এক.
অপরূপা সেই মেয়ের মুখের দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রয়েছি কতদিন। কিন্তু কণ্ঠ তার আমার চেয়েও হাস্কি অথবা হার্স, যাই বলি না কেন, ওর কণ্ঠেও কবিতা! অ্যাবসার্ট। আমি এটিই ভাবতাম। কিন্তু মাসুদ ভাই নাছোড় বান্দা। তিনি কবিতা তুলবেনই তার কণ্ঠে।তার ওপর আবার সেটা শক্তির। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তখন সদ্যপ্রয়াত। এদিকে আমরা বসেছি, সেই কবিতা পাগল কবিকে নিয়ে বিশাল প্রোডাকশন করবো বলে। ব্যাপক তার সাধনা। খ্যাতিমান নাট্যব্যক্তিত্ব ইশরাত নিশাতের গ্রন্থিত পাণ্ডুলিপি নিয়ে বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী মাসুদুজ্জামানের বিশাল কর্মযজ্ঞ সেটা। নাম ‘পদ্যবাউল’। যার কথা বলছিলাম, সে শারমিন। তখনো স্রোত আবৃত্তি সংসদের সবচেয়ে কম আবৃত্তি করা মেয়েটি। ঝরঝরে হাসিতে মাতিয়ে রাখে। ঢলোঢলো মুখখানি রূপের আতিশয্যে ভরপুর। কিন্তু কবিতা পড়তে গিয়ে দারুণ আড়ষ্ট। আজও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই অমোঘ কবিতা পড়তে গেলে যার কণ্ঠ এখনো গভীর বিষাদে মনে পড়ে সে শারমিন মুস্তাফা। তারই কণ্ঠে এই অসম্ভব যেদিন সম্ভব হলো, সেদিন নির্মিত হলো এক অসাধারণ প্রেজেন্টেশন, মুগ্ধশ্রবণ কবিতা ‘একা’।
সেই রূপ ছলছল মেয়েটি যখন রিহার্সেলে বসতো, তখন তার কণ্ঠ গম্ভীর। মেঘের মতো ঘন কালো আর নির্বাক তার দুঃখ। আমরা তখন বসেছি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে। কবিতার নির্মাণ আর আবৃত্তির প্রোডাকশন তো নয়, এ যেন বাংলা সাহিত্যের অনার্স কিংবা মাস্টার্সের ক্লাস। দিনব্যাপী চলমান আমরা কজনে মিলে। সকাল দুপুর গড়িয়ে কখনো সন্ধ্যাও লাগো-লাগো। পড়ে চলেছি একাগ্র নিবিষ্ট ‘শক্তি’। শক্তির ব্যক্তিজীবন। কবিতার ভাবনা। একেকটি কবিতার উন্মুল গ্রন্থিল পেশী প্রতিটি কোষ আমাদের পাঠযোগ্য তখন। কবিকে না বুঝলে কবিতা বোঝা যায় কেমনে? কবিকে না জানলে তার কবিতার পাঠ হয় কী করে? কবিকে না জানলে একজনম জানা যায় কী করে! একজন মানুষ কেমন করে কবি হয়ে ওঠেন তার পাঠ ব্যবচ্ছেদ ইট-কাঠ-পাথর-সিমেন্ট, তারপরই তো একটি কবিতার আবৃত্তিযোগ্য নির্মাণ। তিনি একজন মানুষ। চলেছেন শাশ্বত। তিনি এখন। তিনি তখন। তিনি বর্তমান। তিনি ভবিষ্যৎ। তিনি জীবিত। তিনি মৃত। তার মনোভূমি রামের জন্মস্থান অযোদ্ধার চেয়েও সত্য—আমি জেনেছি কালে-কালে কাজে-কাজে পড়তে-পড়তে। একজন মানুষ শুয়ে রয়েছেন অতল ভবিষ্যতে। নির্বিকার নির্জীব নিঃশঙ্কচিত্ত নিবিঢ় নিথর। আজ বসে ভাবছেন তিনি কালকের কথা। হিন্দু হয়ে ভাবছেন মুসলিমের কথা। চিতায় পুড়ে খাক হতে হতে তিনি ঘুমিয়ে পড়ছেন কবরের নিঝুম অন্ধকারে। আর নিরলে শুয়ে শুয়ে ভাবছেন একা নিঃসঙ্গ প্রহর। ঠিক মৃত একজন মানুষের মতন পার্থিব জীবনেও কখনো গভীর একাকিত্ব জড়িয়ে ধরে পরম প্রেমে। জনমের বিষাদে। জন্মান্তরের দহনে। আর তখন কেবল এক আশ্রয় কবিতা। না হলে এমন গভীরতায় উচ্চারিত হয়?
