পুরস্কার সমাচার
অফিসের ঠিকানায় ডাকযোগে একটি চিঠি এসেছে। অফিসের নজরুল ভাই আমাকে ডেকে বললেন ‘স্যার আপনার একটা চিঠি আছে।’ অবাক ভঙ্গিতে জানতে চাইলাম কিসের চিঠি? আমার নামে কোনো চিঠি আসার তো কথা নয়! নিশ্চয়ই কোনো ব্যাংক থেকে তাই না?
-না স্যার, তা নয়। আমার টেবিলে আছে। আপনি আসবেন, না কি পাঠিয়ে দেবো?
-পাঠাতে হবে না। কিছুক্ষণ পর আমি নিজেই এসে নিয়ে যাবো।
ইন্টারনেট বিপ্লবের যুগে চিঠি চালাচালির ব্যাপারটি হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ একসময় যারা চিঠি লিখেছেন, তারাই জানেন চিঠিতে কত মায়া জড়িয়ে থাকে। চিঠি আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে ব্যক্তিভেদে মায়া-মমতা ও মুগ্ধতার ধরনও বদলে যায়। যেমন, বাবার কাছে টাকা চেয়ে পুত্রের চিঠি, প্রবাসী ভাইয়ের কাছে বোনের চিঠি, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক চিঠি। এসব চিঠি নিয়ে লিখতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে। যদি প্রেমের চিঠি হয়, তবে তো কথাই নেই। চিঠির ভাঁজে গুঁজে দেওয়া থাকে সুগন্ধী ফুলের পাপড়ি। এই চিঠির আবেদন লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’-এর কথা মনে পড়ে গেলো। তিনি লিখেছেন, ‘পৃথিবীতে অনেক মহামূল্য উপহার আছে, তার মধ্যে সামান্য চিঠিখানি কম জিনিষ নয়। চিঠির দ্বারা পৃথিবীতে একটা নুতন আনন্দের স্বষ্টি হয়েছে। আমরা মানুষকে দেখে যতটা লাভ করি, তার সঙ্গে কথাবার্ত্তা কয়ে যতটা লাভ করি, চিঠিপত্র দ্বারা তার চেয়ে আরো একটা বেশি কিছু পেয়ে থাকি। চিঠিপত্রে যে আমরা কেবল প্রত্যক্ষ আলাপের অভাব দুর করি তা নয়, ওর মধ্যে আরও একটু রস আছে যা প্রত্যক্ষ দেখাশোনায় নেই। মানুষ মুখের কথায় আপনাকে যতখানি ও যেরকম করে প্রকাশ করে লেখার কথায় ঠিক ততথানি করে না। আবার লেখার যতখানি করে মুখের কথায় ততথানি করতে পারে না।’ (ছিন্নপত্র: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; শিলাইদহ, ৮ মার্চ, ১৮৯৫)
আমি আপাতত এই পুরস্কার গ্রহণে ইচ্ছুক নই। একথা বলে মোবাইলের লাল বাটনে চাপ দিলাম। পুরস্কার থেকে মুক্তি পেলাম। আবারও প্রমাণিত হলো ‘রঙ্গভরা বঙ্গ দেশ, রঙ্গরসের নেইকো শেষ’।
থাক চিঠির কথা। এবার আসল প্রসঙ্গে আসি। কিছুক্ষণ পর আমি নিজেই অতি কৌতূহলে নজরুল ভাইয়ের রুমে ছুটে গেলাম। খাম খুলে দেখি, একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে পুরস্কারের জন্যে মনোনীত করা হয়েছে। সেই চিঠি। প্যাডের ওপরের দিকে মধ্যভাগে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘…ফাউন্ডেশন গোল্ড অ্যাওয়ার্ড-২০১৯’। চিঠিতে যা লেখা ছিল তার মোদ্দাকথা এ রকম, ‘‘শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ অবদান রাখার জন্য আমাদের জুরিবোর্ড আপনাকে এবারের ‘গোল্ড এওয়ার্ড ২০১৯’ প্রদানের জন্য মনোনীত করেছে। পুরস্কার গ্রহণে সম্মত থাকলে নিচের ইমেইল আইডি-তে আমাদের জানান। অথবা কল করুন।’’
