॥পর্ব-২৩॥
বিন্দুর সামনে বাতাস বুঝি থেমে ছিল। ভেতরে ঢোকার আগে সবাই সবার মুখ পরীক্ষায় নেমেছিল বাইরে। দেখোনি? টঙ দোকানে জমাট ভিড়ের কাছে কান পাতলে কেবল শোনা যাচ্ছিল গতকালে কথা, শুনেছ নিশ্চয়ই। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলে চলেছে সবাই, যে যা দেখেছে, সয়েছে। ওখানেই শোনা হলো, কাউকে পুলিশ নিয়েছে, কেউ পুলিশের পেছন পেছন গেছে স্বেচ্ছায়। তবে থানার বাইরের ধাতব তোরণ পর্যন্ত বড়জোর। এর ভেতরে ঢোকার সাহস কারো ছিল না, সাধ্যও নয়। তবু আপন মানুষগুলো ভেতরে প্রবেশপথে যেভাবে পড়ে ছিল বেশ অনেকটা সময়, তাতে তাদের ওভাবেই ছেড়ে আসা অনুচিত জ্ঞান করেছিল ওরা। থানা ঘরের দরজা কখনো বন্ধ হয় না, আসা যাওয়া চলে সারাক্ষণ, কে না জানে। নোংরা এক পর্দা ভেতর বাহিরের মধ্যে পার্থক্য হয়ে দুলছিল আর বাতাসের ডাকে তার সাড়া ছিল প্রগলভ প্রেমিকের মতো। বন্দি সঙ্গীদের পেছন পেছন আসা জনা পাঁচেক সাথী তখন বাইরে শ্যাওলা ধরা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে যে মশার আসরে পা নিলামে তুলেছিল, তা শুধু ওই দোলার বরাতে দেখা পাওয়ার আশায়। কৃশকায় প্রগলভ প্রেমিকের দোদুল্যমানতায় বন্দি বন্ধুদের ছিন্ন পরিধেয় আর রক্তাক্ত শরীরের কোনো অংশ, বুকের ওপর এলিয়ে পড়া ঘামে ভেজা মাথা, কোনো কোনো দেহের থরথরানো কাঁপুনি ওরা দেখতে পারছিল কেবল। সালামকেও একই ভাবে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসিয়ে রেখেছিল, ছিল সে সবচাইতে ভেতরের অংশে। মুখ দেখে তাকে চেনার কোনো উপায় ছিল না। তাকে চেনা গিয়েছিল শরীরী ভাষায়। কনুই ভেঙে হাতের তালু মেঝেতে ঠেকিয়ে বসার একটা বিশেষ ভঙ্গি ছিল তার। ওই একই ভঙ্গিতে বসেছিল সেখানেও। কোনো কারণে তার হাত খুলে দেওয়া হয়েছিল, অথবা হয়ত বাঁধাই হয়নি। ওদের পাশেই ফাঁকা পড়ে ছিল বেঞ্চ। কিন্তু আহতদের সেখানে বসতে দেওয়া হয়নি, তা পরিষ্কার। থানার ভেতর সাদা পোশাকের আরো অনেক মানুষের আসা যাওয়া করছিল বটে, কিন্তু ওই বেঞ্চিতে বসছিল না কেউ। ভেতরে হঠাৎ খুব চিৎকার চেঁচামেচি শোনা গেল। লোহার ওপর লোহা পড়ল সজোরে, শোর উঠল খুব। এরপরই একে একে সবাইকে আবার দাঁড় করিয়ে সরিয়ে নেওয়া হলো। আর কাউকে দেখা গেল না। একজোড়া ছেলে মেয়ে বেরুচ্ছিল থানার ভেতর থেকে; বিদেশি। ওরা তোরণের বাইরে বেরুতেই দুজন এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, বসিয়ে রাখা মানুষগুলোকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে? ওরা ভয় পেয়ে ছিটকে সরে গেছে তখন। এরপর রিকশা ডেকে হাওয়া। থানার চারদিকে ঘোরার কোনো উপায় ছিল না। আর তারপর বেশিক্ষণ থাকার সাহসও ছিল না, প্রয়োজনও নয়। এরপর কী হবে? কী আর; মামলা দায়ের করা হবে। কারখানামালিকপক্ষ মামলা দায়ের করবে, পুলিশ করবে। সালাম ভাই আর বেনামি একশর নামে আগেই মামলা ছিল, মনে নেই? এবার তো পাওয়া গেছে আরো কটাকে। চাইলে আরো কটাকে ফাঁদে ফেলে বাগে আনাও সম্ভব। ওই সমস্ত মামলার প্যাঁচ কেটে বেরোতে পারে এমন সাধ্য কারো নেই। আদালতে চালান হলো, এরপর বিচার? কবে হবে তার নেই ঠিক। আর হলেও কখনই তা শ্রমিকদের পক্ষে যাবে না। কারণ শ্রমিকদের পক্ষে যতো বড় দলই থাকুক, সংগঠকই থাকুক, দেশে বিদেশে যতো লেখালেখিই হোক, সরকারের চেয়ে বড় কেউ নয়। সরকার তিলকে করতে পারে তাল, আর উকিলরা তালকে করে দেখাতে পারে তিল। সুতরাং? আর সরকার চালায় তো ওরাই। এই যে, এই বিশাল দালানের ওই আরামঘরে যে বসে আছে, তাদের মতো আরো অনেকে মিলেই তো সরকার চালায়। সরকার মানে তো কিছু মানুষই, নয়? ওরা চলে কাদের কাঁচা টাকায়। অথবা ওরাই এরা, আর এরাই ওরা; আলাদা করার কোনো অবকাশ, সুযোগ নেই কোনোটাই। ওই আরামঘরে যিনি বসে আছেন, তার ঘরে তো আর একটু পর ডাক পড়বে, জানো না?
তাই নাকি!
তাই তো শুনলাম। এই যে ঈসার বাপ। তোমাদের সাথে বসবে মালিক। নোটিশ টাঙানো। দেখো নাই?
