[পর্ব-৩১ ]
ইদানীং রাতটা প্রায় নির্ঘুমই কাটছে তুলির। দীপনের দেশে ফিরতে এখনও মাসখানেক দেরি। রতনের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না বেশ কদিন হলো। রুমকী ব্যস্ত তার পরীক্ষার পড়া নিয়ে। অফিস শেষে বাসায় ফিরে কেমন খালি খালি লাগে বাড়িটা। অথচ তেমন কোনো কারণ নেই এমন লাগার। দেশে থাকলেও দীপন বাসায় ফেরে রাত করে। বেশিরভাগ সময়েই অফিসের কাজ সেরে ফিরতে দশটা/এগারোটা বাজে তার। তুলি সময়টা রুমকী আর সংসারের জন্য বরাদ্দ রাখে। গান শোনে বা টুকটাক পড়াশোনা করে সময়-সুযোগ হলে। অথচ দীপন ইউরোপ যাওয়ার পর থেকে বাসায় ঢুকলেই কেমন একটা একাকিত্ব এসে জাপটে ধরে তাকে। মনে হয়, কী যেন একটা নেই, কোথায় যেন একটা অভাব বেজে ওঠে বুকের ভেতর। মন বসতে চায় না কিছুতেই। আজেবাজে কতশত ভাবনা এসে বসে মনজুড়ে। এলোমেলো লাগে তুলির। দমবন্ধ লাগে। দীপন যে কবে ফিরবে দেশে! দিন গোনে আপনমনেই।
ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চোখ পড়তেই নিজেকে দেখে চমকায় তুলি। সে কি মুটিয়ে যাচ্ছে আজকাল? মুখটা কেমন গিন্নিবান্নি লাগছে না? আর চিবুকের নিচটা? দ্বিতীয় চিবুক উঁকি দিচ্ছে নাকি? নাহ্। কাল থেকে ডায়েট চার্ট ফলো করতে হবে আবার। নইলে দেশে ফিরেই দীপনটা শুরু করবে তার স্বভাবমাফিক ইয়ার্কি। বলবে, বাহবা! আমি দেশে নেই বলে দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে দেখছি চর্বি বাড়িয়ে ফেলেছ শরীরে! খুব ফুরফুরে মেজাজে ছিলে আমি না থাকায়, না?
কল্পনায় দীপনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নিজেই ফিক করে হেসে ফেলে তুলি। দীপনটা অমনই। বরাবরের ফাজিল। দেশে এসে ঠিক একথাগুলোই বলবে সে তুলিকে, জানে তুলি। সাবধানে আশপাশ দেখে নিয়ে হুট করে কানের কাছে মুখ এনে বলবে, তোমাকে না, সেই লাগছে, বুঝলে! দারুন সেক্সি!
খাবার চিবোতে থাকা, গেঞ্জি আর ট্রাউজার পরা, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ির মেহেদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে সে মুহূর্তে ভীষণ ভালো লাগছিল তুলির।
আয়নায় নিজেকে দেখে দীপনকে ভেবে মুচকি হাসে তুলি। তারপর চোখ যায় কপালের বাম পাশের কাটা দাগটায়। মুহূর্তেই দীর্ঘশ্বাস পড়ে। কলঙ্কতিলক তার! কলঙ্ক? শব্দটা মনে মনে বারকয়েক নাড়াচাড়া করে তুলি। উল্টেপাল্টে দেখে আপনমনে। মাথা নাড়ে। হ্যাঁ, কলঙ্কই তো! সমাজ তো কলঙ্ক ছাড়া আর কিছু বলবে না এটাকে। কিন্তু সে নিজে? না, নিজে অমন ভাবে না সে। কলঙ্ক নয়, ভুল। আচ্ছা, সব ভুলই কি দাগ রেখে যায় জীবনে? প্রশ্নটা বিড়বিড় করে নিজেকেই করে তুলি। না, উত্তরটা জানা নেই তার। কিন্তু তার ভুলটা দাগ রেখে গেছে। আক্ষরিক অর্থেই দাগ রেখে গেছে তার ভুল। কপালের বাম পাশটায় স্পষ্ট ফুটে আছে দাগটা। লম্বামতোন, ক্ষীণ একটা কাটা দাগ। ক্ষতি মুছে যায়, ক্ষত রয়ে যায় মনের গভীরে, কে যেন কথাটা বলেছিল তাকে একবার, মনে নেই এখন আর। কিন্তু কথাটা মনে আছে। ক্ষতি সত্যিই একসময় পূরণ হয়ে যায়, কিন্তু ক্ষত মোছে না একজীবনে। কপালের এই দাগটা তাকে এক গভীর, গোপন ক্ষতের সামনে দাঁড় করায় প্রতিদিন। প্রতিদিন তাকে মনে করিয়ে দেয় কাপুরুষ, মেরুদণ্ডহীন মেহেদীর গা গুলোনো মুখ। মেহেদী! মেহেদী! নামটা সে মনে করতে চায় না সচেতনে, তবু মনে পড়ে। কেন যে পড়ে! কেন যে ঘেন্নাটা আরও বাড়িয়ে দিতে মনের আরশিতে এসে ছায়া ফেলে প্রতিদিন মেহেদীর স্মৃতি!
