পর্ব-২
রমিজ গল্পটি বলার সময় প্রতিবারই বলেন, হাডি গেছে শব্দটি দক্ষিণের এক জেলার আঞ্চলিক শব্দ, এর অর্থ ফেটে গেছে। কোন জায়গা ক্যান ফাটছে বুঝা গেছে তো?
চতুর রমিজের কাছে রকিব দুধের শিশু। রকিব তখন অনেক চেষ্টা করেও অনায়াসে বিটিআরসি বলতে পারতেন না, মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেত বিআরটিসি। এ নিয়ে দুই বন্ধু বেশ হাসাহাসি। নতুন শহর, নতুন চাকরি, নতুন সহকর্মীদের উপভোগ করতে থাকেন রকিব। চলছিল ছাত্রজীবনের নেশা কাটিয়ে পেশা জীবনের প্রস্তুতিপর্ব।
রকিব পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র। ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক হলেও তিনি ছাত্র বলতেই স্বস্তিবোধ করেন। বলেন, পড়ালেই শিক্ষক হওয়া যায় না। পদার্থবিদ্যার শিক্ষক একজনই, নাম তার আলবার্ট আইনস্টাইন। বাকি সব ছাত্র। এ ছাড়া ছাত্রত্বে এক জাতের তেজস্ক্রিয়তা আছে, যতদিন তা ধরে রাখা যায়। ছাত্রত্বে বিপ্লব, শিক্ষকে প্রৌঢ়ত্ব। শিক্ষক হতে যোগ্যতা লাগে, ছাত্রের লাগে না।
স্কুলের উত্তর পাশে ছাত্রাবাসের ডি ব্লকের চারতলার ছাদে এক রুমের চিলেকোঠায় থাকেন রকিব। সেখান থেকে পুরো স্কুল, মাঠ, ছাত্রদের হোস্টেলের সবকটা ব্লকই দেখা যায়। দেখা যায় সরিষাখেত পেরিয়ে বড় রাস্তা। ছাদে উঠলে চোখে পড়ে শিক্ষক ডরমেটরির পেছনটা। জাফর উল্লাহসহ ২৫ জন শিক্ষক থাকেন ডরমেটরিতে। অধিকাংশ শিক্ষক দিনরাতের দীর্ঘ সময় ল্যাবে কাটান, ইতিহাসের শিক্ষক বলে জাফর উল্লাহর অঢেল সময়, ক্লাসও নিতে হয় কম। তিনি ঘুরে-ফিরে সবার খোঁজখবর নেন আর সূক্ষ্ম পলিটিক্স করে বেড়ান।
ব্রহ্মপুর ল্যাবরেটরি স্কুলে গণিতের শিক্ষক হয়ে আসছেন ডক্টর বজলুর রশীদ অংকন। রকিবের বিশ^বিদ্যালয় জীবনে হলের রুমমেট, সেশনজটসহ ক্যাম্পাসে সাড়ে সাত বছর কেটেছে একসঙ্গে। রেজাল্টের পর ডিপার্টমেন্টেই জয়েন করেছিলেন, কয়েক বছর চাকরি করে পিএইচডি করতে জার্মানি চলে যান। একপর্যায় চাকরি ছেড়ে সেখানে বসবাস করতে থকেন। ১২ বছর পর ফিরে নিজ ক্যাম্পাসে গিয়ে আবার জয়েন করার কথা জানান। ভিসি কোনোভাবেই প্রফেসরশিপ দেবেন না, সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদে জয়েন করতে বলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কদর্য রাজনীতিতে ড. অংকনের মেজাজ অত্যন্ত খারাপ। এসব রকিবকে জানাতে ফোন দেন। রকিব তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির চিন্তা ভুলে নিজের স্কুলে জয়েন করতে বলেন। ড. অংকন এক সেকেন্ডও না ভেবে রাজি হয়ে