॥পর্ব-চার॥
আহা শক্তি—আহা সেই সব দিন। এতকাল পরে নতুন করে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে পড়তে পড়তে আমি বারবার ফিরে যাচ্ছি সেদিনের শক্তিতাড়িত দিনরাতগুলোয়। এ কেবল কবিতাকে আবৃত্তিযোগ্য নির্মাণ ছিল না। ছিল সে এক অনন্য অসাধারণ দিনযাপনও। একের বেদনা অন্যে ধারণ—একজনের ভালোবাসা, তার প্রেম, তার ঘৃণা, তার ক্রোধ, তার যাতনা, বিশ্বাস আর বিশেষের সঙ্গে বসবাস তখন আমাদের প্রত্যেকের। লিখতে বসে আরও আরও নস্টালজিক সব। এখনো এই মুহূর্ত, যখন লিখতে বসেছি, সেসব দিন আর রাত তখন ভীষণ নেশাসক্ত আমি, বিষণ্ন আচ্ছন্নতার এক ঘোর। সময়ের হিসাবের একেবারে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। কৈশোর উত্তীর্ণ যৌবন—সময় বিগত ২১ বছরে। তাই তো জীবন জীবন পার করেও অন্য আর কোনো নেশায় আজও আসক্ত হতে পারিনি। কবিতার নেশা, কবির নেশা—এই এক দারুণ-মরণ নেশা। মারাত্মক তার আগ্রাসন। আমি এই একটা জীবন পার করেছি সেই নেশায়। তখন প্রায় সবাই আমরা ছাত্র। সকাল দশটায় রিহার্সেল শুরু হতো। চলতো দিনব্যাপী। মাঝে খাবার বিরতিতে কাছাকাছি থাকে যারা, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে চলে যেত তারা দুপুরের খাবার খেতে। কখনো দল বেঁধে সবাই যেতাম হোটেল নীরবে ভাত খেতে। কখনো দুপুরে নীলক্ষেত থেকে আনিয়ে নেওয়া হতো বিরানি-তেহারি। শেষ হতে হতে কখনো বিকেল পাঁচটা, কখনো সন্ধ্যে সাতটাও বেজে যেতো। তারপরও কি আর শেষ হয়?
স্বপন মামার দোকানে চায়ের আড্ডায় থাকতেন শিমুল মুস্তাফা, হাসান আরিফ, আহকাম উল্লাহ, মাহিদুল ইসলাম। কখনো থাকতেন গোলাম কুদ্দুস। আবার কখনো সদলবলে উপস্থিত হতেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী হলগুলোয় সানসেট ল মুভমেন্ট কাগজেপত্রে না হলেও কাজে কাজে প্রায় সফল। ছাত্রীরা তখন কাজ না থাকলেও রাত সাড়ে আটটা-ন’টা অবধি হলের বাইরে গেটের সামনে সময় কাটাচ্ছে।আমাকে আর কে পায় তখন! আমার জন্য খুব সহজ হলো দলের সঙ্গে কাজ করা। আমি পড়ে থাকি টিএসসিতে। ‘পদ্য বাউল’ এই প্রযোজনাটিতে অংশ গ্রহণ করতে হলে প্রথম যোগ্যতা হিসেবে শর্ত ছিল রিহার্সেল দশটায়, মানে দশটায়ই উপস্থিত থাকতে হবে। রাস্তায় জ্যাম, ভাইয়ের বিয়ে, বোনের বাজার, গার্জিয়ানের নিষেধ—এসব যার যার থাকবে, তারা এই প্রযোজনাতে অংশ নিতে পারবে না। সব শর্ত মেনে নিয়ে শুরু করি আমরা ক’জন। শুরু হলো মাসব্যাপী শক্তির ধ্যান, সাধনযোগের অনুষঙ্গে তখন অধরা শক্তি চট্টোপাধ্যায়। কোনো এক অজানা কারণে এই প্রোযোজনায় কাজ করলেন না তখনকার স্রোত আবৃত্তি সংসদের তুখোড় দুই আবৃত্তিকার মাহিদুল ইসলাম ও শান্তা শ্রাবণী। তাদের ছাড়াই একটি অসাধারণ সফল প্রযোজনা হিসেবে বেশ কয়েকবারের পর মঞ্চে উপস্থাপন বন্ধ হয়ে যায় ‘পদ্যবাউল’। আজ যেটি নিয়ে লিখব, সে কবিতাটির নাম ‘যম’। পড়তেন আবৃত্তিকার মাসুদুজ্জামান।
