[দশম পর্ব]
ভালোবাসা—অমৃত দুর্লভ কলস
তোমার চেয়ে ১১ বছরের বড়, একমাত্র ভাই নূরুল ইসলাম খান। বোহেমিয়ান তোমাকে তিনি জানেন ভালোই। কে জানতো অসম্ভব প্রতিভাবান তার ছোট্ট ভাইটির ডাকনাম কেন জীবন। যদিও পোশাকি নাম তোমার রফিকুল ইসলাম খান। তবু পারিবারিক ‘খান’ উপাধি বহন করলে না কিছুতেই।
কবিতার কাব্যপুরুষ তুমি নিজের নাম নিজেই রাখলে ‘রফিক আজাদ’। কিন্তু ডাকনামের প্রতি রয়ে গেলো যত দুর্বলতা তোমার।মনে পড়ে সেই ১৯৮২ সালে আমাদের প্রণয়-কালে ‘ডাকনাম’নাম দিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলে তুমি:
আমার ডাকনাম জেনে
তোমার কোনোই কাজে আসবে না,
কী হবে তা জেনে?
বাবা-মা আদর ক’রে‘জীবন’ ‘জীবন’ ব’লে ডাকতো যাকে
সে আজ ‘মৃত্যু’র খুব নিকট-আত্মীয়।
আমাকে ঐ নাম ধ’রে তুমি
কখনো ডেকো না;
মৃত্যুর দোসর ঐ নাম ধ’রে যদি ডাকো তবে
পাখি সাড়া দেবে,
শাপলা সাড়া দেবে,
ঝলমল করা জলভরা স্বচ্ছ হ্রদ সাড়া দেবে,
শালুক পাতারা খুব আলোড়িত হবে,
সমস্ত কাননজুড়ে পুরনো কোকিল
একটানা ডেকে যাবে…তুমি কষ্ট পাবে॥
জানি, কষ্টের কোনো হাত-পা নেই, নাকের বাঁশি নেই, কেবল শুনি তার হৃদয় ব্যাকুল-ধ্বনি। এই কষ্ট পাখির পালক ঝরার কষ্ট নয়, নিতান্তই নিদারুণ এক সংজ্ঞাহীন কষ্টে আমি ‘দহন’ এবং দগ্ধিভূত শব্দ দুইয়ের বহু ব্যঞ্জনাময় অর্থ বুঝতে পারি।
ওপারে আছ তুমি নির্ভাবনায়, জগৎঈশ্বরের মতো, তুমি ভাবতেও পারবে না পাখির পাখাটি ভেঙে গেলে পালকসমেত, পাখি তার ওড়াল শক্তি হারায় কিভাবে। যাকগে, আমার কথা বাদ দাও।
তোমার কথাই বলি, পিতৃতুল্য বড়ভাই তোমার মেধা ও প্রতিভার আগুন তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন তোমার শৈশব থেকেই। তাই তো তোমাকে তিনি পিতৃহৃদয়ের মাধুরী বিলিয়ে গড়ে-পিটে, লেখা-পড়া শিখিয়ে বড় করার ব্রত নিয়েছিলেন।
এ জন্যে ছোটবেলায় লেখা তোমার কবিতার খেরো-খাতা তিনি ছিঁড়েও ফেলেছেন বার কয়েক। বৈষয়িক পাহাড়ের চূড়ায় তিনি তোমাকে তুলতে চেষ্টা করেছেন আপ্রাণ, সুষম হাওয়ার বাতায়ন খুলে দিয়েছিলেন দু’হাতে। কিন্তু অমৃত কুম্ভের জাতক, পরশ পাথরের সন্ধানে সতত নিবিষ্ট তুমি, সৃষ্টিশীলতায় অসীমের সাধনা থেকে তোমাকে তিনি ফেরাতে পারেননি কিছুতেই।
না পারুন, কিন্তু পরীক্ষায় পাস-ফেলের ব্যাপার তো রয়েছে একটা। সেই ভাবনা থেকে তোমার হোস্টেল-জীবনের অপার স্বাধীনতাহরণ করে নিজের চাকরিস্থলে নিয়ে এলেন তোমার লেখা-পড়া তদারকির জন্যে। ভর্তি করে দিলেন নেত্রকোনা কলেজে। সেখানেও তুমি খুঁজে নিলে উত্তর আকাশের তারা, নীলিমার নিবিড় আঁখিসম অপরাজিতার স্বপ্নভুবনের সম্ভাবনাকে।
টাঙ্গাইলের কাঁগমারি কলেজে পড়াকালীন সময়ে শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই ছাড়া লাইব্রেরির সব গ্রন্থ তুমি বিপুল উৎসাহে পাঠ শেষ করেছিলে। ফলে বছর শেষে যা হওয়ার তাই হলো। ইন্টার মিডিয়েটের প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় প্রত্যেক বিষয়ে ফেল। শূন্যতায় ভরাডুবি চতুর্দিক থেকে।
