॥৯॥
পরদিন স্ক্রু তৈরির লাল ঘরে গিয়ে জসিমকে দেখে এলো সলিল। নিজের চেয়েও বড় যন্ত্রটায় আগের মতোই পেশল অঙ্গভঙ্গে কাজ করে চলেছে লোকটা। তেলচিটে চুলগুলো বারবার চলে আসছে চোখের সামনে। চুলের সরু অগ্রভাব লাগছে নাকের ডগায়। থেকে থেকে মাথায় তুলে দিয়েও কোনো লাভ কাজে আসছে না, আবার এসে পড়ছে নাকের ডগায়। একপর্যায় আর না-সরিয়ে মুখচোখ কঠিন করে কাজ করতে থাকল। পেছনের জানালা দিয়ে আলো এসে ঘরটা লালচে করে রেখেছে। সে আলোর কিছু অংশ পড়ছে জসিমের দাঁড়িয়ে থাকা অবয়বের পেছনাংশে। পিঠের কাছে ঘামে ভেজা জামাটা কোমরের কাছে এসে শরীর থেকে একটু আলগা হয়ে ওঠার ফাঁক পেয়েছে বলে, ওখানে ঘামের চিহ্ন নেই। একটু নিচে যেখানে পেছনটা আবার মাংসল হয়ে উঠেছে সেখানটাও ঘামে কালো। তাকে না ডেকেই সলিল আবার ফিরে যাচ্ছিল।
এমন সময় ইশারায় দরজার দিকে জসিমকে চোখ ফেরাতে বলল ইস্পাদের কাটা পাত ভেতরে নিয়ে আসা কমবয়েসী ছেলেটা, ফিরোজ তার নাম। জসিম একটা শ্যামলা বরণ সাদা পোশাকের অবয়বকে বেরিয়ে যেতে দেখে মুহূর্তে চিনে নিল। কণ্ঠ চড়িয়ে বলল, আমি ভালো আছি স্যার!
জসিমের চেনা দক্ষিণি টানের কথাগুলো সলিলের কানে গেলে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে সলিল আবার চললো ওই ঘরের দিকে। উঠে দাঁড়িয়ে দরজা-পথে সলিলকে ফিরে আসতে দেখে ফিরোজের দিকে তাকিয়ে হাসল জসিম। সলিল হেঁটে এসে দাঁড়াল দরজায়, মুখোমুখি হলো দুজন। জসিমই আজ কথা বলে উঠল। আমি ভালো আছি স্যার, আপনার দোয়ায়। আপনি ভালো তো? সলিল মৃদু হেসে বলল, এই তো আছি। ভাবছিলাম আপনার কথা। যাক, ভালো আছেন দেখে ভালো লাগছে। নিজের যত্ন নেবেন, কেমন?
সলিল থাকার কটা মুহূর্ত শব্দ বন্ধ হয়ে ছিল গোটা ঘরের। সরে আসার মুহূর্ত ব্যবধানে আবার শুরু হলো ঝনঝনাৎ-ঝনঝনাৎ! কারও সঙ্গে সরাসরি কথোপকথন বলতে সারাদিনে এটুকুই।
তারেককে দেখে অন্যদিনের মতো কৌতূহলী দৃষ্টি ফুটে ওঠেনি সলিলের চোখে। চোখে পড়েছে চোখ। নীরব শুভেচ্ছা বিনিময়ের ইচ্ছেটুকুই কিছুটা ফুটে উঠেছিল শুধু, কোনো ক্রিয়া নয়। শেষমেষ একরকম শীতলভাবেই পরস্পরকে পাশ কাটাল ওরা। তবে সরে আসবার পর তারেক আরেকবার পেছন ফিরে দেখল সলিলকে।
ব্যতিক্রমটা এলো সন্ধ্যায়। অতিথিশালার স্নানঘর থেকে ভেজা মুখহাত নিয়ে বেরিয়ে এসে সলিল তখন তার তোয়ালেটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। খোলা ট্রাভেল ব্যাগের একেবারে ওপরে ভাঁজ করে রাখা ছিল। সেখানে পাওয়া গেল না। হঠাৎই দেখা গেল রীতিমতো চোখের সামনেই খাটের পায়ের দিকের রেলিঙের একপ্রান্তে তোয়ালেটা কুঁচকে ঝুলে আছে। হাত বাড়াতে গিয়ে দেখে একাট কালো প্রজাপতি খুব ধীরে ডানা নাড়ছে ভাঁজ হয়ে থাকা আধভেজা কাপড়টার ওপর। নেবে কি নেবে না যখন বিভ্রান্ত সলিল তখন দরজায় দেখা দিল মেহেদি।
প্রজাপতি খুব বেড়েছে, খেয়াল করেছেন?
সলিল এক ধরনের নিয়মরক্ষার হাসি হেসে, রেশটা ঠোঁটে ধরে রাখল। মেহেদি কণ্ঠ যথাসম্ভব কোমল করে বলল, অনেকদিন হলো আপনাকে নিয়ে সন্ধ্যায় বেরোব ভাবছি, এটা ওটা সামলাতে গিয়ে সময় ওঠে না। আজ যাবেন? গ্রামের দিকে তো, রিকশা খুব সস্তা। অনেক বেড়ানো যায়।
সলিল মুখের হাসিটা ধরে রেখে তার দিকে তাকিয়ে অনির্দিষ্ট ভাব প্রকাশে ঝাঁকাল দুটি কাঁধ, বোঝালো, গেলে বা না গেলে কোনওটিতেই তার আপত্তি নেই। মেহেদি তার অঙ্গভঙ্গে এবার মরিয়া হয়ে উঠল। বলল, সামনে একটা শালবনে ভরা অংশ আছে। এখানে বাসে করে আসতে আসতে বোধয় দেখেছেন। তারই শেষ অংশ, এরপরই একটা দীঘি। ওটার পারেও ঘন বন, আর একটা বট। কয় শ বছর ওটার বয়স কেউ জানে না।
সলিল তখনও নিরুত্তর। মেহেদির কণ্ঠে এবার ব্যগ্রতা খেলে, চলুন না।
এক পাশে মাথা হেলিয়ে সায় জানায় সলিল। বেশ, চলুন।
শিয়রে বালিশের কাছে রাখা মানিব্যাগ আর মোবাইল ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে, রূপালি হাতঘড়িটা বাম হাতের কব্জিতে লাগিয়ে বেরোল। মেহেদী ততক্ষেণে ফটকের কাছে চলে গেছে। ঝাঁসবাতির আলোয় ওই দুটো প্রকট আর দুটো প্রচ্ছন্ন ছায়া পড়েছে।
ফটকটা খুলে বাইরে আসতেই রাতের গ্রাম তার রহস্য নিয়ে মন জড়িয়ে ধরল।
আমি প্রায়ই বেরোই, তবে একা। জানি না আপনার ভালো লাগবে কিনা।
পথের ধারের একটা বাড়ি থেকে আসা আলোয়, মাটি থেকে বেরিয়ে থাকা বড় পাথরটা দেখতে পেয়ে এড়াল মেহেদী। ওটার ওপর দিয়ে ছোট একটা লাফ দেওয়ার সময় কণ্ঠস্বরটা কেঁপে উঠল, জানি না আপনার পছন্দ কেমন। তবে আমার ভীষণ ভালো লাগে। সেই সূত্রেই যাওয়া। ঘরে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না। বাইরে এলেই আপনি দেখবেন, মনটা কেমন অন্যের ভাবনায় ডোবে, মানে, চারপাশে কী হচ্ছে, এসব কিছু পড়তে শুরু করে আপনার চোখ। তখন চিন্তা একেবারে জেঁকে ধরার সুযোগ থাকে না। সারাক্ষণ দৃশ্য বদলাচ্ছে তো, এ কারণে। কিন্তু বাসায় বসে থাকলে দেখা যায়, সারাক্ষণই কোনও না কোনও দুর্ভাবনা— আর কারও কথা জানি না, আমার কথাই বলছি— একটা না দুর্ভাবনা, স্মৃতি, কোনো রক্তাক্ত কল্পনা, এসব মনে চলে আসছে। তার পেছনেই সময় চলে যাচ্ছে। গভীরে যাচ্ছি, আরও গভীরে যাচ্ছি। একসময় তল না পেয়ে আবার ওপরে ভাসছি। এই এসব।
