॥পর্ব-৫॥
‘যে যায় সে দীর্ঘ যায়’—কবিতাটি এক দীর্ঘতম দূরত্ব অতিক্রম করার গল্প। অদ্ভুত কোনো এক বাঁধনে দারুণ প্রেমে নিদারুণ শাসনে দুঃসহ বিরহে প্রজ্বলিত ঐশ্বর্যে এবং বিস্তৃত ও দুরূহ দৈন্যে দীর্ঘ, দীর্ঘ যে জীবনের স্থিতি, যে জীবনের স্তূতি আর তারপর বিষণ্ন নির্মোহ এক নিবিঢ় বিচ্ছেদী দীর্ঘতর জীবন এ কবিতাটি ঠিক তার এক অদ্ভুত রূপায়ণ। অদ্ভুত বলছি এ কারণে যে, ঠিক এভাবে বিরহ, এভাবে একাকীত্ব, এভাবে জীবন আর মৃত্যুর সংলগ্ন সময় এবং অবসানকে লেখা হয়নি তার অন্য কোনো কবিতায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরই অন্য আরও অনেক কবিতায় বিরহ কিংবা একাকিত্বের, বিয়োগের কিংবা ব্যথার দারুণ দারুণ সব মনোসংলগ্ন আবেদন রয়েছে। কিন্তু এ কবিতার বর্ণনা অন্যরকম। অন্য আমেজ। অন্য ধারায়। আজ যদিও বা এমন গুছিয়ে বলা সম্ভব হচ্ছে, তখন কিন্তু অতটা সহজ ছিল না। যখন এ কবিতাটি আমি মঞ্চে আবৃত্তি করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে থাকি, তখন বয়স বড়জোর ২২। কবিতাটি বোঝার জন্য সেই বয়স আদৌ সক্ষম নয়, এখন বুঝতে পারি সেটা। কিন্তু তখন সেই বোধটাও ছিল না। ‘পদ্য বাউল’ প্রযোজনাটির গ্রন্থনাকার ইশরাত নিশাত কিংবা পরিচালক আবৃত্তিকার মাসুদুজ্জামান—দুজনের কেউ একজন ঠিক করেছিলেন আমাকে দিয়ে কবিতাটি পড়াবেন। আমার হাস্কি ভয়েজ কতটা যাবে এর সঙ্গে, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি সেই প্রত্যুষে, এটা ঠিক। কিন্তু কবিতাটি আমার ভালো লেগে যায়। কবিতাটি পড়লেই বোঝা যাবে, এখানে ভালো লাগার কিছু নেই। ‘যম’ কবিতাটিতে যে অসাধারণ এক রহস্য গভীর দীর্ঘ আর ক্ষিপ্র শব্দগুলো কেবলই জটাজট খোলার হাতছানি দেয়, এখানে তেমন নয়। খুব সাধারণ শব্দ। সাধারণ ভাষা। সহজ বাক্য। প্রত্যন্ত ভাষাভঙ্গি। খুব একটা উপমা নেই। নেই তেমন বিস্তৃত কোনো চিত্রকল্পও। ভিজু্য়ালাইজ করার মতো তেমন বিশদ ব্যাখ্যাও নেই কোথাও। আপতদৃষ্টে মনে হয়—নেই কোনো প্রেম কিংবা বিরহ, যা সাধারণকে আকৃষ্ট করবে। তবু কেন যে একজন দীর্ঘ লোক আমাকে ক্রমাগত আকৃষ্ট করে। কে সে দীর্ঘ লোক! তার দৈর্ঘ্যেরও পরিমাপ আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে ক্রমাগত। আমি সাধারণত ভালো না লাগলে কোনো কবিতা বিনির্মাণ করি না। সে আমার নিজের জন্য হোক কিংবা মঞ্চে আবৃত্তি করার জন্য হোক। যখনই ভাবছি কবিতাটি আমি আবৃত্তি করবো। প্রথম চার থেকে দশবার পড়ার পর একটা বিষয়ই মাথায় প্রখরতর গভীরতায় ঢুকে যেতে থাকে। এই চমকবিহীন শব্দে শব্দে স্রোতাকে কতটা ধরে রাখা সম্ভব। কোথায় করবো কাজ! কোথায় লুকোনো রয়েছে এর প্রাণ। দুরূহ, কঠিন এক সংকটের মুখোমুখি হতে হয় তখন আমাকে। প্রথম দুটো লাইনে কেবল এক