এই ফলাফল জানতে পেরে মুষড়ে পড়লেন তোমার বড় ভাইজান কিন্তু ছোট ভাইটির তো কোনো বিকার নেই। বিব্রত হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ নেই ভেতরে-বাইরে কোথাও।
জন্মের আগেই মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে এসেছ পৃথিবীতে। এখন ভাবি, এ জন্যেই বোধ করি বিষণ্নতা তোমার আজন্ম একজন্ম-সহোদর হয়ে জন্মছিল।
কাজেই তিনি বাধ্য হয়েছিলেন টাঙ্গাইল থেকে তোমাকে সরিয়ে নিতে। মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করেই তিনি এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন। তোমার দেবীতুল্য মা জননী ততোধিক কাতর ছিলেন তোমাকে নিয়ে। তোমাকে গর্ভে নিয়ে প্রায়ই স্বপ্নে দেখতেন চাঁদ। সেই স্বপ্নের কথা বহুবার বলেছেন তিনি আমাকেই।
তোমার সার্বৈব মঙ্গল চিন্তা করেই তিনি তার চাকরিস্থল নেত্রকোনায় নিয়ে এলেন তোমাকে। সন্তানের মতো চোখে চোখে রাখলেন, আর যেন বখে না যায়! অবশেষে পরীক্ষার সকল সাঁকো পার হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হলে তুমি ১৯৬৭ সালে। মহসিন হলে তুমি আবাসিক যখন, তখনো কিছুদিন পর পরেই ছোটভাই জীবনকে দেখতে যান হলে। তার ময়লা গেঞ্জি, প্যান্ট, আন্ডারওয়ার জমা হতে থাকে খাটের তলায়। সে সব খুঁজে নিয়ে ধুয়ে দিয়ে আসেন নিজ হাতে। তিনি না ধুলে, তুমি তো ফেলে দেবে সেসব।
এই ভাইয়ের প্রতি তোমার ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম, অগাধ, অগাধ। আমাকে প্রায়ই বলতে তুমি, ‘আমার বাবা সলিম উদ্দিন খানের নাম লিখি বটে, কিন্তু বড় ভাইজান যদি আমাকে গড়ে-পিটে মানুষ না করতেন তাহলে আমি মফঃস্বল শহরের প্রথম শ্রেণীর একটা গুণ্ডা হয়ে জীবন কাটাতাম।’
চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র যখন, তখন তুমি মায়ের সিন্দুক থেকে টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে পিসি সরকারের কাছে জাদুশিখতে। কলকাতার ট্রেনে উঠেও বসেছিলে তুমি। পার্শ্ববর্তী যাত্রী ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। তিনি অতটুকু বালকের চোখে-মুখে উদ্বেগ দেখে বুঝে ফেলেছিলেন নির্ঘাত বাড়ি থেকে ঘর-পালানো ছেলে। বকুনির ভয়ে এখন হয়তো ফিরতেও ভয় পাচ্ছে। সস্নেহে তোমার মনোভাব জেনে নিয়ে তিনিই মূলত তোমাকে বাড়িতে ফেরৎ পাঠানোর সব ব্যবস্থা পাকা করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনায় মায়ে তো মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি করে চিৎকার, ‘টাকা গেছে যাক, আমার জান ফিরে আসুক, আমার জীবন ফিরে আসুক।’
মায়ের পেটপোছা কোলের সন্তান তুমি ‘জীবন’ নামে অস্থির করে রাখো মাকে। তোমার মুখেই শোনা কথা, মায়ের পেটে থাকতে নামকরণ করেছিলেন তোমার খুকি আপা। সক্কলেরই বড় ছিলেন তিনি। জীবন কুমারের গল্প পড়ে গল্পের নায়কের নামের অনুকরণে তোমার নাম নির্দিষ্ট করে দিয়ে তিনদিনের কালাজ্বরে তিনি হারিয়ে গেলেন পৃথিবী থেকে। তখনো তুমি মায়ের গর্ভে থেকেই বুঝতে পেরেছ সব। শোকে উত্তাল মায়ের মর্মভেদী এই শোকের মুহূর্তে তুমি তার অস্তিত্বের অংশ হয়ে তা বহন করছ নিভৃতে। জন্মের আগেই মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে এসেছ পৃথিবীতে। এখন ভাবি, এ জন্যেই বোধ করি বিষণ্নতা তোমার আজন্ম একজন্ম-সহোদর হয়ে জন্মছিল।