কথা বলতে বলতে ওরা অনেকটা এগোল। একটা সময় পথের মাথায় পৌঁছুল। দূরের নগরের আলোয় ওখানে আবছা আলোকিত হয়ে আছে। দূরে দূরে, এখানে ওখানে, আরও অনেক কারখানা, কারখানার আলো বহুদূর অব্দি আলোকিত করে রেখেছে। কোথাও বনের চিহ্ন নেই। পশ্চিম দিক থেকে উঁচু নিচু মাটির পথ ধরে একটা রিকশা এগিয়ে এলো, নিচে হলুদ আলো ছড়ানো অর্ধস্বচ্ছ হারিকেন জ্বলছে। যে পথ ধরে ওরা হেঁটে এসেছে, পেছন ফিরে সে পথের দিকে তাকিয়ে ভয় করে। যেন অন্ধকার কোনও পিরিপথ পেছনে ফেলে এসেছে। বাতাসের পাচিল তোলা, রক্ষিত গুহাপথ। রিকশা আরও সামনে চলে এসেছে, রিকশার পেছনে দূরের নাগরিক আলো। এবড়োথেবড়ো রাস্তার কারণে রিকশা চলতে গেলেই টুং টাং করে বেল বাজছে। রিকশাটার নিচে ফুলের মতো আলোর চারটি পাঁপড়ি। পাঁপড়ি চারটি বেরিয়েছে ওই আধস্বচ্ছ হারিকেন থেকে। চিমনিটা যেন একটা হলুদ কুসুম, যার ভেতরে প্রাণের আলো। বহুদিন হয় তাপ ছড়াতে ছড়াতে সে আলো জ্বলছে বলে কুসুমের গায়ে আঁচ পড়ে দাগ হয়েছে। ওই দাগও অনেকদিন ধরে আর পরিষ্কার করা হয় না বলে স্থায়ী হয়ে গেছে।
একজন রিকশাচালক এসে দাঁড়াল, মুখটা বাঙালির নয়। বরং মনে হয়, শরীরে মোঙ্গল রক্ত। মনময়পুরের পর সুরবঙ্গের সীমানা শেষ হলে মোঙ্গলদের আদিম রাজ্য। ভুরুজোড়ায় তার শান্ত মনোভাবের ছায়া। ঝুলে পড়া চোয়ালে কোণঠাসা ভাব, আর মুখের প্রশস্ত গড়নে গোবেচারা ভাব প্রবল। ওদের দুজনকে দেখে রিকশাটা হঠাৎ গতি কমিয়ে দিয়ে এগোতে থাকল। দুজনের সামনে এসে থামিয়েই দিলো প্রায়। ওপর-নিচ তাকিয়ে যাচাই করে নিতে চাইলো।
হঠাৎ থেমে যাওয়ায় রিকশার চাকার মধ্যখানে থাকা হারিকেনটা সামনে পেছনে দুলছিল। এই দোলার সঙ্গে দুলছিল চার পাপড়ি আলো। রিকশার পেছনের চাকা দুটোর ছায়াও সামনে-পেছনে নড়তে থাকল। রাতের আলো আঁধারির ভেতর মোক্ষম রহস্য সঞ্চারিত করে বাহনের চেয়েও রহস্যময় রিকশার চালক গলা একবার ঝেড়ে যথাসম্ভব বিনীত স্বরে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন? কণ্ঠে মনময়পুরের টানের চেয়ে সুরবঙ্গের পূর্বপ্রান্তজোড়া পাহাড়ছোঁয়া টানই বেশি।
রিকশা ক্রমশ পেছনের কারখানাগুলোকে আরও পেছনে রেখে সদ্য স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া ঋণগ্রস্ত দেশের মতো ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগিয়ে চলল। কিছু জায়গায় চড়াই-উৎরাই এতো নিবিষ্ট যে আরোহী দুজন পড়ে যায়-যায়। নৈঃশব্দের মধ্যে রিকশার যান্ত্রিক খুনসুটি প্রবল হয়ে ধরা দিলো। ঢেউয়ের মতো ওঠানা যখন চলতেই থাকল, এর কোনো শেষ যেন নেই। দুজন ওটাকে বেশ একটা খেলার মতো বানিয়ে হৈ হৈ করে গেল, কোনো আপত্তি তুলল না।
মেহেদি বলল এ জায়গাটা কারখানার জন্য বেছে নেওয়ার আগে এখানে বিস্তীর্ণ জলাশয় ছিল বলে শোনা যায়। মাটিতে সব ভরাট করে দরমুজপেটা করে বিস্তীর্ণ জলাকে বানানো হলো বিস্তৃত শিল্প এলাকা। শিল্প কারখানা মানেই ভীষণ ভারি সব মালামালের অবিরাম আসা যাওয়া, যার জন্যে প্রয়োজন ভারি আর শক্তিশালী বাহন। তাদের চাকা হবে স্ফীত, চওড়া, দাঁতাল, বাহনগুলোর দেহ হবে দৈত্যাকার। হলোও তেমন, আর ফলটাও মিলল। নদীর ঢেউয়ের মতো রাস্তাতেও ঢেউ খেলে গেছে। ভারি যানবাহনগুলোকে চথচলার সময় মনে হয়, ঝড়ের ঢেউয়ে দোলা আদিম জাহাজ।
ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল আমার। মেহেদির কণ্ঠে ছেলেমানুষী উচ্ছ্বাস। কেমন একটু বলি। আমার খালাদের একজন থাকতেন রূপোসনগর, ঢাকার শেষপ্রান্তে। বাকিরা চট্টগ্রামের দরিয়ারকুলে। তো, বছরে একটিবার অন্তত, হতে পারে শেষের শীতের দিকেই, রূপোসনগর আসা হতো। তো, আমার বোন, বিয়ে করেছে সাত বছর, ভালো নেই— হাহা! যাহোক, মাফ করবেন। তো বলছিলাম আমরা দুজন, হাঁ, বসতাম পাশাপাশি। রূপোসনগরে যাওয়ার পথে কিছু পথ আছে সোজা ওপরে উঠতে থাকত, এরপর সোজা নামতে। তো, বুঝতেই পারছেন, যখন উঠত, তখন এই আমরা দুটি ভাইবোন প্রস্তুতি নিতে শুরু করতাম। হো হো হো— কিসের প্রস্তুতি? গাড়িটা নামার সময় আমাদের মেরুদ-ে একটা শিরশিরে অনুভূতি হতো। একটা কেমন আরামের অনুভূতি হতো। কখনও পেয়েছেন কিনা জানি না। আমরা খুব আনন্দ পেতাম। ভীষণ আনন্দ পেতাম। তো, ওই কথা মনে পড়ে গেল।
সলিলও না হেসে পারল না। ঢাল থেকে নামার সময় একটা শরীর ছেড়ে দেওয়ার মতো আরামের অনুভূতি হয়। তবে এর সঙ্গে আমার কোনও আনন্দস্মৃতি নেই।
নিজ হাত দুটি একে অপরের আঙুলে বাঁধা পড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে রইল মেহেদি বেশ কিছুক্ষণ। পথের ঢেউয়ে তার শোভন চুলে বাতাসের নড়াচড়া চলছে। একসময় মুখ তুলে সলিলের দিকে তাকিয়ে দুপুরের প্রসঙ্গ তুলল। আমি জানি আপনি কী নিয়ে আমার ওপর এমন শীতল হয়ে আছেন, সলিল। অবশ্য পরিবেশে উত্তাপ না থাকলে সলিলের শীতল হয়ে যাওয়াই ধর্ম— হাহাহা! তো বেশ, আমি জানি। এখন আমি আপনাকে এ নিয়ে কিছু কথা বলব। আমি আশা করব আপনি আমাকে এটুকু দয়া করবেন, আমাকে বলতে দেবেন। প্রথমেই বলে নিচ্ছি, আমি আন্তরিক দুঃখিত। অনেক কষ্টে আমার আপনার সামনে থেকে আসতে হয়েছে। নিজের মনকে মানাতে পারছিলাম না। আপনি হয়ত আমাকে কখনো ক্ষমা করবেন না। হঠাৎ করেই যে আঘাত আপনাকে করে বসেছি।
