[পর্ব-৯]
জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,
বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে॥
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
যদিও কুতুবমিনার কমপ্লেক্সের কাছে খাজা কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকীর দরগাহ। ইচ্ছা থাকার পরও আমরা যেতে পারলাম না। কারণ এখানে দেরি হয়ে গেলে পরবর্তী স্পটে যাওয়া কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। দিল্লিতে আসার আগে থেকেই আমার মন পড়ে আছে হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায়। এই তুমুল আগ্রহের পেছনে রয়েছে আরও দুজন বিশেষ ব্যক্তি। যারা আমার মানসলোকে ভাবমগ্ন কবিতার প্রদীপ হয়ে জ্বলছেন নিশিদিন। যাদের কাব্যপ্রতিভার দ্যুতি ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। একজন কবি মির্জা গালিব, অন্যজন বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও সুফি কবি হজরত আমির খসরু। শুরু থেকেই হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায় যাওয়ার কথা এত বেশি আগ্রহ নিয়ে বলেছি যে, আমার সঙ্গে থাকা কামরুল ভাই এবং সেঁজুতি বিরক্ত হয়েছেন বৈকি। আগ্রহে পানি ঢেলে কামরুল ভাই ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন ‘লোটাস টেম্পল’ যেতে।
বিকেলের সোনারোদ দিল্লির উঁচু বাড়ি ও গাছগুলোর মাথায় রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে। দালান ও পরিপাটি শহরের দৃশ্য দেখে দেখে আমরা যাচ্ছি এবার ‘লোটাস টেম্পল’ দেখতে। এই স্থাপনা সম্পর্কে আমি তেমন কিছুই জানি না। কামরুল ভাইয়ের মুখ থেকে প্রথম শুনলাম ‘বাহাই সম্প্রদায়’-এর কথা। এটা বাহাই সম্প্রদায়ের মন্দির।
আমরাও উচ্ছ্বসিত আনন্দে মাথা নাড়লাম। তবে এই স্থাপত্যের সৌন্দর্যই শেষ কথা নয়। পরে জেনেছি এর নেপথ্যে আছে ‘বাহাই ধর্মকথা’র আধ্যাত্মিকতা।
আমাদের গাড়ি ‘লোটাস টেম্পল’-এর গেটে গিয়ে থেমেছে। নেমে দেখি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে লোকজন ‘নিম্বু পানি’ পান করছে। আমরাও ‘নিম্বু পানি’ ও পিঠা খেলাম। ‘লোটাস টেম্পল’-এ প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো টিকেটের প্রয়োজন নেই। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে এখানে সবার প্রবেশ উন্মুক্ত। অবারিত সুযোগ থাকায় লোকে লোকারণ্য। প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে যেতেই দেখি একটি আহত কুকুর রাস্তার একপাশে শুয়ে আছে। কিভাবে যেন পা ভেঙে এখন আর হাঁটতে পারছে না। এই দৃশ্য দেখে শোকে কাতর দুজন ইংরেজ তরুণী ঠায় দাঁড়িয়ে। তাদের মন খারাপ। আমরা দেখে দেখে সামনে অগ্রসর হই।