এমন একটি আনন্দের সংবাদ পেয়ে প্রথমে সহকর্মী, কবি আকমল হোসেন খোকনের কাছে গেলাম। পাশেই ছিলেন আরও দুজন নূরুল ইসলাম ও ময়নুল ইসলাম শাহ স্যার। তারা পুরস্কার প্রদানকারীদের দেওয়া একমাত্র মোবাইল নম্বরে কল দিয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরামর্শ দিলেন। চিঠির নিচে একটি অসম্পূর্ণ ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে। অসম্পূর্ণ ঠিকানা দেখে আমার মনে খটকা লাগে। তাছাড়া লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও শিক্ষা বিস্তারে তেমন কোনো অবদান রেখেছি বলে তো মনে পড়ে না।
পুরস্কার প্রদানের তারিখ ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি। তারিখ ঘনিয়ে এলেও আমার তরফ থেকে কোনোরকম সাড়া না পেয়ে তারা বোধহয় হতাশ। ১২ তারিখ সকালে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে। রিসিভ করে নারীকণ্ঠ শুনতে পেলাম।
-হ্যালো।
-ফারুক সুমন বলছেন?
-জি, বলছি।
-আপনাকে অভিনন্দন, আপনি…ফাউন্ডেশন গোল্ড অ্যাওয়ার্ড-২০১৯ পাচ্ছেন।
ক্ষণকাল চুপ করে থেকে জানতে চাইলাম, আমাকে কেন এই পুরস্কার দিচ্ছেন? বুঝতে পারলাম না ঠিক।
-কেন আমাদের চিঠি পাননি?
পেয়েছি। কিন্তু দীর্ঘদিন কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ চর্চা করা ছাড়া শিক্ষা বিস্তারে আমি গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা রেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না।
-দেখুন, আমাদের জুরি বোর্ড আপনাকে যোগ্য মনে করেছেন। তাই।
আচ্ছা। তো এখন আমাকে কী করতে হবে?
-আপনি আগামীকাল আসবেন। আর…
-আর কী?
-আসলে একটা অনুষ্ঠান অ্যারেঞ্জ করতে তো অনেক খরচ হয়। আপনি যদি কিছু সহযোগিতা করতেন। তাহলে আয়োজক কমিটির জন্য খুব ভালো হতো।
ও আচ্ছা। ঠিক আছে আপু আপনাকে ধন্যবাদ। আমি আপাতত এই পুরস্কার গ্রহণে ইচ্ছুক নই। একথা বলে মোবাইলের লাল বাটনে চাপ দিলাম। পুরস্কার থেকে মুক্তি পেলাম। আবারও প্রমাণিত হলো ‘রঙ্গভরা বঙ্গ দেশ, রঙ্গরসের নেইকো শেষ’।
পার্টটাইম জব
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকাকালীন আমি একটা ব্যবসা করতাম। নাহ! গাঁজা কিংবা ইয়াবার ব্যবসা নয়। তবে ব্যবসার কথা বলার আগে মামার কথা বলা জরুরি।
আমার মাহবুব মামা থাকতেন জাপানে। সেখানে বেশ কয়েকবছর থাকার পর চলে গেলেন ইতালি। সপরিবারে ইতালির সিটিজেনশিপ পেয়ে গেলেন। তখন এই মামা ছিলেন আমার কাছে স্বপ্নের মতো। কারণ জাপান আর ইতালি ঝলমলে দু’টি দেশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আমি। মামা হঠাৎ একদিন ছুটিতে দেশে এলেন। এই খবর পেয়ে কালক্ষেপণ না করে দ্রুত মামার বাসায় চলে গেলাম। মামা যদি কিছু টাকাপয়সা কিংবা গিফট দেন সেই আশায়।
মামা ততদিনে আবার ইতালি চলে গেছেন। মনে মনে মামাকে বললাম, আমার দ্বারা পার্টটাইম জব হবে না মামা। ক্ষমা করো।