কবিতার শুরুতেই এক ব্যাপক তুমুল বিধ্বংসী আর অশ্রুত আঘাত। আঘাত বোধের, আঘাত বোঝার-সক্ষমতার। আঘাত শব্দের কাঠিন্যের। আঘাত বাকভঙ্গির তীর্যক সফল প্রয়োগের। এত বেশি অশ্রুত আর এত এত দুর্বোধ্য শব্দের প্রয়োগ করেছেন এই কবিতাটিতে শক্তি চট্টোপাধ্যায়—ধরে ধরে অর্থ বের করে পড়তে হতো। অন্তত আমার তাই করতে হয়েছে। আমরা কবিতার বিশ্লেষণে যেতাম। কবির মানসিক অবস্থা জানার-বোঝার পরিশ্রমে যেতাম, একেকটি কবিতার আবৃত্তিযোগ্য নির্মাণের জন্য। মাসুদ ভাই ভেতরে ভেতরে কী করেছিলেন, কিভাবে গেঁথেছিলেন কবিতাটির নির্মাণের গাঁথুনী, তা তিনিই জানেন। তবে এটুকু এখনো মনে আছে, আবৃত্তিকার হিসেবে তাকে কখনো গলা ফাটাতে দেখিনি। স্টেজে তাকে যতনা শুনেছি, তারচেয়ে বেশি শুনেছি অনাড়ম্বর একা নীরবে দুজনে। খুব কন্ট্রোল্ড থাকতো তার ভয়েজ—যেকোনো কবিতার আবৃত্তিতে। তিনি কবিতার শব্দের ওপর জোর দিতেন। যেখানে যেভাবে ইমফেসিস করার দরকার, সেখানে সেভাবেই থাকতো তার প্রজেকশন। বোধের প্রকাশে ভীষণ সেনসেটিভলি গেইম খেলতেন তিনি। আমার আজও মনে পড়ে তার কণ্ঠ—‘বিপ্রকর্ষ তমোময় তোমার অভিধা/ সুজন দুর্জন বৃক্ষে তুমিই পরম/ অগ্রদানী নামরূপ লোকায়তে যম।’
আমাদের সবসময় যেকোনো কবিতা পাঠের ক্ষেত্রেই প্রথম উদ্দেশ্য থাকতো স্টেজে মাইক্রোফোনে প্রথম উচ্চারিত শব্দ কিংবা বাক্য কানে যাওয়া মাত্রই শ্রোতা সে কবিতাটি শুনতে বাধ্য হবে, বসে পড়বে পুরোটা শুনবে বলে। যতই শুনি তখন যম কবিতার পাঠ, বুঝি না, বুঝিনা। কিছুই বুঝি না। শব্দ-বাক্য-ভাষা বর্ণনা—সব এতটাই কঠিন! খুব ধীরে স্পষ্ট হয় আমার কাছে দূরবর্তী কোনো এক মানুষের মুখ। অন্ধাকারাচ্ছন্ন তার মায়া। ছায়া ছায়া তার রূপ—সংলগ্ন কী অসংলগ্ন বোঝা যায় না খুব একটা। ধ্যানমগ্ন কোনো এক উপাসকের মতোই বিরাজিত। তবু সে এক সর্বগ্রাসী বিনাশী হন্তারক, ধর্মরাজ। কোন ধর্ম? কোন প্রেম? মানব? মানবের শরীর? খুব ছায়াচ্ছন্ন এখানে প্রেম আর ধর্ম, ধর্ম আর মনুষ, খুব কঠিন বাতাবরণে গুপ্তপ্রেম এখানে। লুকায়িত মানব-মানবীর জৈবিক সম্পর্ক। বিকাশ হতে হতে যেন বুজে আসে গাছের পাতার বিশদ। তবু এখানে দেখি, তেমন একজন মানুষের মুখ, যিনি অপ্রকাশ্য। বেদনায় বেদনায় নীল। যিনি ভালোবাসার মতো; তবু