একজন মরে তবে অন্যজন বেঁচেছে মায়ের সন্তান। কাজেই সেই মায়ে জানে সন্তানের দরদ কাকে বলে? বহু তপস্যায় বিবাহের কুড়ি বছর পরে তুক-তাক-ঝাড়-ফুঁক তাবিজ-কবজ শেষে সন্তান এসেছে তার মায়ের কোলে। পাঁচ সন্তানের মধ্যে বেঁচেছে তিনজন। দুই পুত্র, এক কন্যা বিশেষ।
বোন সুফিয়া সিদ্দিকী রেনু, তিনিও তোমার সাত বছরের বড়। এই বোনের প্রতিও ছিল তোমার গভীর মমত্ববোধ। কোলে শুইয়ে দুধ খাইয়ে দিতেন, ঘুম পারাতেন পা দুলিয়ে দুলিয়ে। সেসব গল্প প্রায়ই করতে তুমি আমার সঙ্গে। এই বোন যখন বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যান, সে কি হৃদয়ভাঙা কান্না তোমার বোনের জন্যে।
একমাত্র এই বোনের বিয়ে হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি আবু সায়িদ চৌধুরীর চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে, টাঙ্গাইলের নাগবাড়ি নামক গ্রামে। পরবর্তী সময়ে তুমি তোমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অসম্ভবের পায়ে’তেই এই বোনকে নিয়ে ‘আপা’ নামক একটি কবিতা লিখলে। এই কবিতাটিও কেমন করে যেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো। এতে তুমি বেশ খুশি হয়েছিলে। তোমার কি মনে আছে কবিতার সেই চরণগুলো?
অসুখে প’ড়ে একাকী এই হাসপাতালে
আপা তোকে পড়ছে মনে।
আকৈশোর কোলে-পিঠে তোর
বেড়ে উঠেছি;
পায়ের উপর শুইয়ে দিয়ে জামবাটিতে
দুধ খাইয়েছিস—
মাঝে-মধ্যে চড়-চাপড়টা, তা-ও খেয়েছি;
তথাপি তোর মিষ্টি হাতে দোল না-খেলে
ঘুম যে আমার মোটে আসেনি!
বড় বোন, ভাই—যাদের জন্যে এত মন কেমন করা এমন সকাল-দুপুর, রাত্রির নিবিড় ছায়াতল, কত অনায়াসে রক্ত-বন্ধনের সবগ্রন্থী পেছনে ফেলে তুমি চলে গেলে অসীমের তীরে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ হয়েও চলে গেলে তুমি সবার আগে।
পরিবারের সবার মনে তুমি অনন্ত-অসীমের অক্ষয় এক দাগ কেন যে ফেলে দিলে অকাতরে। কান্নার কালো বিবরে মিলিয়ে গেলো তরফ গৌরাঙ্গি বংশের সবচাইতে উজ্জ্বল নক্ষত্রটি।
সিদ্ধান্ত হলো ২২ এপ্রিল শুক্রবার (২০১৬) তোমার জন্মভিটা গুণী গ্রামে কবির চল্লিশ দিনের চেহলাম অনুষ্ঠিত হবে। সেই অনুষ্ঠান উপলক্ষে কে কখন বাড়িতে যাবে, কার কি দায়িত্ব সব বণ্টন করে দিলো ভাইজানের বড় ছেলে ফারুক। পৌত্র শান্ত, অনন্তের পিতা হেদায়েতুল ইসলাম ফারুক তোমাদের দু’ভাইয়ের সংসারে অসম্ভব দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তি সে। যেমন ধীর, তেমনি স্থির স্বভাবের মানুষ। তোমার প্রিয় ভাতিজা ফারুক যেদিন থেকে তার রাইফেল স্কয়ারের ‘কার্বন ক্র্যাপ্ট’-এর হীরের জুয়েলারির শোরুম গুটিয়ে চলে গেলো গুলশান মার্কেটে। সেদিন থেকে কণ্ঠে তোমার মর্মভেদী কী এক আহাজারি!
