(পর্ব-১৯)
আকস্মিকভাবে বিজনেস অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. গোলাম রসুল ও সহকারি অধ্যাপক ড. তৌহিদা আমিনকে এক সঙ্গে চাকরিচ্যুত করা হয়। খবরটা সকালেই পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ড. সাদিক আহসান যখন অফিসে ঢুকলেন, তিনি তখন পুরো বিধ্বস্ত। তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না এটা কিভাবে সম্ভব! নিজের কাছেই নিজের আত্মজিজ্ঞাসা, আমাকে অবগত না করে আমার ডিন ও ফ্যাকাল্টিকে কিভাবে চাকরি থেকে সরিয়ে দেয়া হলো! তাহলে এখানে নিশ্চয় কোনো গোপন গহিন গর্ত আছে—যেখানে বিষধর কালসাপ বাস করে! সেই কালসাপটা কে! নিজের কাছে উত্তরটা পরিষ্কার না হলেও, একটা অনুমান তিনি ঠিকই করলেন—গর্তটা আর গর্তের কালসাপের! ভাবলেন, এই গর্তটা যতোটা গভীরই হোক, আর বিষধর কালসাপটা যতোই ভয়ানক হোক, সেটাকে সবার সামনে বের করে এনে, তার বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে। তা না সম্ভব হলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ভালো ফ্যাকাল্টি ধরে রাখা সম্ভব হবে না। কালসাপের ছোবলে একে একে সব মরবে।
উন্নয়নমূলক সব কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে। স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় আর গড়া হবে না! এসব জীবনঘাতি কালসাপদের শেষ করে দিতে হবে। তিনি বোর্ডের চেয়ারম্যার তৌফিক চৌধুরীকে ফোন করলেন, বললেন, তৌফিক ভাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ যে ঘটনা ঘটেছে—ডিন ড. গোলাম রসুল ও ড. তৌহিদা আমিনকে যে সব কারণ দেখিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, এগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তারা যদি সত্যিকারের অপরাধি হন, আমার কোন কথা নেই। কিন্তু তদন্তে যদি তা প্রমাণিত না হয়, যে বা যিনি এসব করিয়েছেন, তার বা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আর কেউ এ ধরণের ভয়ঙ্কর খেলা খেলতে সাহস না করে।
ভিসি সাহেব, ভালো প্রস্তাব। আপনি একটি তদন্ত কমিটি করে রিপোর্ট আপনি চান। আমি আপনার সঙ্গে সেই রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
ড. সাদিক আহসান তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিলেন—প্রোভিসি নাজমুল সৈকত, ডিন আব্দুল হামিদ ও রেজিস্ট্রার শামসকে সদস্য করে। এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দিলেন। কমিটিটা গোপন থাকবে। তারা গোপনে এটার পুঙাখানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে নির্মোহ ও নিরপেক্ষ একটা রিপোর্ট উপাচার্য মহোদয়ের নিকট পেশ করবেন। কমিটি সেভাবেই খুবই সতর্কতার সঙ্গে কাজ শুরু করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সবাই কানাঘুষা করছে—মুখফুটে কেউ কিছু বলছে না। একইসঙ্গে একই বিভাগের দুজন গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাকাল্টিকে এভাবে কেন চাকরি থেকে বিদায় করে দেয় হলো! কেউ বলছেন, ডিনের সঙ্গে তৌহিদা ম্যাডামের অনৈতিক সম্পর্ক ছিল। তা অনেকদিন ধরেই চলে আসছিল। ম্যানেজমেন্ট জানার পরে তাদের চাকরিচ্যুত করেছে। কেউ বলছে, তৌহিদা ম্যাডামের পিএইচডি নকল করে লেখা। বাইরের কোন পিএইচডি থিসিস উনিশ-বিশ করে ডিগ্রি নিয়েছেন। কেউ বলছে, ডিন স্যার নিজেই লিখে দিয়েছেন। আবার কেউ বলছেন, আসলে সিসি স্যার ডিনের সঙ্গে ম্যাডামের সম্পর্ক সহ্য করতে না পেরে কলকাঠি নেড়ে, একটা দারুণ খেলা দেখিয়ে দিলেন! তৌহিদা ম্যাডাম দেখতেও তো সেই রকম সুন্দর। বছরও হয়নি বিয়ে হয়েছে। তা নিয়েও কেউ কেউ রসিয়ে বললো, আরে তৌহিদা ম্যাডাম তো ডিন স্যারের জন্যই বিয়ে করতেন না। কিন্তু কত দিন আর—শেষে লোক দেখানো একটা বিয়ে করলো আর কী! খেলে তো ডিন স্যারের সঙ্গেই। কিন্তু এসব কথা কানে কানে—ফিসফিস করে বাতাসে বাতাসে এর কাছে থেকে ওর কাছে এভাবে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইরাসের মতো ভেসে বেড়াতে লাগলো। কেউ মুখ খুলে বলে সাহস পাচ্ছে না। প্রকৃত কারণ কেউ বুঝতে পারছে না। যে যার মতো আড়ালে আবডালে গল্প বানিয়ে চালিয়ে দিচ্ছে। সবচেয়ে বেশি প্রচার পেলো ডিন ড. গোলাম রসুলের সঙ্গে ড. তৌহিদা আমিনের অনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারটি।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর সুভদ্র চ্যাটার্জির সঙ্গে মিটিং করতে করতেই খবরটা শুনলেন। সুভদ্র চ্যাটার্জি নিজেই বললেন, অনিন্দ্য, কিছু শুনেছো?
আপনার পিয়নটা বলে গেলো, দুজন ফ্যাকাল্টির চাকরি নেই!
