॥পর্ব-১৮॥
রাতের খাবার পর্ব শেষ হওয়ার পর মেহেদিকে নিয়ে জামালের দোকানে এলো সলিল। গিয়ে দেখতে পেল, হলুদ আলো মাথার পেছনে রেখে সেখানে আগেই দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে দীর্ঘদেহী কেউ। সে আলোয় কালো মাটির ওপর তার বিকট বড় ছায়া পড়েছে। ঘাবড়ালে? দেখো, নবাগত দুজনের উপস্থিতিতে ওই মূর্তি অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করে থাকবে; তাই শরীরের ভর এক পায়ের পরিবর্তে দুটি পায়ের ওপরই সমানভাবে দিয়ে বেশ সমীহ প্রকাশ করে দাঁড়াল। সিগারেট তার শরীরের পেছনে চলে গেছে আর সেখান থেকেই এঁকেবেঁকে বিচিত্র সব সরীসৃপের অবয়ব তৈরি করে করে বাতাসে মিলিয়ে যেতে থাকল তার ধোঁয়া। আলোটা মাথার পেছনে বলে অবয়বটির কাছে যাওয়ার আগে তাকে চিনতে পারল না দুজন।
ছেলেটির নাম হাসনাত। বছর পঁচিশের নতুন এই মুখ কারখানায় এসেছে সপ্তাহ খানেক। সলিলের সেই প্রথম দিনগুলোর মতোই এখন চলছে তার অতিথিশালায় বসবাস। সলিল আর মেহেদি এগিয়ে এলে তাদের চোখে ধীরে হাসনাতের কোমল মুখটা বিম্বিত হলো। সলিলের মনে হলো, একটা বিব্রত বিনয়ের হাত হাসনাতের মনটাকে অনাবৃত করে দিয়েছে। বড় বড় চোখের ছেলেমানুষী চাহনীর ভেতর এক ধরনের নিষ্পাপ অনভিজ্ঞতা এখনো খেলা করছে তার। বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে বছর তিন বেকার থাকার পর এটাই তার পাওয়া প্রথম চাকরি, ওরা জানে। ফলত কারখানার রূঢ় জীবনেও সে একেবারেই নবীশ। যখন কথা বলে, বেশ দ্রুত বলে ছেলেটা। আর কথায় সংযোজক অব্যয়ের ব্যবহার অতিরিক্ত, এটা সলিলের পর্যবেক্ষণ। মনে হয়, তার বলা কথাগুলো অবিচ্ছিন্ন একটিমাত্র বাক্য। তবে কথার মধ্যখানে যে থামে না তা নয়। থামে এবং তখন তার ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক হয়ে থাকে। তখন কখনো বোকাটে, আবার কখনো উদ্ধত দেখায় তাকে; নির্ভর করে তার চোখের ভাষার ওপর। নবাগত হাসনাত এখনো যেমন ঊর্ধ্বতনদের মনোযোগ আকৃষ্ট করার মতো কিছু করে উঠতে যেমন পারে নি, তেমনই তার অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে শ্রমিকদের বেশরিভাগই তাকে উপেক্ষা করে চলে। এ দুটির মিলিত প্রভাব সামাল দিতে গিয়ে হাসনাতের চোখের ভাষ্যবদল হয়। আর তখন কথা বলে উঠতে হলে, মুখের ওই বিবর পৃথক অর্থবোধক হয়ে ওঠে।
তার ভাষ্য নিয়ে কোনো অসুবিধা না থাকলেও ভাষা নিয়ে কিন্তু কথা উঠেছিল প্রথম দিনই। খাবার টেবিলে এই মেহেদিই সলিলের কানের কাছে মুখ এনে বলেছিল সে কথা, এ ছেলে বোধয় সারাদিনই খবর শোনে। খবরের কাগজের ভাষায় কথা বলে কেমন!
আপত্তিকর কোনো কথা নয় আদৌ, কিন্তু অভিযুক্তের সামনেই কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলার ওই ভঙ্গিটুকু ছিল দৃষ্টিকটু। হাসনাত সেদিন ওই কথাটুকু স্পষ্ট শুনতে পায় নি। কিন্তু তাকে নিয়ে যে বলা হয়েছে, সেটুকু বুঝতে পেরেছিল দিব্যি। তখনই তার মুখচোখের সহজাত উৎসাহী ভাবটা উধাও হয়ে গিয়েছিল। ছোট ছোট নলায় ধীরে ধীরে চিবুতে থাকা তার চোয়াল আর ভাতের দিকে নিবদ্ধ দৃষ্টি দেখে মনবদল ঘটেছিল মেহেদির। সলিলের সঙ্গে আবারো হয়েছিল তার দৃষ্টিবিনিময়। এরপর, শুরুতেই মনে অবস্থান হারানোর বিষয়টি পুষিয়ে নিতে মেহেদি সুযোগ খুঁজছিল হাসনাতের সঙ্গে কথা বলার। আর হাসনাতের এই একটি সপ্তাহের ধ্যান হয়ে উঠেছিল কিভাবে ঊর্ধ্বতনদের, বিশেষ করে মেহেদির ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে কারখানায় শ্রমিকদের ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকা যায় আর সকাল দুপুর রাতে খাওয়ার টেবিলে সবাই ঠিক মতো এসে পৌঁছানোর আগেই যৎসামান্য খেয়ে দ্রুত উঠে পড়া যায়। কোনো জিজ্ঞাসা নিয়ে কারও কাছে তার আসা আর হলো না। কারও সঙ্গে ভাব জমে ওঠারও কোনো অবকাশ হলো না তৈরি।
একদিনের কথা। একটা একঘরে মানুষের বিপন্নতা তার চোখে দেখতে পেয়ে সলিলের মনটা ভিজে উঠেছিল।
ছেলেটা সেদিন তাকে আসতে দেখে তড়িৎ বিশ্লেষক কোষের ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল দ্রুত। একেবারে দরজার মুখে এসে যখন হয়ে পড়ল সলিলের মুখোমুখি, সূর্যের আলো এসে পড়ল তার চোখে। আর ওই আলোকেই সে কাজে লাগিয়ে দিলো। হাতের তালুর আড়ালে চোখজোড়া মুহূর্তে ঢেকে নিয়ে তারপর বাঁ দিকে জোরে দিলো হাঁটা, যেন খুব তাড়া তার। ওই এক মুহূর্তেই যা দেখার দেখে নিলো সলিল। তাকিয়ে দেখল, হনহনিয়ে নিরীক্ষাগারের দিকে এগোল হাসনাত। যখন ঘরটা হাঁটাপথের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াল, ভেতরে ঢোকার অনুমতি না থাকায় কাচের দেয়ালের পাশে বেকার দাঁড়িয়ে থাকল ছেলেটা। সলিলকে না দেখেও যেন দেখছিল। দেখছিল আর স্থান বদল করতে চাইছিল দ্রুত, শরীরী ভাষা ঠিক এমনই ছিল যেন অসহায় ছেলেটার।
মেহেদিকে বিষয়টা বলতেই তার অপরাধবোধ আবার চাঙা হয়ে ওঠায় বলেছিল, নাহ, আমরা খুব রূঢ় আচরণ করেছি ছেলেটার সঙ্গে যাই বলো। সলিল প্রতিবাদ করে বলে উঠেছিল, আমি মোটেই করিনি, করেছ তুমি।
বাহ, আমি বলেছি আর তুমি বুঝি মাথা ঝাঁকাওনি?