যান। বলেন, তাই তো, ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে হবে কেন? পড়ানো শুরু করতে হবে তৃণমূল থেকে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াতেই তো গলদ, ভিতটা মজবুত হওয়া দরকার। শুনলাম তুই মাত করে ফেলেছিস, দলে দলে ছাত্ররা ভর্তি হতে আসে, কিন্তু তোর স্কুলে নাকি সিট সীমিত, অনলি ফাইভ হান্ড্রেড। এটা ভালো, দুনিয়ায় স্বর্ণের পরিমাণ কম বলেই দাম বেশি। তুই নাকি সোনার খনি বানিয়েছিস, প্রতিটা ছাত্র নাকি সোনার টুকরা। ঢাকায় মেকানিক্যালের কামাল হায়দারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে বলেছে। তোর সোনার খনির ঠিকানা বল, কালই আসছি।
রকিব বলেন, আমাদের জেলা শহরে একবার এসেছিলি মনে আছে নিশ্চয়ই। শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে সোজা পশ্চিমে আধা কিলোমিটার পেরোলে জেনারেল হাসপাতাল, সেখানে না থেমে আরও এক কিলোমিটার গেলে বড় রাস্তার ডানে চারটা বিশাল তালগাছ, এগুলোর মাঝ দিয়ে তাকালে দূরে যে ভবনগুচ্ছ, সেটাই স্কুল। চলে আয়।
পরদিন সূর্য ডুবে ডুবে সময় অংকন হাজির। রকিব বিশ^াস করতে পারছেন না, অংকন জড়িয়ে ধরে বলেন, এবার সত্যি মনে হচ্ছে?
-হুম। বাট স্কুলে জয়েন করবি তো? নাকি দুচার দিন ঢং ঢাং করে চলে যাবি?
-ওয়েবসাইটে দেখে তো তাজ্জব বনে গেলাম, লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলেছিস, কেমনে কী বল। আগে বল, শুধু ছেলেদের স্কুল কেন, মেয়েরা কি বিজ্ঞান পড়বে না?
-অস্থির হবার কিছু নেই, লং জার্নির পর বিশ্রাম নিতে হয়। আমার ছোট্ট একটা মিটিং আছে, ঢাকা থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এসেছেন। বসে আছেন, তাকে বিদায় দিয়ে আসি, রাতে সব বলব। তুই ছোট্ট করে একটা ঘুম দে।
-ওকে, জো হুকুম জাঁহাপনা।
এ কথা বলতেই গায়ের সব লোম সব দাঁড়ায়া গেছে, হাতে হাত দিয়া দেখেন স্যার। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ মেহেরবান।
অতিরিক্ত সচিব সাহেবের সঙ্গে বৈঠক শেষে অনেক রাতে চিলেকোঠায় ফেরেন রকিব। অংকনকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন। বলেন, ঘুম হলো? কিছু খেয়ে নে, চল ছাদে গিয়ে বসি।
-এত রাতে ছাদে কেন?
-রাত বলেই তো ছাদে যাব, অন্যরকম অনুভূতি, জোনাকি আর ঝিঁঝি পোকার রাজত্ব, দক্ষিণের কাঁপন ধরা বাতাস। তারায় ভরা আকাশ, অদ্ভুত নিস্বর্গ।
-এ কারণে সব ছেড়েছুড়ে গ্রামে এলি?
-আরে না, ঢাকার বছিলা ব্রিজ পার হলেই তো গ্রামের পরিবেশ মেলে।
-শিশুদের বিজ্ঞান পড়ানোই কি উদ্দেশ্য?