তুমি বলতে, ‘ফারুকও চলে গেলো দূরে। ফারুক এখানে আমার ঘরের কাছে ছিল, মনে হতো আমার একজন অভিভাবক আছে হাতের কাছেই। যখন যা দরকার হতো, ওকে বলতাম। যথাসাধ্য হাতের কাজ ফেলে আমার কাজ করে দিতো সবার আগে। এখন খুব অসহায়বোধ করছি। ধানমন্ডির এই পাড়াটিকে খুব শূন্য মনে হচ্ছে ফারুককে ছাড়া।’
ফারুকের ছোটভাই শামীম—ওদের সব ভাই-বোনের নামই তো তুমি রেখেছিলে। সবার ছোট জলিকে আদর করে ডাকতে ‘জুল’। সে আজ কত বড় ডাক্তার হয়েছে ভার্জিনায়ায়। তোমার প্রিয় জুলের স্বামী ডাক্তার খোরশেদ আলম তোমার শেষ সময়ে কত সেবা দিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই ৫৮ দিনে কতবার যে তোমাকে সে দেখতে এসেছে। তোমার সার্বিক অবস্থা জানতে ও ভিসিকে খবর জানাতে তোমার আইসিইউতে প্রবেশ করেছে, আজ আর সেসব মনে করতে পারছি না।
শামীম ইতিহাসের ছাত্র, তোমার মতোই বিষণ্ন উদাসীন ।ঐতিহ্যের প্রতি তার প্রবল মমতা, দারুণ টান। ওয়ারী বটেশ্বর খননের অনেক আলেকচিত্র তার হাতে হয়ে উঠেছে বাঙ্ময়। চিরকুমার এই সন্তানটি এখন বাবা-মায়ের পরম ভরসাস্থল, পরিবারের সব সদস্যের মননশীল উদাসীনতার মানচিত্র যেন।
আরেক বড় বোন রেণু আপার বড় ছেলে সাইফুল হক সিদ্দিকী এবং বৌমা মলি সব সময়ে তোমার-আমার সব কাজের ছায়াসঙ্গী হয়ে ছিল। সবশেষ তোমার রুগ্ণবিছানায় ৫৮ দিনের বেদনাযজ্ঞে সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনার আর্ত সময় কেটেছে ওদেরও। জানোই তো তুমি, তোমার বোনের মেঝো ছেলে আকবর দুর্দান্ত শক্তিধর ভাগনে তোমার, থাকে টাঙ্গাইলে। এমন কোনো কাজ নেই, যা সে পারবে না। তার অভিধানে ‘না’ বলে কোনো শব্দ নেই। এতটাই করিতকর্মা ছেলে সে। তাকে ছাড়া এসব কাজ অচল, সেভাবেই আকবরকে ভরসা করি আমরা পরিবারের সবাই।
আমিই তাকে টেলিফোনে কথা বলে দায়িত্ব দিয়ে বললাম, ২০০কেজি গরুর মাংস, দুটো খাসি, ৭মন দইয়ের অর্ডার দিয়ে দাও তোমার মামার চেহলামের অনুষ্ঠানের অতিথিদের জন্যে। গুণী গ্রামের মানুষদের কতদিন কিছু খাওয়ানো হয়নি, বাড়িতেও আসা-যাওয়া নেই কতকাল। নগরকেন্দ্রিক হতে হতে শেকড় ভুলে যেতে বসেছি প্রায়। এই গুণী গাঁয়ের মানুষের তো হক আছে। এই মাটিতেই হেসে-খেলে বেড়ে উঠেছো তুমি।
অভিন্ন, অব্যয় তোমাকে দেখতে টরন্টো থেকে দেশে ফিরলে তাদের নিয়ে এসেছিলে প্রিয় গুণী গাঁয়ের মায়াবী মাটিতে। দক্ষিণমুখী বাড়ির প্রবেশ পথেই বাবা-মায়ের কবর। কবরের পাশে শান্ত, মৌনচিত্তে শেষ বিদায়ের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলে কিছুক্ষণ।
তবে একথাও তো ঠিক, মানুষ ফিরে ফিরে যায় তার সম্পর্কের কাছে, অবকাঠামোর কাছে তো নয়। তুমিই বলতে, ঘরবাড়ির মতো অবকাঠামো তো নিমিত্ত মাত্র। তোমার বাবা-মা যতদিন গুণী গাঁয়ে ছিলেন, ততদিন তোমাকে সঙ্গে নিয়ে নিয়মিত গিয়েছি সেখানে, দু’টো ঈদ-উৎসবের একটিতে বিশেষভাবে কোরবানির ঈদ নিয়মিত কাটিয়েছি তাদের সঙ্গে। কোরবানির গো-মাংস ও ঝোল দিয়ে তৈরি টাঙ্গাইল অঞ্চলের বিখ্যাত রোটপিঠা কত প্রিয় ছিল তোমার। মায়ের হাতের, পরবর্তী সময়ে বৌদির হাতের রোটপিঠা না খেয়ে ঢাকায় ফেরোনি কোনোদিন। সেসব মধুময় দিন আর ধরে রাখতে পারলাম কই? ছেলেবেলার বুড়ি ছোঁয়ার মতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে এ কোথায় পৌঁছুলাম, বলো তো? সবশেষ কবে গিয়েছিলে গুণী, মনে পড়ে তোমার ?