না, ঠিকাছে। আসলে, একটা কথা কী, বোঝার বোঝা পিঠে নিয়ে পথে না-টলে চলতে পারা কঠিন। এটা সত্য, হঠাৎ রীতিমতো আপনার মতো কারো কাছ থেকে এরকম করে বলা কথা, সঙ্গত কারণেই আমি নিতে পারিনি। কারণ আপনার সঙ্গে আমার সখ্য দিয়েই এখানে আমি শুরু করেছি। এর ওপর নানা কারণে মনটা নানা কারণে দুর্বল হয়ে ছিল। বুকটা শূন্য হয়ে ছিল। অপরিচিত মানুষের ভিড়ে, নতুন পরিবেশে, নতুন আলো-বাতাসে মনের অভিযোজন ঘটেনি বলেও। এখনও খুব টলছি। আমার একা হয়ে পড়া বউ, দরদী মা, আদর্শিক প্রতিপক্ষ বাবা, আহ্লাদপাখি ছোট বোন— এদের থেকে আমি এখন অনেক দূরে। আর আড্ডার বন্ধুরা, মনের বাষ্প বের করে হালকা হওয়ার উদার জায়গা ছিল ওটা, ফেলে এসেছি। এতো কিছুর অভাবে অপুষ্ট মনের তো ভর সইতে পারার কোনো কারণ নেই।
খানিক নীরবতার পর কথামালার ফুল নিজ হাতে তুলে নিলো মেহেদি। আপনার কাছে থেকে ফিরে পল্লব আমার কাছে এসেছিল। বলল, এভাবে না-বললেও পারতিস। আরো বলল, আমাদেরই ভুল যেটা হয়েছে, ওকে আগের কিছু কথা হলেও বলে নেওয়া দরকার ছিল আমরা যা করিনি। এখন ছেলেটা কষ্ট পেল। পল্লবের কথাটা তো আমার মনেও বাজছিল। আমি এভাবে কথা বলে উঠতে পারি— এটা যেন আপনি ভাবতেও পারেননি। আপনার চোখের ওই দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার জন্যে অসম্ভব ছিল। ওফ্, এটা যে কত বড় মানসিক পরীক্ষা! এমন পরীক্ষার সঙ্গে আপনার কখনো পরিচয় ঘটেছিল কিনা জানি না। একবার এক বন্ধুকে ধাঁ করে মেরে বসেছিলাম। ও ভাবতেই পারেনি আমার মতো বন্ধু ওকে মারতে পারে। ওর চোখে অপমান নয়, কষ্ট নয়, কী তীব্র অবিশ্বাসমাখা বিস্ময় যে ফুটে উঠেছিল— কী বলব, আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। ওর দৃষ্টি থেকে চোখ বাঁচিয়েছিলাম। যে বিরোধের জন্য মেরেছিলাম ওটা একেবারেই তুচ্ছ দলাদলিকেন্দ্রিক একটা ব্যাপার ছিল ক্যাম্পাসের। এসব প্রতিদিন দশবার করে হয় দশবার করে মেটে। অবাক ব্যাপার, সে রাতেই আমার ওই বন্ধুর জ্বর চলে এলো। বোধয় অপমানে। কারণ আমি ওকে আড়াল নিয়ে কাঁদতে দেখেছিলাম। আমি তিন দিনের মাথায় ওদের বাসায় গেলাম, ওকে দেখব বলে। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘর, আলো কম। একটা দেয়াল জুড়ে বই ছিল, মনে আছে। ফলের রস নিয়ে গিয়েছিলাম। প্যাকেটে স্ট্র লাগিয়ে জোর করে ওর ঠোঁটে ধরিয়ে দিলাম। বললাম, তোকে মারার মুহূর্তে তোর চোখে যে অবিশ্বাস দেখেছিলাম তা আমি কোনোদিন ভুলব না। তো দেখতেই পারছেন, আমার জীবনে এমন মুহূর্ত প্রথম নয়। হয়ত শেষও নয়। এর কষ্ট অনেক। পষ্ট বলবার ভাষা কোথায়? তখনই ঠিক করলাম আপনাকে নিয়ে হাঁটতে যাবার পরিকল্পনা ছিল, এক মাস প্রায় হয়ে গেল, যাওয়া আর হয়ে উঠল না, যেদিন যাব, সেদিন কারখানার বাইরে নিশ্চিন্তে আপনাকে কিছু বলব।
সলিল মেহেদির দিকে পুরোটা সময় তাকিয়ে থেকেছে। থেকে থেকে দূরের দিগন্তরেখা যেন দেখছিল মেহেদি। কথা বলতে বলতে এই হাসছে তো পরক্ষণে গলার স্বর কাঁপছে। কখনো কণ্ঠ উঁচুতে চড়ছে, কখনো নিজের ভেতর সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। আবার কখনো মুখে না হেসেও চোখজোড়া হয়ে উঠছে ভীষণ উচ্ছ্বসিত। আপন অনুধাবনগুলো অন্তঃস্থল থেকে তুলে আনতে গিয়ে বেশ আবেগী হয়ে পড়েছিল সে। কথার বলবার বেশিরভাগ সময় সলিলের চোখের ওপর থেকে চোখ সরাচ্ছিল না, যেন ওই চোখেই ফুটে উঠছে লেখাগুলো, সে শুধুমাত্র অভিব্যক্তি যোগ করে পড়ে চলেছে। সলিল বলল, বেশ তো, বলুন না। আমি শুনছি।
আপনি আসার পর বোধয় শুনেছেন, আরেকজন ছিল আপনার আগে, সে চলে গেছে।
হ্যাঁ, একবার শুনেছি। এর বেশি কিছু না।
অপু। তার গল্পটাই বলব। চলে সে যায়নি, তাকে বরং তাড়ানো হয়েছে। এবং খুব অপমানের সঙ্গে, অবমাননার সঙ্গে। তাড়ানো হয়েছে। এমন ভালো মানুষ আমি খুব কম দেখেছি সলিল। কে তাড়ানোর পথ নিষ্কণ্টক করার জন্যে এক বিশাল পরিকল্পনা ফাঁদা হয়েছিল। ওই পরিকল্পনার ফাঁদ যে এখনো পাতা নেই তা কী করে বলি। আর সেদিন, ওই অপুকে নিয়েই একটা কথা ওঠায় সৌরভের সঙ্গে আমার এক ধরনের তর্ক হয়ে যায়। ট্রান্সফর্মারের নতুন সাশ্রয়ী একটা নকশা অপু দিয়ে গিয়েছিল। যাবার সময় আর ফেরত নেয়নি। নকশাটা কাজে লাগানোর কথা ছিল। কিন্তু ও চলে যাওয়ায় আমি বারণ করি। কিন্তু সৌরভ চাইছিল ওই নকশাটা কাজে লাগাতে। কারণ ওই নকশা ক্ষুদ্র পরিসরে আমরা পরখ করেছিলাম, তখন ফল ছিল বিস্ময়কর একরকম, বলতে পারেন। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে সৌরভ চাইছিল না। আমি বাধ সাধছিলাম। আমার নৈতিকতায় বাধা পাচ্ছিল খুব, স্বাভাবিক।
নিজেকে কষ্টে সংবরণ করে নিলো মেহেদি। অশান্ত চোখজোড়া আবার শান্ত হয়ে এলো, অভিব্যক্তির বাহক হাত দুটো স্থির হলো উরুর ওপর। এরপর বেরিয়ে দেখি আপনি। অপুরই আরেক ধরনের সংস্করণ বলা যেতে পারে আপনাকে। হাহাহা, অবশ্যই আপনি আলাদা, কিন্তু এ কদিনে আপনাকে যতোখানি চিনেছি তাতে মনে হয়েছে, অপু আর আপনার মনের অনেক মিল। দুজন একই ঘরানার মানুষ। তবে যন্ত্র পোষ মানানোর দক্ষতা অপুর আরো বেশি ছিল এটা ঠিক, কিছু মনে করবেন না প্লিজ।
সলিল হেসে বলল, আরে, কী বলছেন। কিছু মনে কেন করব। আমি আমার স্তর জানি। বলুন ওনার কথা। এরপর?
বলছিলাম ফাঁদের কথা। ওই ফাঁদ এখনো পাতা আছে। সেখানে যেন পা দিতে না হয় সে জন্যে সারাক্ষণ আমাদের সতর্ক থাকতে হয়। নয়তো যে কোনো মুহূর্তে মাথার ওপর খড়গ নেমে আসতে পারে। আপনাকে দেখে যদি হাত ধরে তখন টেনে নিয়ে যেতাম তো এটারও অনেক রকম মানে বের করতে পারত। তাই আপনাকে সেখানেই এমনভাবে নিরস্ত করার ছাড়া আমার আর উপায় ছিল না।
সে আমি আরো আগেই বুঝতে পেরেছি। পল্লবদা বুঝিয়ে বলেছে আমাকে। আপনি অপুর ইতিহাসটা বলুন বরং। আর আপনার বটগাছটা কতোদূর এখান থেকে?