কই না? এমন কিছু করেছি বলে তো মনে পড়ে না!
এখন আর পড়বে কেন। আমার মাথায় কিন্তু সব ঠিকই ধরা আছে।
বেশ, মানলাম। এখন কী করা?
এখন আর কী। দেখি, ব্যাটাকে মুখোমুখি কখনো পাই কিনা রাতে।
সেদিনের পর আজ রাতে হঠাৎ এমন প্রিয় সময়ে মুখোমুখি হয়ে পড়ল ওরা। সময়টা সহায়তা করল বলে, যার যার মনের কাঁটা ওরা অপরের সাহায্য নিয়ে তুলে ফেলতেও তৎপর হয়ে উঠল। সলিল বাড়িয়ে দিলো হাত আর হাসনাতও বিনয়ের সঙ্গে তা তালুবন্দি করল। এর আগে সিগারেট করলো হাতবদল। সলিলের পর মেহেদিও হাত বাড়ালো। দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে কুশল বিনিময় দিয়ে কথা হলো শুরু। আর ক্রমে কথার লেনাদেনায় ছন্দও পেতে শুরু করল ওরা। হাসনাতের ভাষা ঠিক আগের মতোই আছে। যেন পত্রিকা পড়ছে, আর বাক্য,অনিঃশেষ। আজো তা মেহেদির কানে বাজলো। কিন্তু ভুলে থাকতে চাইলো তা। উপায় কি? এদিকে হাসনাতের কথার ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে দুজনে ভাসতে ভাসতে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে তারা চোখের এই ভাষ্য বিনিময় করল, দেখলে, কত ভালো ছেলে? কিছুই যেন মনে রাখেনি।
হাসনাত জানে, কী পরিমাণ নিঃসঙ্গতায় সে নিজে ভুগেছে এই কটা দিন। তা কাটিয়ে ওঠার কী তীব্র আকুতি তৈরি হয়েছে তার মধ্যে, সে খবর তো শুধু তারই আছে জানা। নিজের ওপর জোর খাটিয়ে নিজেকে সরিয়ে দূরিয়ে রাখতে রাখতে তার মনেও ক্লান্তি জমেছিল খুব। আজ নবাগতদের মধ্যেও সদিচ্ছার একটা চাপা আলো দেখতে পেয়ে ওই আলোর সবটুকু সে বের করে আনবে বলে মনে ঠিক করে নিয়েছিল। আর অপরদিক থেকেও একই রকম মনোভাবনা থাকায় দুপক্ষই দুপক্ষের সাহায্যে নেমে পড়ল দুর্দম।
এক পর্যায়ে নিজেকে নিজের কথাগুলো বলতে যখন ঠিকভাবে উসকে দেওয়া গেল, ছুটল সংযোজক অব্যয়ে পূর্ণ অনিঃশেষ বাক্যের রেলগাড়ি। তবে আজ মনে হলো প্রথম দিককার কদিনের তুলনায় বগিগুলোর ভেতর অব্যয়যোগ কিছুটা দুর্বল। বগিগুলো থেকে থেকেই ছুটে যাচ্ছিল, ইচ্ছেকৃত।
হাসনাত তার না বলা কথাকে নিজের মতো সাজিয়ে ফেঁদে বসলো দীর্ঘ গল্প এক। আর পাপস্খলনের মানসিকতা নিয়ে আসা মেহেদি আর সলিল চুপচাপ শুনে যেতে থাকল সব, কোথাও তাকে বাধা দিলো না। হাসনাত শক্তিমতি নামে এই প্রতিষ্ঠানটিরই অপর এক ভুবনের কথা বলছিল। যে ভুবন শ্রোতা দুজনের কাছেই রহস্যে জলডোবা; খানিক চেনা, খানিক অচেনা। সুতরাং পুরোপুরি জেনে নেওয়ার এমন সুযোগ না চাইতেই পেয়ে গিয়ে তারাও আর নাক উঁচোতে পারলো না।
আপনারা তো কারখানায় বোধয় সরাসরি এসেছেন। অথচ এদিকে আমাকে কিন্তু সোজা পথে পাঠায়নি। ধীরে অনেক বিতৃষ্ণা জড়ো করে একসময় আমি নড়লাম। এরপর যখন নাড়াতেও পারলাম, তখনই আসার পথ হলো এখানে। অনেক গল্প! কেউ কেউ চাকরিও হারিয়েছে আপটায়। এক আমিই কেবল আসতে পেরেছি এখানে; সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য এখনো জানি না। বিপণন বিভাগের প্রকৌশলীদেরও তো শুনেছি কাজ শুরুর আগে কারখানায় কিছু দিন অন্তত থেকে যেতে হতো। কাতে কলমে শিখে, ধরে, দেখে যেতে হতো। তেমন হলে তো আমার একটু অন্তত ধারণা থাকত কারখানার, সৌভাগ্য দুর্ভাগ্য বোঝার। বিপণনে ধরা ছোঁয়ার বাইরে সাফল্য যার, কমল ভাই, হালে বড় কর্তা হয়েছেন, তিনি তো প্রকৌশলী নন, আপনারা তো বোধয় জানেন সবই। কিন্তু এটা কি জানেন যে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনিই নবীসদের কারখানায় আসা বন্ধ করেছেন? জানি না তার মনবদল হবে কিনা।
বলে চলল হাসনাত। তার কথার ফাঁকে ফাঁকে থেকে থেকেই কখনো প্রশ্ন, কখনো মন্তব্য হিসেবে এটা ওটা যোগ করছিল মেহেদি আর সলিল। আর ক্ষণে ক্ষণে তাকাচ্ছিল পরস্পরের দিকে। সেই দৃষ্টিতে কখনো বিস্ময়, কখনো কৌতুক আর কখনো নিরঙ্কুশ সহানুভবতা।
বিপণনে সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ, অনেক বড় খদ্দের আনো বাবা! কারখানায়, উৎপাদনে তো লোক আছে ভালো। ওদিকে বিপণনে লোকের কিন্তু বেশ অভাব। আসলে এক ধরনের কৃত্রিম অভাব বলা যায় এটাকে। এবং এই অভাবটা দূর করতে ছুটতে হতো আমাদেরই। ঊর্ধ্বতনের নির্দেশনামা মাথায় নিয়ে মোটা প্রচারপত্র হাতে আমাদের অল্প কজন নবীশকে অবিরত ঘুরপাক খেতে হতো ঢাকার এ মাথা ও মাথা, কখনো ঢাকার বাইরেও। আর আমার মতো আরো বেশ কটা হতভাগা ওখানে এক হয়েছিল। সকালে অফিসে এসে হাজিরাটা দিয়েই যার যার মতো করে বেরিয়ে যাও, এই ছিল নিয়ম। এবং দুজনের গন্তব্য আবার এক হতে পারবে না; প্রমাণ মিললে শাস্তি। কিন্তু বাইরে এই নবীশ আমরা যে কী অসহায়, কী একা, তা নিজেরাই শুধু জানি! সুতরাং লুকিয়ে এক হওয়া ছাড়া আমাদের উপায়ও ছিল না। আমরা কাগজে আজকের গন্তব্য হিসেবে আলাদা আলাদা জায়গার নাম লিখে কর্তাকে জমা দিয়ে, প্রশ্নের জবাবে হুঁ হাঁ করে বেরিয়ে এসে, দপ্তরথেকে অনেকটা দূরে গিয়ে সবাই এক হতাম। যেখান থেকে অফিসের কেউ দেখে ফেলে আমাদের বিরুদ্ধে