পর্ব-১৬
প্রিয় শুভ্রা,
আমি জানি না, কী ভুল আমি করেছি। কিন্তু এটা জানি যে সমীরের এমন লাঞ্ছিত হওয়ার দায় আমি পুরোপুরি এড়াতে পারি না।
আমার পরিকল্পিত ধাপের ভেতর কি কোথায় কোনো গলদ, কোনো হুড়োতাড়ার ছাপ ছিল? নিশ্চয়ই ছিল। নয়ত একটা সৎ দায়িত্বশীল, সদকৌতূহলী কিশোরকে আমি কী করে ওই পথে প্রভাবিত করতে পারলাম যে সে চুরির দ্বারে এসে ধর্না দিলো? আমি কি তার সামনে যথেষ্ট সহজ বন্ধুটি হতে পারিনি? কী করে সমীর তার এমন সহজ প্রয়োজনের কথা তারেক বা আমাকে না বলে পারল? আর নিজেকে এমন গর্হিত কাজের দিকে ঠেলে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই খুঁজে পেলো না?
একটু ভাবা যাক। এ ঘটনা শোনার পর থেকে আমি ঠিকভাবে একটা কিছুও ভাবতে পারছি না। যেন আশার অতীত খুব বড় একটা কিছু হয়ে গেছে। যেন আমার অনেক যত্নে সাজানো কোনো বাগান আচমকা ঝড়ে তছনছ হয়ে গেছে।
এবার একটু কি পরম্পরা ধরে ভাবা যেতে পারে?
সমীর আজন্ম অভাবী পরিবারে বেড়ে ওঠা ছেলে। কিন্তু মেধা তাকে আলাদা করেছে। কৌতূহল তাকে বিশেষত্ব দিয়েছে। এটা আমি তার সঙ্গে কথোপকথনের দ্বিতীয় দিনে নিশ্চিত বুঝেছি। এরপর আমি ওর কৌতূহলকে ক্রমাগত প্রশ্ন করার, জানার দিকে উসকে দিতে চাইলাম। আমি সঙ্গত আরও অনেক স্বপ্ন ওকে দেখালাম। স্বপ্নগুলোকে সে ধারণও করলো।
বেশ, এ পর্যন্ত বেশ ঠিক আছে।
কিন্তু ঠিক নেই আরও দূর অতীতের শেকলে। অতীত শেকল থেকে সারাক্ষণ মানুষের বর্তমান প্রাণশেকলে তথ্য আসছে তাই পুরনো এড়ানো কখনও যায় না। এর প্রভাবকে সীমিত করা যায় বড়জোর।
যতদূর জেনেছি, নিজ জন্মস্থান থেকে পালিয়ে এই মনময়পুর এসেছে দুটি ভাই। দু’জনই কাজ জুটিয়ে নিয়েছে একই কারখানায় এরপর। যেহেতু তাদের কেজো বিদ্যায় সমযোগ ছিল। বাবার কাজের সূত্রে কারখানার পাঠ তাদের ছিল। আর তারেকের বিশেষ পড়াশোনাও ছিল। অস্তিত্বের সংকট দূর করতে তাদের করতে হয়েছে প্রবল সংগ্রাম। আর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের ওপর ভরসা করতে হয়েছে বহুবার। যতটুকু ধীরতা ওদের আত্মার অন্তর্গত, ততটুকুর চর্চা করতে তেমন পারেনি। কারণ শক্ত কোনো নৈতিক অবকাঠামোর ভেতর দিয়ে ওরা আসেনি। যে কারণে কৌতূহল মেটাতে গিয়ে মনের লাগাম টেনে ধরতে দেখার মতো কোনো আদর্শের সঙ্গে হয়ত পরিচয়ও ঘটেনি তাদের।
এদিকে আবার ভাইয়ের বাৎসল্যের কারণে, আমার অনুরাগ উৎসাহের কারণে, অনেকটা পথ ইতোমধ্যে এসেছে এমন বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ায় হয়ত সাহায্য না চেয়েই কাজ দেখিয়ে চমকে দিতে চেয়েছিল সমীর!
হ্যাঁ, এটা হতে পারে। সমীরের এখনো-কিশোর মন আসলে চমকে দিকে চেয়েছিল। কিন্তু সে চমকের পথে বিবেক যে আবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়,তার বেলা?