বাবা-মায়ের এল প্যাটার্নের টিনের চালার ঘর যখন অস্থি জর-জর , পড়ে-মরো অবস্থা, তখন বড় ভাইজানের উপর্যুপরি অনুরোধে তোমাকে রাজি করালাম আমি। তোমার প্রিয় ভাতিজা ফারুকের হাতে শুরু হলো পরবর্তী প্রজন্মের বিনির্মাণের কাজ। এবার টিনের চালা নয়, এক্কেবারে পাকাপাকি। দুই কক্ষ বিশিষ্ট দু’ভাইয়ের মিলিত একখানা ইটের গাঁথুনিওয়ালা শয়ন মন্দিরের পরিকল্পনা। ডিজাইন করে দিলেন তোমার প্রাণের বন্ধু কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন। এই ভবনের ভিত্তি-প্রস্তরের সময় অনেক বলে ক’য়ে, সাধ্য-সাধনায় গুণী গাঁয়ে এলে তুমি বহুকাল পরে।
প্রতি সপ্তাহে ফারুক এসে সেসব কাজের তদারকির করতো, স্বেচ্ছায় ভার নিয়েছিল সে কাঁধে। অভিন্ন, অব্যয়, রাজিব দেশে নেই, একমাত্র যে সন্তানটি তোমার মতো দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি নয়, সেই রাহুলকে সঙ্গে নিয়ে তুমি গৃহের প্রথম পিলারের গোড়ায় ইট-সিমেন্ট-সুরকি গোলানো মসলা ঢেলে দিয়েছিলে নিজহাতে। তারপর আর একবার এসে বাড়িটি শেষ হওয়ার পরে দেখে গেছ আগ্রহ ভরে।
সর্বশেষ ২০১৪ সালে অভিন্ন, অব্যয় তোমাকে দেখতে টরন্টো থেকে দেশে ফিরলে তাদের নিয়ে এসেছিলে প্রিয় গুণী গাঁয়ের মায়াবী মাটিতে। দক্ষিণমুখী বাড়ির প্রবেশ পথেই বাবা-মায়ের কবর। কবরের পাশে শান্ত, মৌনচিত্তে শেষ বিদায়ের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলে কিছুক্ষণ।
স্মৃতির মিনার গেঁথে রেখে গেলে নিজহাতে তুমি।সেই বাড়িতেই হবে তোমার শেষ চেহলামের অনুষ্ঠান। আকবরকে বলা মাত্রই পরম মমতায় তার মামার জন্যে সুচারুরূপে সব দায়িত্ব পালন করলো সে। অথচ দেখো, এই অনুষ্ঠান শেষের কয়েকদিনের মধ্যে জানা গেলো, আকবরের ক্যান্সার হয়েছে। আহা, এ কথা জেনে গেলে খুব কষ্ট হতো তোমার।
আয়োজনের ক’দিন আগে থেকে ফারুক ঢাকা থেকে ফোনালাপে তোমার চাচাতো ভাই আসলাম ও জগলুলকে দিয়ে কাজগুছিয়ে রেখেছিল অনেকটাই।
তোমার বড় ভাইজান এবং বৌদি টাঙ্গাইল শহরের বনশ্রীর বাসা থেকে গুণী এসে পৌঁছুলেন ২১ এপ্রিলের সকাল বেলাতেই।
সব কাজের তদারকির অগ্রভাগে রইলো ফারুক, গ্রামে তোমাদের ‘খান পরিবার’ এর অধীন সমাজের লোকজনসহ কাজে হাতলাগালো সবাই। বিশাল বিশাল চুলা খোঁড়া হলো মোহাম্মদ কাক্কুর শূন্য ভিটায়। রান্নার লোক এলো আসেপাশের পাড়া থেকে, কুটা-বাছার জন্যে কয়েকজন এলো ‘বেলদহ’ তোমার নানাবাড়ির গ্রাম থেকে।
এবারই প্রথম আমি গুণী গ্রামে গেলাম তোমাকে ছাড়া। এতদিনে মনে হলো গুণী আমারও গ্রাম। এর আগ পর্যন্ত গুণীকে তোমার এবং তোমার সন্তানদের গ্রাম বলে মনে হতো কেবল। আমার বাড়ি মানিকগঞ্জের গড়পাড়া। এতদিন মনে হতো তোমার গ্রাম কেন আমার হতে যাবে?