আচমকা গাছের পাতার ফাঁকে চোখ পড়ে আধা-কিলোমিটার দূরের ‘লোটাস টেম্পল’। সে এক অনুপম শান্তিময় দৃশ্য। বহুদিন পর এমন দৃশ্য দেখে মনে যেন প্রশান্তির বৃষ্টি নেমে এলো। অস্তগামী অর্কের নরম রোদ ঠিকরে পড়ছে পদ্মফুলাকৃতির শুভ্র-সফেদ ‘লোটাস টেম্পল’ বা ‘পদ্মমন্দির’-এর গায়ে। দূর থেকে মনে হচ্ছে অপূর্ব স্থাপত্য সৌন্দর্যের চাদর মুড়ি দিয়ে সবুজে ডুবে আছে। মৌনতায় ছড়িয়ে দিচ্ছে একধরনের ধ্যানমগ্ন বার্তা। আমরা দেখতে দেখতে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছি টেম্পলের দিকে। ২১টি পাপড়ি মার্বেল, ইট, বালু ও সিমেন্টের সমন্বয়ে তৈরি। এই অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপত্য মূলত বহুধর্মের মানুষকে ঐক্যের পথে আহ্বান করে। এটি একেশ্বরবাদী ধর্মের উপাসনালয়।
মূল প্রবেশদ্বার থেকে একটি সরু মেঠোপথ সবুজ ঘাসের বুক চিরে মন্দির অভিমুখে চলে গেছে। চারিদিকে সবুজ প্রান্তর ও মাঝারি আকারের সুবিন্যস্ত গাছের সারি। সরু পথের পাশেই আগত পর্যটকদের জন্য আছে বিশুদ্ধ পানীয়জলের ব্যবস্থা। কামরুল ভাই যথারীতি নোটবুক হাতে উপচেপড়া আগ্রহ নিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো টুকে নিচ্ছেন। মাঝে মাঝে ছবিও তুলছেন। আমরা পরস্পর টেম্পল নিয়ে বিমুগ্ধ উচ্ছ্বাসের কথা বলছি। সেঁজুতির বিমুগ্ধ বচন, ‘সবুজ ঘাসের বিস্তারের মাঝখানে পদ্মফুলের সাদা রঙের পাপড়িগুলো অপূর্ব তাই না?’ আমরাও উচ্ছ্বসিত আনন্দে মাথা নাড়লাম। তবে এই স্থাপত্যের সৌন্দর্যই শেষ কথা নয়। পরে জেনেছি এর নেপথ্যে আছে ‘বাহাই ধর্মকথা’র আধ্যাত্মিকতা।
বাহাই ধর্ম বা বাহাই বিশ্বাস হচ্ছে বাহাউল্লাহ প্রতিষ্ঠিত একেশ্বরবাদী একটি ধর্ম বা বিশ্বাস। উনিশ শতকে পারস্যে (বর্তমানে ইরান) এই ধর্মের উৎপত্তি। মূলত মানবজাতির আত্মিক ঐক্য হচ্ছে এই ধর্মের মূল ভিত্তি। বিশ্বে বর্তমানে ২০০-এর বেশি দেশ ও অঞ্চলে এই ধর্মের আনুমানিক প্রায় ৬০ লাখ অনুসারী রয়েছে।
বাহাই বিশ্বাস অনুসারে ধর্মীয় ইতিহাস স্বর্গীয় দূতদের ধারাবাহিক আগমণের মাধ্যমে ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়েছে। এইসব দূতদের প্রত্যেকে তাদের সময়কার মানুষদের সামর্থ্য ও সময় অনুসারে একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই সব স্বর্গীয় দূতদের মাঝে আছেন ইব্রাহিম, গৌতম বুদ্ধ, যিশু, মুহাম্মাদ ও অন্যরা। সেই সঙ্গে খুব সাম্প্রতিককালে বাব ও বাহাউল্লাহ (নভেম্বর ১২, ১৮১৭ মে ২৯, ১৮৯২)।
বাহাই ধর্ম মতে, এসব দূতরা প্রত্যেকেই তাদের পরবর্তী দূত আসার ব্যাপারে, ও তাদের অনুসরণ করতে বলে গেছেন। বাহাউল্লার জীবন ও শিক্ষার মাধ্যমে দূতদের এই ধারা ও পূববর্তী ধর্মগ্রন্থগুলোর অঙ্গীকার সম্পূর্ণ হয়েছে। মানবতা সমষ্টিগত বিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে ধরা হয়েছে। বৈশ্বিক মাপকাঠিতে সার্বিকভাবে শান্তি, সুবিচার ও ঐক্য প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে বর্তমান সময়ের প্রয়োজনীয়তা।
‘বাহাই’ (উচ্চারণ: bəˈhaɪ) শব্দটি একটি বিশেষণ হিসেবে বাহাই বিশ্বাস বা ধর্মকে নির্দেশ করতে বা বাহাউল্লার অনুসারীদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এটি উদ্ভূত হয়েছে আরবি বাহা’ থেকে, যার অর্থ ‘মহিমা’ বা ‘উজ্জ্বলদীপ্তি’। ধর্মটিকে নির্দেশ করতে আগে বাহাইজম বা বাহাইবাদ পরিভাষাটি ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে ধর্মটির সঠিক নাম বাহাই বিশ্বাস।’ (তথ্য সংগৃহীত)
