[পর্ব-দুই]
বিওটি অফিসের পিয়নও অনেক ক্ষমতার মালিক। তাকেও অনেকে সমাদর করে চলে। সেখানে বিওটির চিফ কোঅর্ডিনেটর মানে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকজনের কাছে অনেকটা ঈশ্বরের মতো। তিনি একজন ড. ফারজানা কেন দশটা ড. ফারজানাকে নিয়ে সারাদিন রুমে প্রেমের হলিখেলা খেললেও, তা নিয়ে কেউ টু শব্দটিও যে করার সাহস করে না, তা তিনিও ভালো করেই জানেন। কেউ সাহস করলেই চাকরিটা এক ফুঁতে বাতাসে উড়ে ভেসে যাবে। ড. ফারজানা এটা ভালোভাবেই বুঝতে পারে। আবার এটাও বুঝতে পারে উপাচার্য ড. শাহেদ জাহানকে নিজের বাহুবন্দি করে না রাখলে, সেখানেও সমস্যা কম হবে না। যে কারণে ড. ফারজানা দুজনের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে, তাদের খুশি করে, মন ভরে রাখতে হাঁপিয়ে ওঠেন। ড. শাহেদ জাহান ও আব্দুল করিমের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব সবসময় লেগেই থাকে। দুজন সবসময় দুজনের উল্টো দিকে হাঁটেন। দুজন দুজনের নামটা বলার সময়ও অসম্মানজনকভাবে বিকৃত করে উচ্চারণ করেন। কিন্তু যখন সামনা-সামনি দেখা হয় বা কোনো মিটিং হয়, তখন দেখে মনে হয় পৃথিবীতে এ দুজনের চেয়ে সুমধুর সম্পর্ক আর নেই। বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই জানে ভিসি আর চিফ কোঅর্ডিনেটরের দা-কুড়াল সর্ম্পক। এরকম দুজনের সঙ্গে প্রেমের খেলাটা চালিয়ে যেতে—দুজনকেই খুশি করে চলতে ড. ফারজানাকেও প্রতিদিন অনেক অংক কষে চলতে হয়। ড. ফারজানা জানেন এই দুজনের কেউ একজন অখুশি হলেই তার চাকরিটা ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে। এর আরো বড় কারণ বোর্ড নিজেই চায় না বাংলার মতো একটা লোকসান ডিপার্টমেন্ট থাকুক। অনেকবার বন্ধও করে দিতে বলেছে। বন্ধ করেও দিয়েছিল। তারপর আবার কত দেন-দরবার করে চালু করেছে।বাংলা বিভাগ চালু রাখার ক্ষেত্রে ড. শাহেদ জাহান এবং চিফ কোঅর্ডিনেটরের যুক্তি একই। ড. শাহেদ জাহান বোর্ডকে বোঝায় বাংলা বিভাগ একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা মানে তা আমাদের জন্য গর্ব। ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়েই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ঘটেছে এবং স্বাধীন সার্বভৌম একটা দেশ পেয়েছি। চিফ কোঅর্ডিনেটরও ভিসির বক্তব্যকে শতভাগ সমর্থন করেন।
এই একটা জায়গায় দুজন সবসময়ই এক—দুজনের ভেতরই আছে একজন। তাকে রাখতে হলে বাংলা বিভাগ রাখতে হবে। বাংলা বিভাগ না থাকলে ড. ফারজানাও যে থাকবে না! তা ভাবতেই দুজনের মনেই যেন শ্মশানের আগুন জ্বলে ওঠে।
বোর্ডের সদস্যরা দুজনের দেশপ্রেমে মুগ্ধ হয়ে বাংলা বিভাগ লোকসান মেনেও চালু রাখে। ড. শাহেদ জাহান বোর্ড মিটিং শেষে গাড়িতে উঠেই ড. ফারজানাকে মোবাইল করে। বলেন, জানো তোমার বাংলা বিভাগ চালু রাখার জন্য আজ বোর্ডে ভাষা আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ দেশপ্রেম কতো যে দীর্ঘ বক্তব্য দিতে হলো।
চিফ কোঅর্ডিনেটরও মিটিং শেষে গাড়িতে উঠেই ড. ফারজানাকে ফোন করেন। ব্যস্ত। যতবার করে ব্যস্ত।
ড. ফারজানা দেখছেন চিফ কোঅর্ডিনেটর বারবার ফোন করছেন। তিনি তো এতক্ষণে ক্ষেপে আগুন হয়ে গেছেন নিশ্চয়। কিন্তু ড. শাহেদ জাহান কিছুতেই ফোন ছাড়ছেন না। কথা বলেই যাচ্ছেন—কথাগুলো যেন কথা নয় গড়াই নদীর সুখের ঢেউ হয়ে দোল খাচ্ছে। বাংলা বিভাগের জন্য বীরপুরুষের মতো বিরাট একটা কিছু করে ফেলেছেন, সেই বর্ণনা যেন হাজার মাইল পথ হাঁটার মতো গল্প..!