আমার গ্রাম আমারই ছিল, তবু কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম, আমার বাবার বাড়ি মানিকগঞ্জ, স্বামীর বাড়ি টাঙ্গাইল। অভিমানের সঙ্গে বলতাম আমার কোনো বাড়ি নেই। মেয়েদের কখনো বাড়ি থাকে না।
যেন এক ঝাঁক মুনিয়া পাখি আকাশে উড়ে যাচ্ছে আমার মাথা-মনন ছুঁয়ে। তোমার ভাতিজি ড. নীরু শামসুন্নাহার লাকি পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন করলো সুন্দরভাবে।
তোমাকে হারিয়ে এবার বুঝতে পারলাম তোমার গুণী গ্রামটা এক ধাক্কায় আমার হয়ে গেলো, জাগতিক তুমি যখন ছেড়ে গেলে এই আমাকেই। কী দিয়ে ধরে রাখবো তোমার অস্তিত্ব? বুকের ভেতরটা এখন কেবলি আপন-পর খোঁজে। জন্মভিটার যে মাটিতে হেঁটে, দৌড়ে বড় হয়েছ, সেই মাটির গন্ধেই আমূল তৃষ্ণার্ত থাকি, তোমার রক্তের বন্ধন সমূহের মধ্যে, তোমার স্বজন-বিজনদের মমতার মধ্যে, তাদের বলা গল্পের মধ্যে তোমাকে খুঁজে বেড়াই প্রবলভাবে। তখন মনে হয়, তুমি আছ, এখানেই, এই আম-জামের ছায়ায়, তোমার বাড়ির উঠোনে একপাশে প্রতিষ্ঠিত মসজিদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কথা বলছ টাঙ্গাইলের কোনো তরুণ কবির সঙ্গে। নয়তো হালোট সংলগ্ন তোমাদের গারাক্ষেতের আইলে দাঁড়িয়ে দক্ষিণের হাওয়ায় আতপ্ত শরীর জুড়িয়ে নিচ্ছ সময়ের সবুজ কলাপাতায় বসে।
কবি আসাদ চৌধুরী আমার সঙ্গেই এক গাড়িতে গুণী গ্রামে তোমার চেহলামে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। এলেনও। তোমার মতো করেই অভিন্ন তার দেখভালের সমূহ দায়িত্ব পালন করলো। অব্যয় তো থাকতে পারলো না। তোমার কুলখানি শেষ করেই চাকরি রক্ষার্থে চলে গেছে টরন্টো। অভিন্ন একক হাতে সমূহ দায়িত্ব পালনের জন্যে রয়ে গেছে আমার পাশে।
তুমি জানলে অবাক হতে যে, আসাদ ভাই আমাদের নিকট স্বজনদের মতোই গুণীতে থাকলেন দুইরাত তিনদিন। তোমাকে ভালোবেসে। প্রচণ্ড দাবদাহ অগ্রাহ্য করেই হাসিমুখে বরণ করে নিলেন আমাদের সব সীমাবদ্ধতাকেও।
অনুষ্ঠানের দিন এলেন তোমার প্রিয়বন্ধু রবিউল হুসাইন, প্রিয় কবি আবুল হাসনাত, চিত্রা প্রকাশনীর কর্ণধার কবি খোরশেদ বাহার, কবি অন্বেষা, টাঙ্গাইলের কবি মাহমুদ কামাল, শফি কামালসহ অনেক তরুণ কবি টাঙ্গাইলের বিভিন্নস্থান থেকে। এই মুহূর্তে তাদের সবার নাম মনে করতে পারছি না। কিন্তু তাদের সবার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর রফিকউল্যাহ খান এসেছিলেন তার বেশ ক’জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে, যারা তোমার কবিতার অন্ধ ভক্ত। পরিশেষে এলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া তোমার সহযোদ্ধারা। এলেন তোমার ১১ নম্বর সেক্টর-কমান্ডার বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। সবাই কথা বললেন, তোমাকে নিয়ে সব কথা। গুণী গাঁয়ের নীল আকাশ-বাতাস নতুন করে শুনতে পেলো সেসব কথা, গুণী গাঁয়ের গুণী, কীর্তিমান এক কবির কথা।