আবার হুকো লাগানোর সম্ভাবনা তুলনামূলক কম ছিল, তেমনই বেশ কটা বাছা জায়গা ছিল আমাদের। আর জায়গা আলাদা করে আমরা জোড়ায় জোড়ায় যেতাম। তাতে করে নিঃসঙ্গতা কাটতো, আর কাজও সত্যিই এগোত। কিন্তু মনটা দমে থাকতো। কারণ আমাদের ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা ছিল ঠিকই, কিন্তু এই ঘুরে বেড়ানো তো আর বেড়াতে বেরোনোর মতো নয়। কোথায় কাদের ট্রান্সফর্মার লাগবে, লাগলে কেমন কার্যক্ষমতার যন্ত্র হতে হবে সেটা, খুঁজে পেতে এসব বের করার জন্য ছিল যথেচ্ছ ঘোরার স্বাধীনতা। এটাকে স্বাধীনতা বললে ওই শব্দটা লজ্জা পাবে না? ট্রান্সফর্মার লাগবে কিনা দেখতে তোমার নরকে যেতে হবে? তো যাও! প্রয়োজনে দপ্তরগাড়ি দেবে। স্বর্গে যেতে হবে? তো যাও! দপ্তরভাড়া দেবে। প্রতিদিন প্রচ- রোদ মাথায় করে, বৃষ্টি মাথায় করে আমাদের বেরিয়ে পড়তে হতো, আগেই বলেছি। তবু বাইরের রোদ বৃষ্টির মধ্যে ঘোরাও ছিল ভেতরে অবিরত প্রশ্নবাণের ভেতর টেকার চেয়ে অনেক ভালো। ওরা বলতো, কী ব্যাপার? বিপণন প্রকৌশলী এখনো অফিসে কেন? এ বেরোচ্ছে না কেন? এর কী সমস্যা? এ মাসে কটা ঝধষব এসেছে? কী! একটাও না!
এসব প্রশ্নকারদের চোখ বাঁচিয়ে লুকিয়ে থাকার চেয়ে বেরিয়ে যাওয়া ছিল ভালো। বেরোও, এরপর ছোটো। ঢাকার উত্তর দক্ষিণ, পূর্ব পশ্চিম। ছোটো, যানজট ঠেলে এগোও। এবং ছোটো, জল ডিঙোও, হোঁচট খাও। শুধু ডুবে যেন মরো না, তাহলে অসুবিধা আছে। দিনের শেষে আবার অফিসে ফিরে আসতে হতো। ফিরে এসে আমরা সারাদিনের খরচের বিল করতাম। এবং ঊর্ধ্বতনের স্বাক্ষর নিয়ে কোষাগারে গেলে বিলমাফিক টাকা আমাদের ফেরত দেওয়া হতো। এই দিক থেকে ছিল শান্তি, নিজ পকেট ফাঁকা করে কিছু যেত না। কিন্তু একটা কলুষিত প্রলোভন ওখানে ওঁত পেতে থাকত, যেটা প্রথম প্রথম বুঝিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে ওই বেড়ালটা আমার ওপর যখন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করলো, টের পেতে থাকলাম, বাপরে! দাদাভাই, বিরক্ত হচ্ছেন না তো আবার দুজন?
সেলস প্রকৌশলীদের বেতন ছিল খুবই কম। যারা নবিস ঢুকতো তাদের আয়ের অঙ্কে ভিখারি লজ্জা পাবে। এতই কম যে এত খরচা করে, এত মানসম্মানের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে প্রকৌশল পড়া শেষ করে অতো কম বেতনে ঢোকা খুবই লজ্জাষ্কর ব্যাপার, এসব তো জানেন। আর সঙ্গে এও জানেন, চাকরি পাওয়াটা যেহেতু খুবই কঠিন, আর এক জায়গা কিছু না করলে আরেক জায়গায়ও কাজ মিলবে না, সুতরাং নিরুপায় ছেলেমেয়েরা তো কোথাও খুব কম বেতনেও ঢুকে পড়তে বাধ্য। এটারই সুযোগ নিতো যতো প্রতিষ্ঠান। আর এই বিপণন বিভাগের ব্যাপার স্যাপার দেখে মনে হতো, এখানে যে বেতন কম হবে, আর কর্মচারীরা তা পুষিয়ে নিতে নিজেদের মতো করে টাকা আয়ের অবৈধ পথ করে নেবে, এটাই যেন আশা করা হচ্ছে। দেখতাম, সবাই একটু আধটু করে বেশি টাকার হিসেব দেখিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিতো। এরপর বিজয়ীর মতো ঝলমল করতে করতে বেরোত বিপ্লবদার ঘর থেকে, যেন বিপ্লব সফল হয়েছে! প্রথম প্রথম ঠিকভাবে দেখিয়েছি হিসেব। তো, একসময় দেখলাম, মন অবৈধ কাজটা করতে যুক্তি খুঁজতে শুরু করেছে। এদিকে তরুণ বয়স, আদর্শ অটল। কিন্তু ক্রমে মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে চূড়া। ব্যাস। শুরুর দিকে যুক্তি খুঁজতে যাওয়ার পর মনের বাকি কাজ করল মন নিজেই। যুক্তি পাওয়া গেল। আবিষ্কার করলাম মন বলছে, তুমি তো কুলিয়ে উঠতে পারছি না। এবং প্রচ- শ্রম আর এত এত করে ব্যয় করা তোমার মহামূল্য সময়ের বিপরীতে, এত কম বেতন পেয়ে তোমার ধূমপানের খরচটাও কি ওঠে? সুতরাং পুষিয়ে নাও। দেখো অন্যেরা কী করছে। এর বিপরীতে ট্রান্সফর্মারের একটা সেইল যদি দিতে পারো, তোমার প্রতিষ্ঠান তো কৃতার্থ হয়ে থাকবে! আরে, তুমি এভাবে কিছু উপরি আদায় করে নেবে এটা তো প্রতিষ্ঠান ধরেই নিয়েছে, জানো না? দেখো না আরো ওপরের স্তরে যারা আছে, তারা কিভাবে টেবিলের নিচের কারবার করে প্রতিষ্ঠানকে আরো বড় ঝধষব এনে দিচ্ছে, আরো বড় বাড়িতে গিয়ে উঠছে ফি বছর, গাড়ির মডেল বদল করছে? যস্মিন দেশে যদাচার। আর তুমিও যে এমন করছ না, তোমার কর্তারা সেটা বিশ্বাস করবে কোনোদিন? নাইবা করলো, কী এসে যায়, বিবেকের এই প্রতিক্রিয়াটা পড়ল চাপা। এবার ঝধষব এর প্রসঙ্গে আসি।
