পর্ব-৬
কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ: গ্রহণ-বর্জনের রাজনীতি
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে নানা আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। তার সাহিত্য ‘বাজারি সাহিত্য’। ‘পপকর্ণ খেতে খেতে একবসাতেই শেষ হয়ে যায়’। ‘বিষয় ও ভাষার গভীরতা কম’। জীবদ্দশাতে তিনি এরকম আরও অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। যদিও হুমায়ূন এসব কট্টর সমালোচকদের মন্তব্যে খুব বেশি মনোযোগ কখনোই দেননি। লিখে গেছেন দেদারচে। তাকে ঘিরে যত বিরোধিতাই থাকুক, শরৎচন্দ্রের পরে এমন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আর এসেছেন কি না, সন্দেহ করি। হুমায়ূন আহমেদ ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্নের জবাবে বলেছেন:
যুগান্তর: বলা হয়ে থাকে, আপনার লেখালেখি বাংলাদেশের সাহিত্যকে একটা মানে উন্নীত করেছে। আপনি বাংলাদেশের মানুষকে সস্তা দরের চতুর্থ শ্রেণীর লেখকদের লেখা পড়া থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আপনার মত দিন।
হুমায়ূন আহমেদ: আমি লেখালেখি করি সম্পূর্ণ আমার নিজের আনন্দের জন্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনি লেখালেখি করেন কেন? তিনি বলেছিলেন, আমার হাতে একটা চুলকানি আছে। লিখলে সেটা একটু কম হয়। সে রকম একটা বিষয় আমার জন্যও সত্য। আমি সম্পূর্ণ নিজের ব্যক্তিগত আনন্দের জন্য লেখালেখি করি। তোমরা পাঠকরা সেই আনন্দে ভাগ বসাও। এটাই হচ্ছে আসল কথা। আমি পাঠকদের জন্য লিখতেছি, পাঠকরা পড়ে খুব আনন্দ পাচ্ছেন, তা না কিন্তু। আমি যখন লেখালেখি করি, তখন দূর থেকে বিষয়টা যদি তোমরা দেখ তাহলে বুঝতে পারবে এই লোকটি নিজের আনন্দেই লেখালেখি করছে। অনবরত চোখ দিয়ে পানি পড়ছে আমার। চোখ মুছতেছি, লিখতেছি; চোখ মুছতেছি, লিখতেছি। যখন খুবই দুঃখের কথা লিখছি, তখনো চোখে পানি আসছে; যখন খুবই আনন্দের কথা লিখছি, তখনো চোখভর্তি পানি। এই পানিটার উৎস হচ্ছে লেখার আনন্দ। (সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মীর রাকিব-উন-নবী, ১২ মে, ২০১২)
এখন তাকে নিয়ে এমফিল-পিএইচডি গবেষণা হচ্ছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, জীবদ্দশায় গুণীজনের কদর করতে জানি না। এদেশে মরার আগে খুব অল্প মানুষের ভাগ্যে সমাদর জোটে।
হুমায়ূন আহমেদ তথাকথিত সাহিত্যিক হতে চাননি। যারা সবসময় সাহিত্যকে শৈল্পিক হয়েছে কি না, তা মাপার জন্য বাটখারা কিংবা ফিতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন। হুমায়ূন আহমেদ সব শ্রেণীর পাঠকের লেখক। খাটো করার জন্য বলছি না, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ কিংবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সবশ্রেণীর পাঠকের লেখক হতে পেরেছেন কী? পারেননি। যদিও তাদের অবস্থান সাহিত্যানুরাগীদের কাছে স্বতন্ত্র। হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের সংখ্যাধিক্য দেখে অনেকেই ঠাট্টা করেছেন। তাতেও তিনি দমে যাননি। নিজের মতো থেকে যাপন করেছেন সাহিত্যজীবন। আদতে তিনি সাহিত্যে পেতে চেয়েছেন আত্মার আনন্দ। সিরিয়াস কোনো বিষয়কে সহজ সাবলীল এবং চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিতে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে রয়েছে তার জাদুকরী কৌশল। বাংলা সাহিত্যে যখন ‘বইয়ের পাঠক’ কমে যাচ্ছে বলে বুদ্ধিজীবীরা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন। তখন হুমায়ূন আহমেদ একমাত্র লেখক, যিনি মানুষকে বইমুখী করেছেন। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের পাঠক তৈরিতে তিনি অবিশ্বাস্যরকম ভূমিকা রেখেছেন।