আর বেশি দূর নয়। চলে এসেছি প্রায়।
মেহেদি আর অপুর পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল এই শক্তিমতি কারখানাতেই। তখনও পল্লব ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে সখ্যটা ছিল না সেভাবে। পল্লবই বরাবরই একটু একা থাকতে ভালোবাসে, আর মেহেদি চায় সঙ্গ। এদিকে অপুর সঙ্গে বন্ধুতা যখন জুটেছেই, তখন পল্লবের ওপর প্রত্যাশার চাপ অনেকটাই কমে গেল। ক্রমে সেও নিজের মতো থাকতে শুরু করল আর বন্ধুতা ক্রমে জমাট হয়ে উঠল মেহেদি-অপুর ভেতর।
কারখানা কাজের এমন এক স্থল, এখানে বন্ধুতার মতো কোমল কোনও অনুভব টেকে না। স্বার্থপরতা আর যান্ত্রিকতার মধ্যে পড়ে নিজস্ব-আকার হারায়। তা দুজনের মানসিক দূরত্ব সৃষ্টির ভেতর দিয়েই হোক, আর দুজন পরস্পরের সংস্পর্শ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়াতেই হোক। তখন আগের সেই কর্তাব্যক্তির কাল। ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এর কথা তো বোধয় আসার পর থেকেই শুনছেন। পদে পদে শ্রমিকদের, প্রকৌশলীদের, অফিসে যে কোনও পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর নিজ ক্ষমতার সবটা খাটিয়ে চলেছেন। পদাধিকারের শক্তি যখন প্রয়োজন পড়ছে না, তখন কণ্ঠের শক্তি প্রয়োগ করছেন। যে কোনও মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চিৎকার করে উঠতেন। একটা মানুষ কথায় কথায় ধমকাচ্ছে তাতে ভীতির সঞ্চার কার্যকর পথে হয় না। কিন্তু একটা মানুষ কথায় কথায় বরখাস্ত করছে, তখন ভীতির সঞ্চার হয়। সেই ভীতির ছাপ কাজের ওপর পড়ে কাজের মান পড়তে থাকে। কেউ কেউ আবার নির্লিপ্ত হয়ে যায়।
অপু ছিল এই নির্লিপ্তদের দলে। এর আগে কখনও এমন বাজে আচরণের শিকার সে হয়নি। আর তখন নতুন কর্মক্ষেত্রে এসেছে, এসেই বুঝেছে এ জায়গা এতোদিনের বিচরণের জায়গাগুলোর মতোন নয়। এটা জীবন সরবরাহের বিনিময়ে জীবন কেড়ে নেওয়ার স্থল। এমনটাই সে বলতো। আর বলতো, আদতে কোনও অর্জন কিন্তু নেই। বরং ক্ষয় আছে। কারণ রসদটা জৈবিক শরীর যোগাচ্ছে, তার ওই শরীর তো ক্ষয়িষ্ণু। এর বদলে ততটুকু আসছে, শোষণের পর যেটুকু অবশেষ।
এসব ভাবনা অপু শুধু নিজের ভেতর রাখতো না, ছড়িয়ে দিতো। কারখানার আচরণ নিয়ে কথা বলত, কাজের পরিবেশ নিয়ে কথা বলত, বলতো এ বেতন যথেষ্ট নয়, বলত কাজে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতির কথা। এখানে অনেক যন্ত্রপাতি ছিল জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারখানার বেশ কটি ঘর রয়েছে যেখানে কাজ করা-শ্রমিকদের শরীরের ভেতরটা ক্ষয়ে যেত। যেখানে শ্বাস নেওয়া যায় না, যেখানে ধাতব যন্ত্রপাতিও ক্ষয়ে যায়। যেখানে ছাদের পলেস্তরা খসে পড়ে, বাতাসে রাসায়নিকের উপস্থিতি দেয়ালের রঙে ধরা পড়ে, চোখ মেলে রাখা যায় না বেশিক্ষণ। অপু কারখানার ওই বর্জ্য রাখার জায়গাটা নিয়ে কথা বলত, বলত ওটা রোগের আখড়া, ওটার সংস্কার প্রয়োজন, বলত কারখানার বর্জ্য এভাবে খোলা ফেলে রাখা যায় না। যত পরিত্যক্ত ধাতু, পোড়া তেল, দূষিত জল, রঙের রাসায়নিক, এসব ব্যবহারের আলাদাবিধি রয়েছে। পড়ে থাকলে বাতাসের সঙ্গে সারাক্ষণ বিক্রিয়া ঘটছে। ক্ষতি তো সবার! কিন্তু খরচা মালিকের। ওখানেই ঠেক।
এখানেই শেষ নয়। সেরের ওপর সোয়া সের ছিল, কারখানার শ্রমিকদের জন্য ওর রাতের স্কুল খোলা। কারখানার পেছনে সে বয়েসী সজনে গাছটা আছে, তার নীচে বসতো ইশকুল। অপু ঢাকা থেকে নিজের তৈরি একটা ব্যাটারি নিয়ে এসেছির স্কুলের বাতি জ¦ালতে। সারাদিন খেটেকুটে কারখানার বাকি সবাই যখন বিছানায় শরীর এলিয়ে দিত, অপু তখন কারখানার বাইরে খাটছে। ব্যাটারি সেট করতো, লম্বা করে তিন সারি চট বিছিয়ে দিতো গাছের নিচে। গাছটা থেকে পায়ে চলা পথ ছিল আরও বেশ খানিকটা দূরে, ফিট ত্রিশেক। চটগুলোর এককটা ওই রাস্তার কিছু আগে শেষ হতো।
প্রথম যেদিনের অপু শ্রমিকদের বলল ওর পরিকল্পনার কথা, প্রথমত কেউ ওর কথা বুঝতেই পারল না। আর যখন কিনা বুঝল, ঠিক বিশ^াস করতে পারল না, কেউ এমন কথা বলতে পারে। অপুর ভেতর অন্যরকম প্রাণশক্তি আর উৎসাহের একটা অফুরন্ত ঝরণাধারা ছিল। ওর পাশে কিছুক্ষণ মাত্র দাঁড়ালেই সেই ঝরণাধারার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। অপু বলেছিল, ওর দাদা ছিলেন গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক, ফেনীর পালী উপজেলার কুহু গ্রামের সমস্ত মানুষকে তিনি একা অক্ষরজ্ঞান দিয়েছিলেন।
অক্ষরজ্ঞান তো খঞ্জরের মতো, দুই দিকেই কাটে। আর ছুরি যার হাতে পড়ে সে যেমন নকশা কাটতে পারে, তেমন খুনও করতে পারে। কুহু গ্রামের লোকের মধ্যে মোহিনী নদীতে জেগে থাকা চর নিয়ে ছিল ভারি দ্বন্দ্ব। ওই দ্বন্দ্ব অপুর দাদা বহু চেষ্টাতেও দূর করতে পারেননি। তিনি বলতেন, বিষয়ের বিষ মরবার আগে মানুষকে শতবার মারে। শেষতক গ্রামটা দুভাগ হয়ে গিয়েছিল- উত্তর কুহু আর দক্ষিণ কুহু। এবং একদিন এই দুদলের বচসার মধ্যে পড়েই তিনি প্রাণ হারান। দাদার প্রাণশক্তি এমনিতেও বিশেষ ছিল না। তবু তাকে পুঁজি করেই পৌরাণিক খরস্রোতা মোহিনীর চর পারে ফুঁসতে থাকা দুপক্ষের লড়াই থামাতে গিয়েছিলেন। বিকেলে আকাশ ক্রমে রাঙা হয়ে উঠছিল যখন, কেউ একজন তার ওপর হাতের নিশানা পরখ করল।
অপুর ভেতর ছিল ওই ধারাটা। অবশেষে যখন কারখানায় বোঝাতে পারল, অক্ষরজ্ঞান হলে তাদের বেতন বাড়বে, তারা আরও ভালো করে কাজ শিখতে পারবে, সবচেয়ে যা বড়, তা হলো নতুন কিছু তৈরি করতে পারবে নিজেরাই। বিশে^র সব শ্রমিকরা নাকি নিত্য নতুন নতুন জিনিস শিখে শিখিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। শুধু আমরাই নাকি পড়ে আছি, আর অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। এটা চলবে না। আর অক্ষরজ্ঞান পেলে ধীরে ধীরে ওরা অনেক ভালো ভালো বই পড়তে পারবে। বই যে একবার পড়তে শিখেছে, তার জীবনে উন্নতি আর ঠেকায় কে। তার জীবনে উন্নতি তো হবেই হবে, সঙ্গে তার দশ সঙ্গীরও উন্নতি না-হয়ে যায় না, বই এমনই জিনিস। আর জগতের কত গল্প কত জ্ঞানের কথা যে ওই সব বইয়ে লেখা আছে, ওসব জানলে বেঁচে থাকতে ভারি আনন্দ হয়। আর এই আনন্দের যারা শত্রু, তারা কখনও লড়াইয়ে এঁটে উঠতে পারে না, কেউ ঠকাতে পারে না। তবে শর্ত দুটো। এক, যা শেখা হবে তা নিয়ে নিজেদের ভেতর আলাপ চালু রাখতে হবে, আর দুই, সর্বাবস্থায় বজায় রাখতে হবে মহাফলদায়িনী ঐক্য।