-আপাতত তাই, আরেকটা উদ্দেশ্য আছে। দুই মিলে রথ দেখার পাশাপাশি কলা বেচা, তবে কোনটা প্রধান এখনই বলা মুশকিল।
-ভূমিকা দীর্ঘ না করে দ্বিতীয় কারণটা বল শুনি।
-আরে মশাই, এত ব্যস্ততা কিসের? দ্বিতীয় কারণ মুখে বলা যাবে না, দেয়ালেরও কান আছে।
-মানে কী? গোপনীয় হলে থাক, বলার দরকার নাই।
-আমার কীই-বা কোনকালে গোপনীয় ছিল, সবই ওপেন সিক্রেট।
-নারীবিষয়ক কিছু?
-নারে বোকা, ওসব কিছু নয়, তুই তো প্রশ্নের পর কোয়েশ্চেন করে নাড়িভুঁড়ি বের করছিস।
-কী যেন লুকোচ্ছিস, বলার মতো হলে বল।
-গোপনীয় নয়, তবে নিষিদ্ধ। ভয়ংকর রকমের নিষিদ্ধ।
-খুনখারাবি নাকি?
-তার চেয়েও নিষিদ্ধ। মানব সভ্যতাবিরোধী।
-ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে কী যে ঝামেলা করছিস, আল্লায় জানে। আর যাই করিস, শিশুরা যেন ঝুঁকিতে না পড়ে। ফিজিক্স ল্যাব নিয়ে শঙ্কা নেই, কেমেস্ট্রি ল্যাব ভয় পাই। রিস্কি কিছু করিস না সোনা।
-ওয়েবসাইটে তো তেমন কিছু আপ করিনি, সেখানে কী দেখলি?
-তোর প্ল্যান-প্রোগ্রাম সবই তো নেটে আছে, বিশাল লঙ্কাকাণ্ড। শিশুদের বিজ্ঞান পড়া নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই, এ কারণে তোর উদ্যোগে সারা দেশে ব্যাপক সাড়া। সেদিন এক পত্রিকায় পড়লাম, তোর ফিজিক্স ল্যাবের একটি টেবিলের দাম নাকি আট কোটি টাকা, কী আছে তাতে? সোনায় মোড়ানো টেবিল হলেও তো এত দাম হবার কথা না। রাশিয়ার পরমাণু কমিশন এত ব্যয় করছে কেন? আমরা তো ইউনিভাসির্টির ল্যাবেও এসব পাইনি। এই ল্যাব দেখতে নাকি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব সাহেব ছুটে এসেছেন।
-উনি শুধু টেবিল দেখেতে আসেননি, অন্য বিষয় আছে। গোয়েন্দারা তাকে অন্য তথ্য দিয়েছিল। এখানে এসে তার ভুল ভেঙেছে।
-তুই খোলামেলা কথা না বললে আমি কিন্তু ঘুমোতে যাব।
-আজ তবে চল ঘুমাই। দুই-চার দিন বিশ্রাম নে, গ্রামটা ঘুরে দেখ আর ইতিহাসের শিক্ষক জাফর উল্লাহকে একটু ফলো করবি।
-কেন? সে কে?
-অত সিরিয়াস কিছু না, জাস্ট ফলো করবি। ভয় পাচ্ছিস ক্যান, উনি ভীতিকর কিছু না। নানা বিষয়ে চালাকি করলেও আসলে বোকা, নিরীহ টাইপের। নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় কৌশল করে চলেন। তাকে একটু বোঝার চেষ্টা করবি, আর কিছু না।
রকিবের কথায় ক্লান্তিবোধ করেন অংকন। গল্পের একপর্যায় শুয়ে পড়েন দুজন।
ঘুম ধরে না অংকনের। ভাবতে থাকেন রকিবকে। গ্রামে করছেটা কী? একধরনের লুকোছাপা আছে। এরই মধ্যে বন্ধু আমার বর্ণাঢ্য এক জীবন কাটিয়ে যাচ্ছে। পিছুটান নেই, চাহিদা নেই, বাসনা নেই, উচ্চাকাক্সক্ষা নেই। উদাসীন যাযাবর। বউ নেই, বাচ্চা থেকেও নেই। তবে না চাইতেই পেয়েছে অঢেল, সারা দুনিয়া তাকে এক নামে চেনে। জীবন কাটাল কোয়ান্টাম মেকানিক্স আর হিগস-বোসন পার্টিকেল নিয়ে। মাঝের সময় গেল নিউরনে, এখন কী করছে কে জানে! ফোনে বলল, মনোজগতের একটা জটিল প্রশ্নের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। খুলে কিছু বলছেও না। জাফর উল্লাহ নামের মাস্টারকে ফলো করতে বলল, দেখা যাক কী হয়।
অল্প কিছু সময় ঘুমিয়ে দুই বন্ধু গ্রাম ঘুরতে বের হন। স্কুলের সরু রাস্তা পেরিয়ে বড় সড়কে ওঠার আগেই দেখা মিলল জাফরের। উনি ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। দুজনকে দেখে অনেকটা দৌড়ে এগিয়ে এলেন। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, আসসালমু আলাইকুম স্যার, শরীর ভালো? মেহমান কে স্যার?
