॥ দশ ॥
সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে সৌরভ বসে আছ। হাতে প্রথম দিনের মতো একটা স্বচ্ছ অর্ধগোলাকৃতির পেপারওয়েট।উল্টো করে ঘোরানো হচ্ছে। টেবিলের ওপর স্বচ্ছ সবুজাভ কাচের স্তর।তার নিচে বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তি, শর্তাবলী আর সরকারি ছুটির ছোট পঞ্জিকা। ডান হাতের কাছে কলমদানিটিওআছে আগের মতোই—কতগুলো কাগজপত্রের ওপর চাপা। হাতের বাঁ পাশে একটা ছবির টেবিলফ্রেম, সৌরভের দিকে ঘোরানো। তাতে সাদাকালো করে তোলা পারিবারিক ছবি। হাসিমুখে পাশাপাশি দাঁড়ানো স্বামী স্ত্রী, কোলে বছর তিনেকের একটি মেয়ে—মাথার দুপাশে ঝুঁটি বাঁধা। স্ত্রীর হাসিতে সৃশৃঙ্খল দাঁতের সারি দৃশ্যমান, শিশুটি উচ্ছ্বসিত। সৌরভের ঠোঁটে স্বভাবসুলভ চাপা হাসি, বহুজনে যার বহুরকম অর্থ করে। ছবিতে তিনজনের পেছনে আরেকটি দেয়ালছবি, তাতেএকটি পাহাড়ি নদীর বাঁকে সূর্য উঠছে কিংবা অস্ত যাচ্ছে।
কাগজপত্রের ছোট ছোট স্তূপ টেবিলের দুপাশের কিনারা ঘেঁষে। ওগুলোর নিচে চৌকো ফ্রেমের মতো জমে আছে ধুলো। কাপড় দিয়ে রবি যখন টেবিলের ওপর বুলিয়ে চলে তখন স্তূপ কাগজের ওই কিনারগুলো বাদ পড়ে যায়।শরণার্থী শিবিরের মলিন গলিগুলোর মতো অনিশ্চিত ও সরু ওই ফ্রেমের তখন জন্ম হয়।
সৌরভ সোজা তাকিয়ে আছে, তবে সলিলের দিকে নয়। তার দৃষ্টি সলিলের মাথার ওপর দিয়ে পেছনের দেয়ালের খোলা জানালা গলে বাইরে চলে গেছে। ঘরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র একটা আছে বটে, তবে বরাবরের মতোই বন্ধ। কারখানার বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের চেষ্টার অংশবিশেষ। দেয়াললগ্ন আয়তাকার বস্তুটির নিচে লেখা আছে—তাপমাত্রা কুড়িতে রাখুন। ওঠানামা ক্ষতিকর। ছাপানো কাগজটি দেয়ালের মায়া কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।চলছে পাখা, সশব্দে। জানালার পাশেশক্তিমতির নামে প্রকাশিত হওয়া একটা দিনপঞ্জি পাখার বাতাসে দুলছে পেন্ডুলামের মতো। একেকটি পাতায় কারখানার তৈরি বিভিন্ন আকার ও সক্ষমতার ট্রান্সফর্মারের ছবি শোভা পাচ্ছে। নতুন চুনকাম করা দেয়ালেএদিক-ওদিক দুলে দেয়ালে একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করেছে দিনপঞ্জি।
অনির্দিষ্ট গন্তব্য থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে সুনির্দিষ্ট গন্তব্যে তাকে স্থির করল সৌরভ। চশমার আড়ালে সলিলের মৃদু হলুদাভ চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,গেস্টরুমে আপনার থাকতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে?
না। বেশ আছি, বলল সৌরভ।
এখন আমি যেখানে থাকছি—সৌরভের কণ্ঠে আক্ষেপ, দেখেছেন তো, পানির ট্যাঙ্কির নিচে, ছোট একটা ঘরে, মানে অদ্ভুত। ওখানে ওঠার আগে পাকা সপ্তাহ ওই অতিথিশালায় ছিলাম জানেন? আমি জানি ওখানকার কষ্ট। পেপারওয়েট ঘোরানো থেমেছিল, আবার সচল হলো।আমি চলে আসার পর কিছুই আর বদলায়নি।বিছানাটা ছিল খুব উঁচু নিচু। মাঝে মাঝে তো মনে হতো আপনার দুটো চৌকি বুঝি জোড়া দেওয়া হয়েছে। কী, ঠিক না? আর সারারাত তো আছেই—মশার অত্যাচার। জানেন তো, নমরুদের মাথার ভেতর আল্লা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, চাইলে কী না পারেন। শুনেছেন না গল্পটা?
জি, জানা আছে।
খাবার ঘরটা আলাদা করতে বলেছি কয়েকবার, কোনো লাভ হয়নি। ঢাকা থেকে অনুমতি না এলে তো সম্ভব নয়। এ কারখানায় অনেক কিছুই দেখবেন সরকারি ধাঁচে চলে, মানে একটু ঢিমেতালে। একবার কিছু চালু হলে সহজে আর বদলায় না। চোখে কপট ভীতি ফুটিয়ে তুলে বলল, যাক বাবা, এসব আবার গোপন দাপ্তরিক ব্যাপার, দেখবেন আবার, আলাপে-সালাপে কাউকে বলবেন না যেন আমি এসব বলেছি!
সলিল সৌজন্যের হাসি হাসল।
সপ্রতিভ হাসির সঙ্গে হাত নেড়ে সৌরভ আগের কথাগুলো যেন উড়িয়ে দিতে চাইলো। তবে, সরকারি প্রতিানের মতোই এটা স্থায়ী, বলতে পারেন। দায় দায়িত্বের ভারও সরকারি প্রতিানের মতোই। এতোদিনে বোধয় টের পেয়ে গেছেন।
আর আরেকটা ব্যাপার। এটা সবচেয়ে ভয়াবহ। যারা একটু একা থাকতে চায়, তাদের জন্য বিশেষ করে। যখন তখন যে সে ঢুকে পড়ছে, খাচ্ছে, দাচ্ছে, আলাপ করছে, তাই না?