এভাবে নানামুখী স্বপ্নের দিগন্ত দেখিয়ে অপু ধীরে শ্রমিকদের আগ্রহী করে তুলতে পারল। বসল স্কুল।
প্রথমদিন জনা পাঁচেক এলো। পরদিন রাতারাতি পনের বিশজন। এভাবে সপ্তাহ খানেক চলার পর আবার ভাটা পড়তে শুরু করল। একেবারে তিনজনে এসে ঠেকল। অপু চালিয়ে গেল, পেছনে ফেরার মতো মানুষ সে ছিল না। তিনজন নিয়ে এক সপ্তাহ চালিয়ে যাওয়ার পর আবার একজন দুজন করে ফিরতে শুরু করল। তিনটি চটের শুরু থেকে শেষ তার ছাত্রতে ভরে যেত।
অপু বলত, যাদের ওপর আমার ভরসা ছিল, তারা কেউ তেমন কোনও দৃষ্টান্ত সামনে রেখে যেতে পারেনি। সুরবঙ্গ একটা পরিণতি পাবার আগেই তারা নিজেরা তুচ্ছ কারণে, মাটি না-বুঝে, কাল না-বুঝে, দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বিনা কারণে দুটো আলাদা ছায়ার শরণ নিলো, ছিহ! তবু ভরসা এই, কাজে নামলে বোঝা যায় কী-করে কোন পথে এগোতে হবে। বলত, ভেবেছিলাম, সবাইকে একসঙ্গে বসিয়ে অক্ষরজ্ঞান দিয়ে ক্রমে শ্লোক, শ্লোক থেকে গদ্যে নিয়ে ভাষায় দখল এনে দেবে। এরপর ক্রমে সৃজনশীল থেকে কারিগরির দিকে যাবে, ততদিনে নিশ্চয়ই শিক্ষকের জায়গাতেও আর একা থাকব না। এই যে একা না থাকার কথাটা, এটা পরোক্ষভাবে অন্যদেরও তার কাজে যোগ দেওয়ার এক ধরনের পরোক্ষ আহ্বান ছিল। তার ওই আহ্বান কেউ বুঝত না তা নয়, কিন্তু ওই বিপুলা কর্মযজ্ঞের যজ্ঞী হওয়ার মতো প্রাণশক্তি, চেতনশক্তি সবার ছিল না। শুধু তাই না, ক্রমে তার এই স্কুলের বিরুদ্ধে ক্রিয়াশীল একটা গোপন শক্তি ঘনিয়ে উঠতে থাকল। আর সেটা ঘনাতে থাকল ক্রমশ ওপর থেকে।
শ্রমিকদের ধীরে স্বাপ্নিক হয়ে উঠতে দেখা গেল চোখের সামনে। মানুষ হিসেবে তাদের মেরুদ-টাকে হাত দিয়ে ধরিয়ে দিয়ে যেন কেউ বুঝিয়ে দিয়েছে।
অপুর এ নিয়ে একটা পর্যবেক্ষণটা ছিল, মানুষের অমিত শক্তিটা একটা শক্ত খোলসের ভেতর আটক নাজুক নিউক্লিয়াসের মতো। শক্ত খোল সটা এক বাড়িতে ভেঙে দিলে কোমল নিউক্লিয়াস কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই অরক্ষিত হয়ে যাওয়ায় এর শক্তি, সম্ভাবনা সব নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু প্রেরণার উষ্ণতা দিয়ে ওই শক্ত খোলসের ওপরে অবিরত ওম দিয়ে গেলে ওই অনুকূল উষ্ণতায় কুসুমে প্রাণ সঞ্চারিত হবে। একদিন ভেতরের প্রাণ বাইরের পৃথিবীর ডাকে, যোগ্য হয়ে, ওই খোলস ভেঙে নিজেই বেরিয়ে আসবে। অপুর স্কুলের নাম ও সেখান থেকেই দিয়েছিল, ওম। ওমের ওমে বেশ কাজ হতে শুরু হলো। এবং এটা যে কত বড় ফল আনতে যাচ্ছে, তারও একটা অস্পষ্ট স্বপ্ন সবার মনে তখন ধীরে তৈরি হচ্ছে। ক্রমাগত ওমের ভেতর থাকতে থাকতে শ্রমিকরা টের পেল, নেহাৎ শ্রমিক হয়ে থাকার জন্য তাদের জন্ম হয়নি, আর মনিবদের জন্ম হয়নি নেহাৎ মনিব হয়ে থাকার জন্য। একটা বড় অংশ সমাজের এতোখানি নিম্নবর্গ থেকে এসেছিল যে এই ধারণা মজ্জাগত ছিল, জন্মভাগ্যেই কেউ শ্রমিক হয়েছে, জন্মভাগ্যেই কেউ মনিব। আর এক শ্রেণির ধর্মবেত্তারা এসে বলত, বরং মনিবের মাল হেফাজত করো, ফিতনা সৃষ্টি জঘন্যতম হত্যার চেয়ে। শ্রমিক আর মনিব হওয়াটা যে কোনও জন্মগত অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়, ওরা এটা অপুর অবিরত কথার ভেতর দিয়ে একদিন হুট করে বুঝে ফেলেছে। এও বুঝেছে মনিবের যে মাল ওরা হেফাজত করবে সে মাল ওদের ঠকিয়ে গড়া কিনা দেখতব্য। নিজেরটা বুঝে পাওয়া শেখাচ্ছে কেউ— এ যে বিরাট ব্যাপার। ওদের ভেতর পড়ালেখা নিয়ে আলাপ চালু ছিল। ঐক্য তেমন ছিল না। তাই সবাই মিলিত কোনো ফল আনতে না-পারলেও বেশিরভাগই ওরা কথা-সব ভাবে বুঝে নিয়েছে। অথচ কোনও বাক্যও শুরুতে সরাসরি ওদের বিষয়টা বোঝাতে পারেনি। এর মানে ওদের মনটা ক্রমে এভাবে বিবর্তিত হচ্ছিল।
অপু প্রায়ই বলত, মানুষের ভেতর একজন আদিম দাস বাস করে। দাসবৃত্তির সুখ তার মগজের একেবারে প্রারম্ভিক গঠনে লুকোন আছে। তার অমিত শক্তিকে সুপ্ত রাখার এটা এক ধরনের প্রাকৃতিক ষড়যন্ত্র।। এটা দিয়ে শক্তিকে সাধ্যের বিপরীতে দমিয়ে রাখে। শক্তির বিপরীতে দুর্বলতার এই এক বহমান চোরাস্রোত। বিশ্ব মনিবের সাধ্য ভেতরে আছে, এর ভারসাম্য রক্ষার খাতিরে চলা দাসত্বের স্রোত। যে স্রোতের অনুকূলে চলা আরাম বলেই ঈশ্বর-ধারণার উৎপত্তি। বিপরীতে চলতে প্রকৃতির ষড়যন্ত্রকে উৎরে আসতে হয় বলে অনেক শক্তির প্রয়োজন। প্রয়োজন বলেই ওটা অর্জন করতে উল্টো সাঁতারে পেশি শক্ত করতে হয়। এরপর জীবনের বাকিটা সময় ওই ভারসাম্য বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে রক্ষা করতে হয়।
দেখতে দেখতে অপুর দুই মাস হয়ে গেল কারখানায়। অক্ষরজ্ঞান পেতে শুরু করলে সবার আগে মানুষের কণ্ঠ সরোষ হয়ে ওঠে। সে যখন হঠাৎ বুঝতে পারে, এতোদিন তার ওপর যা হয়েছে তা স্রেফ অনৈতিকতা, অবিচার। কোথাও একটা অন্যায় হয়েছে। তখন ওসবের বিপরীতে আসা সঙ্গত জেদের যে ভর, তা সে অপ্রস্তুত অবস্থায় বইতে পারে না। প্রস্তুতির জন্যেই ঐক্য, আর ঐক্যের জন্যেই শিক্ষা।
এই কি হলো কাল? শিক্ষা বলতে তো কেবল অক্ষরজ্ঞান নয়। আর শিক্ষা যদি হয় শিখা তো তা আগুন নিয়ে খেলারও শামিল। ঐক্য গড়াই কঠিন। ফলে কারখানায় অপ্রস্তুত শ্রমিকদের ওপর চেপে বসা ওই জেদের প্রতিক্রিয়ায় যে ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করলো, তা সামাল দিতে অপুও পারল না। যে শ্রমিকরা মাথা গোঁজ করে চুপটি করে কাজ করত, তারা কথায় কথায় আপত্তি তুলতে লাগল, আর কার্যালয়ের সামনে যখন তখন আসতে থাকল জোটবদ্ধ অভিযোগ।
