি কাউকে কখনো অনুরোধ করি না, আজও করব না। আমাকে অবগত করার বিষয়টি আপনার নিজের নিরাপত্তার জন্য রমিজকে না বললে ভালো হবে।
রফিক মাতবর হত্যাকাণ্ড কি রমিজের নির্দেশে হয়েছে?
– জি না স্যার। কাজটা রাগের মাথায় ঘটছে। রফিক কেয়ার সঙ্গে বেয়াদবি করেছিল, সেটা আমি সহ্য করতে পারি নাই।
– আপনার সহ্য করার ক্ষমতা দেখছি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার থিউরি মেনে চলে। কেয়ার সঙ্গে বেয়াদবির আপেক্ষিক গুরুত্ব বেশি ছিল, তাই না? যাই হোক, সেটা আপনার বিষয়। আপাতত আপনি মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই থাকবেন, বেশি নড়াচড়ার দরকার নেই।
আমি আপনার ডিএনএ টেস্ট করব, অল্প রক্ত লাগবে। রক্ত দিতে আপত্তি নেই তো?
– আপনার কাজে আমার সব রক্ত নিয়ে যান। শরীর ভর্তি রক্ত দিয়ে কী করব, ফাঁসির পর তো সব জমাট বেঁধে যাবে, অপচয় হবে বিপুল পরিমাণে রক্তের। রক্ত নিতে ছুরি-কাঁচি, পটঘট আনছেন স্যার?
– আবার অকারণে কথা বলছেন, চুপ থাকেন। রক্ত লাগবে কয়েক ফোঁটা। আমি লোক পাঠাব পরে। কেয়া মেয়েটাকে বিয়ে করবেন বলেছিলেন, তার কী হবে?
– জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ আল্লাহ পাকের ইচ্ছা, মানুষের হাত নাই।
– নিজের ইচ্ছায় রফিকের মৃত্যু ঘটালেন আর কেয়ার বিয়ে ছেড়ে দিলেন আল্লাহ পাকের ইচ্ছায়? তাহলে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ এক সারিতে রাখলেন কেমনে?
জাফরকে মানসিক কেন্দ্রে রেখে মফস্বল শহরে গভীর রাতের ফাঁকা সড়কে একা হাঁটতে থাকেন রকিব। রমিজ ইস্যুতে জটিল চিন্তায় পড়েন। ষড়যন্ত্র ফাঁসের বিষয় কাউকে বুঝতে দেয়া যাবে না। হাঙ্গামা লেগে যাবে। রমিজ পাগলা কুকুর হয়ে উঠবে। থিসিসটা শেষ মুহূর্তে মাঠে মারা পড়বে। রমিজ-কাণ্ডে খুব বেশি বিরক্ত হওয়া যাবে না, জন্মের ওপর তো আর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। একই কারণে জাফরের প্রতি রাগ করার সুযোগ নেই। রমিজের কয়েক ফোঁটা রক্ত প্রয়োজন, তার আগে পরিস্থিতি ধৈর্য নিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে।
যতসব ফালতু কথা, মানুষ মোটেও বানর থেকে আসেনি। তবে বিবর্তনবাদ অনুসারে বানর, হনুমান ও শিম্পাঞ্জি যা থেকে বিভক্ত হয়েছে, মানুষের উদ্ভবও সেখান থেকে। এটা অনুমান বা মুখের কথা নয়, বিজ্ঞান।
এর মধ্যে অনেক দিন কেটে গেল। রকিবের আমন্ত্রণে রমিজ ব্রহ্মপুর বেড়াতে আসেন। রমিজের ডরমেটরিতে দুদিন দুরাত কাটান। হুইস্কি নিয়ে এসেছেন কিন্তু রকিবের বাধায় খেতে পারলেন না। ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, স্কুল তো আর মসজিদ-মন্দির না, এখানে মদ খাওয়া যাবে না ক্যান?
রকিব শান্ত স্বরে বলেন, উপাসনালয়ের চেয়েও নাজুক জায়গা স্কুল, এখানে যা খুশি করা যায় না। হুইস্কি এনেছিস খুবই ভালো কথা, অবশ্যই আয়েশ করে খাব, বাইরে ব্যবস্থা করব।
– দেখিস কিন্তু, স্কটল্যান্ডের জেনুইন মাল, কষ্ট করে তোর জন্য বহন করছি, বিফলে যেন না যায়।
– বিফলে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
– সিগ্রেট খাওয়া যাবে? নাকি তাতেও প্রিন্সিপাল সাবের নিষেধাজ্ঞা।
– নিষেধ, তবে তুই দরজা-জানালা বন্ধ করে খা।
– এইটা কোনো কথা? মালমুল ছাড়া রাইত কাটব ক্যামনে?