ড. ফারজানা আব্দুল করিমের মানসিক অবস্থা অনুধাবন করে ড. শাহেদ জাহানকে বললো, স্যার, বাসায় তো হাজবেন্ড। ও অসুস্থ। বারবার আমাকে নক করছে। আপনাকে একটু পরে আমি কল ব্যাক করি!
না, তা আর দরকার হবে না। আমি বাসার কাছে চলে এসেছি। আসলে তোমার জন্য কিছু করতে পেরে অনেকটা আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। কাল এসো। কথা বলবো।
কলটা কেটেই ড. ফারজানা আব্দুল করিমকে ফোন দেয়। রাগে ক্ষোভে ফোন ধরলেন ন তিনি। ড. ফারজানা আবারও ফোন দিলেন। আব্দুল করিম ফোন রিসিভ করেই মেজাজি কণ্ঠে বললো, এতক্ষণ তো আপনার ভিসি না ডিসি দুনিয়া জাহানের মালিকের সঙ্গে ফোনে ছিলেন। আরও থাকতেন!
কী যে বলেন আপনি! ভিসির সঙ্গে আমি ফোনে এতক্ষণ কেন থাকবো? আমার ভিসি বলেন—ডিসি বলেন—চিফ কোঅর্ডিনেটর বলেন—যা-ই বলেন—আমার কাছে সবই আপনি। আপনি জানেন আমার বাবা কত অসুস্থ! কখন মরেন কখন বাঁচেন! মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম। পাগলের মতো মা কাঁদছেন। শৈল্পিক করুণতার সঙ্গে মিথ্যে করে বললেন ড. ফারজানা।
এই শরীর নিয়েই তো এত কিছু! ভাগাড়ে ফেলে দিলে ভগবানরূপী শয়তানগুলো হয়তো তখন সস্তা শরীরের স্বাদ নিতে লেবাস ছেড়ে নগ্ন শকুন হয়ে নেমে আসবে!
আব্দুল করিম এটা শুনে একেবারে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চান ড. ফারজানার কাছে। আমি সত্যি বুঝতে পারিনি। আপনি অন্যভাবে নেবেন না। আপনার চরম বিপদের সময় ছোট্ট একটা সুখবর দেই আপনাকে, বাংলা বিভাগটা আর বন্ধ হচ্ছে না।
এ সবই আপনার কৃতিত্ব। বিনয়ের সঙ্গে বললেন ড. ফারজানা।
আসলে বোর্ডের লোকজন তো ব্যবসা ছাড়া কিছু বোঝে না। কোথায় কয় টাকা লাভ হয়, সেটাই হিসাব করে। কতো কথা যে বলতে হলো—ভাষা আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধ এসবের কারণে যে দেশটা পেয়েছি, বাংলার জন্যই তো পেয়েছি।
এক একজনের লাভের চিন্তা এক একরকম। আপনি যেমন চেয়েছেন বাংলা বিভাগ থাকলে ড. ফারজানা থাকবে। ড. ফারজানা থাকলে আপনার মন ভরে থাকবে। চোখও ভরে থাকবে। নাকি ভুল বললাম!
