(পর্ব-৫)
রবীন্দ্রনাথ ও নেহেরু
স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ফটোগ্রাফ দেখেছি সেদিন। যেখানে তারা পরস্পর মুখোমুখি বসে আলাপ করছেন। হ্যাঁ, ছবিও কথা বলে। ছবির ভাষা পড়ার চেষ্টা করি। একজন কবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রধানমন্ত্রী। দুজনের আন্তরিকতায় মুগ্ধতার ভাষা। রবীন্দ্রনাথ, শিরদাঁড়া সম্পন্ন একজন কবি। বর্তমান বিবেচনায় আমাদের সেদিন ফুরিয়েছে। নয় কি? এখন জ্ঞান নয়, পদবি ও ক্ষমতার পাল্লা ভীষণ ভারী। যার ফলে সমাজে শিক্ষার হার বেশি হয়েও মূল্যবোধ ও নৈতিকতার চরম অবনমন। রন্ধ্রে-রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে।
জওহরলাল নেহেরু ১৯৩৪-এর জুন থেকে ১৯৩৫-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেলে ছিলেন। সেখানে বসে নিজের আত্মজীবনী ‘অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ লিখেছিলেন। (‘টুওয়ার্ডস ফ্রিডম’ নামেও পরিচিত বইটি)। বইটি ১৯৩৬ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ বইটি পড়ে নেহেরুকে চিঠি লেখেন।
৩১ মে ১৯৩৬
প্রিয় জওহরলাল,
তোমার বইখানি সবেমাত্র শেষ করেছি। আমি অত্যন্ত অভিভূত এবং তোমার কীর্তিতে যারপরনাই গর্বিত। এ বইয়ের যাবতীয় খুঁটিনাটির মধ্য দিয়ে মানবিকতার এক গভীর স্রোত প্রবাহিত হয়ে চলেছে। তথ্যের ঘনঘটাকে ছাপিয়ে গিয়ে সেটা আমাদের এমন এক ব্যক্তির সমীপে নিয়ে যায়, যে তার কর্মের চেয়ে বড়, তার পারিপার্শ্বিকের চেয়ে খাঁটি।ভবদীয়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এখন কবির সঙ্গে পরিচয় নেই রাজনীতির। কেবল ফুল-পাখি-লতা-পাতা নিয়ে লিরিকধর্মী কবিতায় কবিদের পরিতৃপ্তি। শিল্পের সৌন্দর্যে কেবল বায়বীয় স্নান। কবি-কথাশিল্পী-গায়ক-নায়ক-চিত্রশিল্পী পরস্পর বিচ্ছিন্ন বৈকি। উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে সময় পার।
বঙ্গবন্ধু ও কবি নজরুল
স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ফটোগ্রাফ নিয়ে কথা বলেছি। আজ আবার আমাদের বঙ্গবন্ধু এবং কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনুরূপ দুটি ছবি খুঁজে পেলাম। একটি ছবিতে দেখা যায় বাকশক্তিহীন কবি নজরুল হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধু বেডের নিচে মেঝেতে বসে কবি নজরুলের চিকিৎসা ও শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। কতটা বিনয়ী অভিব্যক্তি সেটা ছবির দিকে তাকালেই আন্দাজ করা যায়। বলতে চাইছি, ছবির ভাষা নিয়ে। কবির সঙ্গে একজন রাজনীতির মানুষের শ্রদ্ধাশীল সম্পর্ক নিয়ে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, দুই মেয়ে এবং ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলও ছিলেন।
মজার ব্যাপার এই, একজন কবি ও রাজনীতিবিদের মধ্যে দর্শনগত সাযুজ্য আমাদের মুগ্ধ করে। কবি নজরুল কাব্যচেতনায় আর বঙ্গবন্ধু বাস্তবে নির্যাতিত-নিষ্পেষিত মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। দুজনেই অন্যায়-অত্যাচার, বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন। বয়সের বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু কবি নজরুলের চেয়ে মাত্র ২১ বছরের ছোট ছিলেন। সমসময়ে দুজনেই মানুষের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে কারাবরণ করেছেন।
বলতে চাইছি, সমকালীন দুই আন্তর্জাতিক দীপ্তিময় মনীষার মাঝে এই যে আন্তঃসংযোগ।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পরে বঙ্গবন্ধু স্বপ্রণোদিত হয়ে কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। ১৯৭২ সালের ২০ মে তিনি ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসেবে তৎকালীন আওয়ামীলীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজসেবা সম্পাদক মোস্তফা সারওয়ার ও পূর্তমন্ত্রী মতিউর রহমানকে পশ্চিমবঙ্গে পাঠান। এটা একজন কবির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর হার্দিক বহিঃপ্রকাশ। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু তখন একটি চিঠিও লিখেছেন:
‘আমি আমার বন্ধু ও সহকর্মী জনাব মতিউর রহমান এবং আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক জনাব মোস্তফা সারওয়ারকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। অনুগ্রহপূর্বক আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন। মুক্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জনগণ ও আমার পক্ষে আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনার জন্মবার্ষিকীতে আপনার আদর্শে বাংলাদেশকে সিক্ত হতে দিন। আমরা বাংলাদেশে সাগ্রহে আপনার আগমনের প্রতীক্ষা করছি। আমি আশা করি, আপনি অনুগ্রহ করে আসবেন। জয় বাংলা।’
আরেকটি ছবিতে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু কবি নজরুলকে পুষ্পমাল্য গলায় পরিয়ে দিচ্ছেন। আবেগাপ্লুত হয়ে বারবার কবির গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। নির্বাক কবি সেদিন ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিলেন।
আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ
আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫) এবং রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) সমকালীন বিশ্বে বিস্ময়কর দুই প্রতিভা। একজন বিজ্ঞানী, অন্যজন কবি। তারা একাধিকবার সাক্ষাৎ করেছিলেন। সেই সাক্ষাৎ জ্ঞানচর্চার পরম্পরায় উত্তরপ্রজন্মের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বৈকি। কবিতা ও বিজ্ঞান পরস্পর বিপরীতধর্মী হলেও তাঁদের দুজনের মধ্যে ছিল নিবিড় সখ্যতা।
আইনস্টাইন বয়সে রবীন্দ্রনাথের ছোট। কিন্তু হলে কি হবে, জ্ঞানের গভীরতায় তাদের বয়সের দুরত্ব ঘুছে গিয়েছিল। আমরা আর্কাইভে রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টাইনের বেশকিছু ছবি দেখে থাকব। যেখানে তারা কখনো হেঁটে, কখনো বা মুখোমুখি বসে আলাপ করছিলেন। মূলত কৌতূহল থেকে এই দুই মনীষী সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছিলাম। তাদের মধ্যে কেমন সম্পর্ক ছিল। সাক্ষাতে তারা কী নিয়ে আলাপ করেছিলেন। মূলত সমসময়ে সৃজনশীল মানুষের মধ্যে যে পারস্পরিক আন্তঃসংযোগ জরুরি। সেটা অনুভব করতে গিয়ে এই লেখার অবতারণা।
রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের মধ্যে মোট চারবার দেখা হয়েছিল। প্রথম দেখা হয় ১৯২৬ সালে। এসময় তারা কী নিয়ে আলাপ করেছিলেন সে-সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। তবে প্রথম দেখা হওয়ার পর তাদের মধ্যে পত্র-যোগাযোগ ছিল। চিঠির মাধ্যমে পরস্পরের জ্ঞানচর্চার খোঁজখবর নিতেন। চিঠিতে বিভিন্ন দর্শন ও মতবাদ নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা স্থান পেতো। রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে আইনস্টাইনের সহস্তে লেখা দুটি পত্র এখনো শান্তি-নিকেতনের সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। যেগুলো জার্মান ভাষায় লেখা হয়েছিল।
তবে এরকম একটি কথা শোনা যায় যে, আইনস্টাইনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ শেষে রবীন্দ্রনাথ যখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। তখন সাংবাদিকেরা তাকে প্রশ্ন করেন, ‘এইমাত্র আপনি একজন বিশ্ব-বিখ্যাত বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বললেন, আপনার প্রতিক্রিয়া কী?’ রবীন্দ্রনাথ উত্তর দিলেন, ‘আমি তো একজন বিশ্ববিখ্যাত কবির সঙ্গে কথা বললাম।’ এরপর সাংবাদিকরা আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করে জানতে চাইলেন, ‘আপনি একজন বিশ্বকবির সঙ্গে আলাপ করলেন, আপনার প্রতিক্রিয়া কী?’ আইনস্টাইন জবাব দিলেন, ‘আমি কবির সঙ্গে কথা বলিনি, আমি একজন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলেছি।’
১৯৩০ সালের ১৪ জুলাই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আইনস্টাইনের দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়। সেসময় কবি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা শেষে বার্লিনে গিয়েছেন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন ত্রিশের দশকের অন্যতম কবি অমিয় চক্রবর্তী। বার্লিনের ক্যাপুথ (Caputh) নামক স্থানে আইনস্টাইন তাঁর নিজ বাড়িতে রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ করেন। সেখানে মুখোমুখি বসে তাঁরা শিল্প-সাহিত্য, সমকালীন বিশ্বপরিস্থিতি, সমাজ-সংস্কৃতি-সহ নানাবিষয়ে কথা বলেন। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তৃতীয়বার এবং ডিসেম্বর মাসে চতুর্থবার তারা নিউইয়র্ক এ দেখা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রেলিজ্যন অব ম্যান’ বা ‘মানবধর্ম’ বইয়ে আলাপচারিতাটি স্থান পেয়েছে। যেখানে তারা দুজন বিজ্ঞান, বাস্তবতা, সৃষ্টি, সত্য, সৌন্দর্যবোধ, মানুষ ও মানবতা নিয়ে অন্তরঙ্গ আলাপ করেছেন।
বলতে চাইছি, সমকালীন দুই আন্তর্জাতিক দীপ্তিময় মনীষার মাঝে এই যে আন্তঃসংযোগ। এটা শিল্পমুখর মানুষের জন্যে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ভাবের বিনিময়ে বিশ্ব হবে আরও ঐশ্বর্যময়। রবীন্দ্রনাথ বুঝি একারণেই লিখেছেন:
হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।
হেথায় দাঁড়ায়ে দু বাহু বাড়ায়ে নমি নরদেবতারে—
উদার ছন্দে, পরমানন্দে বন্দন করি তাঁরে।
ধ্যানগম্ভীর এই-যে ভূধর, নদী-জপমালা-ধৃত প্রান্তর,
হেথায় নিত্য হেরো পবিত্র ধরিত্রীরে—
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে॥কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা।
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন—
শক-হুন-দল পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন।
পশ্চিমে আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার,
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে—
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে॥এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃস্টান।
এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার।
এসো হে পতিত, হোক অপনীত সব অপমানভার।
মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা, মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা
সবার-পরশে-পবিত্র-করা তীর্থনীরে—
আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে॥
[গীতবিতান: হে মোর চিত্ত](চলবে)
করাতের কথা-৪॥ ফারুক সুমন