সেই একদিন মেহেদীর চিলেকোঠার বাসাটায় যাওয়ার পর থেকে আর কোনো আগল ছিল না কোথাও। না শরীরে, না মনে। না যাওয়াটাই অস্বাভাবিক লাগতো বরং। ছুটির দিনগুলোতে, বিশেষত শুক্রবারে মেহেদীর বাসায় যাওয়াটা একরকম নিয়মই হয়ে গেছিল তুলির। দশটার ভেতর মেহেদীর মেসে গিয়ে হাজির হতো সে। নিজের হাতে নাশতা বানাতো, রান্না করতো, সারাদিন একসঙ্গে কাটাতো দুজনে। হাসি, আনন্দ আর গান ঘিরে থাকতো তাদের সারাটা দিন। তুলির মনে হতো, জীবনটা সত্যিই অনেক সুন্দর আর মায়াময়। জন্মাবধি যে অবহেলা আর অপমানের গ্লানিতে ছেয়েছিল তার মন, যে অসহ্য বিষাদভারজুড়ে বসেছিল তার মন ও মনন, ধীরে ধীরে, একান্ত অনবধানে, কেটে যাচ্ছিল সেসব, বিপরীতে মনের ভেতর একটু একটু করে চোখ মেলছিল আনন্দকুঁড়ি, সঙ্গোপনে ডানা মেলছিল স্বপ্নফানুস। ফেলে আসা জীবনের অশুভ ছায়া তাকে তাড়া করে ফিরতো না আর। আঁতুড়ঘরে হারিয়ে যাওয়া মায়ের কোনো স্মৃতি ছিল না তুলির মনে। শৈশব থেকে যৌবনের সেই পরমারাধ্য সময় পর্যন্ত তার স্মৃতিতে ছিল শুধু চোখ মেলার পর থেকে কচুরিপানার ভাসন্ত জীবন, মামাবাড়ির গ্লানিময় শৈশব ও কৈশোর স্মৃতি।
মেহেদী যেন এক লহমায় মুছে দিলো সেসব। তাকে দিলো আলোকময় জীবনের এক আশ্চর্য পরশপাথর, প্রেম। যার ছোঁয়ায় তুলি বদলে গেলো আমূল। বিষাদরেখা মুছে মুখে ফুটে উঠলো উজ্জ্বল জীবনবিন্দু। মেহেদীকেও সুখীই দেখাতো ভীষণ। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এক প্রেমার্ত পুরুষ। প্রেমে যে নত হয় তুলির কাছে, প্রণয়ে যে ফুটিয়ে তোলে তুলির মনের কুসুম।
অদেখা মাকে খুব করে মনে পড়তো তখন তুলির, মাকে ভেবে জল জমতো চোখে। সেই মা, তুলিকে জন্ম দিতে গিয়ে যে মা জীবনের সব দেনা-পাওনা মিটিয়ে দিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন অজানায়, কল্পনায় সেই মায়ের মুখটা আঁকতে চেষ্টা করতো তুলি, ব্যর্থ হতো আর কষ্টের ভীষণ সুক্ষ্ণ ফলা আচমকা বিঁধে যেতো বুকের ভেতর। চোখের জল মুছতে মুছতে ভাবতো, আহা, মা যদি বেঁচে থাকতো আজও, তাহলে তুলির এই অপার্থিব সুখটুকু দেখে না জানি কতটা সুখী হতো, না জানি কতটা আনন্দে ভরে উঠতো সেই না দেখা কোমল মুখটা!