এই গোটা শিল্পে এত বেশি দুর্নীতি, এত অকল্পনীয় তার বিস্তার যে, আমরা একটি দুটি চুনোপুটি গোটা শহর ঘুরে হয়ত কোনো ট্রন্সফর্মার বিকোতে পারতাম না মাসের পর মাস, কিন্তু সব তলে তলে এদিকে বিক্রি হয়ে যেত। কী করে? এসব তো জানেনই বোধয়। সেকি, জানেন না? আচ্ছা বলছি। বলামাত্রই ধরা পড়বে এসব আপনার প্রথম শুনছেন না। হতেই পারে না। যাহোক, এমনকি এও হয়েছে, আমরা কোথাও গিয়ে হয়ত কথাবার্তা বলে এসেছি, সেই খোঁজ গোপনে পেয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানেরই আরো বড় কর্তা কেউ গোপনে গিয়ে আরো বেশি পয়সা ফেলে তুলে নিজের নামে সেই ট্রান্সফর্মার বিকিয়ে এসেছে। অর্থাৎ গাছেরটা কাঁঠাল তো খেয়েছেই, অফিসে এসে তলারটাও কুড়িয়ে আমাদের মাথায় ভেঙে খেয়েছে, টু শব্দ করতে পারিনি। আর মাস শেষের মিটিঙে সে কী কী সব যে খিস্তি যে শুনতে হতো! শুনেছি একজন মহাব্যবস্থাপক নাকি ছিলেন, এখন আর নেই, তিনি থাকতে মিটিঙে খিস্তির বন্যা বইয়ে দিতেন। অথচ নিজেই নাকি ছিলেন পাজির পা ঝাড়া, মহা দুর্নীতিবাজ লোক! যাক, ওসব শোনা কথা, সত্যাসত্য জানা নেই যেহেতু, বেশি আর আওড়াবো না। যা বলছিলাম ভাই, তা হলো, আমরা বাজারের কিছু রীতি বুঝে উঠতে পারতাম না। আর তাই বিক্রিও হতো না। এবং মাস ছয় পর, বা কারও আগে বা পরে, আমাদের বিপণন প্রকৌশলীদের চাকরি চলে যেত। যেখানে কাঁচা টাকা চোখ টিপছে, সেখানে মায়াদয়া অপচয়। আর অপচয় অবচয় থেকে প্রতিষ্ঠান সর্বদা শত হস্ত দূরে। আর এই সমস্ত শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধের বলি হিসেবে এই আমাদের নবীশদের মতো ভালো সৈনিকপাঁঠা আর হয় না।
মেহেদি ভাই, সলিলদা, বাজারে কিন্তু শক্তিমতির চেয়েও অনেক বড় প্রতিষ্ঠান আছে। এদের সঙ্গে তার প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছে না শক্তিমতিকে? একটা ব্যাপার কারখানায় কেউ জানে কিনা জানি না। তা হলো, ওই প্রতিযোগিতায় টেকার একটা পন্থা নেওয়া হয়েছে এমন, ট্রান্সফর্মারের দাম ধরা হবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কম হলেও দেড়গুণ বেশি। তাতে নাকি একটা মোহ তৈরি করা যাবে যে, দাম যখন বেশি, জিনিসও বোধয় ভালো। আসলে জিনিস কিন্ত ততো ভালো নয়; মাফ করবেন, আপনাদের ব্যথা দেওয়ার জন্য কিছু বলছি না। আপনারা বানান আপনাদের সবটা দিয়ে, কিন্তু মাল আসেই কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণির, ধরতে পারেন কিনা জানি না। নিশ্চয়ই পারেন। যাক, ওই কথায় পরে আরো মজার একটা গল্প নিয়ে আসবো। আপাতত এটা শেষ করি। তো, ওই বেশি দামের চাপে আমাদের সব পরিশ্রম মাঠে অক্কা পেত। আমাদের ঘেমে নেয়ে এত রোদে ঘোরা, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে অঢ়ঢ়ড়রহঃসবহঃ ঠিক রাখা কোনো কাজে আসতো না। অন্য প্রতিষ্ঠান আরো কম দাম দেখিয়ে ঝধষব বাগিয়ে নিতো। অথবা ভোক্তা প্রতিষ্ঠান নিজ থেকেই ডাকতো অন্যদের, আমাদের আর ডাকতো না। ভোক্তাদের বোকা ঠাওরালে যা হয়! ওহ, বলা হয়নি, রোদ বৃষ্টির কথা বললাম না? মাঝে মধ্যে কিন্তু কপাল ভালো হলে কোনো বড় স্যারের সঙ্গে বেরোতে পারলে গাড়িতে ঘোরা যেত। কপাল তো আর রোজ ভালো হতো না। কালে ভদ্রে। ওই সময়কার বাঁদরঝোলা মুহূর্তে খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম, কোনো খাটাশ বন্ধুর সঙ্গে দেখা না হয়ে যায়! যে খাটাশ আমার চেয়ে ভালো চাকরি বাগিয়েছে। সঙ্গে এটাও ভাবতাম, আমিই না যেন আবার কোনো বন্ধুকে এমন লজ্জায় ফেলি।
জামালের দোকানের কাছ থেকে ওরা তিনজন অনেকটাই সরে এসেছিল। কাছে পিঠে এখানে সেখানে জমাট অন্ধকার। মিটমিটিয়ে জ¦লছে জোনাকি, করছে স্থানবদল। বলে গেল হাসনাত।
আমার সঙ্গে আরো দুজন ঢুকেছিল চাকরিতে ভাই। এবং আগের যারা ছিল, তারা তো আছেনই। সবার নিজ নিজ ডেস্ক থাকলেও ডেস্কের কম্পিউটার একই মানের ছিল না। কারওটা ছিল ভালো, কারও খুব খারাপ। এবং দুর্ভাগ্যক্রমে আমারটা ছিল সবচেয়ে ভালো। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, কষ্টের আমার শেষ ছিল না। আমার কম্পিউটার থেকেই ছাপা হতো নির্ঝঞ্ঝাট। সফটঅয়্যারের সংস্করণটাও ছিল ভালো। তাই অনেকেই নকশাও করতে চাইতো আমার কম্পিউটারে বসে। বলতো, ভাই, কিছুক্ষণ একটু ওখানে বসো তো! এই যেমনটা হয় আরকি! তো এই করে করে, কত ভোগান্তিতে যে ফেলত আমাকে ওরা, নতুন বলে কিছু বলতেও পারতাম না। তাছাড়া আমাকেও তো নকশা করতে হতো। এভাবে যুদ্ধ করে যতটা পারতাম করে আমাদের নির্বাহী পরিচালক স্যারকে দেখাতাম। এই স্যার করিডোরে দাঁড়িয়ে সিগারেটে এভাবে আড়াআড়ি আঁচ দিয়ে এরপর ধরাতেন। এবং এই একজন কর্তা ছিলেন সত্যিকার বন্ধু আমাদের। সুতরাং, আমাদের ওপর নিত্য চড়াও পাতি কর্তাদের বেশিরভাগই তাকে ঘোর অপছন্দ করত, খুবই স্বাভাবিক।
তো নকশা দেখিয়ে, এরপর যে প্রস্তাবনা তৈরি করেছি তা দেখিয়ে সবুজ সংকেত পেলেই আমরা বেরিয়ে পড়তাম। কোনো রাজনীতি বুঝি না, কৌশল বুঝি না, কাকের জন্যে ভাত ছিটানোর ঐতিহ্য সম্পর্কেও জ্ঞান ভাসা ভাসা। মোট কথা, বড় হতে হতে ওই পর্যায়ে গিয়ে আমরা খাবি খেতে খেতে খুব হাত পা ছুঁড়ছি; জানি না সেটাকে সাঁতার বলে কিনা। অবস্থাটা এই। অনেক প্রতিষ্ঠানই আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিতো না, ভাবতো আমরা সস্তা দালাল বুঝি। একেকজন যে নামী প্রতিষ্ঠানের পাস করা প্রকৌশলী, সেই অহম তো বহু আগেই মরে গেছে, তবু কিছু ব্যবহার খুব পোড়াত। অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্তাকে ওই পেটমোটা হলুদ বই দেখে ফোন দিয়ে কখনো শুনিনি তিনি দেখা করতে পারবেন। হয়ত সময় ছিল, কিন্তু দরজা তো আর সবার জন্যে খোলা নয়। কাদের জন্যে খোলা? এবার সে গল্পে আসি।