তা ঠিক। তবে বলতে কি, আমার আবার তেমন একটা সমস্যা হয়নি। আমি যৌথ পরিবারে মানুষ, তার ওপর জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি কোলাহলের শহরে। এরপরও আমার কিছুটা অস্বস্তিও যে আবার হয়নি, তাও নয়।
সৌরভ যেন শেষ বাক্যটা শোনার অপেক্ষাতেই ছিল, এমন সন্তোষের ভঙ্গিতে মাথা ওপরনিচ দুলিয়ে হাসতে হাসতে বলল সেটাই, সেটাই। তাহলেই বুঝুন। যাহোক, সুখবরটা দিয়েই দিই। তাহলো, আজ রাত থেকেই আপনি পল্লবের পাশের ঘরে উঠতে পারবেন। ব্যবস্থা পাকা। ঘরটা ভালো, দক্ষিণদিকে জানালা, আশপাশটা পরিচ্ছন্নও। কিন্তু একটাই সমস্যা। খুব চুরি হয়। বিশেষ করে বেতন হবার কটা দিন। সুতরাং ঘুমোনোর আর বেরোনোর সময় মনে করে জানালা ভালো করে আটকে—এরপর। যাক, আপনি নিজেই আবিষ্কার করতে পারবেন ওসব।
এরপর চেহারায় বেশ একটু গুরুভর এনে বলল, তারপর বলুন, আপনার কাছে তো আর জানাই হয়নি, প্রায় এক মাস হতে চলল। শক্তিমতি কেমন লাগছে, কেমন মানিয়ে নিতে পারছেন সবার সঙ্গে। আমাকে বন্ধুর মতো বলতে পারেন। কিছু কিছু ব্যাপারে কিন্তু বেশ ভালো রিপোর্ট পাই, হুম। কর্মীদের সঙ্গে আপনার আচরণ খুবই ভালো। ওরা আপনাকে পছন্দ করেছে। খোঁজখবরগুলো রাখতে হয়, কারণ একসঙ্গে কাজ করছি সবাই, সবার মতই তো জরুরি। বেশ বেশ। তো মানে, সব বুঝতে পারছেন তো? কেমন বোধ হচ্ছে বলুন—এইঞযবড়ৎু আরচৎধপঃরপধষ-এর পার্থক্যটা, হ্যাঁ? সবাই আপনাকে সাহায্য করছে তো? মেহেদি, পল্লব ওরা?
ভীষণ। কৃতজ্ঞ আমি সবার কাছে।
তা কেমন বোঝাচ্ছে মেহেদি? ওর সঙ্গেই তো বোধয় বেশি সময় কাটছে আপনার। যেন অবোধ বালককে এখনই কোনও সদুপদেশ দেবেন, মুখটায় এমন এক হতাশা মেশানো না-বোধক ভাব ফুটে উঠল। পরে আবার নিজেকে সংবরণ করে নিলেন মাথাটা এদিক-ওদিক একবার নেড়ে।চেহারায় পরিকল্পনার পরিবর্তনের ছাপ চোখে পড়ল। এমন সময় একটা ধূসর চড়–ই তার পেছনের খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে একবার চৌকাঠের ওপর বসল, অস্থিরভাবে বারকয়েক পাশবদল করে উড়ে গেল আবার।
শুনুনু সলিল, আপনার তো এখনও কাজের মধুচন্দ্রিমাকাল চলছে। বিয়ের পর ওই স্বামী স্ত্রী যায় না? বিয়ে করেছেন?
করেছি।
তো, ওরকম আরকি।ধরুন, কিছু বলা টলা হচ্ছে না, অনেক কিছুই নিজের মতো করছেন। এই মধুচাঁদ কেটে গেলে সে-রকম চাপ শুরু হবে। কোর তৈরি হচ্ছে খারাপ-না। পল্লবও তো আছে ওই সেকশনে তাই আপনাকে পুরো কৃতিত্ব দেওয়া যায় না সেভাবে, কী বলেন। এরইমধ্যে তো দায়িত্ব ভাগ হয়েছে। এরপর আলাদাভাবে কাজ চাওয়া হবে। সপ্তাহান্তে প্রতিবেদন দিতে হবে কাজের। নির্দিষ্ট পরিমাণ কাজ তুলে আনতে হবে। বুঝতে পেরেছেন? কঠিন কাজ। আরো মান নিয়ন্ত্রণে জসিমকেও একটু সাহায্য করতে হবে, কাজটা আপনাকেই দেবো ভাবছি। ততদিনে আপনাকে আরো একটু জেনে-বুঝে নিই। খুব সংবেদনশীল জায়গা ওই মান-নিয়ন্ত্রণ, বুঝলেন না? প্রতিান মানসম্মানও ওটাই নিয়ন্ত্রণ করে আরকি। আর শুনুন—খানিকটা সামনের দিকে ঝুঁকে এসে পাঁচ আঙুল তুলে অভয় দেওয়ার মতো ভঙ্গি করে বলল সৌরভ,শ্রমিকদের সঙ্গে আপনার ভালো সম্পর্ক, খুবই ভালো কথা। কিন্তু শ্রমিকদের চাপে রাখা শিখতে হবে। এখানে একটা ছেলে আগে কাজ করে গেছে, নাম করবো না। একদম নষ্ট করে দিয়ে গেছে পরিবেশ। শ্রমিকদের মন মানসিকতা—সব। বুঝলেন? তাদের চাপে রেখে কাজ বের করে আনতে হবে। ওরা আপনাকে হাইকোর্ট দেখাবে, বৃন্দাবন দেখাবে—সব দেখাবে, বুঝলেন না? দেখবেন, আশ্বাসও দেবেন, তবে আমাকে এসে বলতে হবে এরপর। আমার হাত হয়েই তো সব যাবে। কিছু বদলের দরকার হলেও আমিই তো দেখব। এসব মেহেদি ওরা জানে, আপনাকেই আলাদা করে বলা হয়নি আরকি।