কলম ছুড়ে দিয়ে অস্ত্রহাতে তুলে নেওয়া এক মহান মুক্তিযোদ্ধার কথা। যেন এক ঝাঁক মুনিয়া পাখি আকাশে উড়ে যাচ্ছে আমার মাথা-মনন ছুঁয়ে। তোমার ভাতিজি ড. নীরু শামসুন্নাহার লাকি পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন করলো সুন্দরভাবে।
মঞ্চের কোথায় তোমার কোন ছবি দিয়ে সাজাবে, আমার অনুমতি নিয়ে সবই ঠিকঠাক মতো সম্পন্ন করেছে ঐ। বুঝতেই পারো, মানসিকভাবে এতটাই ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত ছিলাম যে, আমি আর মানুষ নই যেন, একটা ছায়ার মতো নিঃশব্দে সুতোর এপার ওপার করছিলাম সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে। অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থাপনায় ফারুক এবং অভিন্ন মূল দায়িত্ব পালন করেছে, সঙ্গে আকবর, আসলাম ও সমাজের লোকজন।
শোকের চেহলাম নয়, এ যেন তোমার একক কবিতা পাঠের মহৎ এক অনুষ্ঠান। মঞ্চ ঘিরে তোমার প্রতিকৃতি, রজনীগন্ধার মালায় জড়ানো। শুরু থেকে জীবনের শেষাবধি কত আলোকচিত্রের সমাহার, কত ভালোবাসার লিখন। তোমার কালজয়ী সব পঙ্ক্তি। মুদ্রিত হলো জীবনের জয়গান।
২১ শে পদকপ্রাপ্ত কবি ও মুক্তিযোদ্ধা
রফিক আজাদ —এর
চেহলাম অনুষ্ঠান
তারিখ : ২২শে এপ্রিল ২০১৬
স্থান : গ্রাম— গুণী, থানা : ঘাটাইলজেলা : টাঙ্গাইল, সময় : সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা
কবিরাই তো আসবে, নয়তো কী?
আরশ আলীর মতো মেঘ-ছোঁয়া এক স্বপ্ন বুকে নিয়ে তুমি চলে গেলেও তোমার ভক্ত পাঠকেরা এখনো তোমার সর্বশেষ কবিতাশুনতে অধীর আগ্রহে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করে। সেকি রফিক আজাদ না রফিকুল ইসলাম খান?
কে বড়?
১৯৮৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মাসে যেদিন তুমি ‘শুশ্রূষার হাত’ নামক কবিতার শেষ দু’টি মুদ্রিত চরণে অঙ্গীকার রেখে বলেছিলে…
পিতৃদত্ত নাম ছিল রফিকুল ইসলাম খান, নিজেই উদ্ভূত হলে নিজের ভেতর, রফিক আজাদ। স্মার্ট ও কাব্যসারথি এই নাম তো তোমাকে রক্ষা করতে পারেনি জীবনের বহুবিধ রুঢ় বাস্তবতার দুঃখ-জঞ্জাল থেকে। ‘রফিকুল ইসলাম খান’ নামের কবিতায় তাই প্রিয় বন্ধুদের উদ্দেশে ফুটিয়ে তুলেছ সেই রক্তাক্ত বেদনার দুঃখ নামক আরক্তিম আপেল এক:
এটি কার নাম, বন্ধু, বলো তো বেলাল, রবিউল?
বলো বন্ধু আসাদ, মান্নান, বলো বন্ধু
হায়াৎ সাইফ?—তোমরা কি চেনো এই
লোকটিকে, দেখেছ কোথাও তাকে
তোমাদের কোনো সোনালি বিকেলে
কফি হাউজের গাঢ় অন্ধকারে?
তোমাদের বন্ধু বলে যাকে চেনো সে কি
এই নামে পরিচিত কিংবা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে?