বিপণন প্রকৌশলীদের অনেককেই দেখেছি খোলাখুলি দুটো প্রস্তাবনা বানাচ্ছেন। এবং দুটোয় লেখা দামের ভেতর বিরাট হেরফের থাকতো। যেটা অফিসে জমা রাখতে হতো, সেটায় ট্রান্সফর্মারের দামে অংক লেখা থাকতো কম। আর যেটা ওই ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের টেবিলে পড়ত, সেটায় লেখা থাকত বেশি। হয়ত বুঝতে পারছেন মধ্যখানের ওই বিপুল অংকটার গন্তব্যটা কোথায়। ইশ্, কারখানায় আপনারা এসব থেকে কত দূরে! এসব কি আপনারা এখানে বসে থেকে জানতে পারেন? একটু আধটু, না? তো দুই প্রতিষ্ঠানের দুটি দুর্নীতিপরায়ণ মানুষের ধূর্ততায় হতো একটা বড়সড় যৌথচুরি। দুটি মানুষ? ভুল বললাম। অংক যতো বড়, মুখও ততো বেশি। এভাবে হয়ত ট্রান্সফর্মারের মূল্য ক্রেতা যা দিলো শক্তিমতি পেল তার দুই তৃতীয়াংশ মতো; বাকিটা ওই দুই পক্ষে হলো ভাগ। লালে লাল দুনিয়া ভাই, কোথায় আছেন!
প্রথমবার ওই খরচের হিসেব বড় করে লেখার লোভের ফাঁদে পা দিয়েছিলাম। শেষোক্ত ফাঁদেও যে নিজ হাতে চোখ দুটো ঢেকে পা টা রাখতে হবে, তা কি আমি ভেবেছিলাম এর আগে কখনো?
সেবার আমার যোগটা হয়েছিল এক আবাসন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকের সঙ্গে। লোকটা বলল, আপনার কাছ থেকে মাল নিলে আমার কী লাভ? আমি লক্ষ করলাম আমার শব্দটার ওপর তার জোরটা বড় বেশি। প্রথমবার যখন বলল, এর ভেতরকার মানেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। ফেলফেলিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটা খুব বিরক্ত হলো। কিন্তু আমি যে এ পথে নতুন, কচি এবং কাঁচা তা বুঝতে পেরে আমাকে সাহায্য করতেই বোধয় বলল আরো একবার। আমি আপনার কাছ থেকেই নিলাম ধরুন। কিন্তু তাতে আমার লাভ? এবার বুঝলাম। হায় খোদা! এতদিন পত্রিকাতে গল্পে পড়েছি, আর টেলিভিশনে নাটকেই দেখেছি কেবল যে লোকে এভাবে কথা বলে, এসব করে। এই আমার প্রথম চাকরি, জীবনে প্রথম এটার মুখোমুখি হওয়া। কপাল আমার ঘেমে গেল। দুই কান দিয়ে যেন আগুন বেরুচ্ছে। আমাকে আচমকা একটা চিন্তায় পেয়ে বসলো। আমি আসার পর তিন মাস হয়ে গেছে ট্রান্সফর্মার একটাও বিকোতে পারিনি। সপ্তাহান্তের মিটিংগুলো পিলে চমকানো চিৎকার আর শোনা যায় না, ওই আগের ব্যবস্থাপকের সময়ে নাকি যেত। কিন্তু সাপের মতো শীতল চোখে যেভাবে তাকানো হয়, মনে হয় চোখ দিয়েই রক্ত শুষে নিচ্ছে আমার। আর আমাদের সামনেই কাছাকাছি বড় সহকর্মী যারা, তাদের সঙ্গে কর্তারা এমন ব্যবহার করেন যে বুঝিয়ে দেন, নেহাৎ চুনোপুটি বলে আমাদের তিনি মার্জনা করছেন। বড় ভাইদের সঙ্গেই অমন ব্যবহার দেখে আমরা সিঁটিয়ে যাই। বুঝি ট্রান্সফর্মার বিক্রি করতে না পারলে কোনো আদর নেই, স্রেফ তাড়ানো হবে। বিক্রিটা কিভাবে হবে সে বিষয়ে কোনো ভালো পথনির্দেশনা থাকবে না, পণ্যের ভালো মানের নিশ্চয়তাও দেবে না, দামও থাকবে অবিচল, কিন্তু বিক্রি করতে হবে। কিভাবে? সে তুমি জানো।
দেখুন বড় ভাই, আমি আমার এইটুকু জীবনে অম্লান মুখে একটা মিথ্যেও কোনো দিন বলতে পারিনি। টুটাফাটা মিথ্যে, বন্ধুকে মারের হাত থেকে বাঁচানোর মতো মিথ্যের জন্যে আমার বন্ধুরা কত কেঁদে গেছে, আমি ছিলাম নিরুপায়। আর কোনোদিন কাউকে ঠকাতে মিথ্যে বলব, এটা তো ভাবতেই পারিনি। সেই আমি, ওই আবাসন ব্যবসায়ির সামনে বসে মনকে স্থির করে ধীরে ধীরে কলকলাতে থাকা বিবেকটার টুটিটা স্রেফ এক হাতে চেপে ধরলাম। আমার ওই কা- তো ভেতরের। আর বাইরের কা-টা হলো, একবার ঢোক গিলে বললাম, জি¦, মানে, আপনার লাভের কথা যে আমার মাথায় নেই তা কিন্তু না। আছে, সেটাও আমি ভেবে রেখেছি। তা বলুন আপনি? আমি চেষ্টা করব আপনার পছন্দনীয় অংকটা রাখতে।
কুড়ি হাজার টাকার ফারাক রেখে দুটো প্রস্তাবনা তৈরি করলাম। লোকটা ওটুকুই চেয়েছে। মানে, নিজের জন্য রাখলাম না, কিন্তু আরেকজনকে ঠিকই অবৈধভাবে কিছু পাইয়ের দিতে আমার পক্ষ থেকে সবটুকু করা হলো। আর এভাবেই আমার ভালোমানুষ সহকর্মীদের অবাক চোখের সামনে দিয়ে চাকরিতে যোগ দেওয়ার মাত্র তিন মাসের মাথায় আমার প্রথম ঝধষবটা হলো। এবং একটা দৃষ্টান্তও স্থাপিত হলো। সাদা চোখে ওটা আমার দক্ষতার দৃষ্টান্ত। কিন্তু সরু চোখে? আমার পতনের; কোনো সন্দেহ নেই।