সলিল হাত দুটো সামনে এনে বিনীত ভঙ্গিতে তখনো দাঁড়িয়ে আছে। সৌরভ তার আরামচেয়ারে মেরুদণ্ডসোজা করে বসল। এতোক্ষণ বেশ ভালো ভালো কথা বললাম, এবার একটু কঠিন কথা বলি। কারণ দর্শানোর নোটিস দিতে আমার বেশ লাগে। কিন্তু ওটা দেওয়ার আগে ন্যূনতম একটু সতর্ক করা তো লাগেই। সেটাই করে নিলাম। এরপর কারণ দর্শানোর নোটিস সরাসরি যাবে। ছমাস কাটার আগে তিনবার কারণ দর্শানোর নোটিস পেলে তৃতীয়টি কিন্তু একেবারে কারখানা ছাড়ার নোটিস বলেই গণ্য হবে। এটা আপনি জানতেন না, এখন জানলেন। এটা হেড অফিসের নিয়ম নয়, আমার নিজস্ব নিয়ম।আপনার ঐড়হবুসড়ড়হ চবৎরড়ফ শেষ হতে আর তিন দিন বাকি। এরপর কারখানার বাঁশিটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে—শপাং! বুঝতে পেরেছেন? এখন তো বোধয় বাঁশির শব্দে ঘুম ভাঙে আপনার। এটা কারখানার বাঁশি, ঘুম ভাঙার অ্যালার্ম নয়।
সৌরভ শান্ত স্বরে কথাগুলো বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে দক্ষিণ পাশের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে মেহগণির সাজানো বাগান, মাঠ দেখতে থাকল চুপ করে। সলিল দাঁড়িয়ে আছে তখনও। তার দিকে মুখ ফিরিয়ে সৌরভ বলল, সকালটাই কেমন করে দিলাম, না-পারতে করলাম ভাইটি। আমার এসব কথা ভুলে যান। নিয়মটা শুধু মনে রাখুন, আর কিছু না। ঠিকাছে, আসুন।
সলিল দরজার দিকে ফিরে দাঁড়াল। ধীর পায়ে এগিয়ে বন্ধ দরজাটা খুলে বাইরের সিঁড়িতে রাখল পা। নিজেকে সংবরণের দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় চোয়ার শক্ত হয়ে উঠেছে। হৃদপি-টা বুকের দেয়ালে ঘা মরছে সজোরে, সরোষে। খানিকটা টলে ওঠায় শক্ত করে চেপে ধরল রেলিং। ধাতব সিঁড়িতে হালকা শব্দ তুলে একসময় পা রাখল মাটিতে।
সিঁড়ি ধরে নামতেই কোর তৈরির বিশাল ঘর। পূর্বপাশে বিশাল ওই টানা দরজার খানিকটা খোলা। সে পথে বাতাসেরা আসছে। ভেতরের জানালাগুলো খোলা থাকায় ওদের খেলবার সুযোগ মিলেছে বেশ। বাতাসের সঙ্গে আসা ধুলোর চরিত্রগুলো লম্বা দণ্ডধরে নেমে আসা পাখার বাতাসের চাপে বুকে হেঁটে ঘরের কোণগুলোর দিকে চলেছে। কেউ কেউ জানালা টপকে বেরিয়ে পড়ছে বাইরে। সলিল খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকালো। পুবের সূর্য ওর মুখের একটি পাশ তখন আলো করে রাখল। বাতাসে সামনের দিকের চুলগুলো সরে গেল আরেক পাশে। তাতে কপালে ঘামাচির মতো ওঠা ফুসকুড়িগুলো বেরিয়ে পড়ল।ভেতরে কপারের পাত কাটার ধাতব ভারি শব্দ তো আছেই, সঙ্গে দরজার ফাঁক গলে হাসতে হাসতে ঢুকে পড়ছে দূরের লোহা কাটার চাকা ঘোরার শব্দ,দরজার বাইরে দক্ষিণ দিকে কাচে ঘেরা টেস্টিং রুমের খোলা দরজা দিয়ে বিদ্যুৎ স্ফূলিঙ্গের চিট-চিট শব্দ আসছে থেকে থেকেই।তার সামনের খোলা একচিলতে জায়গায়ধাতব পাতের ওপর পড়তে থাকলো রূপালি রঙের পরত অবিরত হিস-হিস শব্দে। রঙমানুষটির চুল বাঁধার পট্টি আর নাক বাঁধার রুমালের ওপর উড়ে উড়ে এসে পড়তে থাকল রূপালি রঙের গুঁড়া। পট্টি, রুমাল দুটোই ক্রমে রুপালি হয়ে যেতে থাকল।
সলিল দরজা টেনে বেরিয়ে গেলে ডেস্কের ওপর আরও বেশ কিছুক্ষণ ভারী পেপারওয়েটটা উল্টো করে ঘোরালো সৌরভ। একেকবার ঘুরিয়ে ছেড়ে দিলে ঘুরতে ঘুরতে একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করে হাঁটছে ওটা। কাচের ওপর তার ঘূর্ণায়মান কাঠামোর বিম্ব পড়েছে তখন। তিন আঙুলে ওটাকে ধরে আবার ঠিক করে রাখছে সৌরভ, একটুপর আবারও ঘূর্ণি। ড্রয়ার খুলে একতাড়া ফরমের ভেতর থেকে একটা বের করল তার বিভ্রান্ত হাতজোড়া। কাগজগুলো টেবিলের ওপর সশব্দে জায়গা করে নিলো। একটি কাগজ টেনে নিয়ে কলমের খাপ খুলে তিন দিনের ছুটির আবেদন ঘর পূরণ করল সৌরভ। চোখে মুখে একটা থমথমে ভাব তার, আঙুলে অনাবশ্যক জোর।ফরম পূরণ শেষ করতে না-করতেই হঠাৎ কাগজটা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল কোণের ঝুড়িতে। সকালে রবি ঝুড়ি খালি করে নিয়ে যাওয়ার পর ওটাই ছিল প্রথম বাতিল কাগজ। ঝুড়ির বৃত্তাকার বেড়ায় মাথা ঠুকে ঠুকে শেষমেষ তলায় স্থির হলোওটা।বাঁ পাশে রাখা টেলিফোনটা এসময় বেজে উঠল সশব্দে। রিসিভারটা তুলে কানে ঠেকাতে গিয়ে টেলিফোনের সর্পিল তারের সঙ্গে ছবির ফ্রেমটা লেগে কাত হয়ে পড়ার জোগাড় হলো। বাঁ কানে রিসিভারটা ঠেকানোর ফাঁকেই ডান হাতে ওটাকে ধরল সৌরভ।
ওপাশ থেকে কারও যান্ত্রিক স্বর কাঠ কাঠ স্বরে বলে উঠল,সৌরভ, জহির বলছি। কারখানার সব ভালো তো?