নিজের ভেতরের পরিবর্তনটা হুট করেই টের পেলো তুলি, একদমই আচমকা। বোকা নয় সে, বুঝলো যা বোঝার। তবু নিশ্চিত হতে চাইলো। প্রেগনেন্সি টেস্টিং কিট কিনে নিজে নিজেই পরীক্ষা করলো এক সকালে। পজিটিভ। খুব একটা ঘাবড়ালো না তুলি। ঘাবড়ানোর কিছু ছিলও না আদতে। সে, মেহেদী, তারা, ভালোবাসে একে অন্যকে। বিয়ে করবে তারা যেকোনো দিন। কাজেই নতুন অতিথি তাদের কাছে অনাহূত কেউ হওয়ার প্রশ্ন ছিল না। মুখে লাজুক হাসি নিয়ে পরবর্তী ছুটির দিনে মেহেদীর চিলেকোঠার ছোট্ট বাসাটায় হাজির হলো সে। টেবিলে নাশতা সাজিয়ে মেহেদীকে ডাকলো, নাশতা রেডি, এসো!
খেতে খেতে আনমনা হলো তুলি। মেহেদীকে কী করে খবরটা দেওয়া যায়, কিছুতেই ভেবে বের করতে পারলো না প্রথমটায়। মেহেদী একমনে নাশতা খাচ্ছে। মাঝে মাঝে পাতা ওল্টাচ্ছে সেদিনের দৈনিকের। বারকয়েক তার মনোযোগ আকর্ষণের ব্যর্থ চেষ্টা করলো তুলি। শব্দ করলো অকারণ। মেহেদীর কোনো ভাবান্তর নেই। খাবার চিবোতে থাকা, গেঞ্জি আর ট্রাউজার পরা, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ির মেহেদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে সে মুহূর্তে ভীষণ ভালো লাগছিল তুলির। খাওয়া ভুলে তাকিয়ে ছিল অপলক। হঠাৎ চমকে তাকালো মেহেদী। অপ্রস্তুত গলায় বললো, কী হলো? খাচ্ছো না যে?
–তোমাকে দেখছি। গাঢ়স্বরে বললো তুলি।
–মানে? আমাকে আবার নতুন করে দেখার কী হলো?
–কিছু তো হলোই! গলায় রহস্য ঢেলে বললো তুলি।
–কী পাগলামি করছো? মানে কী?
–তোমাকে নয়, আজ আমি আমার বাচ্চার বাবাকে দেখছি!
–কী যে বাজে বকতে পারো তুমি! খেয়ে নাও তো তাড়াতাড়ি!