আরও বিষয় আছে এর ভেতর এখানেই শেষ নয়। সমীরের ব্যবহারিক জ্ঞানে যে উৎকর্ষ ইতোমধ্যে চলে এসেছিল, ওই উৎকর্ষের সমান অনুপাতে যে প্রত্যাশার জন্ম হয়েছিল, তার ভর ওই তরুণ কল্পনাপ্রবণ মন আর নিতে পারেনি। ভর নেওয়ার জন্য কল্পনার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বাহির থেকে তাকে তুলে ধরতে হয়। তোমার কল্পনাকে তোমাকেই তুলে ধরতে হবে। যদি বলো, ‘অ্যাই কল্পনা আমাকে তুলে ধর’, তাহলে চলবে না।কল্পনার বায়বীয় শরীর কখনো বস্তুর ভার বহন করে না। প্রকৃতির নিয়ম তা নয়। এ কারণেই কিশোর-কিশোরীর মন সবচেয়ে বেশি ভাঙে, খুব সহজেই। আর কী মারাত্মক বিপর্যয় ঘটায় ওই ভেঙে পড়া মন!
প্রত্যাশার ভর আর নিতে না পারায়, তাড়াতাড়ি সেই ভরকে কাজে রূপ দিয়ে ঘাড় থেকে নামাতে গিয়ে সমীর ভুলটা করল। তাই কি? একটু হুড়োতাড়া করে ফেলল। হ্যাঁ, আমি বোধয় এবার ধরতে পারছি কী সমস্যা হয়েছিল সমীরের। কোথায় ছিল তার বিপদ, সংকট। আর সেই সংকটের পেছনে আমার হাতও-বা ছিল কতখানি।
শুভ্রা, কৌতূহল আর এর প্রকাশকে সংবরণ করা আসলে যুগপৎ শেখানোর বিষয়।
কৌতূহল সংবরণ নয় বরং কৌতূহলের প্রকাশকে ক্ষেত্রবিশেষে সংবরণ; এটার কথাই আমি বলছি। তো, এই কৌতূহল আর এর ওই সংবরণটুকু যুগপৎ শেখানোর মতো গুরুতর বিষয়। আমি সমীরের কৌতূহলকেই শুধু উসকে দিয়েছি। শেখাইনি এর প্রকাশের সংবরণটা।
হায় আমার অহম! এই তো পেয়েছি আমার পতনের গোড়া। এখানেই তো গলদ লুকোনো ছিল! আমার নিজের ভেতর নিজ মেধার, প্রভাবের একটা অহমিকা নিশ্চয়ই রয়ে গেছে। নইলে ভারসাম্য নীতিজ্ঞান যার আছে, সে জ্ঞানে আস্থা যার আছে, সে কী করে এক নবীন তরুণকে পাঠ দেওয়ার ক্ষেত্রে এটা এড়িয়ে যেতে পারল?
তারেককে ধন্যবাদ, তারেক ভাই আমার, ধন্যবাদ তোমাকে। এই তারেক চোখে আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিয়েছে আমার প্রমাদ, আমার ভুল। বলেনি কিছুই প্রায়, তবু যেন সব বলে দিয়েছে। আমাকে সব বলে দিয়েছে তার চাহনি, তার কাজ।
সমীরকে যতো বইপত্র আমি দিয়েছিলাম তার সবক’টা সে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। তার চোখ দুটো একটা কথাই বলেছে শুধু। হায় শুভ্রা, ওই একটা কথার ভার আমাকে আমারণ বহন করে বেড়াতে হবে!