সৌরভ শান্ত কণ্ঠে, কিছুটা আনুগত্য ঢেলে বলল, তা ভালো, স্যার।
কাল সৈকত আসছে এক বড় ক্লায়েন্ট নিয়ে—চারুর চেয়ারম্যান। তার অর্ডারটার কী খবর?
জি ভালো। শুধু ওই টেস্টিংটা শেষ হতে বাকি আছে, তবে কাজ চলছে। এরপর হঠাৎ জিভে জড়িয়ে যেতে থাকল কথা।এছাড়া আর সব বলতে গেলে, বলতে গেলে না, মানে আদতেই, ঠিক আছে, খুব ঠিক আছে।
বেশ, তাহলে আজকের মধ্যেই সব সেরে ফেলুন। কাল ওদের সামনে আবার যেন কিছু করতে না হয়। আপনাদের ওপর—, এরপর বেশ খানিকটা বিরতি দিয়ে,আপনার ওপর—এই আস্থা আমাদের আছে। নির্বাহী পরিচালকের কথার মধ্যখানে ওই বিরতিটায় খেদ তাড়িয়ে ভদ্রতার জোর খাটিয়ে বলার অংশটুকু ধরে ফেলায় সৌরভের চেহারার থমথমে ভাবটা বাড়ল।
নির্বাহী বলে গেল—আর, কারখানা ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখতে বলুন। এটা হলে, এটা ঠিক ঠাক ভাবে হলে, এরপর আরও কিছু কাজ আমরা পাব। আমি কি আপনাকে বোঝাতে পেরেছি সৌরভ?
জি স্যার, নিশ্চয়ই। আপনি চিন্তা করবেন না। সব ঠিক থাকবে। শেষের দিকের কথাগুলোর কারখানার পেছনের সীমানার বাইরে থেকে আসা শোরগোলে ঢাকা পড়ে যাওয়ার জোগাড় হলো। নির্বাহী পরিচালক আরো একটা কিছু বলে ফোনটা রেখে দিলো, শোরের দিকে মন চলে যাওয়ায় শেষ কথাটি না শুনতে পেরে ভুরুজোড়ায় অসন্তোষ ফুটল সৌরভের।
চেয়ার ছেড়ে পশ্চিমের জানালাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সৌরভ। কারখানার পেছনে খানিকটা দূরত্বে কয়েকঘর কৃষকের বাস। শোরগোলটা সেখানেই। দেখা গেল, কতগুলো লোক গোল হয়ে চেয়ার নিয়ে বসেছে আর তাদের দুপাশে তৈরি হয়ে গেছে দুটি দল। চলছে সমানে কটুকাটব্য, রগফোলানোর চিৎকার। কেউ কারো কথা শুনছে না। ওকে থামিয়ে সে বলছে, তাকে থামিয়ে এ। হঠাৎ চক্রটির এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লুঙি-স্যান্ডো পরা স্বাস্থ্যবান এক তরুণ হনহনিয়ে চলে গেল ঘরের ভেতর। মুহূর্তের জন্যে চিৎকারটা থামলো—বুঝি ভয়ানক একটা কিছুর জন্যে অপেক্ষা শুরু হলো সবার।পরমুহূর্তে ছেলেটি দোর দেওয়ার কালো বড় এক কাঠ নিয়ে সরোষে বেরিয়ে এলো। ভয়ানক ক্ষেপে উঠল সভার সবাই।শুরু হলোঠেলপাকড়, চিৎকার, নারী কণ্ঠের মাতম। কাঠ নিয়ে বেরিয়ে আসা ছেলেটার মুখচোখ হিংস্র হয়ে উঠছে। সৌরভ অবাক হয়ে দেখল, ছেলেটি ঝটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে চক্রের অপর পাশের এক প্রৌঢ়ের মাথা বরাবর কাঠটা নির্দ্বিধায় সজোরে দিলো বসিয়ে। কাঠটা মাথা বরাবর বসবার ঠিক সেই মুহূর্তে—হিঁৎ! বলে এক জান্তব শব্দ উঠল। চেয়ার থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ধরে ছটফট করতে থাকল বৃদ্ধ।
সৌরভ জানালার শিক ধরে টাল সামলে বিস্ফারিত চোখে দাঁড়িয়ে থাকল। শক্তিমান একজোড়া বাহু যেন তার মুখটিকে দৃশ্যের দিকে ধরে রেখেছে।
প্রচণ্ড শক্তির একটা শেল বুঝি বিস্ফারিত হয়েছে, এমনভাবে চক্রের ভেতর বসা মানুষগুলো ছিটকে যে যেদিকে পারলো দৌড়ে পালাতে লাগল। এরপর দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে গেল চোখের পলকে।