ভুল কেন হবে! একদম ঠিক।। আর শোনেন, আপনি ভিসির রুমে অত যান কেন? গতকাল তো সারাদিন তার রুমে ছিলেন। চাকরি বাঁচানোর জন্য তাকে অত তেল দিতে যেতে হবে না। উনার কিন্তু অনেক সমস্যা আছে। বুঝতে পারছেন কী বোঝাতে চাচ্ছি?
না, বুঝতে পারিনি।
আরে ড. ফারজানা ও তো আপনাকে শেষ করে দেবে! লোকটা মেয়েমানুষ পাগলা। মেয়েমানুষ ছাড়া কিছু বোঝে না। আপনাকে নিয়েও কিন্তু তার নামের সঙ্গে অনেক কথা বাতাসে ছড়াচ্ছে। হিসাব করে চলবেন। নাহলে কিন্তু ঝামেলায় পড়ে যাবেন। বোর্ড থেকে কিন্তু আমার কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইছিল। আমি একবারে না বলে দিয়েছি। আর বোঝেন তো বাংলার মতো মরা ডিপার্টমেন্ট নিয়ে কিন্তু বোর্ডের কোনো মাথাব্যথা নেই। ব্যথা একটু উঠলেই কিন্তু কেটে ফেলবে। একবার ভাবছিলাম আপনাকে এসব বলবো না। আবার ভাবলাম আপনার আমার ব্যক্তিগত একটা সম্পর্ক যেহেতু আছে, আপনাকে রক্ষা করা আমার দায়িত্ব।
কথাগুলো বলে খুব ভালো করেছেন। ভিসি স্যারের সঙ্গে আমার ও রকম কোন সম্পর্ক নেই। ডিপার্টমেন্টের প্রয়োজনে তো কখনো কখনো স্যারের কাছে যেতেই হয়। সেটাও কমিয়ে দিতে চেষ্টা করবো।
গিয়ে তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার দরকার নেই।
ড. ফারজানা মনে মনে ভাবলেন চিফ কোঅর্ডিনেটর ভালোরকমই ক্ষেপেছেন। কথা বেশি না বাড়ানোই ভালো। বললেন, স্যার, আমার মনটা খুব খারাপ আজ। বাবার শারীরিক অবস্থা ভালো না। তবুও একটা অনুরোধ করবো—রাখবেন কিনা জানি না।
তার আগে বলেন আপনার কোন অনুরোধটা আমি রাখিনি?
সে জন্য আপনার কাছে আমার সারাজনমের ঋণ মানি। আগামীকাল সন্ধ্যায় অফিসের পরে আমাকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবেন? আপনার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে পারলে, মনটা হয়তো অনেকখানি হাল্কা হয়ে যেতো।
কোথায় যেতে চান?
জানি না। আপনার খুশি। আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন, সেখানেই…।
ওকে। আমি বাসায় চলে এসেছি। মনটা খারাপ ছিল তোমাকে ফোনে ব্যস্ত পেয়ে। রাগ করে কথা বলেছি। মনে নিও না।
তা কেন! আমি তো আপনাকে ভালোবাসি। ভালোবাসার মানুষের এই অভিমান ক্ষোভ রাগই তো প্রেমের শক্তি।
সুন্দর বলেছেন। রাখছি। কাল সকালেই কিন্তু আপনাকে রুমে চাই। মনটা তেতে আছে।
আব্দুল করিম লাইনটা কেটে দিয়ে, মনে মনে ভাবে, ড. ফারজানা, আমি আপনাকে ভিসির সুখের নদী হতে দেবো না। আপনি শুধুই চিফ কোঅর্ডিনেটর আব্দুল করিমের।