শ্রমিকদের ভাগ্য ভালো ছিল না, কারণ তখন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ওই এমডি, নামটা উহ্যই থাক। একদিকে তার জেনারেলপনা দিয়ে সবাইকে কোণঠাসা করে রেখে, অপরদিতে ভেতরে ভেতরে সে যা করছিল তা ছিল দুর্নীতির চূড়ান্ত। বড় বড় কাজগুলো গোপনে নিজ প্রতিষ্ঠানের দিকে চালিয়ে দিয়ে শক্তিমতিকে তিনি ধীরে ফতুর করে তুলছিলেন। তাই কারখানায় কাজের পরিবেশ তৈরিতে, শ্রমিকদের নিরাপত্তা বাড়াতে সঙ্গত দাবিগুলো পূরণ করার সক্ষমতা শক্তিমতি ধীরে হারাতে শুরু করেছিল, তা তিনি ভালোই জানতেন। তার মতো ভালো না জানলেও আধাআধি জানতেন— আরো যারা পরিচালক ছিলেন তারা।
এর ফলে যা হলো তা অনুমেয় ছিল। শ্রমিকদের ওপর এমডি চড়াও হয়ে উঠলেন। আর তাদের উস্কানিদাতা হিসেবে চিহ্নিত করলেন অপুকে। অপুকে কী করে চরম লজ্জাজনক পরিস্থিতি তৈরি করে, স্মরণকালের শাস্তি দিয়ে, সারাজীবনের জন্য প্রাণশক্তি হরণ করে কারখানা থেকে বিতাড়িত করা যায়, তা খুঁজে বের করতে তিনি উঠে পড়ে লেগে গেলেন এবং পেয়েও গেলেন উপায়।
এর আগে অপুকে দেবতার স্থান দিয়েছিল যে শ্রমিকরা, তাদের মধ্যে চোখ আর পেশির শক্তিধারী শ্রমিকদের তিনি কারখানার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি চুরির অজুহাত দিয়ে, যন্ত্রের দাম বেতনে থেকে কাটিয়ে ভীষণ লজ্জাজনক পরিস্থিতি তৈরি করে বিদায় করলেন। এই চুরির কলঙ্ক তিলক এমন স্থায়ী সিলমোহরের মতো ওদের কপালে সেঁটে দিলেন, শ্রমিকরা ধারে কাছে আর কোথাও চাকরি পেল না। তাদের দূরদূরান্তের শহরে পাড়ি জমাতে হলো। কেউ চলে গেল দরিয়ারকূল চট্টগ্রাম, কেউ বাঘহাটা খুলনা, কেউ শপথনগর কলকাতা, কেউ রূপোসনগর ঢাকা। মানে যেটুকু প্রয়োজন ছিল না, সেটুকু সাবধানতা অবলম্বনও করতে ছাড়লেন না ব্যবস্থাপক।
এও বলে দিলেন, মামলা করলেন-না নেহাৎ তিনি ওই ধাঁচের লোক নন বলে। আর কেউ হলে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়তো, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ছোটলোকের সঙ্গে তিনিই কেবল ছোটলোক হতে পারলেন না— এই বলে গৌরব করলেন।
অপুর জন্য তিনি আধ-জটিল এক ছক আঁকলেন, যে ছকের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা অপুর ছিল না। লোকবল তো আগেই তৈরি ছির ব্যবস্থাপকের, তাই পেতে রাখা ফাঁদে অপু এমনভাবে পড়ল যে তার হয়ে লড়ার দূরে থাক, কাঁধে হাত রাখারও কেউ থাকল না। যে নকশার সূত্র ধরে সকালে সৌরভের সঙ্গে একচোট হয়ে গেল— সেই নকশা দিয়েই বানানো হয়েছিল নীলনকশা। পরিকল্পনাটা ছিল এমডির। কার্যকর করেছিল প্রবাল আর সৌরভ। প্রবাল ছিল বিপণন বিভাগের উঁচু পদের প্রকৌশলী। একইসঙ্গে এমডির শ্যালকও বটে। তবে ধূর্ততায় আরো কয়েক কাঠি ওপরে সন্দেহ নেই। নয়ত এমডিকে তাড়ানোর আগেই বিদেশে প্রশিক্ষণে যাবার নাম করে কৌশলে পাওনাদি বাগিয়ে ছুটি নিয়ে সটকে পড়ে কী করে? ওটা তার আলাদা মুনসিয়ানা। ওসব পরের কথা আরো। যখনকার কথা বলা হচ্ছে সৌরভ তখনো এ কারখানার প্রধান। বেশিদিন আগের কথা তো আর নয়। তো— ফন্দি আঁটল এমডি, তার কাজে লাগাতে নড়ে উঠল প্রবাল আর সৌরভ। অপু ছিল মাননিয়ন্ত্রণ বিভাগে। তখনও কারখানায় আলাদা কোনো গবেষণা বিভাগ ছিল না, এখনো নেই। তবে মাননিয়ন্ত্রণে যারা থাকে তাদের দিয়ে গবেষণার ছোটখাটো কাজও করিয়ে নেওয়া হতো। ওই সূত্রেই মাত্র দ্বিতীয় মাসে নকশাটা চূড়ান্ত করতে পেরেছিল অপু। তার পর্যাপ্ত সুবিধাদি ছিল তখনও, ওই নকশাকালের কথা। যখন-তখন যে কোনো কিছু নেওয়ার অধিকার ছিল তার কারখানার ভাঁড়ার থেকে। আসলে এই এক শ্রমিকদের জাগাতে চাওয়া ছাড়া কর্তৃপক্ষের চক্ষুশূল হওয়ার মতো আর কোনো কিছুই ছিল না অপুর। বরং ওকে নিয়ে গর্ব করতে পারে যে কোনো প্রতিষ্ঠান। নকশাটা চূড়ান্ত হওয়ার পর সৌরভের জিম্মায় তা চলে গেল। এ ধরনের নকশা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যে অমূল্য সম্পদ। এদিকে অপুর উত্থানে যে ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারত তা ঠেকাতে ওই অমূল্যকেও মূল্যে বাঁধতে বাধ্য ছিল এমডি। কারণ তা-না হলে তার থলে ছিঁড়ে বেড়াল বেরিয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। নিজ প্রতিষ্ঠান গুছিয়ে শক্তিমতি থেকে সটকে পড়বার মতলব থাকলেও তখনও তার অনেক কাজ ছিল বাকি। তাই স্বার্থসিদ্ধির জন্যে শক্তিমতির ভাগ্য নিয়ে আরো একটি জুয়া খেলতে সঙ্গত কারণেই তার বাধেনি।
হঠাৎ একদিন অপুকে হেড অফিসে ডেকে পাঠানো হলো। মারকুটে এমডির শ্যালক প্রবালের কণ্ঠটা চিনতে ভুল হলো না অপুর। পদাধিকারে প্রবাল অনেক ওপরে ছিল বলে দ্বিতীয় প্রশ্নের কোনো অবকাশ ছিল না। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তখনই ষড়যন্ত্রের আভাস দিয়েছিল অপুকে, ঘনিষ্ঠদের বলেছিল সে কথা। কারখানায় আসার আগে যে কদিন প্রধান কার্যালয়ে ছিল ওই কদিনেই এমডির ডান, বাম, ট্রাম, নন্দঘোষ সব রকমের ঐধহফং অপুর একটু আধটু চেনা হয়ে গিয়েছিল। প্রবালের সঙ্গী হয়ে বেশ কবারই ক্রেতার বৈঠকে বসেছিল অপু। ক্রেতা যেভাবে যা চায়, সামনে হ্যাঁ স্যার— নিশ্চয়ই স্যার— বলে কয়ে কাজ বাগিয়ে নিতো, কিন্তু কারখানায় পাঠানো সরবরাহে যেত নকলসহ নিম্ন মানের সব যন্ত্রাংশ। যে প্রস্তবনা ক্রেতার কাছে যেত সে নির্দেশনা কারখানায় কখনও আসতো না। না চাইতেও এমন দুর্নীতি-শেকলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে হচ্ছে— অপুর জন্যে এসব ভীষণ মনোপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার ভাবনা ক্রমে অন্যদের ভেতরও কি সঞ্চারিত হয়নি? দুটো পাশাপাশি দেশের ভাষায়ও তো দেখা যায়, একের সৌরভ আরেকের কণার সঙ্গে মিশেছে। তো— প্রতারণার দীর্ঘসূত্রী ক্ষতি থেকে প্রতিষ্ঠানকে, আরো বড় পরিসরে গোটা সুরবঙ্গকে বের করে নিয়ে আসার একেবারেই শুরুর ধাপ হিসেবে কাজটা করতে চেয়েছিল অপু। চেয়েছিল শ্রমিকদের মনোগঠনকে আদর্শের আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি করতে। মালিকপক্ষ এমন এক প্রক্রিয়ার ওপর দিয়ে যায় যে কালক্রমে নিজ অস্তিত্বের স্বার্থে শ্রমিকদের ওপরই তাদের নির্ভর করতে হয়। শুধু মালিকপক্ষই নয়, মালিকপক্ষের প্রতিপক্ষ আরো নানান শ্রেণি নিজ নিজ স্বার্থে ক্রমে ওদেরই শরণাপন্ন হয়। অর্থাৎ তথাকথিত নিচতলার ও নীচতলার এই শ্রেণির সংসর্গে সবপক্ষকেই আসতে হয়, কম হোক কি বেশি। আর তখনই ওদের প্রভাবিত হওয়ার কাল এসে উপস্থিত হয়। অপুর ভাবনায় ছিল, প্রভাবিত হওয়ার কালকে প্রভাবিত করার কালে পরিণত করা চাই। ও বলতো, এখানে আসবার আগে আমি এতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে কোনোদিনও এসব ভাবতে পারিনি। আসলে মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ জ্ঞানের একটা বড় অংশ যৌথ জীবনে এসে পূর্ণতা পায়।
