[৫ম পর্ব]
খুঁজিতেছি কোথা তুমি
আমি তখন, অব্যয় অব্যয় করে ডাকছি আমার অন্তরাত্মা দিয়ে। কিন্তু মুখ ফুটে কোনো শব্দ বা ধ্বনি বেরুচ্ছে না মোটে।
তোমাকে নিয়ে তার শীতল অস্থিরতা আমাকে মোটে বুঝতে দিতে চায় না, আমি যদি আরও ভেঙে পড়ি। এজন্য পারতপক্ষে আমার সামনেও আসছে না। এতদিন মাকে জানতো ছায়াদানকারী বৃক্ষ, এদিকে তার মাথার ওপর বড় ভাইটির অভয় মুদ্রাও নেই। সে উড়ছে তখন দুবাইয়ের আকাশে। পুরো আকাশটাই যেন সেদিন ভেঙে পড়েছিল একা অব্যয়ের মাথার ’পরে।
জবান তো তোমার বন্ধই ছিল জন্মদিনের দিন থেকে। অর্থাৎ সেই ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালেই তো আমাদের ডেকে নিয়ে ডাক্তার বলেছিলেন, ‘কবিকে যেতে দিন প্রকৃতির নিয়মে। লাইফ সাপোর্টের ভেন্টিলেশনে দিয়ে চেষ্টা করা যায়, তবে সব রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের আমরা এ কথাই বলি যে, খামোকা টাকা-পয়সা নষ্ট করে লাভ নেই। রোগীরও কষ্ট, স্বজনদেরও অনেক হয়রানি হয়।’
আমরা সবাই মাথা নত করে শুনছি ডাক্তারের সব কথা। সুইজারল্যান্ড থেকে আগত আমার ছোট ভাই হাবিবও আছে, তোমার একমাত্র বড় ভায়ের মেয়ে ড. নীরু, তার ছোট ভাই ফারুক, একমাত্র বোনের পুত্র সাইফুল হক সিদ্দিকী, আমার ছোট ভাই সেলিম আহমেদ, রাকিব আহমেদ, আমার মাসহ সব ভাই-বোন উপস্থিত সেদিন।
এই সময় অভিন্ন ডাক্তারকে প্রশ্ন করলো, ভেণ্টিল্টারে রোগী ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কত ভাগ? ডাক্তার বললেন, ১০ পার্সেন্ট। অভিন্ন বললো, তাহলে আমরা চেষ্টা করবো না কেন? আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা, একইসঙ্গে কলমযোদ্ধাও। তিনি যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছেন সব সময়। কাজেই তিনি এই অসুখের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও জয়ী হবেন নিশ্চয়, আমাদের মধ্যে তিনি ফিরে আসবেন।
অব্যয়ও ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ‘হ্যাঁ’সূচক মৌনতা নিয়ে, রামের ছোট ভাই লক্ষণের মতো সে নমিত সর্বদা। অভিন্নের এই কথার সঙ্গে কারও আর দ্বিমত করার সাহস হয়নি। বরং উপস্থিত স্বজনেরা সবাই মিলে সেদিন একমত হয়েছিলাম এবং আমরা বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলাম যে, তুমি পুনরায় জীবনে ফিরে আসবে অবশ্যই। হয়তো , তুমিও জীবননান্দ দাশের মতো বলবে, ‘তোমরা যেখানে সাধ চ’লে যাও—আমি এই বাংলার পারে র’য়ে যাব।’
কিন্তু না, আমি তো বুঝতে পারছি, তোমার অর্ধ-নির্মিলিত দু’চোখ কিছুতেই আর পূর্ণ জ্যোতিতে জেগে উঠবে না। আমি ডা. মিকাইলকে জিজ্ঞেস করলাম, অর্ধনির্মিলিত চোখে তিনি কি কিছু দেখছেন, আমাকে কি তিনি দেখতে পাচ্ছেন মিকাইল?
তখন আমি তোমার পায়ের কাছে দাঁড়ানো ছিলাম। তোমার চোখের দিকে চোখ রেখে তাকিয়ে আছি অপলক। বারবার মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের ‘নিষ্ফল কামনা’কবিতার বিখ্যাত চরণক’টি:
খুঁজিতেছি কোথা তুমি,
কোথা তুমি!
যে অমৃত লুকানো তোমায়
সে কোথায়!অন্ধকার সন্ধ্যার আকাশে
বিজন তারার মাঝে কাঁপিছে যেমন
স্বর্গের আলোকময় রহস্য অসীম,
ওই নয়নের
নিবিড় তিমির তলে কাঁপিছে তেমনি
আত্মার রহস্যশিখা।
তাই চেয়ে আছি।
প্রাণ মন সব লয়ে তাই ডুবিতেছি
অতল আকাঙ্ক্ষা পারাবার।তোমার আঁখির মাঝে,
হাসির আড়ালে,
বচনের সুধাস্রোতে,
তোমার বদনব্যাপীকরুণ শান্তির তলে
তোমারে কেথায় পাব
তাই এ ক্রন্দন।
আমার নীরবতা ভঙ্গ করে মিকাইল বললো, ‘আন্টি কবি কিছু দেখছেন না, তবে তার ব্রেন ওয়ার্ক করছে বলে চোখের পাতাদুটোকে মৃদু খোলা মনে হচ্ছে।’
এ কথা শুনেই আমি তোমার শিয়রের কাছে গেলাম, চায়ের চামচের এক চামচ পানি নিয়ে তার দু’ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে আলতোভাবে জিহ্বায় ঢেলে দিলাম। তোমার ঠোঁট ভিজে গেলো তৃষ্ণার বারিতে। সন্তানেরা কেউ কাছে নেই, আমি, শুধু আমি একা তোমার পাশে দাঁড়িয়ে আছি শেষ সত্যের মুখোমুখি হয়ে। তোমার অনন্ত যাত্রার এই রকম শুভ সুন্দর স্বপ্নময় মুহূর্তটুকুতে শুধু আমি আর তুমি!
চলছে…