ছিন্নভিন্ন হয়েছ কি হৃদয়ে কখনো তোমরা এই
ভাগ্যাহত, ক্ষুদ্র , নীচাশয়ের মতন?
রক্তাক্ত হৃদয়ে দাঁড়িয়েছ কভু,বন্ধু,নিজ সন্তানের আদালতে?
জন্মদাতা পিতার মতন আসামির ভূমিকায়
কভু, বন্ধুগণ?— তোমাদের
সফল জীবনেও, জানি, বহুতর সমস্যা রয়েছে;
কিন্তু হৃদয় কি এতোটা রক্তাক্ত হয়,
কখনো তোমাদের এই মূর্খের মতন?
‘রফিকুল ইসলাম খান ‘কবিতায় বিধৃত এই দুঃখ-বেদনার অন্য নাম রফিক আজাদ। কবিতায় উল্লিখিত তোমার বন্ধুদের অন্যতম একজন কবি আসাদ চৌধুরী। যিনি খুব উচ্চকণ্ঠে বলতে ভালোবাসেন, ‘রফিক আমাকে কবি বানিয়েছে,বাধ্য করেছে কবিতা লিখতে।’ এমন নিরাভরণ উচ্চারণ আর কারু মুখে আমি শুনিনি। তিনি ছাড়াও এর আগে নির্মলন্দু গুণ, মহাদেব সাহাসহ তোমার গুণী গ্রামের বাড়িতে অনেকেই এসেছে বলে শুনেছি তোমার মুখেই।
ধরে দেই যদি, আসাদ ভাই তোমার প্রতি গভীর ভালোবাসা জানাতে গুণী গাঁয়ে শেষবারের মতো এসেছিলেন, হবেও হয়তো বা তাই। তবে, তার এই আগমনে ব্যক্তিগতভাবে খুব সান্ত্বনা লাভ করেছি আমি। আশ্বস্ত বোধ করেছি বিপুল রিক্ততার সমুখে। তার হাতটি বড় ভাইয়ের মতো ছায়া তুলে ধরেছে আমার মাথায়, বরষার ছত্রের মতো।
সেদিন তিনিই ছিলেন আমার সুশীতল বৈধব্যের নিরক্ত যাত্রা-পথের সাক্ষী। আর এক সাক্ষী হলো তোমার কবিতা। ‘অপঘাত মৃত্যুর আগে’ কবিতায় নিজেই বলেছ যে কথা—কী করে অমান্য করি আমি তোমার সে নির্দেশবাণী। সামান্য ক’টি চরণ তার শোনোই না একবার:
এই নরাধম অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রিয়
পৃথিবীর রূপেরসে মজেছিল গভীর গোপনে—
কেউ তা জানেনি—জেনেছিল কেবল ‘কোমল’ নামে
শ্যামাঙ্গী রমণী এক—তাকে বলো এই মরদেহ
ময়নাতদন্ত শেষ হ’লে মর্গ থেকে সে-ই শুধু
নিয়ে যেতে পারে…
তোমার মরদেহ অথবা মৃত্যু সবই আমি গ্রহণ করেছি সকাতরে। ৫৮ দিন তোমার মৃত্যুশয্যা পাশে থেকে। এমনকি অনন্তে চলে যাওয়ার মুহূর্তটুকুও উপহার দিয়েছ তুমি এই আমাকেই। এই বেদনাবোধ থেকেই সোনালি শিশিরের মতো পান করতে শিখেছি তোমার মৃত্যুসুধারস। ১৯৮৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মাসে যেদিন তুমি ‘শুশ্রূষার হাত’ নামক কবিতার শেষ দু’টি মুদ্রিত চরণে অঙ্গীকার রেখে বলেছিলে,
তোমাকেই শুধু
সমুদ্র-শোষণ করে উপহার দেবো
ভালোবাসা—অমৃতের দুর্লভ কলস॥
সেদিন থেকেই বেহুলার মতো বুঝে গিয়েছিলাম গিরিপথের গন্তব্য আমার কোথায়, কোন্ অতলে টেনে নেবে। নশ্বর দেহে তুমি বেঁচে নেই, অবিনশ্বর শিল্পনিখিলের এই পথে এখনো তুমি এবং তোমার কালজয়ী পঙ্ক্তিমালা আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অভয়াশ্রম।
কবি রফিক আজাদের শেষ ৫৮ দিন এবং ইতঃপূর্ব-৯॥ দিলারা হাফিজ
শেষ