–মোটেই বাজে বকছি না মেহেদী। তুমি বাবা হতে যাচ্ছো।
–মানে কী? আচমকা যেন ভীষণ একটা ধাক্কা খেলো মেহেদী। কণ্ঠটাও রূঢ় শোনালো খুব। পাত্তা দিলো না তুলি। মৃদু, কিন্তু কণ্ঠে দৃঢ়তা রেখে বললো, মানে খুব সহজ তো মেহেদী। আমি মা হতে যাচ্ছি। এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে? তুমি তো কোনো প্রটেকশান নাওনি।
–তুমি! তুমি পিল খাওনি এতদিন? রাগত, তোতলানো গলায় কোনোমতো কথাগুলো বললো মেহেদী।
–পিল তো তুমি এনে দাওনি মেহেদী, খেতেও বলোনি কোনোদিন। আমি পিল কোথায় পাবো যে খাবো? আর পিল খাবোই বা কেন? চলো বিয়েটা সেরে ফেলি তাড়াতাড়ি। তাহলেই তো সমস্যা থাকবে না আর আমাদের।
আকাশ থেকে পড়লো যেন মেহেদী। রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে পড়লো চেয়ার থেকে। অচেনা, অপরিচিতের গলায় বললো, বিয়ে করে ফেলি মানে? বললেই হলো? বিয়ে এত সহজ? ফ্যামিলিকে না জানিয়ে, ফ্যামিলির অমতে তোমাকে বিয়ে করা কিছুতেই সম্ভব নয় আমার পক্ষে। ফ্যামিলিকে তোমার কথা জানিয়ে দেখি আগে, তারা মত দিলে বিয়ে হবে, নয়তো নয়। তার আগে কোনো ক্লিনিকে চলো, অ্যাবোরশন করিয়ে ফেলি।
তখনো জানতো না তুলি, আচমকা সেই পতনে আরও কোথাও উষ্ণ ধারা বইছে তার, কেটে গেছে মেহেদীর ‘ঝামেলা’ও।
–মেহেদী! শব্দটা যেন ছিটকে বের হলো তুলির কণ্ঠ থেকে, নিজের কণ্ঠ নিজের কাছেই অচেনা লাগলো ভীষণ।
–নাটক করো না তো। কোনো ক্লিনিকে চলো, ঝামেলাটা চুকিয়ে ফেলি।
–মেহেদী, মনে করো ঝামেলাটা চুকিয়ে ফেললাম, তারপর তুমি ফ্যামিলিকে জানালে, তারা আমার সাথে তোমার বিয়েতে তাদের অমত জানালো, তখন? কী করবে তুমি? মেহেদীর চোখে চোখ রেখে, কথাগুলো আস্তে তার দিকে ছুড়ে দিলো তুলি। চোরের মতো, কাপুরুষের মতো চোখ নামিয়ে নিলো মেহেদী। এড়িয়ে যাওয়ার, মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে গলা নামিয়ে বললো, সে তখন দেখা যাবে।
–উঁহু। তখন নয়, আমি এখনই দেখতে চাই মেহেদী। তুমি এইমাত্র বলেছ, পরিবারের অমতে আমাকে বিয়ে করা সম্ভব নয় তোমার পক্ষে।
–হ্যাঁ, সম্ভব নয়। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দ্বিধাহীন, স্পষ্ট গলায় বললো মেহেদী।
–বাহ মেহেদী। তাহলে সম্পর্কে জড়ানোর আগে কেন পরিবারের অনুমতি নিলে না তুমি?
–বাজে বকো না। যা বলছি, করো।
–কী বলছো? ঝামেলা চুকিয়ে ফেলতে? অ্যাবোরশন করাতে?
–হ্যাঁ, তাই।
–স্যরি মেহেদী। আমার বাচ্চা আমার কাছে মোটেই ঝামেলা নয়। আমি অ্যাবোরশন করাবো না। আজ থেকে তোমার সাথেও কোনো সম্পর্ক থাকবে না আমার। আমার বাচ্চার দায়িত্বও নিতে হবে না তোমাকে। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ঝট করে উঠে দাঁড়ায় তুলি। বেশ কিছুদিন যাবত খাওয়ায় অরুচি, আর শরীরের নাজুক অবস্থার কারণে দুর্বল তুলির মাথা ঘুরে যায় হঠাৎ। ধুপ করে শব্দ হয় পড়ার। মেহেদী এসে ধরার আগেই পড়ে যায় তুলি, অজ্ঞান হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গেই।
চোখে-মুখে জলের ঝাপটায় চোখ খোলে তুলি। ঝাপসা লাগে সব। দুর্বল লাগে খুব। কপালের বাম পাশটায় জ্বলছে। হাত দেয় তুলি। ভেজা। চোখের কাছে হাতটা আনতেই দেখে রক্তে ভেসে যাচ্ছে হাত। ড্রেসিং টেবিলের কোণায় লেগে গভীর হয়ে কেটেছে কপালটা। তখনো জানতো না তুলি, আচমকা সেই পতনে আরও কোথাও উষ্ণ ধারা বইছে তার, কেটে গেছে মেহেদীর ‘ঝামেলা’ও।
চলছে…
উজানে গড়াই-৩০॥ শিল্পী নাজনীন