দেখুন, আপনার এখানে যন্ত্রের সঙ্গে সংগ্রাম করছেন। আর ওদিকে আমাদের যন্ত্র এবং মানুষ দুটোর সঙ্গেই কেমন নোংরা লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত নামতে হচ্ছে একবার দেখুন। সন্দেহ নাই, দুদিকেই দুটো আলাদা নাটক মঞ্চায়িত হচ্ছে, কোনোটার চেয়ে কোনোটা হয়ত কম ঘোরালো নয়। এবং যারটা সেই ভালো জানে। যাহোক, তো ওই ঘটনার অফিসে আমার যতো বেশি প্রশংসা হতে থাকল আমি ততোই নিজের কাছে নিচে নেমে যেতে থাকলাম। এক পর্যায়ে ওদের কোনো কথা শোনাও আমার জন্যে শাস্তির মতো হয়ে দাঁড়াল। আমার সরল সহকর্মীরা যখন আমার সৌভাগ্যের, আমার দক্ষতার প্রশংসা করতো, আমি হাসতাম। কিন্তু আমার মনটা কাঁদতো। পাপের কান্না আর শোকের কান্নায় বড় তফাৎ কি জানেন? পাপের কান্নায় পাপবোধ ক্রমশ বাড়ে। আর শোকের কান্নায় হয় উল্টো, অর্থাৎ কমে আসে শোকবোধ। আমার মনের কান্নায় ধীরে ধীরে পাপবোধ এত বেশি বেড়ে গেল যে একরাতে সিদ্ধান্ত নিলাম, হয় এই প্রতিষ্ঠানের কারখানায় কাজ করব, নয় এই চাকরি ছাড়ব। আমার মনে হয়েছে, কারখানার লোকের সৎ থাকতে গিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে কম। আর বিপণনের লোকের তো পাপের কাদায় গড়াগড়ি। একসময় ওরা মহিষ হয়ে যায়, কাদা ছেড়ে তখন আর উঠতেই ইচ্ছে করে না। আমি শুধু এটুকু চিন্তা করেছিলাম যে মহিষ হয়ে পড়ার আগেই আমাকে সরে পড়তে হবে।
তিনজন এগোতে এগোতে সলিলে ওই গৃহস্থবাড়িটার সামনে চলে এলো। আলাপের ভেতর শেষ হওয়ার মতো সুর তখনো ওঠেনি বলে আরো একবার মোড় ঘোরা হলো জামালের দোকানের দিকে।
এরপর? এরপর তো ভাই আমি ওই শীতল চোখ আর বৈঠকে বিশ্রী সব পরোক্ষ আক্রমণ থেকে সাময়িক রেহাই পেলাম। চাকরিও বাঁচালাম। মানে নিশ্চিত করতে পারলাম আরকি পরবর্তী আরো কয়েকটা মাসের জন্য। কিন্তু আমার সঙ্গে, অথবা আরো মাস দুয়েক আগে যারা ঢুকেছিল তারা ভীষণ বিপদে পড়ে গেল। আমার কারণে পদে পদে ওদের কথা শুনতে হচ্ছিল। কথাগুলো কী ধরনের ছিল, আশা করি আঁচ করতে পারছেন। এ অবস্থায় আমার মনের অবস্থাটা কী হলো তা আর বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই। মনে বলছিলাম, হায়রে মায়ের সাধের প্রকৌশলী পুত্র! উদ্ভট দেশে আত্মবিক্রিটা দিব্যি শিখে নিয়ে আয় করতে শিখেছে। এটা নিয়ে কি আর কারও কথাপরিমাণ মাথাব্যথাও আছে? না, নেই। হায় সুরবঙ্গ সাধক! স্বার্থক জন্ম তোমার। রক্তের যে শোষকদের আজন্ম ঘৃণা করতিস, তাদের দলেই শেষতক নাম লেখালি! বাংলা মা ফের উঠে দাঁড়াবে, এমন বাক্য আরো কোনোদিন যেন বড় মুখ করে বলতে যাস না।
মনের এই অবস্থায় এমন একটা ঘটনা ঘটলো, যেটা ছিল চূড়ান্ত আঘাত। এতক্ষণ মাটির ওপর দাঁড়িয়ে ছিলাম। এবার স্রেফ ধসে পড়ে গেলাম, তাও একেবারেই অপ্রস্তুত অবস্থায়। লজ্জায় ঘৃণায় মাটিতে মিশে যাওয়া ছাড়া আমার আর উপায় থাকল না। শুধু বললাম, ধরণী মা, দ্বিধা হ, আমি তোর এই কুসন্তান ভেতরে ঢুকে পড়ি। হায়, প্রকৌশলী হওয়ার সাধ আমার মিটেছে, চাকরির সাধ মিটেছে। সব ছেঢ়ে ছুড়ে এবার আমি বাড়ি যাব মা। আমার এই সোনার হরিণ চাই না, তুই ফিরিয়ে নে।
আমার আনা নির্দেশনাপত্র অনুযায়ী তো ক্রয় বিভাগ মাল আনিয়ে নিলো। এরপর সেই মাল গেলো আপনাদের কাছে। এবং আপনারা আন্তরিকতায়, ভালোবাসায় জিনিসটা বানিয়েও পাঠালেন। কিন্তু জানতেও পারলেন না, আপনাদের ভালোবাসা দক্ষতার কিভাবে অবমূল্যায়ন ঘটেছে। আরে ভাই! জানতে পারলেন কিনা বলুন, নাকি আঁচ করতে পারলেন আদৌ যে, ওই লোক যা যা চেয়েছিল আপনারা বানিয়েছেন স্রেফ তার একটা দ্বিতীয় শ্রেণির সংস্করণ? ইতালির তৈরি যন্ত্রাংশের দাম পরিশোধ করে আপনার ক্রেতা পেয়েছে নবাবপুর রোডে তৈরি যন্ত্রাংশ দিয়ে বানানো পিএফআই প্যানেল। আর ট্রান্সফর্মার পেয়েছে যা চেয়েছিল তার চেয়ে অন্তত পঞ্চাশ কিলো ভোল্ট অ্যাম্পিয়ার কম সক্ষমতার। আপনারা ভেবেছেন এমনটাই বোধয় নির্দেশ এসেছে। কিন্তু ভজঘট যে ঘটেছে তা জানলো কেবল ক্রয় বিভাগ, আর জানলাম আমি; যখন কারখানা থেকে মাল ৃঠিকানামতো গিয়ে পৌঁছেছে। জানলাম তখনই যখন আমার আর কিছুই করার নেই কোথাও।
মাল পৌঁছুলে আমার মক্কেলের ফোন। বলে, করেছেন কী! আপনি আমার সর্বনাশ করেছেন। আগেই আমার বোঝা উচিৎ ছিল আপনার বয়েস কম, আপনাকে দিয়ে হবে না, আপনি পারবেন না। উল্টো আমাকে বিপদে ফেলবেন, এই এখন যেমন ফেলেছেন। হায় এখন আমি কী করি।
আমি তো তার কথার কিছুই ধরতে পারছিলাম না। বললাম, হয়েছেটা কী ভাই, খুলে বলুন।
লোকটা বলল, আপনাদের ট্রান্সফর্মার এলে আমাদের এঞ্জিনিয়র পিএফআই খুলে দেখেছে। দেখা মাত্র বলে দিয়েছে সব দু নম্বুরি মাল। আমাদের এই এঞ্জিনিয়র, আপনি তো বুঝবেন না, মালিকের লোক। আমি একদম ফলস পজিশনে পড়ে গেলাম। এটা আপনি কী করলেন ভাই! একদম ঠিক করলেন না, কাজটা একদম ঠিক করলেন না। এসবেরও কিন্তু একটা সততা আছে, আপনি এসবের কিছুই জানেন না। আপনি কিছুই জানেন না। এই এক কথা বারবার বলতে থাকল। আর বলতে থাকল কী, আপনাকে দাম কমাতে বলিনি কিছুরই। যা যা দিয়েছিলেন অফার লেটারে,যে দাম বলেছেন সে দামেই অনুমোদন করিয়ে দিয়েছি। আর কোথাও পাবেন? আপনাকে তখনই বারবার বলে দিয়েছিলাম, যেন ঠিকভাবে পাই। কিন্তু আপনি একটা ছোট শিশু, আপনার পক্ষে যে সম্ভব না আমার বোঝা উচিৎ ছিল। ছি ছি ছি, আমার মতো লোক কিভাবে এই কাজ করতে পারলো?