ওই প্রৌঢ়ের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল আরেক জোয়ান। এর বয়েস আগেরজনের তুলনায় কম। স্যান্ডো গেঞ্জির হাতার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে তার সরু শ্যামল বাহু। দাঁতে দাঁত চেপে জান্তব শব্দ করে হঠাৎ মাটির দিকে ঝুঁকল। পায়ের কাছেই মাটিতে গাঁথা ছিল একটা ধারালো কাস্তে, যে হাতল বসানো একফালি ঈদের রুপালি চাঁদ। মুহূর্তে তুলে নিয়ে উড়ে গিয়ে সপাটে চালালো কাঠের দ-ধারী ছেলেটির কণ্ঠনালী লক্ষ করে। সৌরভ তার স্রষ্টার নাম করে চোখ দুটি বন্ধ করল,পরবর্তী দৃশ্য সে দেখতে চায় না। বাইরে সময়ের দেয়াল ভেঙে গেছে। প্রস্তর যুগের পাশবিক হাহাকার বাতাসের কণায় কণায় তুলেছে অণুরণন। সৌরভ চোখ যখন খুলল, দেখতে পেয়ে আশ্বস্ত হলো, দ-ধারীর গলাটি কাটা পড়েনি। সবুজ ঘাসের ওপর সে কুঁকড়ে পড়ে আছে। এক হাত দিয়ে আরেক হাতের কব্জি চেপে রেখেছে। মুখটা যন্ত্রণায় বিকৃত। চেপে রাখা হাতটা সরালেই ফোয়ারার মতো রক্ত ছিটকে গিয়ে ভিজিয়ে লাল করে তুলছে সবুজ ঘাস। রুপালি নাকফুল পরা খালি গায়ের একটি ছোট মেয়ে শুধু পা টিপে টিপে এগোচ্ছে তার দিকে, আর কেউ নেই। ওদিকে বৃদ্ধ লোকটিকে পাঁজাকোলা করে ভেতরে নেওয়ার উদ্যোড় করছে বাকিরা। লা-পাত্তাকাস্তেধারী।
সৌরভ এসময় জানালা শিকটা ছেড়ে ধীরে ধীরেঘুরে দাঁড়িয়ে শিক আর দেয়ালে পিঠ ঘষটে মেঝেতে বসে পড়ল। দু হাতে কিছুক্ষণ মাথাটা চেপে ধরে দ্রুত উঠে দাঁড়াল হঠাৎ। দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে এলো। আরো একবার যেতে ধরে ফিরে এলো আবার। ঝুঁকে টেবিলের একপাশে থেকে সবুজ কাচের বোতল তুলে ঢকাঢক শব্দে নিঃশেষ করতে শুরু করল জল। ঠোঁট গড়িয়ে পড়া জলে বুকের কাছে ভিজে লেপ্টে গেল পরনের শার্ট।
বাইরে, অতিথিশালার স্নানঘর থেকে ফেরার পথে পিএফআইএ ঢোকার মুহূর্তে কোর বিভাগে তাকিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে সলিলকে দেখতে পেল তারেক। ভেতরে ঢুকে দুই ভক্তের সঙ্গে আলাপ এ-পথ ও-পথ গড়িয়ে সেদিনের স্মৃতিতে চলে এলো সটান। আর তারেক তড়িৎ বিশ্লেষণের রহস্যটাওউন্মোচন করলো ওদের কাছে। সঙ্গে সে আলাপের সূত্রটি ধরে এলো সেদিনের নীরব দর্শকটির কথাও।
তারেক বলল, শোন পান্না, আর মি. জন। যা তোমরা ভেবেছিলে মোটেও তা নয়। আমি তো চারদিকে নজর করা বহু আগেই বাদ দিয়েছি। তবু বহুদিন পর, সে লক্ষ করে দেখেছে, সলিল যখন শ্রমিকদের তদারকিতে থাকে, তখন নিজেকে ওদের সামনে জোর করে জাহির করার কোনও প্রবণতা থাকে না তার ভেতর। বরং এক ধরনের সহানুভব মমতামাখা চোখে তাকিয়ে থাকে, তা-ও আবার কাজের দিকে নয়। শ্রমিকদের পেশির সঞ্চালনের দিকে, ঘামে বারবার ভারি হয়ে আসা চোখের পাতার দিকে। আর যন্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধে থেকে থেকে যখন ওদের মুখ বিকৃত হয়ে যায়, সেই বিকৃত মুখটার দিকে। তারেক আরো দেখেছে, লোহা কাটার এক জ্বরগ্রস্ত শ্রমিকের মুখের বিকৃতি দেখে সলিল তার হাত থেকে কাজটা কেড়ে নিতে উদ্যত হয়েছিল।সামান্য ব্যাপার তো নয়! এসবের জন্য শ্রমিকদের কাছ থেকে যে খুব সম্মান বা সম্ভ্রম সে পাচ্ছে, তা নয়কিন্তু। বরং শ্রমিকদের বেশিরভাগ আগের মতোই নির্লিপ্ত, কেউ কেউ আবার বিরক্তও। তবে ছোট হলেও, একটি অংশ আবার তার প্রতি বেশ শ্রদ্ধাশীল। এই শ্রদ্ধাশীলদের মধ্যে কারখানার অতিদক্ষ তেমন কেউ নেই বলতে গেলে। যাহোক। এসব ছাপিয়ে কোন ব্যাপারটি তারেকের কাছে আরেকটি ব্যাপার ভীষণ মূল্যবান হয়ে ধরা দিয়েছে। সেটি হলো—তার ছোট ভাই সমীরের সঙ্গে সলিলের বড় ভাই-বন্ধুসুলভ অভূতপূর্ব আচরণ। সেদিন তো সমীরের বলটা হারিয়ে গেল। খেলেছে তো সবাই, ওই খবরটা কজন রেখেছে? সমীরের মনের অবস্থা কেউ তো ভাবেনি! এমননি তারেক যে বড় ভাইটি, সে-ও কিছু জানতে পারেনি তখন। তো—বলটা হারিয়ে গেল। তুচ্ছ ব্যাপার। একটা বল, কতই বা তার মূল্য। কিন্তু বলেরমূল্যের চেয়েও যা বড়—তা হলো একটা কিশোরের অমূল্য হৃদয়। সেই হৃদয়ের মোচড়টা সলিল বুঝেছিল। যে বলটা সমীরের হারিয়েছিল তারচেয়েও অনেক ভালো একটা বল সলিল তাকে উপহার দিয়েছে। পৃথিবীতে তিনটি প্রাণি ছাড়া আর কেউ জানে না সে কথা। বলটা এতোই ভালো আর দামি যে সমীর এখন ওটা শুধু দেখার জন্য রেখে দিয়েছে, ঘুমোনোর আগে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেই ওটা শুধু, খেলা আর হয় না। এমনই ছেলেমানুষ।