তিনি অন্ধকারের আবরণে অবগুণ্ঠিত। দূরবর্তী তার নাম। বিধাতার মতো। প্রাণে বিহার করেন যে পরম প্রিয়, তেমনি শান্ত সমাহিত রূপে একদিন জড়ে প্রাণ করেছেন সঞ্চারিত। কৃষ্ণের মতো দুই হাতে ধরে বাজিয়েছেন আড়বাঁশি। শরীরকে করে তুলেছেন তরঙ্গায়িত সাপের আকার। স্থির নিশ্চলকে যিনি করে তুলেছেন দুরন্ত কোনো এক প্রাণ। রক্তে তুলেছেন উন্মাদনা। স্রোতে ভেসে গেছে মোহ-প্রেম-কাম—সব। আর তারপর প্রথম স্বাদ, অমৃতের মতো অসংযমী অনির্ণিত প্রেম রস সুধা—সত্যিকার অর্থে প্রেম, ধর্ম আর মানব মানবীর মনোজৈবিক সম্পর্কের অসাধারণ এক প্রচ্ছায়া নিয়ে খেলেছেন এখানে শক্তি চট্টোপাধ্যায়। মানুষের শরীরকে তুলে এনেছেন নদীর রূপে সমুদ্রের দিকে ধাবমান যার স্রোত, অবশেষে স্খলিত সুধা—‘প্রাণব্রজা শান্ত ব’লে তুমিই একদা/জড়ের বিশ্রামবাহ, দুই হাতে সদা/দুর্জয় প্রেমের বেণু বাজিয়ে সশ্রম,/জীবনের নদবাহে সমুদ্রে প্রথম/অসংসারী স্বাদ দাও অপ্রমিত সুধা।’
‘আবার নদী মাত্রই সুশীতল জল, জলরাশি’
দূরতম সেই মানুষকে ছাড়া চলেও না আবার। তবু তিনি যম। তিনি বিনাশী। তিনি বিন্যাসী। যত যত নাম, যত যত সম্পর্ক, তার কিছু বন্ধু, কিছু সুজন, কিছু শত্রু। তারই মাঝে তবু তিনিই পরম। তিনি কি বন্ধু? তিনিই কি শত্রু? তিনি কি প্রেমিক? তিনি কি সন্ন্যাসী, তিনি কি ব্রাহ্মণ! অথবা রাধা কিংবা কৃষ্ণ! এই এক গভীর জটাজাল।
শেষ ছয় লাইনে এসে সরে যেতে থাকে অবগুণ্ঠন। এতটা কবিতা পরিভ্রমণ করে যাকে মানব অথবা মানবী ভেবেছি, এখানে এসে স্পষ্ট হয় তার মর্ত্যশরীর। মূর্ত হয় তার বাহ্যিক প্রকাশ। প্রকাশিত হয় তার নারী ব্যক্তিত্ব। এখানে এসে গীত হয় তার গুণগান, এতক্ষণ ধরে অস্বচ্ছ যে কায়ার প্রতি তীব্র বিস্বাদ কিংবা অভিযোগ; এখানে এসে তা পরিণতি পায় অনুযোগে। তিনি এক অনন্যা। তিনি এক নর্মদা। নর্মদা শব্দটি এখানে খুব সচেতনভাবে প্রচণ্ড স্পর্শকাতরতার সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। আমার তাই মত। মধ্যভারতের পঞ্চম দীর্ঘতম নদের নাম নর্মদা। নদী মাত্রই স্রোতস্বিনী। নদী মাত্রই তাণ্ডবলীলায় পারঙ্গম। আবার নদী মাত্রই সুশীতল জল, জলরাশি। আবার নর্মদার আর এক অর্থ সুখপ্রদায়িনী। তাই এখানে অনুযোগ আর ভালোবাসা দুটো বিষয়ে দারুণ এক মিথস্ক্রিয়া তৈরি করেছেন নর্মদা শব্দটি দিয়ে—যে নদী সুখ দেয়। বিষয়টি একেবারে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের কামপ্রেমের প্রকাশেরেই ধারঘেঁষা।