অসততারও সততা আছে, বুঝুন। এটা বিপরীতে নাহয় তর্ক করা যায়। শেষ দুটো কথার বিপরীতে কী বলার ছিল আমার? এক, সত্যিই তো যা যেভাবে প্রস্তাব করেছিলাম সেভাবেই দাম মিটিয়েছে, তবু ভালো জিনিস চেয়েছে। আমাকে বলেছে, আমিও ক্রয়কে বলেছি, আর ক্রয়ও হাত তুলে বলেছে, ঠিকাছে ঠিকাছে। কিন্তু এখন?
আর লোকটা বলছিল আরো একটা কথা। বলছিল, এটা বাড়ি ঘরের ব্যাপার। এখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কী করবেন! প্রাণের দায় নেবেন? সব দায় তো পড়বে আমাদের ওপর। মনে আমার ওপর। বলবে আমিই দু নম্বুরি মাল আনিয়েছি। ছোট ভাই, আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক করা কি ভুল হলো?
এমন কিছু যে হতে পারে আমি কল্পনাতেও ভাবিনি। একেকটা ধাপ পেরোচ্ছি, আর একেকটা বিষয় শিখছি। হায় আমার অনভিজ্ঞ মন! আমার দুকান দিয়ে তখন গরম হাওয়া বেরোচ্ছে, বুক করছে ধড়ফড়। দপ্তরের এসির ভেতর থেকেও আমার কপাল দিয়ে চিকন ঘাম বেরিয়ে গেল। এরপর? এরপর ফোনটা রেখেই সোজা ক্রয় বিভাগে! ফেটে পড়তে নিয়েছিলাম প্রথমে। পরে মনকে বোঝালাম, উত্তেজিত হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে না। এখানে একটা সিস্টেম দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এক অর্বাচীনের চিৎকারে সব চুরচুরিয়ে ভেঙে পড়বে না। শান্ত গলায় বললাম, দুর্জয় ভাই, কী হলো এটা বলুন তো? আমার খদ্দের ফোন দিয়েছিল। বলে পিএফআই’র যন্ত্রাংশগুলো নাকি আমরা দিয়েছি সব দুই নম্বর। বলে ট্রান্সফর্মারও নাকি একশ কেভিএ’র। ওদের প্রকৌশলী সব যাচাই করে বলেছে এসব। সত্যি নাকি ভাই? বলুন তো আমাকে? আমি ঠিক মানতে পারছি না। এমন পরিস্থিতিতে কখনো পড়িনি, পড়ব বলে ভাবিওনি। সত্যিই কি হয়েছে এমন?
দুর্জয় ভাইকে আপনারা হয়ত চিনে থাকবেন। ওনার সঙ্গে কথায় কি আর পারা যায়? ক্রয় বিভাগের তিনিই সর্বেসর্বা। বললেন, আপনার মক্কেল আর তাদের প্রকৌশলী দুজনেরই নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে। আপনি যা যা নির্দেশনা এনেছেন ঠিক তা ই আমি কিনিয়ে কারখানায় পাঠিয়েছি। আর দেড়শ কেভিএ চেয়েছে না ওরা? অনেক খরচা করে পরীক্ষা নিরীক্ষার পরই তাদের কাছ মাল গেছে। একশ কেভিএ হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না, অসম্ভব।
অসম্ভব হলেও আপনি একটু খোঁজ নিন ভাই, বললাম আমি। দুর্জয় ভাই হাত নেড়ে যেন কাক তাড়ালেন। ভাই, আপনি আপনার কাজ করুন তো, এটা নিয়ে আর মাথা ঘামাবেন না একদম, আমি এদিকটা দেখছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমার ওপর ভরসা রাখুন। কোনো সমস্যা হবে না।
আমার পাশে এসে তখন দাঁড়িয়েছে আরো একজন প্রকৌশলী। তিনি আমায় চেয়ে বছর খানেক জ্যে এ প্রতিষ্ঠানে। সুতরাং নাম বললে নিশ্চয়ই চিনবেন তাকে আপনারা, তাই নামটা আমি বলছি না। তিনি নিতান্ত শুভাকাক্সক্ষীর মতো আমাকে যা বললেন তাতে আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললেন, আমরা যাদের কাছ থেকে সুইচ বা এসব কিনি তারা বাংলাদেশে ওসবের একমাত্র ডিলার। আর আমাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও খুবই ভালো। আপনার মক্কেলরা যদি যন্ত্রাংশের ব্যাপারে খোঁজ নিতে যায় তো ওই ডিলারদের ফোন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আপনি এক কাজ করুন। ওই ডিলার অফিসে আগে একটা ফোন করে রাখেন যেন, মক্কেলদের কাছ থেকে ফোন গেলে ওরা বলে যন্ত্রাংশ সব ইতালিরগুলোই দেওয়া হয়েছে। এটুকু সুবিধা ওরা যে আমাদেরই শুধু দেয় তা ই না। আমাদের মতো আরো যারা ওদের মক্কেল, সবার হয়েই ওরা মাঝে মাঝে এমন কাজ খুশিমনে করে। আপনি এটা নিয়ে একেবারেই চিন্তা করবেন না।
সলিলদা, মেহেদি ভাই, আসলে ওরা বুঝতেও পারে নি আমার ক্ষোভের জায়গাটা কোথায়, অপমানের জায়গাটা কোথায়। আমার চিন্তার জায়গা ঠিক কোনটি। যাক, দুর্জয় ভাই অবশেষে আমার চাপে পড়ে সামনেই ফোন করলেন কারখানায়। কিছুক্ষণ হুঁ হাঁ করে রেখে বললেন, হুম, পিএফআই’র যন্ত্রাংশগুলো দু নম্বর চলে গেছে। ট্রান্সফর্মার কিন্তু দেড়শ কেভিএই আছে, সেখানে কোনো সমস্যা কিন্তু হয়নি। আরে, এমন হয়েই থাকে। এসব এক আধটু সবার বেলাতেই হয়, আমরা যাদের কাছ থেকে কিনি তাদের কাছ থেকেও এমন এক আধবার হয় না তা না। এসব কোনো ব্যাপার না ভাই, আহারে। এরপর আমার পাশের ওই প্রকৌশলীকে বললেন, আপনি ওনাকে একটু বোঝান তো ভাই লক্ষ্মী।
ততক্ষণে অপমানে টলতে টলতে আমি পেছনে চলে এসেছি কয়েক পা। আর আমার চোখে জল; শুনে আপনারা হয়ত হাসছেন। কি, হাসছেন না? হাসির পাত্রই আমি বটে, হাসবেন না কেন ভাই? এরপর আমি কি করলাম জানেন? একেরপর এক আরো হাস্যোস্পদ হওয়ার মতো ঘটনার জন্ম দিলাম। জ্যে এক প্রকৌশলীর কাছে গিয়ে বললাম, ভাইয়া, আমার খদ্দেরকে নকল জিনিস দেওয়া হয়েছে। তিনি হাসি গোপন করে বললেন, একদম ঠিক হয় নাই। খুব খারাপ কাজ হয়েছে। এরপর তিনি নিজেই পাশের জনকে ডেকে বললেন, শুনেছেন ভাই, হাসনাতের খদ্দেরকে নাকি নকল মাল দিয়েছে। পাশের জনের জন্য বুঝি বছরের সেরা কৌতুক ছিল এটা। ঠা ঠা করে হেসে উঠে বলল, তাই নাকি! খুব খারাপ করেছে, খুব খারাপ!