তো— ওপরের নির্দেশমতো নির্দিষ্ট সময়ে ঢাকার হেড অফিসে গিয়ে পৌঁছুল অপু। সেখানে তার জন্যে এক মহানাটক অপেক্ষা করছিল। যখন গোটা প্রতিষ্ঠান তার ভেতরকার কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে লাগে, আর পর্যাপ্ত লোককে নাচাবার সুতো থাকে কর্তার হাতের মুঠোয়, তখন আক্রান্তের নিজেকে রক্ষার উপায় সঙ্গত কারণেই আর থাকে না। সেইসঙ্গে কর্মীদের সামনে একটি উদাহরণ তৈরি করে দেখিয়ে শেখানোর পরিকল্পনা যদি প্রতিষ্ঠানে থাকে, তখন তো প্রাণবিয়োগও যথেষ্ট নয়। অপু গিয়ে দেখতে পেল শক্তিমতির সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী হেরার কারখানার এক কর্মীর ইমেইল ঠিকানায় অপু নকশাটি পাচার করে দিয়েছে। অপুর নামে তৈরি একটি ইমেইল ঠিকানা থেকেই পাঠানো হয়েছে ওই নকশা। এ বিষয়ে অপুর ভাষ্যটি জানতে চাওয়া হলো।
অপমানের চূড়ান্ত করিয়ে চোর সাজিয়ে সেদিন কার্যালয় থেকে বিদায় করে দেওয়া হলো অপুকে। অপু কি চাইলে প্রমাণ করে দিতে পারতো-না যে এটি তার পাঠানো নয়? পারত বটে। কিন্তু সে ঠিকই বুঝেছিল, তাতে করে তার শেষরক্ষা যেমন হবে না, তেমনই অন্য আরো অনেকেই এর সূত্র ধরে পড়বে বিপদে। তদুপরি নীচতার এই সীমা অতিক্রমকারী মানুষগুলো অধীনে নিজেকে আর দেখতেও চায়নি অপু। তাই কাঁটার মুকুট পরে বেরিয়ে এলো রক্তাপ্লুত অপু। কারখানায় এসে গোছগাছ করে চলে যাবার সময় বলেছিল, তার ভেতর যদি কণা পরিমাণ সত্যও থেকে থাকে, তো প্রতিষ্ঠান একদিন অনুতপ্ত হবে।
যেহেতু কারখানার অফিসঘরে সৌরভের ডেস্কটপ কম্পিউটারটাই গৃহিত সব নকশার সিন্দুক, তাই ওখানে সৌরভের উপস্থিতি এবং একান্ত বিশ^স্ত হয়ে ওঠা ছাড়া কার্যালয়ে কেউ যেতে পারবে না— এমন একটা লিখিত নিয়ম কারখানায় সেঁটে দেওয়া হয়। সে নিয়ম এবার চুনকাম করবার সময় হাওয়া হয়েছে, কিন্তু চোখে আঙুল দিয়ে শেখানোর মানুষটি যেহেতু এতো ধুলো সাফ করার পরও রয়ে যেতে পেরেছে, তার হাতে ইস্যু তুলে না-দেওয়াই ছিল সমীচিন এবং মেহেদি ঠিক তাই করেছে।
এর দিনকয় পর তার গোমর ফাঁস হয়ে গেল। ফাঁস করলো হেরার ওই কর্মচারীটিই, যার ইমেইল ব্যবহার করা হয়েছিল। এমডির সঙ্গে লেনদেন নিয়ে নিশ্চয়ই গোল বেঁধে থাকবে। অন্য পরিচালকরা সেই প্রথম নড়েচড়ে বসেন। এর আগে তারা এমডির ওপর এতোখানি বেশি আস্থাশীল থেকে গায়ে এতোটাই মেদ জমিয়ে নিয়েছিলেন যে অনুতাপের আর অন্ত থাকলো না। তারা নিজেরা যখন অনেক কাগজপত্র প্রমাণাদি চাইলেন এমডির কাছে, তারুণ্যের বন্ধুত্বে ধরল ফাটল, বচসা ঘনিয়ে উঠল। আর বেরিয়ে পড়ল থলেতে গোল পাকিয়ে থাকা অনেক বেড়াল। এরপর কী হলো? প্রকৃতিতে বরাবরই যা হয়। সবাইকে যত অপমান তিনি করেছিলেন, তার প্রায় কিছুই মাটিতে পড়েনি। প্রায় সবটাই তার নাকে মুখে লেপে তাকে বের করে দেওয়া হলো। পুঁজির এমন বিশাল গুদামগুলোয় যতো পুঁজ ধরে, আর সে পুঁজে যত দুর্গন্ধ ভর করে, সব একটার সঙ্গে আরেকটা টেক্কা দিতে পারে।
ব্যবস্থাপককে তাড়ানোর পর অপুকে আবার ফিরে আসতে বলা হলো। কিন্তু সে কি আর আসে? ব্যবস্থাপক চলে গেলেও, তার ভূত কিন্তু আজও রয়ে গেছে। এবং এখনও সে প্রতিশোধ নিতে, শক্তিমতিতে ভোগাতে, ভীষণ ভোগাতে, শতপথে তৎপর হয়ে আছে। আর এটাই সেই ঘোরালো কারণ। যে কারণে সলিলকে তখন কার্যালয়ে উঠতে দেওয়া হয়নি, যদিও সৌরভ তখনও ছিল কার্যালয়ে। সবাই জানে কারখানার, কেবল নবাগত ছাড়া। সৌরভ থাকা এবং না থাকা একই রকম ভয়ঙ্কর। তখন সলিল অপুর প্রতিস্থাপন হিসেবে এসেছে বলেই, মেহেদি তাকে রক্ষার আলাদা দায় অনুভব করেছে।
সংক্ষেপে এই। মনে হলো যদিও অনেক কথা বলেছি, এরপরও বলব, সংক্ষেপে এই। অপুর সঙ্গে দুটি মাস কাটানোর স্মৃতির কোনও শেষ নেই। প্রথম মাসে অপুর বেতন জানালা দিয়ে চুরি হলো। কে জানে, হয়ত করানো হয়েছে। তখন গরমকাল, মানুষ ভূতের ভয় পায়, তবু তা গরমের ভয়ের চেয়ে বেশি না, অবস্থা এমন। পল্লবের পাশের ঘরেই অপু থাকত, ওখানে গেলে দেখতে পাবেন, উঠোনের এক কোণে দুটো কবর আছে। গৃহস্থেরই দুই আত্মীয়ার, এরা কী করে মারা গেছে জানা নেই, তবে মৃত্যুর পরও ওদের পর করা হয়নি, প্রাঙ্গণে, মানে ঘরেই ওরা আছে। সবচেয়ে সম্পন্ন গৃহস্থ।
এক রাতে ভীষণ গরম, জানালা খুলে শুয়েছিল অপু, খুলেই শোয় ও বরাবর। অনেকদিনের নাকি অভ্যাস। বাড়িতে নাহয় চার-পাঁচ তলার ওপর থাকে, জানালা বন্ধ করাটা ইচ্ছাধীন। কিন্তু এখানে তো তা সাবধানতার অংশ। যেদিনের ঘটনা সেদিন কারখানায় বেতন হয়েছিল। কারখানায় বেতন হলে সেটা এলাকায় আর গোপন থাকে না। কারণ টাকা নিয়ে তো মানুষ বাজারে দৌড়োয়। অপুর ঘরে আসি। অপরপাশের দেয়ালে ওর প্যান্টের পকেট থেকে বেতনের খামটা আর বের করেনি, ওভাবেই শুয়ে পড়ে। অফিস থেকে বেরিয়ে সামনের ওই দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনেছিল, তাতে কিছু খুচরা মিলেছিল, ওই খুচরাগুলো প্যান্টের সঙ্গে জানালার কাছে মেঝেতে পড়ে ছিল, সকালে উঠে দ্যাখে। আর খাম হাওয়া। একটা মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে নিজ বাসা থেকে বহুদূরের এক কারখানায়, তার এক মাসের শ্রমের বেতন নেই, কোনো উদ্বৃত্ত টাকা নেই, বাড়িতে টাকা চেয়ে পাঠানোর মুখ নেই, তার দিনগুলো কেমন ছিল?