সন্ধ্যার দিকে ট্রাউজার পরা মামা ড্রয়িং রুমে এসে বসলেন। আমি দাঁড়িয়ে সালাম করলাম। মামাকে বেশ কৌতূহল নিয়ে দেখতে লাগলাম। আহা উন্নত দেশ থেকে মামা এসেছেন।
মামা বললেন, তোমার কথা শুনেছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইছো। ভালো। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া সহজ কথা নয়।
জি মামা, অনেক কষ্ট করেছি। এখন হলে থাকি। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে একটু সমস্যা হয়। ডাইনিংয়ের খাবার ভালো লাগে না। বাইরের হোটেলে খেতে গেলে পোষাবে না।
মামা বললেন, কেন? পার্টটাইম জব করবা। টাকার অভাব হবে কেন? খরচের পর টাকা আরও থাকবে।
বুঝেছি, ২০-২৫ বছর বিদেশে থেকে মামা দেশের বাস্তবচিত্র হয়তো ভুলেই গেছেন।
বললাম, মামা এদেশে ছাত্রদের জন্য টিউশনি ছাড়া পার্টটাইম জব নাই। বিদেশে ছাত্রদের জন্য তো প্রচুর কাজের সুযোগ আছে।
মামা বললেন, আরে বোকা, প্রতিদিন বিকেলে ১ মণ আলু কিনে বাজারে বিক্রি করে দিবি। কেজি প্রতি ২ টাকা লাভ হলে ৮০ টাকা। কম কী? উন্নত রাষ্ট্রে কাজকে ছোট করে দেখা হয় না বলেই তারা উন্নত।
মামার আইডিয়া মন্দ নয়। কিন্তু ব্যবসা করার মূলধন কই পাবো? মামাকে বললাম ১ মণ আলু কেনার মূলধন কই পাবো মামা?
মামা বললেন, আচ্ছা, আমি ২ হাজার টাকা দিচ্ছি। এটা দিয়ে শুরু কর।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ বাসে চড়ে ঢাকা থেকে জাহাঙ্গীরনগর ফিরে এলাম। কয়েকদিন মনে-মনে অনেক চেষ্টা করেও আলুর ব্যবসা ধরতে পারলাম না।
হঠাৎ একদিন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখলাম। ‘সিটিসেল আমার ফোন’ পোস্টপেইড এখন মাত্র ৪ হাজার টাকা। ভাবলাম এই ফোনটি কিনে হলে ব্যবসা করা যায়। কারণ ২০০২-২০০৩ সালের দিকে তখনো মোবাইলফোন এখনকার মতো এত সহজলভ্য ছিল না। বন্ধু খায়রুল হাবীব, রুস্তমের সহযোগিতায় ফোনটি কিনে ফেললাম।
আহা! দারুণ ব্যবসা করলাম কিছুদিন। সকাল-বিকাল এমনকি গভীর রাত গড়িয়ে ভোর হয়ে যায়। তবু ব্যবসা চলছেই। আমার রুমের সামনে প্রেমিকদের লাইন। সিরিয়াল দেওয়া আছে। মোবাইল নিয়ে কেউ হলের ছাদে চলে যায়। কেউবা কথা বলতে বলতে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। আমি তো টাকায় লালে লাল। এভাবে চলতে থাকলে এতদিনে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী হতাম। কিন্তু এখানেও রাজনীতির নগ্ন থাবা। অল্পদিনের মধ্যেই দেখি বাকির খাতা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। কারণ হলের রাজনৈতিক নেতা, পাতিনেতারা মোবাইলফোনে কথা শেষ করে টাকা না দিয়ে দেয় ভোঁ দৌড়। বলে, সুমন লিখে রেখো। পরে দিচ্ছি।
মাস তিনেক চলার পর ব্যবসা লাটে উঠলো। মামা ততদিনে আবার ইতালি চলে গেছেন। মনে মনে মামাকে বললাম, আমার দ্বারা পার্টটাইম জব হবে না মামা। ক্ষমা করো।
চলবে…
করাতের কথা-১ ॥ ফারুক সুমন