আমাকে আর কিছু বলতে হলো না, ধীরে ধীরে সবাই জেনে গেল। আর আমার দিকে তাকিয়ে দুলে দুলে হাসতে থাকল। বহু কষ্টে নিজেকে সামলালাম। চোখ দুটো বন্ধ করে চোখের মণিটা একটু ওপরে তুলে দশ থেকে উল্টো গুনে একে এলাম। এমন সময়ে আমার জিভে পড়ল কামড়, কী ব্যাপার? দেখি সঙ্গে সঙ্গে মক্কেলের ফোন। ধরতে ওপার থেকে মেঘ গর্জালো। খোঁজ নিয়েছেন? নিজেকে ততোক্ষণে সামলে নিয়েছি আমি। আর চোখ দুটোও মুছে নিয়েছি। কঠিন কণ্ঠে বললাম, একশ নয়, দেড়শই আছে কেভিএ।
আর সুইচগুলো? পাল্টা প্রশ্ন তার।
বললাম তো! তার ঝাঁঝটা এবার আমার কণ্ঠে। ওদিকে ওই লোকটারও তো মন দুর্বল, বুঝতেই পারছেন। ফোনের বিপরীতে তাই বোধয় কোনো রা আর ছিল না। অথবা আমাকে কঠিন স্বরে কী বলা যায় তাই বোধয় ভাবছিল। নিজেই ফোনের লাইনটা কাটলাম। চারদিকে আমাকে নিয়ে তখনো হাসি ঠাট্টা চলছে। শুধু একজনকে দেখলাম আমার হয়ে পারচেজের দুর্জয় ভাইয়ের সঙ্গে লড়ছে। তিনিও আমার জ্যে হবেন। তাঁর সঙ্গে আমার কখনো ভালো মতো কথা হয়নি। তবে সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামার সময় নিত্য হাসি বিনিময় চলতো। শুনলাম তিনি বলছেন, একটা ছেলে প্রথম সেইল করল, আর তারটাতেই আপনারা এমন করলেন! অন্যগুলোয় করেন ভালো কথা, কিন্তু এটা তো ছেলেটার প্রথম কাজ ছিল। ওর ক্যারিয়ারের ব্যাপার রীতিমতো। এটা মাথায় রাখবেন না আপনারা?
সেদিন থেকেই ভাবলাম, এখানে আর নয়। কিন্তু চাকরিই বা ছাড়ি কী করে? আমাকে পড়াতে গিয়েই তো সঞ্চয়ের সিংহভাগ খোয়ালো আমার পরিবার। সুতরাং ছেড়ে দেওয়া চলবে না, বাঁচি কি মরি। এখানে মন যেহেতু টেকার লক্ষণ নেই, কারখানায় যাওয়া যায় কিনা চেষ্টা করে দেখা যাক। আগেই বলেছি, নির্বাহী পরিচালক স্যার আমাদেরকে, মানে নতুনদেরকে অনেক সাহায্য করতেন। পছন্দই করতেন হয়ত। তিনি অফিসের করিডোরে দাঁড়িয়ে, দামি চকমকির আগুনে সিগারেটে আঁচ দিতে দিতে সাদা গোঁফের আড়ালে হাসি নিয়ে আমাকে কথা বলার অনুমতি দিলেন। এরপর ধোঁয়ায় চারপাশ নীল হয়ে গেল। শুনলেন সব। অবশেষে বললেন, ঠিকাছে, দেখব।
ওই যে বলেছি আগেই, তাঁর শত্রুও অনেক। পছন্দ করার লোক কমই। সবাই মিলে বাধা দিতে থাকল। বলা হলো কারখানা হলো আঁতুড়ঘর। আর বিপণনের লোকেরা হলো রোগের মতোন। বিপণনের প্রকৌশলী কেউ কারখানায় যাবে, তা মানা যায় না। এটা হতেই পারে না। কিন্তু ওই নির্বাহী স্যার, পরিচয় আছে কি তার সঙ্গে ভাই, কতখানি একরোখা মানুষ তাও আমি দেখলাম। তাঁরও রোখ চেপে গিয়েছিল। তবে আমাকে বাকি সব পরিচালকদের সামনেও আরো পরীক্ষায় বসতে হলো। এরপর একসময় সৌরভ স্যার যখন জানালেন, হ্যাঁ, কারখানায় লোক তার প্রয়োজন, অবশেষে তখনই ছাড়পত্র পেলাম। এই হলো ইতিহাস।
আলাপের উদার আলো হাওয়ায় সবার মনের কাদা শুকিয়ে ধুলো। এরপর ঝাঁটপর্বও চললো কিছুক্ষণ, আড্ডায় আর আপ্যায়নে।
সলিলকে বিদায় দিয়ে মেহেদি আর হাসনাত দাঁড়িয়ে থাকল মেটে রাস্তার মাথায়। গৃহস্থ বাড়ির দরজা গলে অবয়বটা ভেতরে ঢুকতেই ওরা ধরল কারখানায় ফেরার পথ; দুজনেরই গন্তব্য অভিন্ন।
চলবে…
কারখানার বাঁশি: পর্ব-১৭॥ হামিম কামাল