আমরা নিরুপায় হয়ে মূলত ড্রাইভারের ঐকান্তিক ইচ্ছায় সেখানে গেলাম। পরে জেনেছি, ট্যুরিস্ট নিয়ে গেলে ড্রাইভারদের জন্য মার্কেট কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কমিশনের ব্যবস্থা আছে।
মূলত বাহাই এমন একটি ধর্ম যা কি না, সব ধর্মের মানুষকে একত্রে রাখতে চায়। এই টেম্পলে সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে ধর্মচর্চা করতে পারে। বাহাই ধর্মের একটা বিশেষ মাধ্যম হচ্ছে ‘নিবিড় ধ্যানমগ্নতা’। বাহাউল্লাহ জন্মসূত্রে ইরানি হলেও ইসরায়েলে রয়েছে তার সমাধি। সারা পৃথিবীতে এই ধর্মের অনুসারী প্রায় ৬০ লাখ।
অবস্থানগত দিক থেকে ‘লোটাস টেম্পল’ দিল্লির নেহরু প্যালেসের পাশে অবস্থিত। টেম্পলের ভেতরে সুবিশাল ফাঁকা জায়গা আছে। যেখানে ধ্যান করার জন্য পেতে রাখা হয়েছে অসংখ্য বেঞ্চি। একসঙ্গে প্রায় বারো’শ মানুষ এখানে ধ্যান করতে পারেন। প্রত্যেক ধর্মের মানুষ যার যার ধর্ম মেনে এখানে ধ্যান করতে পারেন। এতে কোনো বাধানিষেধ নেই। টেম্পলের সৌন্দর্যে অবগাহন করতে করতে সূর্যমামা কখন যে ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আমরা টের পাইনি। দ্রুত বেরিয়ে এলাম গাড়ির কাছে। এবার অন্য কোথাও যাবো না। গন্তব্য দিল্লির সুপরিচিত বিপণীকেন্দ্র ‘কোনাট প্লেস’।
সন্ধ্যার আগমুহূর্তে বিকেলের শেষ আলোয় আমাদের গাড়ি ছুটছে। আমরা যাচ্ছি এবার দিল্লির বিখ্যাত শপিং জোন ‘কনট প্লেসে’। যদিও যাওয়ার পথে আমাদের ‘ইন্ডিয়া গেট’ দেখার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে ‘কুতুবমিনার’ এবং ‘লোটাস টেম্পল’-এর জাদুকরী সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে আমরা হাতে রাখা সময় খরচ করে ফেলেছি। এদিকে ড্রাইভারের সঙ্গে চুক্তি করা নির্ধারিত ৪ ঘণ্টা শেষ হওয়ার পথে। ড্রাইভারকে বলা হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের আগে যেভাবে সম্ভব আমরা ‘কনট প্লেস’-এ পৌঁছতে চাই। অবশ্য ৪ ঘণ্টা শেষ হতে যতটুকু সময় হাতে আছে। তাতে অনায়াসে ‘কনট প্লেস’-এ যাওয়া সম্ভব।
গাড়ির ড্রাইভার আরও ২ ঘণ্টা সময় বাড়িয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আমরা সময় বাড়াতে চাই না। কিছুদূর গিয়ে ড্রাইভার নতুন সুর ধরলেন। আমাদের নিয়ে একটি বিশেষ শপিংমলে যাবেন। যেটি যাওয়ার পথেই পড়বে। আমরা কিছুতেই সেখানে যেতে আগ্রহী নই। সেখানে গেলে চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত ৪ ঘণ্টা ফুরিয়ে যাবে। এতে আমাদের টাকার পরিমাণও বেড়ে যাবে। কিন্তু ড্রাইভার নাছোড়বান্দা। আমাদের নিয়ে যাবেন এই যেন তার প্রতিজ্ঞা। এতে করে যদি নির্দিষ্ট ৪ ঘণ্টা শেষ হয়েও যায়। তিনি বাড়তি টাকা নেবেন না। আমরা নিরুপায় হয়ে মূলত ড্রাইভারের ঐকান্তিক ইচ্ছায় সেখানে গেলাম। পরে জেনেছি, ট্যুরিস্ট নিয়ে গেলে ড্রাইভারদের জন্য মার্কেট কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কমিশনের ব্যবস্থা আছে। এটাই ড্রাইভারের অবিচল প্রতিজ্ঞার মূল কারণ।
চলবে…