‘আমার ভাইয়ের জন্য আমি একাই যথেষ্ট।’
ফিরিয়ে দিয়ে যাওয়া বইগুলি আর এই কথাটি একসঙ্গে অসংখ্য বিষমাখাতীরের মতো বিঁধল আমার বুকে। বেশ। এবার আমার নিজেকে সংবরণ করার পালা।
কৌতূহলের প্রকাশকে সংবরণ করার ধ্যান আমার নিজেরও হয়ত যথেষ্ট নেই। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমি ভেবেছিলাম বুঝি তা আছে। আর এখানেই তো আমার হার। এ হারের গ্লানি আর ঘুচবে না। এ হার আমার গলা থেকে আর খুলবে না।
একটা অবাক সত্য আমি জেনেছি শুভ্রা। এটা নিছক কোনো আপেক্ষিক বাস্তবতা নয় বুঝলে, এটা সত্য! তা হলো, ভালোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মন্দও উৎপন্ন হয়।
এটা সম্ভবত প্রকৃতির মৌলিক নীতি গুলোর একটি। আমি নিশ্চিত নই যদিও, তবু আমার ঘোর সন্দেহ, এটাই।
প্রকৃতিতে অসংখ্য নিয়ম পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। মানুষ এজন্যেই একটা সাধারণ নিয়ম বের করতে গিয়ে এর দুঃসাধ্যতা টের পেতে শুরু করেছে। এ কারণেই মতে, ধর্মে, মনুষ্যত্বের বোধে এতো প্রভেদ।
মানুষের মন বড় নমনীয় মাত্র। তার মনের আকারের গড়াপেটা সারাজীবন চলতে পারে যদি সে তা চায়। জানো, এই কারখানাজীবন আমার ভালো লাগছে না। আমি নিজেও জানতাম, ভালো লাগবে না বেশিদিন। তবু এসেছিলাম।এসেছিলাম আমার ওপর একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রত্যাশার দায় মেটাতে। আচ্ছা বলোতো, ওরা আমার কাছে কী চায়? কী চায় তা জানিয়ে কিন্তু ঠিকই মুখ গোঁজ করে রেখেছে। যদিও আমি নিশ্চিত জানি ওরা আমার কাছে ঠিক তাও চায় না। কী চায় এ বিষয়ে ওদের স্পষ্ট কোনো ধারণা কি আছে? এরপরও এই যে ওদের তাৎক্ষণিক চাওয়া, আমার কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে না-উঠে পারে না। কারণ আমার পরিবার আমার আজকের এই আমিটির অস্তিত্বের পেছনের বর্তমান। ওই যে শুরুতেই বললাম, বর্তমান মানুষের কাছে সারাক্ষণ অতীতের শেকল থেকে তথ্য আসছে! সুতরাং আমার পরিবারকে আমার ভালোবাসতে হয়েছে। এর বদলা জীবন!আর, এ থেকেই আমার একটা নতুন অনুধাবন এসেছে।
বাবা মায়ের স্নেহকে অনেক মহিমান্বিত করা হয় না? সাবধানে এবং দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এটা একটা ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু নয়।
আমাকে ভুল বুঝে কষ্ট নিও না শুভ্রা। জানি না তোমার কাছে এ সত্যকে কখনো উন্মোচিত করবে কিনা প্রকৃতি। বা উন্মোচিত করলেই এর ভরটা তুমি নিতে পারবে কিনা এও এক প্রশ্ন। আপাতত এ প্রশ্ন তোলা থাক, পরে এ নিয়ে বসবো আবার, যখন মুখোমুখি হবো। আপাতত শুনে নাও এই, শুধু বাবা আর মাকে দিব্যি মহিমান্বিত করা যায়! কারণ তাদের মিলনে একটা নতুন প্রাণ এসেছে। কিন্তু সন্তানের প্রতি তাদের স্নেহকে মহিমান্বিত করার কিছু নেই। কেন? কারণ ওটা সাপেক্ষ বাস্তবতা। সত্য নয়।
আর এ কারণেই অপত্যের প্রতি স্নেহময় বাবা-স্নেহময়ী মা অপরের অপত্যের প্রতি ভয়ানক নিষ্ঠুর বা অনুভূতিহীন হয়ে উঠতে পারেন। হয়ে ওঠেন। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের, প্রতিটি সমাজের, প্রতিটি পরিবার এর অগ্নিস্বাক্ষী। ওই প্রীতি, ওই স্নেহসাপেক্ষ বাস্তবতা বলেই এমন হওয়া সম্ভব হয়েছে। সত্য হলে সম্ভব হতো না। কারণ বাস্তবতা পরিবেশ প্রতিবেশনির্ভর। সত্য নয়। কেউ যদি দুটো গুলিয়ে ফেলে, তো বলতে হবে বাস্তবতা আর সত্য এ দুটোর সংজ্ঞাই তা অজানা থেকে গেছে।
তোমাকে আমার পরিবারে একাকী রেখে এসে এখানে প্রতিমুহূর্তে পুড়ছি। আর কিছু কথা না-বলে মনে শান্তি পারছি না। আমার আগের কথাগুলোর সঙ্গে এটুকু ভারি প্রাসঙ্গিক। তুমি আমার জীবনসাথী হওয়ার পর এই পুরুষের তৈরি তন্ত্রের দাসী হয়ে যখন আমাদের সঙ্গে থাকতে এলে, এমন অবিশ্বাস্য সব অভিজ্ঞতা আমার বাবা-মাকে নিয়ে হয়েছে যা বিয়ে না করলে কোনোদিনও হতো না! কোনোদিন জানতেও পারতাম না ওই সাপেক্ষ বাস্তবতা আর সত্যের ব্যবধান এতো রূঢ় হতে পারে! কোনোদিন ওই সব সত্য আমার কাছে উন্মোচিতই হতো না! একটা তৈরি করা বাস্তবতার ঘোরগ্রস্ত আমি ওই ঘোরটাকে সত্য জ্ঞান করে আজীবন কাটিয়ে দিতাম!