দৃশ্যকল্প। আর সেটাই আমাকে প্রলুব্ধ করতে থাকে। পড়তে থাকি, পড়তেই থাকি, পড়তেই থাকি। জীবন ও মৃত্যুর দৈর্ঘ্যে একজন মানুষ খুঁজে পাই সেদিন। তাকেই তুলে আনতে চেষ্টা করি প্রাণপণে। বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের ৫০৯ নম্বর রুমের সব রুমমেট যখন রুমের বাইরে, তখন আয়নার সামনে দাঁড়াই। ২০ বারের মতো পড়ার পর কবিতার প্রথম ৪টি লাইন এমনিই মুখস্ত হয়ে যায়। আর বলতে থাকি—‘একজন দীর্ঘ লোক…একজ…ন দী…র্ঘ লোক। একজন…দীর্ঘ লোক। কোন জায়গা থেকে উচ্চারণ করবো প্রথম শব্দ, কী প্রজেকশন হবে এর, এত গভীর এত ব্যপক শব্দটি উচ্চারণ করতে গিয়ে কোনোভাবেই নিজের কানে ভালো লাগে না। বুঝতে পারি না কী সব হচ্ছে। তারপর হঠাৎ খুব জেঁকে বসে যায় প্রখরতর গভীরতায়। ঠিক করি কবিতাটি ঠিক যেমন প্রাত্যহিক জীবনের সাধারণ শব্দে লেখা, ঠিক তেমনি খুব সাধারণ হবে এর প্রথম উচ্চারণ:
একজন দীর্ঘ লোক সামনে থেকে চলে গেল দূরে
দিগন্তের দিকে মুখ, পিছনে প্রসিদ্ধ বটচ্ছায়া
মানুষের বয়স হয়। জীবনের ভার কমে আসে। নিজেরই দেহের ভার তখন পর্যাপ্ত মনে হয়। সম্পর্কগুলো আলগা হয়, দূর দূর হয় সব যখন, সেই সময়ের এক করুণ চিত্র এখানে। যখন কেবল মৃত্যুরই অপেক্ষা। যাপিত জীবনের বেঁচে থাকার স্বপ্ন বোনা হয় কতশত। এই স্বপ্নই জ্বালিয়ে রাখে আলো। নিয়ে চলে সামনে। তারপর স্বপ্নের অবসান। জীবনের অবসান। একটা স্থির নির্দিষ্ট প্রশস্ত বাসস্থান। যেন গাছের এক গভীর শেকড়ে বসে থাকে মানুষ। সেখানে এক গভীর নীরবতা। একাকী। নিঃসঙ্গ। নিঃশঙ্ক চিত্ত। এখানে আর কোনো স্বপ্ন নেই। কোনো প্রত্যাশার হাতছানি নেই। সব ধুলো, সব মায়া। নিশ্চল সেই জীবনই মানুষের চিরকালের বর্তমান। সেই মৃত্যু পরের ছায়াছবি যা তার অসংখ্য কবিতায় নানাভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। এখানেও সেই একই কথা। ভিন্ন আঙ্গিকে আর একেবারে বিপ্রতীপ ধারায়।
বিষয়ের ব্যাখ্যায় আজ কমই যেতে চাই বরং কবিতাটির বিনির্মাণের প্রসঙ্গেই বেশি থাকতে চাই। পরিচালক বিনির্মাণের কঠিন এক ধ্যানের মধ্যে এখানে এনে দাঁড় করালেন আমাকেসহ ‘পদ্য বাউল’ প্রযোজনার সবাইকে। সাধারণত আমাদের নানা পঙ্ক্তি নানাভাবে পড়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো অন্য সব প্রযোজনায়। কিন্তু এখানে তা নয়। প্রত্যেকের পড়ার ভঙ্গি নিজে নিজে খুঁজে বের করতে হবে। তাই এখানেই সবচেয়ে শ্রমসাধ্য কাজগুলো করতে হলো। একটিই কবিতা শত শতবার পড়েছি তখন। এরপর সহজ হয়ে এলো জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানের পরিমাপটি। যে হ্রস্ব একটি ধারায় শুরু হয় তারপর চলতে চলতে দিগন্তের কাছাকাছি পরন্ত সূর্যের বয়সী হয়ে ওঠে জীবনের দৈর্ঘ্য, সে জীবনেরই