কী বুঝলে? দুজনের দিকে কপট রাগে চোখ পাকাল তারেক। এরপর দরজার দিকে তাকিয়ে আনমনে একটা রেঞ্চ ঘোরাতে ঘোরাতে বলে চলল, তবে তোমাদের মনোভাবটা আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না পান্না, জন। তোমরা যেখান থেকে উঠে এসেছ, আমিও তো উঠেছি সেখান থেকেই। আমার মনের ভাবটাও যে কেমন ছিল, তা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে। আমি দেখেছি।
তারেক দেখেছে, এই বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারগুলোর বাহ্যজ্ঞান যতোটা, তার চেয়েও বহুগুণে পেশল তাদের অহম। সে এক ধরনের মুক্তমন নিয়ে প্রথমে বিষয়টার সুরাহা করতে চায়নি তারেক, এমন নয়। কিন্তু তাতে দেখা গেছে, তাকে এমন বিব্রতকর আর অসম্মানজনক পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে যে ওই ভাবনা থেকে সরে আসা ছাড়া আর কোনও উপায় খুঁজে পায়নি। ধৈর্যের অভাব কখনোই তারেকের ছিল না, কিন্তু তারও তো একটা সীমা আছে। আর বিকৃতি কি শুধু এক দিক থেকেই? প্রভাব খাটানোর নোংরা লড়াই তো বহুদিক থেকে আসে। মানুষের প্রকৃতিই এই—দল পাকানো আর দল বদল। প্রভাব তো দলাদলির উৎপাদ, আর দলবদলে কুশীলব বদলায়। এর ভালো উদাহরণ হতে পারে জসিম। ওইতিক্ত প্রসঙ্গ ঘাঁটতে অরুচি হয়। তবু দলবদলের প্রসঙ্গ উঠলে না-বলে উপায় কি।
এই কারখানায় বিএসসি আর ডিপ্লোমাদের মধ্যে অহমের লড়াই মোটেও বড় ছিল না। কারণ সৌরভের আগে যিনি কারখানার প্রধান ছিলেন, তিনি নিজেও ছিলেন ডিপ্লোমা এঞ্জিনিয়ার। যার-যার যোগ্যতার সম্মান তাকে-তাকে তিনি দিতে পারতেন। বাইরে সবাই হাতিঘোড়া যা-ই হোক, কারখানার ফটকের ভেতরে ঢুকলে সবাই পিঁপড়ে। ভীতু পিঁপড়ে নয়, কর্মী পিঁপড়ে। সুশৃঙ্খল। শীতল লড়াইয়ের পেছনে দায়ী ওই জসিম। কারখানায় তখন আগের প্রধান গেছে, নতুন প্রধান এসেছে; আজ যিনি ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। এই জসিম সেদিনওছিলডিপ্লোমা এঞ্জিনিয়ারের দলে। না-মেনে উপায় নেই,তার একটা বড় গুণ ছিল। পড়াশোনার ইচ্ছোটাকে সে হত্যা করেনি। টাকায় মন মজায়নি। টাকা জমিয়ে সে পড়েছে। এমন খুব কমই দেখা যায়।এ জন্যে অবশ্যই তাকে কৃতিত্ব দিতেই হবে। তখন ঢাকায় নতুন নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রমরমা। সপ্তাহান্তে মাসান্তে গিয়ে জসিম পরীক্ষায় বসতো। এভাবেইডিপ্লোমার গণ্ডি ডিঙিয়ে বিএসসির বলয়ে প্রবেশাধিকার পেলো, আর অমনি ওর দগ বেড়ে গেল। মনের ধ্যান না করে ধনের ধ্যান করলে মানুষ যেমন হয়। যেহেতু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে প্রচুর—সে হয়ে উঠলবিএসসির চেয়েও বড় বিএসসি। ওদেরও বেড়ে অহমধারী। ডিপ্লোমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্যেতার মতো আগ্রহ আর কার ছিল তো মনে করা যায় না। সবচেয়ে যা করুণ, তা হলো তার ভেতর ক্ষমতা চর্চাকারীর স্পষ্টলক্ষণ দৃশ্যমান হতে থাকা, ক্রমশ। মোসাহেবি থেকে অধীনস্তে চোটপাট। আর বর্তমানটাও তার খুব বেশি অন্যরকম নয়। ভবিষ্যতে কাকে সে পাশে পাওয়ার আশা করে?