আশার কথা হচ্ছে, যারা হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্য নিয়ে এতদিন নাক-সিঁটকাতেন, তারা এখন হুমায়ূন-বন্দনায় মেতেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ তার সৃষ্ট গল্প-উপন্যাস নিয়ে প্রবন্ধ লিখে নিজেদের পদোন্নতির পথকে ত্বরান্বিত করছেন। এখন তাকে নিয়ে এমফিল-পিএইচডি গবেষণা হচ্ছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, জীবদ্দশায় গুণীজনের কদর করতে জানি না। এদেশে মরার আগে খুব অল্প মানুষের ভাগ্যে সমাদর জোটে।
‘কোথাও কেউ নেই’ নাটক দেখার পর
একথা বলাই বাহুল্য যে, ‘কোথাও কেউ নেই’ হুমায়ূন আহমেদের কালজয়ী সৃষ্টি। এযাবৎ এই নাটক নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। ১৯৯২-৯৩ সালে এই নাটক বিটিভিতে প্রদর্শিত হয়েছিল। নাটকের আলোচিত চরিত্র ‘বাকের ভাই’ মহল্লার মাস্তান চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সাধারণত পাড়ার গুণ্ডা কিংবা মাস্তান টাইপের মানুষের প্রতি আমাদের মনে একধরনের অবজ্ঞা কিংবা ঘৃণাবোধ আভাসিত হয়।
নাটকের শেষাংশে বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ হওয়ায় আমার মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। চোখের কোণে জল জমে। কিন্তু কেন এই অশ্রুপাত? যারা ইতোমধ্যে নাটকটি দেখেছেন নিশ্চয় এর কারণ খুঁজেছেন।
আমাদের পাড়ামহল্লায় বাকের ভাইয়ের মতো এমন গুণ্ডা-মাস্তান চরিত্রের দেখা পাওয়া এখনো দুর্লভ নয়। যারা কেবলই ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়’। যারা সারাদিন অন্যের বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ব্যতিব্যস্ত থাকে। আমরা যাদেরকে অভিভাবকের অবাধ্য গোঁয়ার সন্তান হিসেবে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। অথচ ভীষণ দুর্দিনে এই বখে যাওয়া গুণ্ডা-মাস্তানের দ্বারস্থ হই। তথাকথিত শিক্ষিত সুবিধাবাদী তরুণেরা যখন উটপাখির মতো মুখ লুকিয়ে রাখে। তখন সমাজের এই বাকের ভাইদের অবদানও কিন্তু কম নয়।
বাকের ভাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী উঠতি মাস্তান মতি এই ষড়যন্ত্র মামলায় মিথ্যা সাক্ষী দেয়। শুধু তাই নয়, রেবেকা হক টাকার লোভ দেখিয়ে বাকেরের বিশ্বস্ত সহযোগী বদিকে মিথ্যা সাক্ষ দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। এভাবেই সত্যে অবিচল থেকেও শেষপর্যন্ত বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ হয়।
নাটকের পরতে পরতে বাকের ভাইয়ের পরোপকারী মনোভাব দর্শকের মনে চিরস্থায়ী মায়ার উদ্রেক করে। ফলে নাটকের শেষে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি না দেওয়ার জন্য দর্শকরা রাস্তায় মিছিল করে। বাংলা নাটকের ইতিহাসে বোধহয় এটা এক অভিনব ঘটনা। কিন্তু নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ তার পরিকল্পনায় অবিচল ছিলেন। শেষপর্যন্ত ফাঁসি দেওয়া হয়।