– রাত চোখের নিমেষে কেটে যাবে, চল তোকে স্কুলের ল্যাব ঘুরে দেখাই, মজা পাবি।
– কী আর করা চল, আজাইরা কামে টাইম পাস করি।
দুজনে ল্যাবে ঢোকেন। রমিজ যা-ই দেখে অবাক হন। এমন যন্ত্রপাতি জীবনে দেখেননি। রকিব বলেন, এটা হলো ফিজিক্স ল্যাব। এখানে অত্যন্ত দামি কিছু যন্ত্র আছে, যা এ দেশের কোনো ল্যাবে নেই। সব বিদেশি অনুদানে পেয়েছি। যেমন আলোর এই টেবিলটার বর্তমান বাজার দর চব্বিশ কোটি টাকা। আলোর যে একধরনের কনা, তা এই অপটিক্যাল টেবিলে দেখানো সম্ভব। তুই এত জটিলতায় যাওয়ার দরকার নেই। তুই যা বুঝবি, তা হলো এই যন্ত্রটা। দেখতে অনেকটা এমআরআই মেশিনের মতো। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি অসাধারণ যন্ত্র। পুরোটাই চুম্বকের কারসাজি। অনেকটা হাসপাতালের সিটি স্ক্যানের মতো। তবে আমি তো আর হাসপাতাল খুলে বসিনি, জনতার সিটি স্ক্যান বা এমআরআই করার কোনো ইচ্ছাও নেই।
এর মাধ্যমে মস্তিষ্কের নিখুঁত ছবি তোলা যায়। জটিল নিউরনের পার্ট বাই পার্ট ইমেজ ধারণ করতে পারে এই যন্ত্র। এমআরআই মেশিনের আদলে তৈরি, তবে আমি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে বেশ কিছু ইস্যু সংযোজন করেছি। একটি সফটওয়্যার বানিয়েছি, যা নিউরনের পরিকল্পনা মানে মানুষের চিন্তা শনাক্ত করতে পারে। ধর, তোর এখন চিন্তা হচ্ছে কাউকে কামড়ানো দরকার- সফটওয়্যার সেটা নিজের এআই দিয়ে প্রকাশ করবে।
– এ তো দেখছি মারাত্মক জাউরা রোবট।
– এটা রোবট নয়, তার নিজের কিছু করার ক্ষমতা নেই, তোর মস্তিষ্ক যা ভাববে বা চাইবে সে তা বলে দেবে। এটা মস্কিষ্কের কোটি কোটি নিউরন সার্চ করতে পারে এক সেকেন্ডের বারো ভাগের এক ভাগ সময়ে। এর মধ্যে শক্তিশালী ম্যাগনেটের মাধ্যমে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডের প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
– পুরা দেখি গণক বান্দর। এই সাধু কি যৌনবিষয়ক চিন্তাভাবনা বলায়ও ওস্তাদ? ধর, সামনে কোনো সুন্দরী বইসা আছে, তাতে কাম অনুভূতি জাগ্রত হইল কিনা। আবার মনে কর, যৌনশক্তির অবস্থা কী, কলিকাতা হারবালের দরকার কিনা।
– শোন, শুধু তা-ই না, যৌনতায় মস্তিষ্কের কম্পাঙ্কের মাত্রাও বলে দেয়া সম্ভব। কামের ব্যর্থতায় নিউরনের ক্ষরণ ও বিচ্যুতি এবং তার প্রভাবে ক্ষতির পরিমাণও বলা সম্ভব। ফ্রয়েড সাহেব যা বলতে চেয়েছিলেন। অনিবার্য মৃত্যু জেনেও মানুষ কোনো ধর্ষণ করে, হত্যা প্রবৃত্তি, আত্মহত্যার আগমুহূর্তে বিক্ষিপ্ত নিউরনের রিপোর্ট সব বলে দেয়। এই যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে না, শুধু প্রতিবেদন দেয়।
– আমার মাথার কি পরীক্ষা করা যেতে পারে?