তোমাদের ছেড়ে এসে অ-মূল বৈরাগে
একা লাগে ভারী একা লাগে
এ যেন এক বিপুল বিষাদ। নিরন্তর যাতনা। এ এক দূর। ভীষণ এক নিকট। জনবহুল পথ কলরবে-কাকলিতে মুখর প্রভাত সৌরোজ্জ্বল দুপুর আর বিষাদ রাত্রির থেকে দূর। এ বিরাগ বাধ্যতামূলক। এ বিষাদ প্রস্তুতিহীন। এ বৈরাগ ইচ্ছার নয়। এত এত নৈকট্য আহ্বান পেছনে ফেলে এ বড় দূর। ঠিক এমনই এত বিষাদে এত বিনাশের আর এত বিন্যাসের মায়ায় নির্মিত কবিতাটি। এই কবিতার বোধ জন্মান্তরের মতো লাগে। আমাকে রিলেট করে এই কবিতা জীবন আর মুত্যুর মাঝখানে। বেঁচে থেকেও মৃতের কানে শোনা দুরন্ত জীবন। মরে গিয়েও জীবিতের চোখে দেখা খুব প্রিয়তর আঙিনা, খোকা কিংবা ঘাসপোকা। বেভুলে মনে পড়ে যায় দুরন্ত কালো মেঘ। কিন্তু নেই সেখানে জীবিতের কিংবা জীবের উদ্বেগ। মৃত্যু আর জীবনের মাঝখান এটি। মৃত আর জীবিতের এ যেন এক গভীর অপ্রকাশযোগ্য সাঁকো। আমার কাছে এ যেন এক গভীর যোগমন্ত্র। বহুদিন একা একা গভীর শূন্যতায় বিনিদ্র রাত্রি যাপনের মহাশূন্যে আমি পড়েছি এই মন্ত্র। যোগ হয়েছে যা সাধনে। আর পড়তে পড়তে কেবলই মনে পড়েছে, সেই মেয়েটির ঝরঝরে হাসি। অপরূপ গালের মায়া। কী গভীর বেদনার সুখে কী গভীর বিষাদের ঐশ্বর্যে নির্মাণ করেছিল সে ‘একা’! অনেককাল কবিতার সঙ্গে আবৃত্তির সঙ্গে যোগাযোগ বিহীন। দারুণ ব্যস্ততর যাপিত জীবনের কর্মক্লান্তি পেরিয়ে যখন একা, তখনই আমাতে বহুকাল পর জেঁকে বসেছে শক্তি জাঁকিয়ে বসেছে ‘একা’। নেই স্টেজ, নেই মাইক্রোফোন কিংবা গ্যালারিভরা দর্শক। মাঝে গেছে অনেক বছর। তবু একটি শব্দও ভুলিনি। তবু একটি বিন্দু বেদনারও নেই এতটুকু স্খলন। তবু একা নিবিড় নিঃসঙ্গতায় পড়ে চলেছি:
একা লাগে ভারী একা লাগে
তোমাদের ছেড়ে এসে অ-মূল বৈরাগে
একা লাগে ভারী একা লাগে।
এখানে লাফায় ঘাসে পোকা
আঙিনায় মানুষের খোকা
এখানে দূরন্ত ঘাসে পোকা।এখানে উদ্বেগ নেই মেঘে
দেখার মতন নেই জেগে কেউ,
একা দুঃখে ও আবেগে
একা লাগে বড়, একা, লাগে।
(একা: শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
চলবে...