প্রকৃতি এভাবে নানা ছুতোয় আমার ঘোরগুলো ভেঙে দিতে লেগেছে।
সমীর আমার ঘরে এসেছিল গতরাতে। আমাকে খুব ভালোবাসে ছেলেটা, আমি জানি। ভালোবাসার মানুষের কাছে কোনো আশ্রয় পেতে কিন্তু সে আসেনি। আসেনি ভাইয়ের মতো আমাকে দোষী সাব্যস্ত করতেও। এমন কখনো সে করতে পারবেও না। কারণ আমার মন সে যাপন করেছে।তারেক তা করেনি।
সমীর একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার নেওয়া সিদ্ধান্তটার শুদ্ধতা বিচার করতে সে আসেনি। এসেছিলআমাকে স্রেফ জানিয়ে যেতে।
এই কারখানায় সে আর কাজ করবে না।
এটা জানার অধিকার তার সহোদর ভাইয়ের পর আমি ছাড়া কারই বা আছে?
গত ক’টা দিনে সমীর যেন অনেক বড় হয়ে গেছে। কিংবা কে জানে, বড় হয়ত সে আগেও ছিল। কিন্তু আহ্লাদের আশ্রয় ছিল যাদের হাতে, তাদের কাছে সেই বড়ত্বটুকু সে জোর করে গোপন রেখেছিল।
আমি ভাবি—কী আশ্চর্য এই সব ব্যাপার। সমীর পকেট ট্রান্সফর্মার দুটো সরিয়ে কোনো কাজেই লাগাতে পারেনি। আর যন্ত্রদুটোও সেদিনই যেখানকার জিনিস সেখানে ফিরে গেছে। অর্থাৎ যে ঘটনা আদৌ ঘটতে পারেনি; বিবেকবান মানুষের ওপর, আর বিবেকহীন সমাজমানসের ওপরতার প্রভাবও কোনোক্রমে এড়ানোর মতো নয়।
বেরিয়ে যাওয়ার সময় ঘরের চৌকাঠে পা লেগে ব্যথা পেল ছেলেটা। পেছন থেকে আমাকে তাতে উদ্বিগ্ন হতে দেখে করুণ হাসলো একবার। এর ভেতর প্রকৃতির কোনো গোপন ইশারা কি সে টের পেয়েছিল? প্রকৃতির ইশারা বলে তো কিছু নেই আসলে। যা আছে তা হলো প্রকৃতির ঘটনাবলীর ভেতর নিজেরই মনের প্রতিফলন দেখার গোপন ইচ্ছা। পরমন অন্ধকার। তখন সমীরের মনে কী ছিল আমি জানি না। কিন্তুতার ওই চৌকাঠে আটকে যাওয়ার ভেতর আমার ছাত্র হিসেবে সত্য যে সমীর, তাকেই আমি শেষবারের মতো পেয়েছিলাম। আর কাউকে নয়।
আবার ঘরের কবাট ঠেলে সমীর বেরিয়ে গেল। শিশু যেমন আর কখনও মায়ের জঠরে ফিরে আসে না; হঠাৎ মনে হলো সমীরকেও যেন ঠিক তেমনিভাবে চিরতরে হারালাম।
ভালোবাসা নিও আমার লক্ষ্মী প্রেমিকাবধূ!
সলিল।
চলবে
কারখানার বাঁশি: পর্ব-১৫॥ হামিম কামাল