বলার মতো উঠল মেহেদির কথাও। সলিলকে মেহেদির সঙ্গে চলতে খুব দেখছে। মেহেদিকেও তারেকের খুব একটা পছন্দ হয় না। লোকটা নিজের লৌকিক মর্যাদার স্তর মেনে চলে কিনা—মেশামেশির ব্যাপারে সচেতন। জাতপাত মানে। নিজেবে উঁচুজাত বলে জানে।
শুধু ওই একটি জায়গাই আছে, বহুদিন পর একটা ব্যতিক্রম ঘটে গেল। ব্যক্তিমনের খোলা দুয়ার ধরে সবার ঘরেই তার সমান প্রবেশ, সন্দেহ নেই। তারেক নাহয় তারটুকুই বলল! বাবা নেই, মা নেই, দুটি ভাই কারখানার কর্মী। একসঙ্গে বেড়ে উঠছে। মমতা দিয়ে ঘিরে রাখার ক্ষেত্রে একজনের নির্ভরশীলতা কেবল আরেকজনের ওপরই, চেনা জগতের কাছে-পিঠে আর কেউ তো নেই। এ অবস্থায় একজন বাইরের মানুষ তাদের হৃদয়ে প্রবেশ করল একেবারেই তুচ্ছ একটি উপায় ধরে। খুব বড় একটি সম্পদ হয়ে।
জানি না কতটা কী তোমাদের বোঝাতে পারলাম। তবে তাকে আর সবার মতো দেখো না, আমার কথাটা এই। কাছে না-যাও, অবজ্ঞা করো না। সেদিন তো তোমরা একরকম প্রস্তুতি নিয়েই খেতে ঢুকেছিলে। অস্বীকার করব না, তোমাদের কথাবার্তা আমাকেও মজিয়েছিল। তাই দোষটা তোমাদেরকে দিচ্ছি না, আমার দোষ আমারই। যাহোক, সব বাদ। শেষকথা—সম্ভব হয় তো কাছে যেও। আর আমাকেও একটু রেহাই দিও। হটো হটো।
পান্না, জন হাসতে হাসতে যার যার কাজে ফিরে গেল।
কারখানা ছুটি হওয়ার পর, পোশাক বদলে সলিলকে একা বেরোতে দেখে কাজ থামাল তারেক।মুখে দ্বিধাবিভক্তির ছাপ। ফের মন ঠিক করে ঢলে পড়া হাতাটা ভালো করে গুটিয়ে নিয়ে হাত দিলো কাজে। পায়ে ভর বদল করে ঘরে জ্বলতে থাকা টিউববাতিটির দিকে তাকাতেই হলো। ওটাকে ঘিরে উড়তে থাকা কালো পতঙ্গগুলোর আধমরা দেহ থেকে-থেকেই পড়ছে ঘর্মাক্ত বাহুর ওপর। থেকে থেেেক চোখের পাতায়, মাথার তালুতে। সবদিনই এমনটা হয় এবং তারেক থাকে নির্বিকার। আজ মুখে ক্ষণে ক্ষণে জায়গা করে নিতে থাকা সিদ্ধান্তহীনতার ছাপের পাশাপাশি,পতঙ্গগুলোর ওপর ক্ষোভসূচক বাক্যও বারবার উঠে আসতে থাকল। আজ সে কেমন বিকারগ্রস্ত। জোর করে বাধ সাধতে গিয়ে একটা কোনো ইচ্ছে যেন থেকে থেকে ছলকে উঠছে—তার অস্থির পা নাড়ায়, অনির্দিষ্ট স্থানে ঘনঘন দৃষ্টিবদলে তারই স্পষ্ট ছাপ।
ওদিকে কারখানা থেকে বেরিয়ে সলিলের এলো পেছন দিকের মাঠে। পূর্বমুখী ফটকটা গলে ডানে এলে পূর্ব-পশ্চিম বিস্তৃত মেহগণি বাগান।বাগানটা পেরিয়ে আরও পশ্চিমে গেলে আলে ঘেরা একের পর এক ফাঁকা জমির দেখা মেলে। সেখানে কাস্তের কোপে ধানগাছ গোড়া থেকে হাওয়া। নাড়াগুলো ন্যাড়া মাথা তুলেছে। খেলা করতে থাকা ছেলেমেয়েদেরা দৌড়ঝাঁপে পদে পদে বাধা পেতে থাকল। তবু বেপরোয়া। ওদের হাসির শব্দে পাখির কুজনও ঢাকা পড়বার জোগাড়। নাড়াগুলোর বেশিরভাগ মাথা তুলে থাকলেও কিছু কিছু ভড়কে গেছে। ছেলেমেয়েদের কৃতিত্বের চিহ্ন ওসব।
আরো এগোতে দেখা গেল, এমনই এক জমির মধ্যখানে নাড়া তুলে দরমুজপেটা করে আয়তাকার এক টুকরো জমিকে সমতল করা হয়েছে। বেশিক্ষণ আগের কথা নয়। পাশবিক শ্রমের পর ন্যায্য বিশ্রামে কাত হয়ে পড়ে আছে বেকার দরমুজ; সিমেণ্ট পোরা গুঁড়ো দুধের টিন থেকে বেরিয়ে থাকা ফুট চারেকের একটা বাঁশদ-। কাঠ কাটা ব্যাট আর টেপ প্যাঁচানো বলে মাঠে চলছে গ্রামীন ছেলেদের জমাট ক্রিকেট ম্যাচ—উল্লাসে ঝগড়ায়, আগমনে বিদায়ে, চারে ছক্কায়। ওদের খেলার সীমানা থেকে একটু দূরে একটা আলে ওপর বসে ওদের গতি ও মতি লক্ষ করতে থাকল সলিল। মাঝে মাঝে আপনাতেই হাসি ফুটে উঠতে থাকল ওর ঠোঁটে, থেকে থেকে আপনাতেই উদ্বেগ।আবার ক্ষণে ক্ষণে আনমনা হয়ে পড়ছিল সলিল। খেলা ওর মাথা থেকে বিদায় নিচ্ছিল পুরোপুরি। হঠাৎ শোরগোলে ফিরে আসছিল আবার।
নতুন অচেনা একটি লোককে দেখে বোলার বা ব্যাটসম্যানের আদেখলেপনাও বেশ বেড়ে উঠেছিল। থেকে থেকে ভুল ইংরেজিতে চিৎকার করে উঠে ওরা আড়চোখে তাকাচ্ছিল সলিলের দিকে।
মাঠের অপর পাশ থেকে আরেকজন মানুষ নাড়া মাড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছিল খেলাটার দিকে। পরনে আঁটো শহুরে পোশাক। হাতে মহামূল্য ক্যামেরা, দীর্ঘ লেন্সে পরিচয়। সূর্য ডোবার একটু আগের মুহূর্ত এখন, চারদিকে সোনারঙ আলো ঝরছে, ঝরেই চলেছে। ছবি তোলার মাহেন্দ্রক্ষণ। ছেলেটা ক্যামেরা তাক করতে থাকল কখনও খুদে খেলোয়াড়দের দিকে, কখনও মেহগণি বনের দিকে, দিগন্তে দুএকবার আর একটিবার সলিলের দিকে তাক করলো। একটু পর আরও হেলে পড়ায় পশ্চিমে গ্রামের মুখটা দেখালো অন্ধকার। অন্ধকার আড়াল করে ফেলছে গাছটা, ঘরটা। সেখান থেকে অনির্দিষ্ট বিরতি পর-পর করুণ নারী কণ্ঠের বিলাপধ্বনি ছুটে আসছে। বাতাস যতোটা পারছে শুষে নিতে চাইছে সে ধ্বনি। মলিন দীর্ঘ ফতুয়া পরা এক বৃদ্ধ ওই বাড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে সলিলকে অতিক্রম করবার সময় ওকে স্বাক্ষী মানলো—বিষয়ের বিষ বাবা, বিষয়ের বিষ!