মূলত ভুলটা অপুরই। তবু শহর থেকে আসা একটা ছেলে কতটাই বা আর সাবধান থাকতে পারে, আর প্রয়োজনই বা অনুভব করতে পারে। যেখানে কেউ তাকে সাবধানও করেনি, আর এমন কোনও ঘটনাও কখনও ঘটেনি। এর পর থেকে পল্লব কখনই আর তার ঘরে শিয়রের জানালার খোলে না। গেলে দেখতে পাবেন। সম্ভবত আজ রাত থেকেই আপনি ওখানে চলে যাবেন। দেখুন, বন শুরু হয়ে গেছে, দেখেছেন!
দূরে ঘন হয়ে মাথা নাড়ছে আঁধারলক্ষ্মী শালবন। এই অন্ধকারকে কেমন আরও রহস্যে মুড়ে রেখেছে, আর আলোকে করেছে সে রহস্যের উপজাত। আকাশে অর্ধেকটা চাঁদ, যেন রূপালি ভাঙা একটা আয়না। বাতাসে একাটা রাজকীয় ঘনত্ব, রেণুর, ঘ্রাণের। আর শীতলতা বেশ আগে থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। দেখা গেল দুধকুমার নদ। অনেক শোনা সেই নদী, বনগামী, বনসংসর্গী, বনবাসী। বনের এক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে দুধকুমার আর ওখানেই থেমে গেছে বন। নদীর ওপারে বন, আর এ পারে সে বনবিষ্ণু অশত্থ। চাঁদের আলোয় তাকে ঘিরে আছে আশ্চর্য আলোছায়া। ছড়িয়ে যাওয়া সহ¯্র পত্রল শাখা আর নামিয়ে দেওয়া অগণিত স্ফীত ঝুরি হাতের বেড়ে আঁটবার দশা। এর ভেতর আসল কান্ডটিকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সলিলের বিস্ময়বিস্ফারিত চোখ, নির্বাক ঠোঁট জোড়ার মধ্যখানে অল্প একটু বোকাটে ফাঁক আর রিকশা থেকে নেমে সরল দাঁড়িয়ে থাকবার এই ভঙ্গিটি দেখে মেহেদি মুখটি নিচু করে হেসে একবার মাথা নাড়ল। রিকশা থেকে ততক্ষণে সেও নেমে গেছে। পাশ থেকে সলিলের কাঁদে হাত রেখে বলল, এই নদীই বনের সীমানা। নদীর জলে কিন্তু ফল টল ভেসে আসে, এ পাশেও দেখবেন, যদি কখনও আসেন দিনের আলোয়, বন গজাতে চাইছে। এভাবেই কিন্তু বাড়ে বন। কিন্তু মানুষ এর বেশি আর হতে দিতে রাজি না। দেখছেন না রাস্তা হয়ে গেছে? এ রাস্তা মনময়পুর-ঢাকা মহাসড়কে গিয়ে মিশেছে। সুতরাং নদীর ওপারেই বনের ইতি।
সলিল মুগ্ধচোখে রূপালী দুধকুমা নদ, এপারের অশত্থ আর ওপারের বনের দিকে বারবার দৃষ্টিবদল করছে। নদীর ওপারের শুরুতে গাছপালার ঘনত্ব খানিকটা কম, ক্রমে ভেতরের দিকে ঘনত্ব বেড়েছে। বাড়লে কী হবে, চাঁদের আলো কোথায় আটকায়নি, গোটা বন জোছনায় রিন রিন করে গান গাইছে। বাতাস বাজিয়ে চলেছে সুর।
স্বর্গের কল্পনার চেয়েও সুন্দর!
এই তো শুরু হয়ে গেল কাব্য কবির। হাহাহা!
সলিল প্রাণ খুলে হাসল। উঁচু নিচু পথে হাসি, কথা সবকিছুই তরঙ্গিত হয়ে যাচ্ছে। কণ্ঠ, হাসির শব্দ কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে, আবার কখনো ভেঙে পড়ছে, কিন্তু ভাবপ্রকাশে ছেদ পড়ছে না।
সত্যিই মেহেদি ভাই। আমি জানি না আপনাকে কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাব। আমার মনটা ভার হয়ে ছিল খুব। আর আপনি বেছে বেছে এমন একটা জায়গায় আমায় নিয়ে এলেন।
বেশ খানিকটা সময় নিয়ে অশত্থ-জোছনার উদর, নদ-জোছনার কোল আর বনজোছনার সংসর্গ যাপন করল ওরা। হঠাৎ চাঁদের আলোয় ঝিকিয়ে উঠতে থাকা রুপালি হাতঘড়িটায় চোখ রেখে মেহেদি বলল, রাত বেশি হয়েছে বলা যায় না, তবে খাবার দেওয়ার সময় হয়ে এসেছে। আটটার কাছাকাছি বাজে। থাকবেন আরো? নাকি যাবেন।
আপনি কী বলেন। উত্তরের আশায় মেহেদির চোখে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকল সলিল।
এখানে সময় কাটাতে আরেকদিন নাহয় আলাদা সময় নিয়ে আসব, কেমন? এখন তো খাবার দেয়ার সময় হয়ে আসছে, তার ওপর আপনি আজ নতুন ঘরে উঠবেন। যতো তাড়াতাড়ি ওদের জবষবধংব করে দেওয়া যায় ততোই ভালো। তাই বলছি, আজ ফেরা যাক। তবে নদীর পাশে একটু ধূমপান হবে না?
ফিরে রাতের খাওয়াটা ধরা গেল। যদিও ছিল প্রায় শেষের পথে। সলিলকে থেকে যেতে হলো অতিথিশালাতেই। বাড়িওয়ালা ঘরটায় কী সব ঘরোয়া জঞ্জাল যেন রেখেছিল। এতোদিনেও নাকি ওসব সরানো হয়নি। কাল সরিয়ে দেবে, রবি জানাল। রাতে প্রথমবারের মতো মশারী টাঙাল সলিল। শুয়ে শুয়ে চোখ রাখল সূক্ষ্ম সুতো তৈরি খাঁচার ছাদে। পাখার বাতাসে মশারীর ওপরকার তলে দুধকুমারের ঢেউ। সারাদিনের ঘটনাপ্রবাহ মগজ থেকে মেরুদ- হয়ে কোমরের দিকে গেল ছুটে। চোখজোড়া বন্ধ হলো সে রাতের মতো।
চলবে
কারখানার বাঁশি: পর্ব-৮॥ হামিম কামাল