ড. ফারজানা মোবাইলটা দু হাতে শক্ত করে ধরে, ভাবে—এটা কি কোন চাকরি হলো! এতো পড়ালেখা করে, এমফিল পিএইচডি করে চাকরি পাইনি। চাকরি পেতে হয়েছে ভিসি স্যারের বিশেষ প্রস্তাবে। কেউ জানে না কী সেই প্রস্তাব! কেউ জানে না কিভাবে আমার চাকরি হয়েছে! সবাই জানে আমার যোগ্যতায় আমার চাকরি হয়েছে। কিন্তু আমি তো জানি যোগ্য ব্যক্তিকে চাকরি না দিয়ে চাকরিটা দেয়া হয়েছে আমাকে। আমি তো জানি যে ছেলেটোকে বাদ দেয়া হয়েছে, সে কত বেশি যোগ্য ছিল আমার চেয়ে। যোগ্যতায় চাকরি হলো না তার, চাকরি হলো আমার—শাহেদ জাহান স্যারের বিশেষ অনুকম্পায়—উনি যখন যেভাবে আমাকে চাবেন, আমাকে তখন তার জন্য সকালের তাজা পুষ্প হয়ে ফুটে উঠতে হবে। হায় চাকরি! সেই চাকরি এখন তো আমাকে রীতিমতো রক্ষিতা বানিয়ে ফেলেছে। তারপর আবার নতুন করে ক্ষমতার তরবারি আমার গলায় ঠেকিয়ে আব্দুল করিমও খেলছে। এই দুই মহারথির মনোরঞ্জন করে কতোদিন এভাবে পারবো! এভাবে কি পারা যায়! আগে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম সেখানেও ভগবানরূপী শয়তানের রাহু থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এখানে এলাম। মুক্তি! হায়রে মুক্তি! বাইরে আমি ডক্টরেট—বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক—বিভাগের চেয়ারপারশন—কতো সম্মান! কিন্তু আসলে আমি কি! আমি কে! আমি যখন গভীর রাতে অন্ধকারে একা বারান্দায় বসে ভাবি—আমার আমিকে—তখন নিজেকে তো সেই অন্ধকারের থেকেও গভীর অন্ধকার মনে হয়! একদম অচেনা আমি—আমাকেও আমি দেখতে পাই নে। আমি কি কোনদিন এই সমাজের সামনে আমার প্রকৃত আমিকে প্রকাশ করতে পারবো! করলে সমাজ কি আমাকে সম্মান করবে! সমাজে সবাই ড. ফারজানাকে কতো সম্মান করে, কতো আদর্শবতী নারী মনে করে! সত্যিকারের ড. ফারজানা যে পতিতার থেকেও জঘণ্য—আমি এই সত্য কিভাবে বলি—কাকে বলি! যেমন কোনদিন কেউ জানবে না একজন উচ্চশিক্ষিত ড. শাহেদ জাহান আমাকে চাকরি দিয়ে—সেই চাকরি রক্ষার শক্তি হয়ে কীভাবে আমাকে দিনের পর দিন সম্ভোগ করছে! কিভাবে একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর আব্দুল করিম চাকরির ক্ষমতা খাটিয়ে আমাকে রোমান্সের পুতুল করে রেখেছে! এই আমিই তো ড. ফারজানা! আমি এই সমাজকে—সমাজের মানুষকে কিভাবে বলি ভগবানের মতো এই সব মানুষ—যাদের আমরা পূজো করি—এরা শয়তান। আর নিজেকে সমাজে দামি মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে আমি যে ভেতরে ভেতরে বেশ্যার থেকেও ঘৃণ্য হয়ে উঠেছি। বাহ্যিক এই সম্মান—এই খ্যাতি—আমারও তো মোহ্ হয়ে উঠেছে। আমিও তো ইচ্ছে করলে এটা ছাড়তে পারছি নে। আমার স্বামী কত গর্ব করে আমাকে নিয়ে—তার স্ত্রী ড. ফারজানা —কতো দামি নামি! সে কী কোনদিন সত্যিকারের সত্যটা জানবে! জানবে না।
চোখ দুটো ভিজে ওঠে ড. ফারজানার। সোফায় হেলান দিয়ে নিজের শরীরটা ছেড়ে দেয়। কেন যেন নিজের শরীরটাকে নিজের থেকে খুলে ভাগাড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। এই শরীর নিয়েই তো এত কিছু! ভাগাড়ে ফেলে দিলে ভগবানরূপী শয়তানগুলো হয়তো তখন সস্তা শরীরের স্বাদ নিতে লেবাস ছেড়ে নগ্ন শকুন হয়ে নেমে আসবে!
চলবে…
ঈশ্বর ও শয়তান-১॥ রকিবুল হাসান