আরো বেশ কিছুক্ষণ ঠনঠনিয়েহঠাৎ উঠে পড়ে গোছগাছ শুরু করে দিলো তারেক, দ্রুত হাতে। যন্ত্রপাতিগুলো নির্দিষ্ট বাকশে তুলে রেখে সাদা ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের কল ছেড়ে হাতা সামলে চোখে মুখে আর নাকে পানি ছিটিয়ে নিলো। দীর্ঘক্ষণ হাঁটু ভাঁজ করে কাজ করায় এক পায়ে আক্ষেপ জন্মেছে বলেতাকে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে। ফটকের বদলি দারোয়ান ব্যাপারটা লক্ষ করল, কিন্তু কিছু বলল না। হাস্যমুখে সম্ভাষণ বিনিময় হলো শুধু দুজনের। কারখানার বাইরে বেরিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া পেয়ে মন একটা সিগারেট ধরাতে উসকানি দেওয়ায় পকেটে হাত রাখল তারেক। একটা সিগারেট ঠোঁটে গুজে হাতে আগুন আড়াল করে সিগারেটের মুখাগ্নি করে আগে বাড়ল। পায়ের আক্ষেপ ততক্ষণে অনেকটাই কমে আসায় হাঁটায় এসেছে গতি। কিছুটা পথ এগিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট প্যাকেটটা বের করে শার্টের বুকপকেটে রাখল তারেক। লক্ষ করল, বুকপকেটের আধস্বচ্ছ কাপড়ের ভেতর দিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা দেখা যাচ্ছে—এ সময়ে সবচেয়ে দামি ব্রান্ডের প্যাকেট। আগ বাড়ল পশ্চিমের পথে, গাছপালার ঝাড়ে। দূরে ছেলেপিলেরা খেলছে যেখানে, সেখানে আলের ওপর তার আরাধ্য লোকটা একা বসে আছে।
ক্রমে আলো কমে যাওয়ায় ক্রিকেটে ইস্তফা পড়েছে। শুরু হয়েছে নতুন খেলা। সলিল নাম জানে না এর। একটা বৃত্ত করা হয়েছে, যে বৃত্তের ভেতর আছে এক দল কিশোর। বাকি দলের সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাঠময়, সতর্ক চোখ বৃত্তবন্দীদের ওপর আটক। এমন সময় বৃত্ত ছেড়ে একজন বেরিয়ে পড়ল। দম আটকে শুরু করল বেঁধে দেওয়া সীমানা ধরে দৌড়। এক দৌড়ে বুঝি মহাবিশ্ব থেকে ছিটকে পড়বে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিশোরদের মধ্যে দুজন চঞ্চল হয়ে উঠল। আলোকচিত্রী মাঠের একপাশ থেকে ছুটন্ত কিশোরদের দিকে ক্যামেরা তাক করে শাঁট-শাঁট ছবি তুলে যাচ্ছিল একেরপর এক। একটি ছবিতে মাঠের অপর পাশে বসে থাকা তরুণটি এলো। ছবিতে এবার সে আর একা নয়। আরো এক তরুণ এসে তার পেছনে দাঁড়িয়েছে। বসে থাকা তরুণ অবশ্য তখনো সচেতন নয় এ ব্যাপারে।
শব্দ পেয়ে পাশে তাকিয়ে সলিল দেখলো, গোড়ালির ফাঁকে জুতোর ফিতে গোঁজা চেনা একজোড়া পা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আকাশি রঙা জিন্সের প্যান্ট, হাঁটুর কাছে তার সুতা উঠে গিয়ে নরম হয়ে এসেছে, ছিঁড়ে যেতে দেরি নেই। দেহের ভর এক পা থেকে আরেক পায়ে বদলের চেনা ভঙ্গিটাও যখন এলো, চিবুক উঁচিয়ে মুখের দিকে তাকাল সলিল। কারখানার সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পরও লক্ষ্যের কাজটুকু বাগে আনা ছাড়া বেরোয় না যে বান্দা, স্বয়ং সে এসে দাঁড়িয়ে। ভরসন্ধ্যায় একটা বরফগলা সম্ভাষণের হাসি সলিলের কালো মুখে আলো জ্বেলে দিলো।
চলবে…