-আমার বন্ধু, ড. অংকন।
-স্যার, কিছু মনে করবেন না, নামের আগে পরে কিছু একটা যদি থাকে, মানে মোহাম্মদ বা মানে কী বলতে চাচ্ছি স্যার…
-বজলুর রশীদ অংকন।
-আলহামদুলিল্লাহ, আর বলতে হবে না স্যার, বুঝে গেছি সব। আগামী সোমবার স্যারের জয়েনিং, নিয়োগপত্র রেডি স্যার। এত বড় গণিতবিদ পাড়াগাঁয়ের স্কুলে আসতেছেন, মহান আল্লাহ পাকের বিরাট মেহেরবানি, সোবহান আল্লাহ।
-অংকন গণিতবিদ কীভাবে জানলেন?
-আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত চাপা দিয়ে রাখা যায় না স্যার। এই স্যার ইতালির ভিসুভিয়াস মাপের আগ্নেয়গিরি। প্রাচীন রোমানে পম্পেই ও হারকিউলানিয়াম নামে দুইটি শহর চোখের পলকে হারিয়ে যায় এর লাভার নিচে। বড়ই আফসোস। মড়ার উপর খাড়ার ঘা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভিসুভিয়াসের ফের উদগীরণ। সবই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা।
-বুঝলাম, কিন্তু অংকনের বিষয়ে আপনি জানলেন কীভাবে?
-কেরানি বিজন শর্মা বিরাট বজ্জাত, একটু পর পর রুমের বাইরে গিয়া বিড়ি টানে, সব গোপনীয় কাগজপত্র তার টেবিলে এলোমেলো ছড়ানো থাকে। ফাঁকিবাজটার টেবিলে স্যারের বায়োডাটা এক নজর দেখেছি মাত্র। স্যারের তো জার্নালের পর জার্নাল। মাশাল্লাহ। লিনিয়ার অ্যালজেব্রায় স্যারের একটা ইকোয়েশন অনার্সের সিলেবাসে আছে। নাম রাশিদ ইকোয়েশন। কী ভয়ংকর কথা, এই লোকের পাশে বইসা আমি চাকরি করুম। এ কথা বলতেই গায়ের সব লোম সব দাঁড়ায়া গেছে, হাতে হাত দিয়া দেখেন স্যার। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ মেহেরবান।
-ষোলো পৃষ্ঠার সিভি একনজরে এত কিছু দেখেছেন? আপনার মেধাও দেখি অংকনের চেয়ে কম না।
-কী যে বলেন স্যার, আস্তাগফিরুল্লাহ। কই ইমরান খান, আর কই খিলি পান। কলেজ থেকে ইতিহাসে এমএ পাস করছি, জীবনের কোনো দাম নাই।
চলবে…
আরও পড়ুন: খলিশাপুরের কুকুরগুলো এবং রকিবের থিসিস-১ ॥ মুস্তফা মনওয়ার সুজন