‘মুনা’ এই নাটকের গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র। বাঙালি মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে ‘মুনা’ একটি ধ্রুপদী চরিত্র বলা যায়। নাটকের আদ্যন্ত ‘মুনা’ চরিত্রের সক্রিয় উপস্থিতি দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়। হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট আলোচিত চরিত্র ‘হিমু’, ‘মিসির আলী’র পাশে মুনা চরিত্রটিও স্বতন্ত্র মাত্রায় দেদীপ্যমান।
খুব ছোটবেলায় মা-বাবা হারিয়েছে মুনা। মামার পরিবারে থেকে বড় হয়েছে। নিজের সুখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে দিয়ে দিনশেষে যে কি না, একলা হয়ে পড়ে। প্রেমিক মামুনের অন্যত্র বিয়ে করে ফেলা, আকস্মিকভাবে মামীর মৃত্যু। মামার দুই বছরের জেল। বয়সে ছোট মামাতো বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়া। সর্বশেষ ভালোবাসার মানুষ বাকের ভাইয়ের লাশ দাফন শেষে মুনা ভীষণ একা। যেন বিধ্বস্ত নীলিমার নিচে আতঙ্কিত এক মুখচ্ছবি ‘মুনা’। চারিদিকে লোকশূন্য হাহাকার। কোথাও কেউ নেই।
‘বাকের ভাই’ চরিত্রটির পাশে আরও দুটি বিশেষ চরিত্র ‘বদি’ এবং ‘মজনু’। এদের অনবদ্য অভিনয় চোখে পড়ার মতো। বাকের ভাই অন্যায়ের কাছে মাথানত করে না বলেই মিথ্যা মামলায় তার ফাঁসি হয়। রেবেকা হক নামে ভদ্রবেশী এক প্রভাবশালী নারী নিজ বাড়িতে তরুণীদের বাধ্য করে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলো। বাকের ভাই এখবর জানতে পেরে অপকর্মের প্রতিবাদ করেন। শুরু হয় দ্বন্দ্ব। মূলত রেবেকা হকের মিথ্যা ষড়যন্ত্রের কারণে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়। বাকের ভাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী উঠতি মাস্তান মতি এই ষড়যন্ত্র মামলায় মিথ্যা সাক্ষী দেয়। শুধু তাই নয়, রেবেকা হক টাকার লোভ দেখিয়ে বাকেরের বিশ্বস্ত সহযোগী বদিকে মিথ্যা সাক্ষ দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। এভাবেই সত্যে অবিচল থেকেও শেষপর্যন্ত বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ হয়।
‘কোথাও কেউ নেই’ হাস্যরসাত্মকধর্মী নাটক হলেও এখানে বহুবিচিত্র ঘটনার বাতাবরণে উন্মোচিত হয়েছে মনোজগতের অনালোকিত অঞ্চল। হুমায়ূন আহমেদ রচিত নাটকটি পরিচালনা করেন বরকত উল্লাহ। মুনা চরিত্রে নিপুণ অভিনয় করে দর্শকশ্রোতার মন কেড়েছেন সুবর্ণা মোস্তফা। আলোচিত বাকের ভাই চরিত্রে অভিনয় করেছেন কিংবদন্তী অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর।এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন আবদুল কাদের, মাহফুজ আহমেদ, আফসানা মিমি, হুমায়ুন ফরীদি, মোজাম্মেল হোসেন, সালেহ আহমেদ, আবুল খায়ের, নাজমা আনোয়ার, শহীদুজ্জামান সেলিমসহ অনেকে।
সন্দেহ নেই, হুমায়ূন আহমেদ তার কালজয়ী সৃষ্টি ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের জন্য আরও অনেকদিন দর্শকশ্রোতার কাছে প্রিয় হয়ে রইবেন।
(চলবে)
করাতের কথা-৫॥ ফারুক সুমন