জাকারিয়া দুপাশে মাথা নেড়ে জানালো, দেখেনি।
আরে ও এলোই তো মাত্র। যাও ভাই, গিয়ে দেখে আসো
কোথায় যাবো? জাকারিয়ার প্রশ্ন।
কোথায় আবার। ওই নোটিশ বোর্ডে। কটা নামের ওপর আবার মোটা লাল কালি দিয়েছে। তোমার নামেও।
তাই নাকি। দিয়েছে বুঝি।
যাও, দেখে আসো না ঘোড়া! আগে বাড়াও। আমরা আসছি। কাজের তো দেরি নাই।
আমি তো আজ কাজের জন্য আসি নাই, ভাই। ঘরে বসেও থাকতে পারছিলাম না, তাই এলাম। আর, জানি এসব আলাপ হবে। তাতে যদি কিছু জানতে পারি। নাহলে তো অন্ধকারে। জাকারিয়ার কপালে ভাঁজ। চোখে অস্বস্তি।
বৈঠক ডাকলো যে! যাবে?
বুঝতে পারছি না বন্ধু! তবে, কী আর যাব। আমাদের সাথে কি ভালোমতো কথা বলেছে কোনোদিন? আর গতকাল এমন ঘটনা ঘটলো। জাকারিয়া সবার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। পেছনে সবাই চুপ। ফিরে আবার গেল বন্ধুদের মাঝে। দুহাতে শেকল বানিয়ে তুলল মাথার ওপর। পরিচিত ভঙ্গি দেখে সবাই তাকালো তার চোখের দিকে। জাকারিয়া কিছু বলবে। মানে, খবরদারি করবে আরকি। আর আমি নিশ্চিত, খবরদারির সঙ্গে একটু আদরদারিও করবে। নির্ঘাৎ। এরপর ফাটল ধরাবে। আমাদের ভেতর ফাটল ধরাতে কটাকে হাত করবে। আর একবার চাইলে পারবে না তা বলি কিভাবে? পারবে একশোবার। আমাদের ভেতর থেকেই কয়েকজনকে হাত করতে চাইবে। আর এরপর কী হবে জানি না বন্ধু। বৈঠক ডেকেছে যখন যেতে হবে। এখন পিছিয়েছি জানতে পারলে সালাম ভাই কষ্ট পাবে। কী, পাবে না? এছাড়াও যেতে হবে। আমরা তো তার কথাই শুনতে চাই। নয়ত, নয়ত কাজ করবো কিসের ওপর বলো? আমাদের তো কাজ করা দরকার। জানি না আমিই বিক্রি হয়ে যাই কিনা বন্ধু! বেকার কে হতে চাই বলো? এক জায়গায় একটাবার যদি চাকরি যায়, আর কোথায় কিচ্ছু মিলবে না, তোমরা জানো না? তোমার তাহলে জানো না। যাই হোক, শেষ কথা, মালিকের সাথে আমাদের এভাবেও বসতে হবে; ওভাবেও। সুতরাং না গিয়ে কোনো লাভ যখন ওঠানো যাবে না, গিয়েই দেখা যাক না! যাব, আমি যাব।
গতকাল ওরা মার খেলো, তুমি সটকে পড়লে যে?
আমি যেতাম না। একটা নতুন ছেলে এসে ভয়ানক মার খেলো দেখলাম। ওকে বাইরে রেখে আসতে চাচ্ছিলাম। আসতে আসতে এদিকে সব শেষ। ওদের তুলছে। ভাবলাম, তালিকায় তো আছি নির্ঘাৎ। ধরা না দিই বরং। বলল জাকারিয়া। এসময় জনাকয়েকের চোখে অবিশ্বাস দেখে যোগ করল, ধরা দেওয়ার চেয়ে বাইরে থাকলে লাভ কি কেবল আমার?
ভাগ্য তোমার, নতুন ওই ছেলেটা এলো,আর তুমিও সটকালে।
আচ্ছা! উত্তেজিত জাকারিয়া, আর তুমি? তুমি কোথায় ছিলে চাঁদ?
আমি? ছিলাম।
ছিলে তো বুঝলাম। কিন্তু কোথায়? শোনো, আমার হাতে শুধু কালকের বিকালটাই না, আরও অনেক বিকাল ছিল, আছে, থাকবে। আর এটা কোনো একদিনের ব্যাপার না, আমরা গতকালে প্রথম মার খাই নাই, শেষও না। আরেকটা কথা। তোমাদের কার ভেতর কতটুকু ঘি, তা এই জাকারিয়া জানে। খুব ভালো করেই জানে।
জানে সবাই তোমার কথাও!
আরে যা যা! ওসমানের চোখে আগুন। দুজনকে আলাদা করে দিলো বেশ কজন।
এই যে, ফালতু কথায় নষ্টের সময় নাই। জাকারিয়া, ঈসার বাপ না তুমি? তোমাকে তো আমরা চিনি। যে যাই বলুক, সবাই কিন্তু তোমাকে ভালোবাসে। ওসমানের মাথা ঠিক নাই। এই নীলুরে না তুমি ভালো পাও। এই নিলুই বলছি। নাও, থামো।
তাহলে আলাদা করে বীর হতে চাস এখন? এখন বীর হতে চাস? সান্ত¡নায় চোখের আগুন নিভলো না লোকটার। ঠেলে দেওয়া শরীর নিয়ে টাল সামলে ঘুরে দাঁড়িয়ে বারবার বলে যেতে থাকল, এখন একা বীর হওয়ার সময় না কিন্তু, এটা মনে রাখিস। কাজে আসবে। এখন একেবারেই একা বীর হওয়ার সময় না, আবারো বলে দিলাম। একা তোর কাছে আমার চাওয়ার কিছু নাই।
ওসমানের দিকে আগুনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, অনিলের দিকে একবার তাকিয়ে পরমুহূর্তে আবারো প্রথমজনার ওপর রাখলো আগুন চোখ। এরপর ঘাড় ঘুরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে চুপচাপ, গিয়ে দাঁড়াল নোটিশ বোর্ডের সামনে। পেছন থেকে কেউ আর কোনো কথা বলল না।
জাকারিয়াসহ মোট দশজনকে ডাকা হলো মালিকের ঘরে। ঘরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হয়েছে, সজোরে সশব্দে ঘুরছে পাখা। পাখার বাতাসে কাচ বসানো সাচিবিক টেবিলের ওপর সুদৃশ্য কাচপাথরে চাপা দিয়ে কাগজের কোণগুলো সশব্দে উড়ছে। শীতাতপ যন্ত্র চলার সময় ঘরের জানালাগুলো যেমন বন্ধ ছিল, এখনো তেমনই আছে। তাই দরজা খোলা থাকায় বাইরের বাতাস ঘরে প্রবেশ করে ঘরটিকে দ্রুত গরম করে তুলল। পাখার বাতাসে সেই গরম বাতাসই চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকলো ঘরে। আর জানালা ঢাকা ভারি পর্দাগুলো দোলাতে থাকল অল্পস্বল্প।
টেবিলের এক পাশে অর্ধবৃত্ত রচনা করে দাঁড়িয়ে সবাই। অপরপাশে আরামচেয়ারে শরীর এলিয়ে একে একে সবার মুখ পরীক্ষা করে চলেছে মালিক লোকটি। ফর্সা ঘৃতললিত স্থূল মুখ, কালো চাপদাড়ি, ছাঁটা গোঁফ, টাক পড়া মাথা। পেছনদিককার চুলেগুলোও সযতেœ ছাঁটা বলে কোনো অনুমান করা চলে না মাথায় চুলের অস্তিত্ব সম্পর্কে। চোখগুলো তার আয়ত, শান্ত, মনির রঙ ঘোর কালো। ওপরের ঠোঁটের তুলনায় নিচের ঠোঁট তুলনামূলক পুরু। যখন কথা না বলে চুপ করে থেকে কেবল দেখে যায়, তখন মুখটা অল্প হাঁ হয়ে থাকে আর নিচের ঠোঁট খানিকটা এগিয়ে যায়। হতে পারে, এ বিষয়ে সে সচেতন, তাই মনে পড়া মাত্র ঠোঁট ভেতরে টেনে মুখটা বন্ধ করে ফেলে। চোখজোড়া শান্ত হলেও মনের চাঞ্চল্য ফাঁস করে দিচ্ছে আঙুলগুলো। টেবিল কিংবা চেয়ারের হাতলের ওপর দ্রুত তালে এবং লয়ে ওগুলো নেচে চলেছে। বাঁ হাতের মধ্যমায় সোনার আঙটি, তাতে লাঙলের ছবি খোদাই করে তোলা। ডান হাতের মধ্যমায় ভাগ্য নির্ধারক পান্না। সাদা ব্যান্ড কলারের শার্টের সবকটা বোতাম আঁটা। একইরকম মার্জিতির চিহ্ন হিসেবে আঁটা হাতের কাফের বোতামও। মুখ থেকে মুখে দৃষ্টি বদলের সময় তার মুখ ঘুরছে না, ঘুরে যাচ্ছে চেয়ার। তখন মৃদু আপত্তি তুলছে তার আরামচেয়ার।
বাইরে, খোলা দরজা দিয়ে আসা যাওয়ার পথে ঘরটা দেখে অনেকেই একটু উঁকি দিতে চাইছে। কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীর জন্য পেরে উঠছে না।
যাও যাও, ভিড় কোরো না। কাজে যাও! প্রহরীর কণ্ঠে দাপট।
আচ্ছা! কাজ শেখাব তোকে দাঁড়া। বেরোবি না?
যাও যাও!
নিরীক্ষণ পর্ব দিয়ে আগতদের খানিকটা অপ্রস্তুত করে তোলার চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়ে দ্রুত নিজ কথায় ফিরতে চাইলো বিপুল; কারখানার সর্বেসর্বা। এতোটা সময় ধরে সে যা দেখেছে তা হলো, সেদিনও তার চোখের ওপর চোখ রাখতে নাপারা ভীরু শ্রমিক আজ কেমন সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে। একেকজনের চোখের ভাষা একেক। তবে কোনোটিই পুরোপুরি অনুকূল নয়। এভাবে দৃষ্টিপথে সংঘাত হচ্ছে অবিরত, কিন্তু পথের অধিকার কেউ ছাড়তে চাইছে না। সুতরাং বিপুলের নিচের চোয়াল ওপরের সঙ্গে দৃঢ় সংবদ্ধ হয়ে উঠতেই হলো। আর নিজের সঙ্গে ঘন ঘন একমত হতে হলো মাথা ওপরনিচ দুলিয়ে। অবশেষে কথা বলে উঠল বিপুল, এর বেশি দেরি সমীচীন নয়।
আরো বেশ কজনকে ডেকেছিলাম, দেখছি না যে?
কেউ তার এ প্রশ্নের বিপরীতে কিছু নাবলে স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। এমন প্রশ্নের বিপরীতে কারো চোখের ভাষা হয়ে উঠল বেপরোয়া। যেন যাই হোক তাদের বিরুদ্ধে, যায় আসে না কিছু। কারো চোখে মুখে অস্থিরতা, এরা পায়ের নাচন থামিয়ে রেখেছে। চোখে ফুটে উঠেছে এমন সংকেত, যা থেকে বুঝে নেওয়া চলে অস্থিরতার বিপরীতে এরা খানিকটা ভীত, কিন্তু তাই বলে আপোসকামী নয়। তাই প্রতিক্রিয়া দেখাবে তাৎক্ষণিক। কারো চোখের দৃষ্টি শীতল। যেন যা বলে যাবে চুপচাপ শুনে যাবে, আর পছন্দ হলে হয়ত মানবেও। আরেক দলের চোখে পুরোপুরি ভেঙে পড়া ভাব। এ দলের চোখে অনুতাপ, অনুনয়, যেন বলছে, আর কোনোদিন এমন হবে না গুকক্ষশাই! শেষোক্ত চোখজোড়া বিপুলকে তুষ্ট করল। এই দলটার দিকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁটে ওপরের ঠোঁট ঠেলে উঁচু করে তুলল বিপুল, ভুরুজোড়াও তুলল ওপরে। বলতে শুরু করল আবার।
যাহোক, যারা এসেছে, আমি ধরে নিচ্ছি তারা কিছুটা হলেও কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতাবোধ জিনিসটা খুব দামি, সবার ভেতর এটা থাকে না। সবার ভেতর এই বোধ আশাও করা যায় না। যারা এসেছে, আমি ধরে নিচ্ছি তাদের এই বোধটা আছে। আর কৃতজ্ঞতাবোধ যাদের আছে, তাদের ভেতর কাজ করার ইচ্ছাও আছে, ধরে নিচ্ছি। দেখো, আমার অনেক কাজ, অনেক ব্যস্ততা। এরপরও আমি তোমাদের জন্য সময় বের করেছি। করেছি কিনা। কেন করেছি? করেছি এজন্য যে, আমি চাই তোমরা এখন গোটা পরিস্থিতিটা ভালোভাবে বিচার করবে। আমি জানি, তোমরা জানতে পেরেছ, তোমাদের এই প্রতিষ্ঠান আরো একবার হলুদ কার্ড পেয়েছে। সুতরাং বাইরের দেশে ব্যবসা বন্ধ হতে যাচ্ছে একরকম, কী বুঝলে বল। বাইরে আমরা আর মাল হয়ত পাঠাতে পারবো না, ঝামেলা হবে। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। অনেকখানি আমরা পিছিয়ে পড়েছি। কতখানি তা কল্পনাও করতে পারবে না। তোমরা অনেক’দিন ধরে কাজ করছ, এরপরও পারবে না।
চোখের কোণ দুটো কুঁচকে অর্ধবৃত্তের অপরপ্রান্তের দিকে চোখ ফিরিয়ে বিপুল বলল, আচ্ছা, তোমরা কি মনে করো এখানে কাজের পরিবেশ নেই তাই ওরা আমাদের হলুদ কার্ড দিয়ে গেল? মোটেই তা না। এরকম একটা কারখানা যার আছে সেই বোঝে, চারপাশে কত রকম শত্রুকে তার সামলাতে হয়। সামলাতে হয়, নয়ত সুযোগ পেলেই ওরা ছোবল মেরে বসে। এই এভাবে ফণা তুলে আছে একেকটা! হাতের পাতা ভাঁজ করে সাপের ফণা তোলার ভঙ্গিটা নকল করে দেখাল বিপুল। ফের বলতে শুরু করল, আমার তেমন শত্রু অনেক! কোনো অভাব নাই। আর আমার শত্রু মানে ওরা তোমারও শত্রু। যতক্ষণ তোমরা আমার চাকরি করছ, আমার শত্রু মানে তোমাদেরও শত্রু। কী, ঠিক বললাম কিনা।
কারও মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো জবাব পেল না বিপুল। একজনকে দেখে মনে হলো, বুঝি কিছু বলবে। তাই একটা বাঁধা তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকিয়ে থাকল বিপুল তার দিকে। কিন্তু লোকটা সামলে নিয়ে নিজেকে মনের কথা রাখলো মনেই। মুখ আর খুলল না। দেখে বিপুল মুখটা তার দিক থেকে অন্য দিকে ফিরিয়ে আবার বলতে শুরু করল, তো, আমাদের এই শত্রুরা সারাক্ষণ তৎপর। খুব তৎপর। আমার একসময়ের বন্ধু, খুব বন্ধু, এমন তিনজন একজোট হয়ে আমার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। প্রতিমুহূর্তে আমি আতঙ্কে আছি। একসময় আমার হাত ধরে তারা দাঁড়িয়েছে। আমার কাছে কেঁদে পড়েছিল। এই আমি তখন তাদেরকে এখানে ওখানে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি, হাতে ধরে শিখিয়েছি সব। আজ তারাই আমার বিরুদ্ধে লেগেছে। কারণ বাজারে আমাদের সুনাম এতোই যে তারা সুবিধা করতে পারছে না। এ যাবত যাকেই আমি হাতে ধরে তুলেছি, প্রত্যেকে আমার সঙ্গে এমন শত্রু শত্রু খেলা খেলেছে, প্রত্যেকে। একজনও বাকি নেই। তোমাদের এই সালাম! কে এনেছে তাকে? ওই কুলাঙ্গারের কথা পরে আসছি। আগের কথা আগে শেষ করে নেই। আমার বিরুদ্ধে ওরা উঠে পড়ে লেগেছে। আমাকে ধসিয়ে দিতে চায়। এই যে বিদেশ থেকে প্রতিনিধি দল এলো, এমনি এসেছে? ওরাই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এনেছে ওদের, কোটি কোটি টাকা ঢেলেছে এর পেছনে, কোটি কোটি টাকা। ওই পরিচয়গুলো সব আমার হাতে গড়া। আমার দুর্ভাগ্য যে ওরা চোখ খেটে যে কাজ করতে পারে, আমি মন বেঁধে সে কাজ করতে পারি না। আমার সেই ক্ষমতা আল্লা দেননি। আমার দুর্ভাগ্য যে এতোবার বিশ্বাস ভাঙা পড়লেও আমি আবার লোককে বিশ্বাস করি, আবারও করি। আর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমারই একসময়ের এতো আপন এক লোক, আজ আমার ওই শত্রুদের হাতে হাত মিলিয়ে আমার বিরুদ্ধে নামে।
সবার ওপর একবার চোখ ঘুরিয়ে এনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল বিপুল। তোমাদের সালাম। নাম বলে নিজ সমর্থনে মাথা ওপরনিচ দোলালো বারকয়েক। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ফের দম নিয়ে বলতে শুরু করল, এই সালামকে কোথা থেকে তুলে এনে কোথায় বসিয়েছি আমি। ঘরের ভিটাটা ছাড়া বাইরে পা ফেলার মতো এক টুকরো মাটিও ছিল না এমন ঘরের ছেলে। তবে তার বুদ্ধিটা ছিল। আর বিদ্যাও কিছুটা। বিদ্যাবুদ্ধিওয়ালার কদর বিপুল জানে। ওই কদরটা বিদ্যাওয়ালা নিজে নিজেকে না দিতে পারে, তবে বিপুল দেয়। দেখো, কী থেকে কী হয়। ভালো মনে ওকে আমার প্রতিষ্ঠানে এসে দেখা করতে বলে চাকরি দিলাম। অন্য কোথাও ঢুকিয়ে দিতে পারতাম চাইলে। কিন্তু আমার কাছেই রাখলাম। ভাবলাম, থাক না! একদিন এসে পায়ে পড়তে নিয়েছিল, তখন হাত রাখতে দিইনি, ধরে ফেলেছি। মায়া লেগেছিল। ভেবেছিলাম আমার গাঁয়ের ছেলে, আমার ভাই। এখানেই থাকুক, কাজ শিখুক, হাতে কলমে শেখাই, কাছে রাখি। হয়ত হাতের লাঠি হবে একদিন। এজন্যেই কথায় বলে,
বাক্যটা শেষ না করে বিপুল সবার দিকে তাকালো একবার। বেশ কজন নামিয়ে নিলো তার চোখ। বিপুল হঠাৎ ঘাড় এদিকওদিক করে ঘরের ভেতর কিছু খুঁজতে থাকল যেন। কিছু মিলল না বলে ওই বস্তু যে কী, তা আর বোঝা গেল না। অবশেষে এদিক ওদিক থেকে চোখকে ফিরিয়ে এনে, ভেজা চকচকে গোলক দুটো স্থির করল জাকারিয়ার ওপর এরপর।
গলাটা শেষ দিকে খানিকটা নেমে এসেছিল তার। এ বেলা আবার উঠে এলো আগের মতো। ক্রমে চড়া হয়ে উঠল অন্যান্য সময়ের মতো।
যাক! তোমাদের এতো কথা বলছি কেন জানো? এই তোমাদের আমি অনেক’দিন ধরে জানি। তোমরা আমার দক্ষ লোক, আমার হাতের লাঠি। আমি যতোটা পেরেছি, তোমাদের বসিয়েছি জায়গামতন। তোমাদের যত্ন করেছি সাধ্য মতোন। আমার সাধ্যের সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, স্বীকার করছি। ভুলত্রুটি সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে কেবল আল্লা। মানুষের তো সীমাবদ্ধতা থাকবেই। এসব কাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়, কাদের এসব বলা যায়? বলা যায় কেবল আপন মানুষদের কাছে। তোমরা আমাকে মনে করো কিনা জানি না, কিন্তু আমি তোমাদের আমার খুব আপন মানুষ জ্ঞান করি। আর এই ভরসাতেই ডেকেছি তোমাদের। আশা করি তোমরা আমার এই ধারণার অমর্যাদা করবে না। তোমরা আমার সন্তানতুল্য। কী, ভুল বলেছি?
কজন দুপাশে মাথা নেড়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল। তাদের দিকেই ফিরে ফিরে তাকিয়ে বিপুল বলতে থাকল আবার।
তোমাদের প্রতি যদি কারো দরদ থেকে থাকে তো তা আমার। তোমাদের জন্য কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের এতো দরদ জেগে ওঠে নাই যে ওরা তোমাদের কথা ভেবে আমাকে শাসাতে আসবে। কারণ ওরা আমার পণ্যের লাভের গুড় খায়। কী, খায় না? খায় তো। তাহলে? অন্য কোনো মিষ্টির সন্ধান পেয়েছে তারা, হিসেব পরিষ্কার। তোমাদের প্রতি দরদ করে আমাকে আরো একবার হলুদ কার্ড খাওয়াতে ওদের বয়ে গেছে, হেহ! এই যে তদন্তের নাম করে ঘুরে গেল, জানি তো কী প্রতিবেদন দেবে। সালামও বলেছে তোমাদের, তাও জানি। সে কী করে জানলো? মনগড়া উত্তরও দিয়েছে তার। এসব শুনি আর হাসি।
আবার কিছুক্ষণের নীরবতা। ওদিকে পর্দার ওপারে দরজার বাইরে কাদের পায়ের আওয়াজ এসে এসে থেমে যাচ্ছে, ফেরার নাম নেই। রক্ষীর হিসহিসে সাবধানবাণী শোনা যাচ্ছে থেকে থেকে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে বলে ভেতর থেকে মনে হওয়ার কোনো কারণ ঘটল না। সেদিকে তাকিয়ে থেকে বিপুল তার কণ্ঠস্বর আরো চড়াল, যেন বাইরের দাঁড়ওয়ালাদেরও শুনিয়ে দেওয়া যায়।
শোনো! এই হলুদ কার্ড তো? জেনে রাখো যদি নাজানা থাকে। টাকায় কেনাবেচা চলে এই হলুদ কার্ড। সুতরাং এটার কথা শুনে কেউ নাচালেই নেচো না। আমার পিঠে ছুরি মারতে চেয়েছিল সালাম, তা তো জানোই। কিন্তু তোমাদের পিঠেও যে ছুরি মারতে চেয়েছিল তা জানো? কী, জবাব দাও? এ ব্যাপারে কে জানো কিছু, বলো আমাকে যদি পারো। জানো না তো। জানলেই না বলবে। বলো?
সবাই নিরুত্তর। জাকারিয়ার ভুরু জোড়া সাবধানী। বিপুলের হাতে একটা টেক্কা আছে। কী সেটা?
বিপুল বলে গেল, তোমাদের মতো যারা দক্ষ কর্মী, ও বেছে বেছে তোমাদেরই আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। কী, তুলেছিল না? কী উদ্দেশ্য এর পেছনে? তোমাদের সেবা? বাব্বাহ! সালাম এতো মানবসেবী হলো কবে? ওর আসল রূপটা আমি যতোদিন পারি ঢেকে রেখেছিলাম, কিন্তু এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। একদিকে তোমাদের ক্ষেপিয়ে তুলে একটা ঘোট পাকিয়ে, লুকিয়ে আবার সে আমার কাছেই এসেছিল তা জানো? মানে, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম! আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না নিজের কানকে। সেদিনের হাড়হাভাতে দুদিন যেতে নাযেতেই দুনিয়ার ভাও বুঝে গেল! বাহরে বাহ!
বিপুল নিজ ঘাত করে হাত তালি দিলো দুবার। আমার কাছে এসে বলে, ওর সব কথা শুনতে হবে। মানে, খুশি করতে হবে ওকে, ওকে ফোরম্যানের পদ দিতে হবে, সঙ্গে আরো কী কী। হাসিমুখে ওকে শান্ত করতে চাইলাম। জানতে চাইলাম, এত তাড়াহুড়ো কেন রে বাবা। ওমা, শুনতেই চায় না! বলে, নইলে আমাকে নড়িয়ে দেবে। কলকব্জা নাকি ওর হাতে সব। তা, তোমরা অনেক কিছুই জানো, কিন্তু এসব জানো বলে তো মনে হয় না। যাহোক, শুনে আমি তো হতভম্ব হয়ে বসে থাকলাম! এই পর্যায়ে ও যেতে পারল কী করে! কাদের সঙ্গে মিশছে কে জানে। মানে, রাজনীতি খেলাতে পুরো শিখে গেছে,আর কুশিক্ষাটা পুরোদমে ছড়িয়ে দিতে লেগেছে। নাহ, অনেক বাড় বাড়তে দিয়েছি, একে তো এবার থামানো দরকার! নিজ ভুলে আমি কষ্ট পাই, কিন্তু মাথার চুল ছিঁড়ি না কখনো।
মুহূর্তকালের বিরতি। জাকারিয়ার চোখ যে তার মাথার দিকে, তা লক্ষ করেও বিপুল নির্লিপ্ত থাকল।
যাহোক, সালাম ভেবেছিল, আহা, আমাকে তো খুব আদর করে কোলে নিয়েছে, এবার একটু মাথার ওপর উঠেই দেখি! হ্যাঁ, বিপুল আদর করে, কিন্তু শাস্তিও দিতে জানে। যখন তার আদরের ধন বেপরোয়া হয়ে যায়, ধূর্ত শয়তান হয়ে যায়। দরজা ঠেলে বেড়াল এসেছে দেখলে আমি প্রথম দিনই তাড়াই। আমার ওপর চড়াও হতেই আমি পাল্টা চড়াও হলাম! বিপুলের কণ্ঠস্বর এ পর্যায়ে ভারী আর গম্ভীর স্তর থেকে একলাফে উঠে গেল চড়া উত্তেজিত প্রগলভ নাটকীয় স্তরে। চিৎকার করে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল, সাবধান!
মুহূর্তের দেরাজটানা কড়ার শব্দে পর সবাই দেখতে পেল বিপুলের হাতে একটা রিভলবার। সবার দিকে পালাক্রমে তাক করে অর্ধবৃত্তাকারে ঘোরালো তার হাত। চোখগুলো বুঝি কোটর গলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। গলে খসে পড়েছে এতোক্ষণের শান্ত অবয়ব। বিপুল আরো একবার চিৎকার করে উঠল, সাবধান! বাইরে থেকে দরজাটা এবার বন্ধ করে দিলো রক্ষী। বাইরে কোলাহল বাড়ছিল। দরজা বন্ধ হতেই সেই কোলাহলের শব্দ কয়েক স্তর নিচে নেমে গিয়ে হয়ে উঠল ঝাপসা, স্বপ্নময়। আঘাতে জ্ঞান হারিয়ে ফের ফিরে পাওয়ার পর কিছু সময় যেমন মনে হয়, শব্দগুলো হামা দিয়ে একশ মাইল দূর থেকে আসছে, অনেকটা তেমন। বিপুলের পিস্তল ধরা হাত তখনো তাদের দিকে তাক করে রাখা। পালাক্রমে ঘটছে লক্ষ্যবদল। শ্রমিকদের দেখে মনে হলো জায়গা ছেড়ে নড়ার ক্ষমতাও বুঝি হারিয়েছে। পরিস্থিতি যখন অসহনীয় হয়ে উঠল, যখন মনে হলো এই বুঝি মরিয়া হয়ে শ্রমিকরা একটা কিছু ঘটিয়ে বসবে, তখনই বলে উঠল বিপুল;
পিস্তল বের করে তাক করলাম শালার বুকে। বললাম, আগে তুই আঙুল বাঁকা করেছিস, এবার আমারটা দেখ। মচকানোর লোক আমি না। এই পিস্তল দেখে; বলে পিস্তলটার দিকে ঘাড় কাত করে তাকাল একবার বিপুল; ব্যাটা পিছু হটলো। বুঝে গেল কার সঙ্গে কী করতে এসেছিল। এতোটা করব আমি ভাবে নি, আমার আদরের সুযোগ নিতে চেয়েছিল, বললাম না? কিন্তু আমি এতোটা ক্ষেপে হয়ে উঠবো ভাবতেই পারে নি ব্যাটা! হাহা! বললাম, সোজা বেরিয়ে যা। পেছনে তাকাবি না একবারো। আর কোনো ট্যাঁ ফোঁ চাই না, একদম চুপ! বেরিয়ে গেল। আমি তাকে তখনই তাড়িয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু ওই যে, স্নেহ! যেই অপাত্রে স্নেহের কারণেই আমার হয়ত একদিন মরণ হবে! ওই স্নেহের কারণে ভাবলাম, ভয় দিয়েছি, শুধরে যাবে, সুযোগ দেওয়া যাক না। কিন্তু এবারো সুযোগটাকে অন্যভাবে নিলো ঘৃণ্য কীটটা, যেহেতু সে বুঝে গেছে তার আর ফেরার পথ নেই। জানে তো, কোন পথে এগোতে হবে। এই তো শুরু করলো পুরোদমে। প্রথমেই নিরাপত্তা নেই বলে ধুয়া তুলল। এরপর কম বেতনের ধুয়া। আমার অনেক বন্ধু আছে কারখানার মালিক। তাদের চেয়ে অনেক বেশি মজুরি আমি দিই। এমন কয়েকজনকে সামনে নিয়ে এলো, কী বলবো। আরে মজুরি তো বাড়ে দক্ষতার ওপর। দক্ষ হও! ঠেকাব কাকে! সে লোক আমি না! যে কটাকে খুব করে চাগিয়েছিল সালাম, সব কটা সহ তো এখন জেলে। এই প্রত্যেক ব্যাটা ঠগ, নেমকহারাম। এগুলোকে গড়ে তুলতে আমার লাখ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কী, হয় নাই? অকৃতজ্ঞের দল! এসমস্ত দুষ্ট গরু আমি আর গোয়ালে ঢুকতে দেবো না। টের পাওয়া মাত্র পাঁচনে পিটিয়ে লাথিয়ে খোঁয়াড়ে পাঠাব। আমার আদরের রূপ দেখেছে, কঠিনের রূপ দেখে নাই কেউ এখনো! প্রয়োজনে আমি ভয়ঙ্কর হতে পারি, ভয়ঙ্কর! কিচ্ছুর কিচ্ছু মানবো না। মনে রাখতে হবে, আল্লা রহমতের মালিক সত্য, কিন্তু আল্লার কাহহার রূপও আছে। আমি সেই আল্লার বান্দা। অনেক ভালোবাসবো। কিন্তু প্রয়োজনে সব দুমড়ে শেষ করে দিতেও ছাড়ব না! বিশৃঙ্খলা আল্লার কাছে হত্যার চেয়ে জঘন্য। আর ওই হারামিগুলো ফেৎনা সৃষ্টি করতে চেয়েছে আমার কারখানায়। কোথায় মালিকের মালের হেফাজত করবে, তা না। ধ্বংস করতে হাত তুলেছে যত নাফরমান। এদের জন্য আল্লার কাহহার মূর্তি!
বিপুল কিছুক্ষণ থেমে চোখজোড়া টেবিলের ওপর নামিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলতে থাকল। যেন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছে ভীষণ। এই যুদ্ধ চললো বেশ খানিকটা সময়। হাতের মুঠো দুটো বন্ধ করে চিবুক শক্ত করে বন্ধ করলো চোখ দুটো। এরপর নিজেকে শান্ত করতে অবশেষে যেন সে সমর্থ হয়েছে, এমনভাবে চোখ আর মুঠো দুটোই খুলল ধীরে ধীরে। শান্ত স্বরে বলল, শোনো আল্লার কাছ থেকে সব পাওয়ার পথ বান্দার বন্ধ হলেও তওবার পথ কখনো বন্ধ হয় না। আমিও সেও দরজা বন্ধ করি নাই। এটা বলতেই তোমাদের ডেকেছি। আমার পরিষ্কার কথা, তোমরা যারা কারখানা ত্যাগ করতে চাও, এখনই পাওনাদি নিয়ে চলে যাও, আর কখনো এসো না। তোমাদের গাফিলতির কারণে আমাকে যে লাখ লাখ টাকার ক্ষতি গুনতে হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণও চাইবো না, মাফ। তোমরা আমাকে কী ক্ষতিপূরণ দেবে। অর্থাৎ কোনো বাধাই দেবো না। তোমরা চলে যাও।
আর যদি তোমরা আল্লার কাছে তওবা করো, আমার কাছে ক্ষমা চাও; আর যদি প্রতিজ্ঞা করো আর কখনো এমন হবে না, এরকম করবে না তোমরা, তাহলে ডবষপড়সব! থাকো আমার এখানে, কাজ করো। সময় মতো সব হবে, সঅব। কিচ্ছুর কিচ্ছু তোমাদের ভাবতে হবে না। তোমাদের ভাবনার ভার আমিই নিয়ে নেব। কী, বোঝা গেল আমার কথা? বেশ। এবার বলো কারা যাবে। যারা যাবে তারা চলে যাও। কিন্তু যারা থাকতে চাও, তাদের জন্য একটা সুখবর। কী, সুখবর শব্দটা শুনলেই মনের ভেতরটা কেমন চনমন করে ওঠে না? খবরটা হলো, এদের প্রত্যেকের বেতন যার যার মূল বেতনের সমপরিমাণ টাকা করে আমি বাড়িয়ে দিয়েছি, নির্দেশনা চলে গেছে। শুধু;
কথা বলতে বলতেই ডেস্কের যে দেরাজে তার পিস্তল ছিল, তার নিচের দেরাজ থেকে কিছু কাগজপত্র বের করল বিপুল। কাগজগুলোর ভেতর থেকে একটা শাপলা ফুলের জলছাপ দেওয়া হলুদ সরকারি দলিলি কাগজ বের করে শ্রমিকদের সামনে এগিয়ে এলো। একশ টাকা মূল্যের। এক কোণে টকটকে লাল সূর্যের স্মারক জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে। শ্রমিকদের কারো কারো মুখ খানিকটা নরম হয়ে উঠেছিল। আবার কোথাও স্বাক্ষর করাটা অবধারিত হয়ে উঠছে বুঝতে পেরে মুখভাব হয়ে উঠল বিভ্রান্ত, সিদ্ধান্তহীন। তারা পা থেকে পায়ে ভরবদল করল, কেউ কেউ করল দৃষ্টিবিনিময়। কেউ একজন কেশে উঠল, তার ভেতর একটা তাচ্ছিল্যমাখা হাসির অংশ প্রচ্ছন্ন।
এখানে একটা স্বাক্ষর রাখতে হবে। ওই আমি যা যা বললাম সেসবই দেখো এখানে লেখা আছে। দেখো, দেখে নাও, পড়ে, বুঝে নাও। আর কে থাকবে এখনই সিদ্ধান্ত নাও। সালামের মতো পরিবার বিচ্ছিন্ন নও কিন্তু তোমরা কেউ। তোমরা কিন্তু কেউ পরিবারহীন নও, ওই কুলাঙ্গারটার মতো এখানে শেকড়বিহীন নও। তোমাদের প্রত্যেকের ছেলে মেয়ে আছে, কারো বৃদ্ধ বাবা মা আছে। তাদের সবাইকে নিশ্চয়ই অকুল সাগরে ভাসাবে না তোমরা!
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আবার এমুখো ওমুখো হতে হতে বিপুল বলল, তোমাদের যারা বেরিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছ, তারা একটা ব্যাপার হয়ত চিন্তা করো নি। এক মিনিট। উপযাজক হয়েই; উপযাজক মানে কী বোঝ তো; মানে ধরো যেচে পড়ে, একটা কথা মনে করিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার যদিও উচিৎ নয় আদৌ। তোমারা কী ভাবো। তোমরা এরপর যেখানে যেখানে যাবে, সেই সব জায়গায় তোমাদের নেওয়ার জন্যে ওরা হাত বাড়িয়ে বসে আছে? কুটিল হেসে হাত নেড়ে মাছি ওড়ানোর মতো ভঙ্গি করলো বিপুল। আচ্ছা, যদি মনে করে থাকো তো গিয়ে একবার দেখো। বাজিয়েই দেখো না। হাসি হাসি অর্ধতরল মুখটা হঠাৎ করেই কঠিন হয়ে উঠল। পুছবেও না! তোমাদের পুছবেও না! কী, মনে করছো আমি ফোন করে বলে দেবো কিছু ওদের, তাই? মনে করতে পারো, কিন্তু সত্যটা বলি। এখানকার ব্যাপার সব চাউর হয়ে গেছে। যারা জড়িত তারা এখান থেকে বেরিয়ে যেখানেই যেতে চাইবে, যে কারখানাতেই ঢুকতেই চাইবে, সেখানকার কর্তাব্যক্তিরা তাদের নেবে কিনা দশবার ভাববে। আর গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি হলে তো কথাই নেই! দশবার ভাববে, আমাকে ফোন করবে। আমি যদি সবার নামে সুন্দর সুন্দর কথা বলে ভাসিয়েও দিই, কী বললাম, যদি ভাসিয়েও দিই, তবু একটা লোক আমার কথা হয়ত বিশ্বাস করবে না। তারা নিজের বিশ্বাসে চলবে। এবং নিজের পায়ে কখনো কুড়াল চালাতে চাইবে না। ওরা কী বলবে জানো? বলবে, তোমরা তোমাদের মালিকের সঙ্গে যা করেছ, আমার সঙ্গে তা করতে কত দিন! অতো ঝুঁকি ওরা নেবে না। আহারে, সেধে নিজেদের কোথায় তোমরা নামিয়েছ। ওরা জানে, সবাই জানে, কাজের পরিবেশ পরিবেশ বলে চেঁচানো লোকগুলোই কাজের পরিবেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করে। নাও নাও, কী করবে করো।
বিপুল স্টাম্পটা ওদের দিকে এগিয়ে দিয়ে চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিলো। দু হাতের আঙুলগুলো পরস্পরের খাঁজে আবদ্ধ করে ধীরে ধীরে বলল, প্রয়োজনে কিছুক্ষণ সময় নাও্ বাইরে গিয়ে আলাপ সালাপ করো।
শ্রমিক নেতাদের দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলা গেছে বলে মনে করল বিপুল। আর শ্রমিকদের কারো কারো চোখেও দোমনা ভাব প্রকাশ পেতে থাকল। একে অপরের দিকে তাকালো নেতারা। কারো চোখে চাপা ক্রোধ, কারো চোখে চাতুরি, কারো চোখে আর ঠোঁটের ভাবে নিরুপায় সমর্পণ। কারো দৃষ্টি শিথিল, যেন সে এসবের পর্যবেক্ষকমাত্র, আর কেউ নয়। বিপুলের মাথার ওপর দিয়ে সোজা একদৃষ্টে কোন স্বর্গের দিকে তাকিয়ে আছে জাকারিয়া কে বলবে। তার ভুরুজোড়া ধীরে ধীরে উঁচুতে উঠল, কপালে পড়ল ভাঁজ, আর মুখ অল্প হা করে লম্বা শ্বাস টানলো একবার।
এসময় বিপুল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আর তাতে বাধা পড়ল জাকারিয়ার দৃষ্টিপথে। তখন চোখজোড়া নামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে সহকর্মীদের জুতো দেখতে থাকল জাকারিয়া। আর টেবিলে হাতজোড়া ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বিপুল উঁচু গলায় নির্দেশ দিলো প্রহরীকে, এই! দরজাটা আটকে দাও!
প্রহরী লোকটা খোলা দরজার বাইরে টুল পেতে বসে ছিল। বিপুলের নির্দেশ শুনতে পেয়ে প্রথমটায় বুঝতে সময় নিলো ক মুহূর্ত। এরপর পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজার নব ধরে কপাট টেনে নিলো। টেবিলের কাচের আবরণের ওপর রিভলবারটা তখনও সবিম্ব বর্তমান। আর ওদিকে দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকরা চঞ্চল হয়ে উঠল।
না, তোমরা ভয় পেয়ো না। বিপুলের অভয়বাণী। এসি চালাবো তো, মাথাটা গরম হয়ে গেছে কেমন। দরজাটা সে কারণেই বন্ধ করতে বললাম। ভয়ের কোনো কারণ নেই।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রকটা ফের চলতে ঘরটা চাপা গমগমে শব্দে ভরে উঠল। ওদিকে চেয়ারে আরাম করে বসে টেবিলে পড়ে থাকা সোনালী প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে নিলো বিপুল। এরপর কলমদানির ভেতর রাখা চকমকি তুলে নিয়ে করলো অগ্নিসংযোগ। তাকিয়ে এসব দেখতে থাকা জাকারিয়ার ভুরু দুটো ফূর্তিবাজ নেশারুর মতো ক্রমে আবারো উঠে গেল উঁচুতে। শক্তির একটা প্রবাহ থেকে থেকে তার কোমর থেকে বিদ্যুৎগতিতে ওপরে উঠে এসে মগজে ঝিম ধরিয়ে দিতে থাকল। কল্পনায় দেখতে পেল, শক্তির স্রোতটা আরেকবার শরীরে ছড়িয়ে পড়ার পরমুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে রিভলবার হাতে তুলে বিপুলের দিকে তাক ট্রিগার টেনে দিয়েছে। সেফটি ক্যাচ ছিল বন্ধ, আগেই। বিপুলই করে রেখেছিল তখন, কী কারণে কে বলবে! গুলিটা গিয়ে বিঁধল ঠিক বিপুলের এলানো কপালটার মধ্যখানে। ওখানে তার ছোট শিশু মেয়ে লিন্ডা চুমু খায়; এসেছিল একদিন বাবার সঙ্গে কারখানায়; ঈসার মতোই বয়েস। হঠাৎ ঝিমুনি উধাও। এক পা এগিয়ে বলে উঠল জাকারিয়া, আমি স্বাক্ষর করব স্যার।
কেঁপে উঠল কণ্ঠটা। তার পেছনে বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল ক’জন। বক্তার মুখ চোখে বেমানান বিহ্বল ভাব, চোয়ালের চেনা কাঠিন্য কখন আপসে সরে গেছে। আবারও কথা বলে উঠল জাকারিয়া। এবার কণ্ঠে সিদ্ধান্তের দৃঢ়তা আরো প্রকট। যাব না আমি স্যার।
এবার ক’জন নড়েচড়ে দাঁড়াল পেছনে। নিজের ভেতর হলো দৃষ্টিবদল। একজন এগোনোর উদ্যোগ করল এক পা। বাকিরা আধো উৎসুক আধো দমিত, বিভ্রান্ত চোখে দাঁড়িয়ে। ক’জনের মুখ তখনও নির্লিপ্ত।
চলবে…
কারখানার বাঁশি: পর্ব-২২॥ হামিম কামাল