গল্প এখানে। এখানে আমার গল্প, এখানে আমার বাবার গল্প, এখানে আমার দাদা এবং পূর্বাপর সমগ্র মানব জীবনের শুরু আর শেষের কাহিনি কেবল নয়, শেকড় মানুষ ও মহিষ—কেবল এ তিনটি শব্দের মধ্যে দিয়েই সমস্ত প্রাণী জগতের বিপুল এক জীবন প্রবাহের স্রোতটিকে দুটি মাত্র পঙ্ক্তিতে বিন্যস্ত করতে দারুণভাবে সমর্থ হয়েছেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, এটা আমার মত। কারণ ওই বয়সে অন্তত এটুকু আমি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলাম। আর বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে এর বিনির্মাণ ও উপস্থাপন আমার কাছে সহজতর হয়ে উঠেছিল।
আজকের কথা যদি বলি—বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বোধের ব্যাপ্তি অসীমে চলে। তখন ধীরে ধীরে খুলে যায় অনেক অনেক অস্পষ্টতার দেয়াল। তাই আজ এত বছর পরেও যখন কবিতাটি পড়তে বসি, তখনো সেই কবিতাটি অদ্ভুত এক মাদকতা তৈরি করে, যা কেবল আমিই এই লেখা লিখতে বসে অনুধাবন করতে পারছি। আমার কাছে মনে হয়, এই হলো আবৃত্তির জন্য বিনির্মাণযোগ্য কবিতার সক্ষমতা। সব কবিতা আবৃত্তির যোগ্য নয় যেমন, তেমনি সব আবৃত্তিও কবিতার যোগ্যতাকে ধারণ করতে পারে না। কোনো কোনো আবৃত্তিও কবিতার যোগ্যতাকে হরণ করে—আমি এ-ও মানি। কিন্তু আজ জীবনের জটিল গভীর প্রখর-ক্ষরণ-দহন একাকিত্ব আর যাতনার সফল যাপনের পর কবিতাটিকে আমার এতটাই সহজবোধ্য মনে হয়, যেমন ভোরবেলায় ঘর থেকে বাইরে পা ফেললেই শিশিরে ভিজে যায় পা; যদিও তখনো কবিতাটির মঞ্চায়নে শ্রোতাভর্তি অডিটরিয়মে ছিল পিনপতন নিস্তব্ধতা। পরবর্তী সময়ে স্রোত আবৃত্তি সংসদের আর এক আবৃত্তিকার সানজিদা সোহেলীও কবিতাটি পড়েছিলেন। তার আবৃত্তিও যথারীতি শ্রোতার কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিল। পরবর্তী সময়ে ইন্ডিয়ান হাই কমিশনের আমন্ত্রণে ‘পদ্য বাউল’ প্রযোজনার কিছু অংশ আমরা মঞ্চস্থ করেছিলাম।
একজন দীর্ঘ লোক সামনে থেকে চলে গেল দূরে—
দিগন্তের দিকে মুখ, পিছনে প্রসিদ্ধ বটচ্ছায়া
কে জানে কোথায় যাবে—কোথা থেকে এসেছে দৈবাৎ-ই
এসেছে বলেই গেলো, না এলে যেতো না দূরে আজ!
সমস্ত মানুষ, শুধু আসে বলে, যেতে চায় ফিরে।
মানুষের মধ্যে আলো, মানুষেরই ভূমধ্য তিমিরে লুকোতে চেয়েছে বলে
আরও দীপ্যমান হয়ে ওঠে—আশা দেয়, ভাষা দেয়, অধিকন্তু, স্বপ্ন দেয় ঘোরযে যায় সে দীর্ঘ যায়,
থাকা মানে সীমাবদ্ধ থাকা
একটা উদাত্ত মাঠে, শিকড়ে কি বসেছে মানুষ-ই?
তখন নিশ্চিত একা, তার থাকা-তার বর্তমানে,
স্বপ্নহীন, ঘুমহীন-ধুলাধুম তাকে নাহি টানে।একজন দীর্ঘ লোক সামনে থেকে চলে গেলো দূরে—
এভাবেই যেতে হয়, যেতে পারে মানুষ, মহিষ!
চলবে…
কবিতার ডিসেকশন: নির্মাণ-৪॥ শাপলা সপর্যিতা