– তুই যে গালিগালাজ ছাড়া কথা বলিস না, এর কারণও বের করা যেতে পারে।
– কর, তাই কর। গত সপ্তাহে নোয়াব মানে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠনের এক উচ্চপর্যায়ের মিটিংয়ে মুখ দিয়া ভুলে খানকির পোলা বের হয়ে গেছে, আমার কাণ্ড দেখ। মিটিংয়ে অনেকে মাইন্ড করছে। জানিস তো, ওই মিটিংয়ে ঢাকার বড় বড় পত্রিকার মালিক-সম্পাদকরা থাকেন।
দোস্ত, আমি বদ কাজ করতে চাই না, কিন্তু ঘইটা যায়। সোজা কোনো কাজ করতে পারি না, সব বাঁকা পথে। ক্রাইমের পর ক্রাইম। আমি যে খুব সাহসী তা-ও না। জিন-ভূত নাই জানি, তবু ভয় পাই। মতিঝিলের ক্যাসিনো গড বাদশারে আমি কুত্তার মতো ভয় পাই। সে ছাড়া পাইলে আমার দুই রান দুই দিকে ফাইড়া ফেলব। তারপরও তার লগে খেলতে গেছি। দুনিয়ার কাউরে বিশ^াস করি না, আসলে আমি নিজেরেই নিজে বিশ^াস করি না।
মাথার মগজের ছবি তোল। এরপর বল কী ওষুধ খামু।
– থাম এবার। ওষুধ কিসের? আমি তো ডাক্তার না। নিউরনের নেচার নিয়ে আমাদের কাজ। তোকে প্রাণিবিদ্যার আসল ল্যাব দেখানো হয়নি। পাশের ভবনে চল।
এই হলো প্রাণবিজ্ঞান গবেষণাগার। এখানে জীবনের মূল উপাদান রহস্যময় কোষ নিয়ে কাজ হয়। কোষ ভাঙতে ভাঙতে পাওয়া যায় জিন, সেই জিনতত্ত্ব নিয়ে কাজ চলছে। তোর জিন-ভূতের জিন না, এই জিন বলে দেয় জীবের বংশাণুক্রমিক ধারাবাহিক ইতিহাস।
– সত্যি বলছিস? বিজ্ঞান তো দেখি অনেক আগাইছে। আমি তো জানতাম নটীর পোলারা বইসা বইসা শুধু মিসাইল বানায়। তোদের জিনের ভিতরে এত কিছু। যাই হোক, আমার কোষ-মোষ, জিন-মিন পরীক্ষা কর, সব জানা দরকার। জন্মের কত আগের হিসাব দেয় এই জিনে?
– আমাদের এই ল্যাব খুবই সূক্ষ্ম হিসাব দেয়। এককোষী এমিবা থেকে প্রাণের উদ্ভব- তেমন একটি হাইপোথিসিস দাঁড় করার কাজ করছে স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রদের একটি টিম। তারা আমেরিকার এমআইটিতে এর প্রজেক্ট জমাও দিয়েছে, দেখা যাক কী হয়। তুই সত্যিই ডিএনএ টেস্ট করবি? রক্ত লাগবে তো।
– এই গভীর রাইতে আমি কী তোর সঙ্গে ফাইজলামি মারাইতেছি? রক্ত, গু, মুত যা লাগে নিয়ে নে, সব নিয়া শক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা কর। মাথার ভিতরের ছবি যা লাগে তা-ও তুলে নে, জন্মের ইতিহাসটা জানা দরকার। মানুষের জন্ম নাকি বান্দর থেইকা হইছে, আমার পূর্বপুরুষ মনে হয় টাউট টাইপের বান্দর আছিল, হনুমানও হইতে পারে, দেখতে তো একই।
– যতসব ফালতু কথা, মানুষ মোটেও বানর থেকে আসেনি। তবে বিবর্তনবাদ অনুসারে বানর, হনুমান ও শিম্পাঞ্জি যা থেকে বিভক্ত হয়েছে, মানুষের উদ্ভবও সেখান থেকে। এটা অনুমান বা মুখের কথা নয়, বিজ্ঞান।
পরদিন ঢাকায় ফেরার আগে গোপনে জাফর উল্লাহর সঙ্গে দেখা করেন রমিজ। তিনি মূলত এ কারণেই এসেছেন। রকির জেনেও না জানার ভান করেন।
চলবে…
খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-১২॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন