।এক।
কারখানার বাঁশি বেজে চলেছে। ফটকের বাইরে ক্রমে ছোট হচ্ছে শ্রমিকের সারি। নীল ফটকের বাম পাল্লার পকেট দরজাটি খোলা। তা দিয়ে ভেতরের উঠানে পা রাখছে কিশোর থেকে প্রৌঢ়—সব বয়সের, খাটো থেকে লম্বা—সব দৈর্ঘ্যের, লিকলিকে থেকে স্থূল—সব প্রস্থের, কালো থেকে গৌর—সববর্ণের শ্রমিক,একের পর এক।
প্রবেশ ফটক পেরিয়ে গজ পাঁচেক এগোলে হাতের বাঁয়ে একটা দোতলা ভবন। তার দোতলার ঘরে চারকোণ জানালা কাটা, তাতে এপার-ওপারগামী থাইগ্লাস। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ফটকের বাইরে শ্রমিকসারির দিকে তাকিয়ে আছে একটি লোক। বয়স চল্লিশের কোঠায়। চারকোণা মুখ,একপাশে সিঁথি কাটা লালচে চুল। আয়ত চোখ,চোখের মণিজোড়া লালচে। পরনে হাফহাতা খয়েরি শার্ট আর কালো কাপড়ের প্যান্ট। প্যান্টইস্ত্রির অতি আঁচে চকচকে। লোকটি কারখানার ব্যবস্থাপক, সৌরভ তার নাম। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ঘুমভাঙা শিরাওঠা চোখে শ্রমিকদের পোশাকবৈচিত্র্য দেখছে। শ্রমিকদের ওপরের অংশে কালো, সাদা, নীল, লাল, সবুজ, টিয়ে, বেগুনী, হলুদসহ কত রং, ছায়া রং। নিচের অংশে রঙবৈচিত্র্য ওপরের সঙ্গে হেরে গেছে পাল্লায়। রঙ বলতে কেবল তিনটিই ওখানে। কালো, ধূসর আর ঘিয়ে। মাথা ঝুঁকিয়ে নীল ফটকের এপারে চলে আসছে ওরা একের পর এক।
এপাশ থেকে যে লোকটা শব্দ করে তাদের গুনে পার করে দিতে লেগেছে, তার পরনে দরজার চেয়েও গাঢ় নীলরঙা নিরাপত্তারক্ষীর পোশাক। লোকটা রক্ষীদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক। সবচেয়ে পরিচ্ছন্নও বটে। আর আচরণে সবচেয়ে মার্জিত বলেও কারখানার সিংহভাগ লোক স্বীকার করে থাকে। চোখে পুরু এবং কিছুটা ঘোলাটে এক বাইফোকাল চশমা। চশমাটির প্রতি তার আলাদা দরদ লোকের চোখে পড়ে। অনেকে বলে,টালি খাতায় লেখার আগে চোখে এঁটে দিয়ে লেখা শেষে খুলে রাখতে নাকি ইচ্ছে করেই ভুলে যায় বুড়ো। এ কথা কানে এলে নির্বিকার মুখে পকেট থেকে রোঁয়া ওঠা সাদা একটা রুমাল বের করে মুখ হাঁ করে কাচে ভাপ দিয়ে ডলে ডলে মুছতে থাকে বৃদ্ধ। এরপরএকটা কোনো ছুতোয় গার্ডরুমের থাই কাচের দিকে প্রথমে আড়চোখে, এরপর সরাসরি তাকায়। নিচের ঠোঁটটি ওপরের ঠোঁটকে তখন ঠেলে আরও ওপরে তোলে। মৃদু হাসির আভাস ধরা পড়ে চোখের দুই কোণে যেখানে জলের ফোয়ারার মতো ভাঁজ। বৃদ্ধ এ রক্ষীর নাম আলমগীর।
এদিকে গাম্ভীর্যের বাহন তার ওই চশমাকে কাল যেন ডাক পাঠিয়েছে। অবস্থা সঙ্গীন। ফ্রেমের সোনালি রঙ প্রায় মুছে গেছে, বেরিয়ে পড়েছে মলিন রূপালি রং। নাকের কাছে চশমার যে ঠেস দুটো এঁটে থাকে, সে দুটো শ্যাওলাপড়া। চশমার কাচ আর ফ্রেমের ওপরের অংশে যেখানে সন্ধি, সেখানটা চুক্তির মতো নড়বড়ে। ফাঁক পেয়ে নোংরার উপস্থিতি। তবে লোকেরা যখন তার দিকে তাকায়, কাচের আড়ালে আয়ত চোখজোড়াই দেখে। ওই চোখজোড়ার আলো ছয় দশকের পুরনো। লোকটার মুখের ওই প্রাকৃতিক গাম্ভীর্য আরও বাড়িয়েছে ছেঁটে রাখা গোঁফ আর চিবুকে জড়ানো চাপদাড়ি। দুটোই সাদা।
হাত তুলে পকেট গেট পেরিয়ে তার কাছে আসার জন্য শ্রমিকদের আহ্বান করছে আলমগীর। আর আওয়াজ তুলে গুনছে তাদের সংখ্যা। থেকে থেকে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে। অবিরত কথা বলে চলায় ভিজে থাকা নিচের ঠোঁটের ঠিক মাঝ বরাবর পড়েছে লালার ছোট্ট সাদা বিন্দু।
ছিয়াত্তর, সাতাত্তর, আটাত্তর…।
শ্রমিকরা ঢোকার পর সশব্দে বন্ধ হলো ফটকের পকেট দরজা। ছিটকিনি উঠল। যার যার নির্দিষ্ট স্থানে চলে গিয়ে গতকালের রেখে যাওয়া কাজের শেষ থেকে শুরু করলো ওরা। তীক্ষ্ম, ভোঁতা নানা রকম শব্দে ভরে উঠল গোটা কারখানা। বহুদিনের পুরনো সহকর্মী যারা, একরকম ঘরাঘরি দাঁড়িয়েছে সম্বন্ধ তাদের। সুতরাং লোহার সঙ্গে ঝালাই হতে থাকল রগূড়ে সম্পর্ক, ইস্পাতের মতো পেটাই হতে থাকল ধ্রুপদী বন্ধুত্ব, কপার পাতের মতো ফালি ফালি হতে থাকল বিশ্বাস। ক্রমে তেতে উঠল কারখানার বাতাস। সকালে সাদা গন্ধ ক্রমে টকে উঠল।
এ সময় দেখা দিলো কারখানার ত্রিরত্ন। এরা কারখানার তদারককারী অক্ষশক্তি হিসেবে নিজেদের জানে। লোকেও স্বীকার করে। তৎপর চোখমুখ থেকে ঘুমের রেশ তখনও কাটেনি তাদের। কপালে, গোঁফে, দাড়িতে, চুলের গোড়ায় জলের ফোঁটা। শ্রমিকদের কাছ থেকে একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তারা চোখ রেখে হেঁটে বেড়াতে লাগলো। তিন কর্মকর্তা কেউ কারও দিকে তাকালো না। কোনো সম্ভাষণ বিনিময় হলো না। যেন দেখতেই পায়নি। তিনজনের জন্যে রয়েছে আলাদা তিনটি বিভাগ। নিজ নিজ বিভাগে তারা হাত দুটি কখনো পেছনে বেঁধে, কখনো দু’পাশে ঝুলিয়ে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কখনো মেঝে কখনো শ্রমিকের হাতিয়ার চালানো, পেশির সঞ্চালন দেখতে দেখতে পায়চারি করতে থাকল। তেতে ওঠা বাতাসে ক্রমে ঘেমে উঠলে, কেউ শার্টের ওপরের বোতাম খুলে দিয়ে কলারটা পেছনে ঠেলে দিল। কেউ হাতা গুটিয়ে নিলো কনুই অব্দি। তিন জনের মধ্যে একজনের হাত ও পা প্রস্রবণধর্মী। অবিরল ঘামে। সে পা থেকে স্যান্ডেল খুলে বালু বালু মেঝেতে ঘষে নিতে থাকল পায়ের তালু। এরপর আবার পায়ে গলালো স্যান্ডেল। চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিলো কেউ তাকে লক্ষ করেছে কি না। আশ্বস্ত হয়ে আবার দেখাশোনায় দিলো মন।
তিনটি পৃথক বিভাগ থেকে বেরিয়ে গেছে তিনটি পৃথক পাকা করা পথ। সোজা পূর্বে এগিয়ে মধ্যখানের পথটির সঙ্গে সন্ধি করেছে। সন্ধিস্থল থেকে চলে গেছে কারখানায় ঢোকার ফটক থেকে পশ্চিমে আসা চওড়া রাস্তার সঙ্গে বিয়ে বসবে বলে। মধ্যখানে মাটি কিছুদূর দুভাগ রেখেছে সবুজ শ্যাওলার পুরু আস্তরপড়া টানা নর্দমা। তা দিয়ে অবিরল বয়ে চলে ঘোলাজল।
ফটক দিয়ে ঢুকতেই হাতের ডানে একটি পায়ে চলা পথ হাত বিশেক এগিয়ে উত্তরে চলে গেছে। একটা পাতাবাহার গাছকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া পথটি শেষ হয়েছে ছোট বারান্দাওয়ালা তিনটি ঘরের সামনে। সবচেয়ে বামে যেটি, সেটি অতিথিশালা। কোনো শিক্ষানবিস আর পরিদর্শক এলে সেখানে রাত কাটান এবং মশাদের সরব দর্শক বানিয়ে নৃত্য করেন। পরের দুটি ঘর ত্রিরত্নের দুজনের। বাকিজন থাকেন কারখানার অদূরে এক গেরস্তঘরে, কারখানাকে তার ভাড়া গুনতে হয়। কারখানার যিনি প্রধান, সর্বেসর্বা, ব্যবস্থাপক তিনি তখন প্রথম বর্ণিত সেই দোতলা ঘর থেকে নামার আয়োজন করছেন। কারখানার পরনের কাপড় যা ছিল তাই আছে, শুধু বদলেছে জুতোজোড়া। চপ্পলের বদলে চামড়ার সাইকেল শ্যু।
_______________________________________________________________________________
এখানে কিছু ফেলতে চাইলে সীমানার বাইরে থেকে ছুড়ে দেওয়া হয়।
_______________________________________________________________________________
সৌরভের সে ঘরের নিচতলায় আবাসিক নিরাপত্তারক্ষীদের ঘর। দিনভর ছড়ি ঘোরানো শেষে সৌরভ যখন নিরাপত্তারক্ষীদের ঘরের দ্বিতলে চড়ে, কারখানার মানগর্বীদের কাউকে মুখ টিপে হাসতে দেখা যায়। আবার ঢাকা যাওয়ার প্রয়োজনে যখন কারখানার ট্রাকে চালকের পাশে এঁটে বসে,এঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে সে হাসি স্বরে বাড়ে। গার্ডরুমের দোতলায় তার ঘরের ঠিক ওপরেই আবার পানির আধার। বর্গাকার এই ট্যাঙ্কটিও তার সঙ্গেঅবোধ শত্রুতায় মেতেছে বলেও অনেকে কৌতুক করে। গরমকালে ট্যাঙ্কের পানি তেতে উঠে ঘর ভাপিয়ে তোলে। আর শীতকালে ঘরের যৎসামান্য উত্তাপটিও শুষে নিয়ে যায়।
ঘর বদলে দেওয়ার জন্য সৌরভ ঢাকার হেড অফিসে অনেকবারই আবেদনপত্র পাঠিয়েছিল। হেড অফিসের আশ্বাস যে আসেনি তা নয়।
দ্বিতল সেই ঘর থেকে বেরিয়ে ওই বিয়ে বসার রাস্তা। ফটক থেকে সোজা এগিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে পশ্চিমে সোজা কারখানার টেস্টিং রুমের দিকে। ওখানে কারখানার ট্রান্সফর্মারকে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। টেস্টিং রুমের ওপরতলায় ম্যানেজারের কাজের ঘর। সে ঘর থেকে একটি জানালা ফটকের দিকে খোলা। পথ ধরে পশ্চিমে যেতে সোজা পথের ডানপাশটা নানা রকম যন্ত্রে দানবে বোঝাই। আরও ডানে টানা ঢেউটিনের ছাউনি, পাশাপাশি দুটি। একেকটি ছাউনি প্রায় সোয়া কিলোমিটার লম্বা। নিচে পাকা মেঝে, মেঝের ওপর রাখা নির্দিষ্ট সজ্জায় সাজানো ঝকমারি কাজের রকমারি যন্ত্রপাতি। পাশাপাশি দুটো টিনের ছাউনির পর সমান্তরালে কারখানার সীমানা দেয়ালের সঙ্গে লাগোয়া আরেক দেয়াল। দেয়ালটা পাঁচ ছয় মানুষ ওপরে উঠে গিয়ে ঢালাই দেওয়া ছাদ মেলে ধরেছে মাথার ওপর। ঢালাই ছাদের নিচেও একই রকম পাকা মেঝে। এই পাকা মেঝের দৈর্ঘ্যও আগের দুটোর মতো। এখানে রাখা থাকে তৈরি হয়ে যাওয়া বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার। বিভিন্ন আকারের, রকমের।
ওদিকে পথের বাঁ পাশে, বেশ ক’ঘর একচালা ঘর পরপর। ভেতর বাইরে দেয়ালের রং সিদ্ধ মানুষের মতো, অভিন্ন সাদা। দরজা জানালার চৌকাঠের রং খয়েরি। রঙের পরত নতুন। ঘরের এই সারির পেছনে কারখানার সীমানা দেয়াল। যে দেয়ালের ওপাশে দোলে বয়েসী মেহগণি গাছের সারি। একচালা ঘরগুলোর জানালা দিয়ে শ্রমিকদের চোখে পড়ে গাছের পাতা নাড়া। আর ঘরের মেঝেতে দেখতে পায়, গাছের কালো ছায়ারা দোল খায়। শ্রমিকরা ও ছায়া মাড়িয়ে যায়। একজন আছে মেঝেতে পাতার ছায়া মেনে খড়িমাটিতে নকশা করে। সে নকশা কাউকে মাড়াতে দেয় না। ট্রান্সফর্মারের সঙ্গে আরও যেসব যন্ত্র যুক্ত করতে হয়, এ ঘরগুলোয় ওসব তৈরির ঘটা। এক ঘরে তড়িৎ বিশ্লেষক কোষ। সে ঘরের অম্লবাতাসে টিনের চালের বুক ঝলসে যায়।
ম্যানেজারের ঘর অর্থাৎ কারখানার একমাত্র অফিস ঘরের উত্তরপাশের জানালা থেকে এর একটি বিশেষ জায়গা চোখে পড়ে। ওটাকে কারখানার ভাঙাকুলা। যাবতীয় পরিত্যক্ত জিনিসপত্রের স্থান হয় ওখানে। ব্যবহৃত তেলের ড্রাম, বৈদ্যুতিক তারের রোল, কপারের কাটা পড়া টুকরা, লোহার রিং, বাতিল লাইটনিং এরেস্টরসহ আরও কত কী যে চিৎপাত হয়ে আছে, তার হিসাব নেই। বছরের পর বছর রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ওখানকার যন্ত্রপাতিতে মরচে পড়েছে, ক্ষয়ে গেছে। তারের রোলগুলোর কাঠ পচে খসে খসে পড়েছে। তেলের ড্রামে শ্যাওলা ধরেছে, জল জমে শুককীট-মূককীটের আস্তানা হয়ে উঠেছে ওসব। এখানে ওখানে কাটা টিনের পাতে টিটেনাস। ভাঙা দেয়ালের খাঁজে শ্যাওলার কোমল মখমল। যেখানেই একটু আড়াল, সেখানেই রংচঙে পেটমোটা মাকড়শা। এখানে কিছু ফেলতে চাইলে সীমানার বাইরে থেকে ছুড়ে দেওয়া হয়। পরিত্যক্ত বস্তু বেশি ভারী না হলে ভেতরে কেউ সচরাচর আসে না। বাইরে থেকে একটা সজনে গাছ সীমানা দেয়াল টপকে এসে পরিত্যক্ত ওই জায়গায় উপুড় হয়ে ছায়া দিয়ে রেখেছে।
বিশেষ ওই জায়গাটির সামনে একটি বড় ঘর। সে ঘরে যেখানে কপারসহ ধাতুর পাত কাটা হয়। এবং তৈরি শিটের ওপর নির্দিষ্ট সংখ্যক প্যাঁচের তার পরানো হয়। মহামূল্য সব যন্ত্রপাতি ওখানে। তাই সুরক্ষার স্বার্থে প্রায় তিন মানুষ উঁচু লোহার একডালা ফটক ওই ঘরের দরজার করছে। আর কারখানা-অফিসের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করেছে ওই ফটক। ওটা খুললেই টেস্টিং রুমের ওপরতলার অফিসঘরে ওঠার সিঁড়ি পাওয়া যায়। বিশাল ওই ফটকের সামনে এসে থেমেছে দক্ষিণপাশের টিনের চালা।
ধাতুর পাত কাটার ওই ঘরের পাশে আরও একটি ঘর। যে ঘরে ত্রুটিপূর্ণ ট্রান্সফর্মারগুলো আলাদা করে রাখার জায়গা করে নেওয়া হয়েছে। ও ঘরে যাবার অনুমতি সবার নেই। আজকের পরিত্যক্ত জিনিসের স্তূপ জমে ওঠা অংশটিও যে একসময় ওই ঘরেরই অভিন্ন ছাদের নীচে ছিল,তার প্রমাণ মেলে জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে চারদিকে লক্ষ্য করে। এখনও গোড়ালি সমান উচ্চতায় দেয়ালের ভগ্নাংশ চোখে পড়ে।
কারখানায় আগের চেয়ে ব্যস্ততা বেড়েছে বলে একজন নবিস তরুণ চেয়ে পাঠানো হয়েছিল হেড অফিসে। কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছিল, গোটা বাংলা থেকেই এসেছে আবেদনপত্র। পত্রওয়ালাদের ডেকে ঢাকায় চলছে ঝাড়াই বাছাই। তার কত দূর কী হলো জানা নেই। সকাল সকাল এ নিয়ে সৌরভের মেজাজের মুখাগ্নি ঘটল। অফিস ঘরে চলে এসে এয়ারকুলার যন্ত্রটা ছেড়ে ঘর ঠাণ্ডা হওয়ার অপেক্ষায় পত্রিকার ডোবালো মুখ। না চাইতেও চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল কাজের বিজ্ঞাপনগুলোয়। শেষমেষ পত্রিকা ছেড়ে দাপ্তরিক কাগজপত্র চোখের সামনে এনে ফেলল সৌরভ। শুরু হলো কর্মদিন।
ঘরটা পূর্ব-পশ্চিম মুখো, আয়তাকার। পশ্চিমে, সৌরভের চেয়ারের পেছনেই জানালা। তা দিয়ে কারখানার পেছনের বাঁশঝাড়গুলোর একাংশে দৃষ্টি যায়। আসে পাতার সরসর শব্দ আর গ্রামের স্বর। সকালে পুবদিক থেকে আসা সূর্যের আলো মেঝেতে জানালার শিকের ছবি আঁকে। মধ্যদুপুরে দক্ষিণের জানালা পথে আলো আসে কিছু মেহগণি, কিছু আকাশমণি গাছের পাতার ছায়াছবি নিয়ে। মেঝেতে দুই নকশার একটি অন্যটির ওপর চড়ে বসে। যখন সূর্য পশ্চিমে আসে তখন মেঝেতে বাঁশপাতার ছায়া। ওসবের ওপর দিয়েই সৌরবভসহ আর যতো কর্মীদের যাওয়া-আসা, কারও ভ্রূক্ষেপ নেই। একজন ব্যতিক্রম। গোটা কারখানায় ওই একজনই শুধু আছে, যে পাকার সারির ঘরসহ এ অফিস ঘরে মেঝেতে পাতার বা রোদের যে নকশাই পড়ুক তা না মাড়িয়ে, বরং পাশ কাটিয়ে চলে। অবসর মিললে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়, না মিললে ওটুকু সম্মান দিয়ে প্রকৃতির ওই ছবির প্রতি স্বীকৃতি অন্তত দেবে। সেই একমাত্র মানুষটি এ কারখানার সর্বকনিষ্ঠ কর্মী। পদে পিয়ন, বয়সে কিশোর। রবি তার নাম।
সকালে যখন পুব দিক থেকে চা নিয়ে কারখানার অফিসঘরে রবির উদয় ঘটে, তখন ভারসাম্য ঠিক রেখে এঁকেবেঁকে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে আসার ধকলে পা দুটো টলোমলো। এরপর শিল্পের সমঝদারপনা করতে গিয়ে ঘটলো নাশ। মেঝেতে জানালার শিকের গড়া নকশা এড়াতে এক টেবিলের কোণে ধাক্কা খেয়ে চা প্রায় ছলকে পড়ে আর কি। এটি কোনো নতুন দৃশ্যও নয়।
এমন কিছু ঘটে গেলে, প্রথম প্রথম খুব ভীত চোখে সৌরভের দিকে তাকিয়ে থাকত। চোখে মুখে প্রস্তুতির আভাস দেখা যেত— যে কোনো ঝড় সামলানোর জন্য পর্যাপ্ত নুয়ে পড়া গেছে। প্রস্তুতি বৃথা যেত। মাঝে মাঝে এর-ওর কাছ থেকে ধমকটা খেত নিয়মিত, কিন্তু সৌরভ কখনোকিছু বলেনি। তবে মাস শেষে হেড অফিসে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব পাঠাতে গিয়ে ওই ভাঙা তৈজসের দাম রবির বেতন থেকে কেটে রাখতেও ভোলেনি।
রবি যখন মেঝেতে রোদের কারুকাজ না মাড়িয়ে আসার আদিখ্যেতা দেখাতে গিয়ে চা ছলকে ফেলল, বিগত অনেক দিনের মতো সৌরভ কিছু বলল না। টেবিলের ওপর ট্রে নামিয়ে রেখে অধোমুখো রবি এক হাতে কাপ নিয়ে আর হাতে পিরিচটা কাত করে ছলকে পড়া চাটুকু ট্রেতে পড়ে যেতে দিলো। এরপর পিরিচের ওপর কাপটা রেখে এগিয়ে দিলো সৌরভের দিকে। সৌরভ ওই চা যখন শেষ করেছে,তখন পিরিচের ওপর বিচিত্র কোনো দেশের মানচিত্রের মতো আঠালো একটি নকশা তৈরি হয়েছে। মাঝে মাঝে একটা দুটো কালো পিঁপড়াকে ওখানে আটকে থাকতে দেখা যায়। চিনির গন্ধ পেয়ে খেতে এসে ওরা ওই আঠালো মানচিত্রে আটকা পড়ে, যেন কালই ওদের পাঠায়। অতপর মৃত্যু ছাড়া কী উপায়?
_______________________________________________________________________________
সৌরভ কথা কাটতে গিয়ে কথার ধারাই কেটে ফেলে
________________________________________________________________________________
সৌরভের অফিসঘরের উত্তরের জানালা দিয়ে মেশিনঘরের একাংশ আর এর বিশাল কালো চলনশীল ফটকটা দেখা যায়। আর পুবদিকের জানালা দিয়ে দেখা যায় কারখানায় ঢোকার ফটক। সূর্যের আলোয় ওই ফটক থেকে আসা পথটা এ মুহূর্তে ঝলমল করছে। ওই ফটক টপকে একটা আধসবুজ মাঠেরও কিছুটা দেখা যায়। চারপাশে মেহগণি আর সুপারি গাছ লাগানো। মাঠের শুরুতেই দৃষ্টি বাধা পড়ে। ঘাস মলিন, কারণ ওখানে নিত্য দৌড়ঝাঁপ চলে। গরমের দিনে দিনের ভাগ যখন বড়, কারখানা থেকে বেরিয়ে শ্রমিকরা সব দল পাকিয়ে ক্রিকেট খেলে। আর যখন শীতের দিন, কারখানা ছুটি হওয়ার খানিক বাদেই সন্ধ্যা, তখন খেলে ফুটবল। আজ চায়ে চুমুক দিতে দিতে মাঠের দিকে তাকিয়ে ছিল সৌরভ। সকাল থেকেই মনটা শুধু বাহিরে চরছে।
এমন সময় কাচে ঢাকা টেবিলটার ওপর টেলিফান ঝনঝন। মগ্নতা ভেঙে শতটুকরো।
ওপারে শীতল কণ্ঠে কেউ বলতে শুরু করেন। থেমে থেমে, কণ্ঠে গুরুত্ব আরোপ করে করে, বলে চলে পরিচিত কণ্ঠ। আজ ওই নতুন ছেলেটা আসবে মিস্টার। আশা করি তাকে ভালোভাবে নেবেন। প্রথম দিন থেকেই তাড়ানোর তালে থাকবেন না।
সৌরভ নিশ্চুপ। ক’দিন আগে প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে যাওয়া বিশ্বাসঘাতক মহাব্যবস্থাপকের একান্ত লোক হিসেবে তার নামটি এখনো নেওয়া হয় প্রধান কার্যালয়ে। শক্তিমতি কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক যে আরও এক প্রতিষ্ঠানের অধিকারী ছিল, তা তো গোপনও ছিল না, নিষিদ্ধও ছিল না। গোপন যা ছিল তা মহাব্যবস্থাপকের নিখুঁত ‘হাতসাফাইয়ের’ কাজ, শ্রমিকরাও এমনটাই বলে। শক্তিমতি কারখানার পেতে চলা অনেক সে নিজ প্রতিষ্ঠানে বাইপাস করে দিতো, কেউ কিছুই টের পেত না। এই টেরটিও পেতে না দেওয়ার পেছনে কম লোক কাজ করেনি। মহাব্যবস্থাপককে বিপণন ও কারখানার অনেককে হাত করতে হয়েছে বলে শোনা যায়। তাদের ভেতর সৌরভও যে একজন, এ নিয়ে লোকের ভেতর সন্দেহ বেশ কম। তবে বিষয়টি এখনো কেন্দ্রের প্রমাণসাপেক্ষ, তাই বাঁকাকথার ঘ্যাঁচোর ঘ্যাঁচ চলে বড়জোর। এর বেশি কিছু নয়।
সৌরভকে প্রায়ই রবির সঙ্গে তার জীবনের একান্ত অনুধাবন ভাগ করে নিতে দেখা যায়। এক জীবনে সবার কাছে ভালো হয়ে থাকা যায় নারে রবি, মাথা যতোই কুটিস। কখনো হওয়ার নয়।
রবি শ্রোতা হিসেবে গাছের মতো। নির্বাক, তবে হাওয়ায় নড়ে। কথা শুনতে শুনতে রবি যখন অস্থির হয়ে পড়ে, মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা হাওয়া দেয়,তখন শরীরের ভর এ-পা থেকে ও-পায়ে সে বদল করে। যদিও মুখটি থাকে নিষ্কম্প, কোনো পেশির কাঁপন ধরারও উপায় থাকে না, আর ভুরুতেও থাকে না কোনো ঢেউ, এরপরও একটি বার্তা হয়ত সৌরভের মনে পৌঁছে যায়। সৌরভ কথা কাটতে গিয়ে কথার ধারাই কেটে ফেলে অসতর্কতায়। বলে, বুঝলি রবি, পারবি না। যারা এটা মানবে না, তারা কী জানিস? গোঁয়ার। তো গোঁয়ার্তুমি করছ যখন চালাও! যুদ্ধ চালাও! তবে সব কথার শেষ কথা তোকে বলি—একটু বিরতি নিয়ে বলে, আচ্ছা বলছি পরে, আগে কাপ দুটো নিয়ে যা। আর ওই সবুজ কাচের বোতলটা কই? হ্যাঁ ওটা। ধুয়ে পানি নিয়ে আয়। নিচে কিন্তু শ্যাওলা পড়ে গেছে। মেজে নিস।
প্রধান কার্যালয় থেকে শাসানো কণ্ঠটির শেষ কথা ক’টি মনে পড়ে। কথা হচ্ছিল নতুন লোকটির থাকার জায়গা নিয়ে। ওই যে গেরস্ত লোকটার বাড়িতে। পল্লব বাবুর পাশের ঘরটা ফাঁকা না এখন? ওখানে ওর থাকার ব্যবস্থা করুন। নিরাপত্তার ব্যাপার স্যাপার সেরে টেরে তবেই। ওখানে তো বেশ চুরি হয়, আপনারাই তো বলেন।
আচ্ছা। আর আমার ঘর বদলের ব্যাপারটা?—কিছুটা দ্বিধার সঙ্গে বলে সৌরভ। ততক্ষণে ওপাশে রিসিভার নামিয়ে রাখা হয়েছে।
ক্ষুব্ধ সৌরভও রিসিভার নামিয়ে রাখে। সারাক্ষণ বাতাসে এই কথাই ভাসছে, সম্মান বজায় থাকতেই নিজ ফিতে দিয়ে রাস্তা মাপুন সৌরভ সাহেব, নিজ দায়িত্বে বিদায় হোন। হাওয়াকথা এখানেই শেষ নয়। একটি ‘নয়ত’ আছে।
নয়ত,কারখানার উৎপাদন যথেষ্ট নয় বলে মাস শেষে মহাব্যবস্থাপকের কাছ থেকে যতই কাটা কথা জবাব চাওয়া হোক, পরিদর্শনে এসে সবার সামনে মান তুড়িয়ে যতই কথা বলা হোক, ছোটপদের সেলস ইঞ্জিনিয়ারটিও রাজধানী থেকে বড় ক্লায়েন্ট নিয়ে এসে সুন্দর পোশাক আর ভাষার গৌরবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করুক, দাপট দেখিয়ে যাক—দিব্যি চাকরটা সেজে থাকুন।
সৌরভ সিঁড়ি ধরে ধীরে নিচে নামতে থাকে। ক্রমে শব্দে, শক্তিতে জেগে উঠছে কারখানা।
চলবে…