সাহিত্যে একটা বিষয় রয়েছে ‘কাকু বক্রোক্তি’। যা বলতে চায়, তা না বলে ভিন্ন শব্দ কখনো কখনো বিপরীত শব্দ প্রয়োগ করে একটা অর্থ প্রকাশ করা। যম কবিতাটির বেশ কিছু অংশে আমি এমন ভাবের বৈচিত্র্য দেখেছি। যা-ই হোক, দিনে যে সুখ দেয়, সন্ধ্যায় সে অসাধারণ সুন্দরী নারীরূপে বিরাজে। বাহ্যে সুস্থ পরিশীলিত, পৃথিবীর মতো উদ্বাহু অথচ পুড়ে পুড়ে খাক দেহ। তেমনই এক যম এ্ই নারী। প্রেম আর কামের সুযোগ্য এক শব্দ এখানে ‘যম’। অনুযোগে ভরপুর। পুরো কবিতাটিতে এত যে মিস্ট্রি, এত যে রহস্য, তার জটাজাল খুলে পড়ে যায় যেন এখানে এসে—‘কখনো দক্ষিণ নয় সে সুখের রঙ।’
এক বিমূর্ত আবছায়ায় ঢাকা গভীর মনোদৈহিক প্রেমের অসাধারণ এক চিত্রকল্প রয়েছে কবিতাটির কিছু পঙ্ক্তিতে। কিছু শব্দে কিছু উপমায়। সঙ্গে আছে এই প্রেমের মায়ায় কোথাও এক গভীর বিষাদ। লেখা নেই সে বিষাদের রূপ। নেই বলা কোনো অভিযোগ। খুব বড় নয়, নাতিদীর্ঘ একটি কবিতা। কিন্তু বিষয় আর তার প্রকাশের গুঢ় শব্দের কারণে খুব ভারবাহী হয়ে উঠেছে কবিতাটি অন্তরালে প্রবাহিত প্রেমেরই মতো। রহস্যময় এক দুঃখী প্রেমের অন্তর্গত বোধের ব্যাপ্তিতে কবিতাটি পড়তে পড়তে কেবলই যেন মাটির কোনো এক গভীর অন্ধকারের ভেতর থেকে উঠে আসতে থাকে জল, উথলে উঠতে থাকে জীবন-জগৎ-সংসার ছাপিয়ে। বেজে উঠতে থাকে বিরহী বাতাসের কান্নার সুর।
কবিতাটি আবৃত্তিকার মাসুদুজ্জামান পড়তেন মন্দ্রস্বরে। শব্দ প্রক্ষেপণে এতটা স্পষ্টতা আর এতটা গভীরতা আমি খুব কম দেখেছি। অনেক আবৃত্তিকারকে শুনেছি চিৎকার করতে শব্দে শব্দে। ভরাট কণ্ঠে কানে মনে দোলা দিতে দিতে কত আবৃত্তিকার যে কবিতার বারোটা বাজিয়েছেন, তাও দেখেছি কত কতবার। কিন্তু প্রতিটা শব্দকে আত্মস্থ করে বোধের গভীরতায় জারিত করে অসীম ভালোবাসায় অসাধারণ আবেগের কারুকাজে নির্মিত হয়েছিল এক ক্ল্যাসিক আবৃত্তি—‘যম’।
বিপ্রকর্ষ তমোময় তোমার অভিধা
সুজন দুর্জন বৃক্ষে তুমিই পরম
অগ্রদানী নামরূপ লোকায়তে যম
প্রাণব্রজা শান্ত ব’লে তুমিই একদা।
জড়ের বিশ্রামবাহ, দুই হাতে সদা
দুর্জয় প্রেমের বেণু বাজিয়ে সশ্রম,
জীবনের নদবাহে সমুদ্রে প্রথম
অসংসারী স্বাদ দাও অপ্রমিত সুধা।সে নারীকে যম বলি, দিনের নর্মদা
সন্ধ্যায় অহল্যা হয়, স্বর অনুত্তম,
কখনো দক্ষিণ নয় সে সুখের রঙ
অথচ সুভদ্র পর্ণে স্বস্থ, হে বসুধা
যৌবন সহসা অঙ্গে জ্বলে জ্বলে সোম
নির্লজ্জ নির্মল দেহ বিভার সায়ং।
(যম: শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
চলবে…
কবিতার ডিসেকশন: নির্মাণ-৩ ॥ শাপলা সপর্যিতা
কবিতার ডিসেকশন: নির্মাণ-২ ॥ শাপলা সপর্যিতা
কবিতার ডিসেকশন: নির্মাণ-১ ॥ শাপলা সপর্যিতা