হ্যাঁ, তার মধ্যে আবার একজন ডিন আর একজন তারই বিভাগের সহকারি অধ্যাপক। এখানে আগেও এরকম ছিল। হুটহাট করে যখনতখন যার তার চাকরি চলে যাওয়া। ড. সাদিক আসার পরে তো ভালোই চলছিল। হঠাৎ করে আবার এসব কি শুরু হলো! এসবে তো বাইরে দুর্নাম হয়—বদনাম হয়। আমরা তো এখানে অনেক বছর আছি। তুমি তো মাত্র কয়েকমাস হলো। বছরও হয়নি।
ড. অনিন্দ্য কিছু একটা ভাবলেন, কিন্তু কিছুই বললো না। মিটিংয়ের কাজেই নিজেকে ব্যস্ত করে রাখে।
সুভদ্র চ্যাটার্জি আবার বললেন, আচ্ছা বলো তো অনিন্দ্য, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ভাইস চ্যান্সেলর থাকেন, প্রোভাইস চ্যান্সেলর থাকেন, ডিন মহোদয়েরা থাকেন। এদের মাথার উপর যদি একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর বসিয়ে রাখা হয়, এদের কর্মকাণ্ডের রিপোর্ট কনে ইন্টারমিডিয়েট পাস সিসি!—তাহলে বড় কে! বিওটি নামে একটা অফিস করে এখানে ভিসির মাথায় উপর খড়গস্বরূপ সিসিকে বসিয়ে রেখেছে! এটা কোন কথা হলো! এতে ভিসির সম্মান থাকে! শিক্ষকদের সম্মান থাকে! বিওটির কেরানি যা বলে, তাই হয়। তবু তো ড. সাদিক আহসান শক্ত মানুষ—রাজনৈতিকভাবেও একটা ভালো ক্ষমতা আছে। সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন বলে, বোর্ড তাকে মেনে চলে। তারপরও দেখো আজ কী ঘটে গেলো! ভিসিকে এটা জানিয়ে নাকি না-জানিয়ে করেছে—বলতে পারবো না। তুমি জানো না ভাই গোলঅম রসুল স্যারের মতো মানুষ হয় না—দেখো, তাকে ফাঁসিয়ে দিলো। তৌহিদা মেয়েটাকেও আমি ভালো করে চিনি। এখানে কয়েক বছর আছে। একটা ভালো মেয়ে—ভালো শিক্ষক। তাকে কী অপবাদটা দিয়ে চাকরিচ্যুত করলো! মানুষজন্ম আত্মা থাকলে কেউ এসব করতে পারে? ভগবান এসব কিভাবে সহ্য করে জানি না। মাঝেমধ্যে এসব দেখেশুনে ভগবানের উপরই আস্থা হারিয়ে যায়! প্রফেসর সুভদ্র চ্যাটার্জির চোখের কোণে ভিজে ওঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, যা হোক আগে তো বিওটি অফিস গোটা বিশ্ববিদ্যালয়কে আঙ্গুলের উপর তুলে ঘোরাতো! কী যে অবস্থা ছিল রে ভাই! তুমি তো ভালো সময়ে এসেছ। আমরা যে কী দিন পার করেছি!
আমরা দুজন যদি ঠিক থাকি স্যার, সব ঠিক। ডিপার্টমেন্ট নিয়ে কেউ কোন খেলা খেলতে পারবে না। আমি সব বুঝি। ডিপার্টমেন্ট কিন্তু এতদিন আমিই চালিয়েছি। ম্যাডাম তো সারাদিন প্রশাসনিক বিল্ডিংয়েই পড়ে থাকতেন।
-এমন সময় ড. অনিন্দ্যকে সিসি আব্দুল করিম ফোন করে বললেন, আপনি নাকি ড. এলিনাকে ক্লাস দেননি?
-জি।
-আমি আপনাকে বলার পরেও, আপনি তা করলেন না? আজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কী অবস্থা! তা তো জানেন নিশ্চয়—বাতাসে পোড়া গন্ধ পাচ্ছেন -না!
-গন্ধ একটা পাচ্ছি। তবে তা পোড়া না দুর্গন্ধের—বুঝতে পারছিনে! কিন্তু করিম ভাই, ড. এলিনাকে আমি ক্লাস দিতে পারবো না। যিনি বাংলায় পড়েইনি, তাকে আমি কিভাবে ক্লাস দেই, আপনিই আমাকে বলুন তো।
আরে এদেশে তো কত কিছু হয়! সব কি নিয়ম মেনে হয়! আপনি এতো নিয়ম নিয়ম করেন না তো। ভালো লাগে না। আমি যা বলি তা শোনেন। ড. এলিনাকে আপনি দেখবেন, আমি আপনার ক্যারিয়ার দেখবো। আপনার মঙ্গল হবে। তর তর করে প্রমোশন হবে—বেতন বাড়বে। এসব চান না?
-সরি, করিম ভাই। আমি একদিন চাকরি করলেও ন্যায়ের সঙ্গেই চাকরি করবো। আমাকে দিয়ে কোন অন্যায় কাজ হবে না। বাংলা বিভাগে অনিয়মের যতো শেকড় ছড়িয়েছে, আমি তা সব উপড়ে ফেলতে চাই। আপনি আমাকে সাহায্য করুন।
-আপনি ভুল করছেন কিন্তু ড. অনিন্দ্য। বলেই ফোন রেখে দিলেন আব্দুল করিম। তিনি ড. এলিনার রহমানের বাসা থেকেই, তার সামনেই ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে ফোন করেছিলেন। তিনি আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি। ড. এলিনা রহমান বিশেষভাবে তাকে বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তার স্বামী অবসরপ্রাপ্ত মেজর আকিজ রহমান একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি করেন। সেই অফিসের কাজে চার দিনের জন্য গতকাল চীনে গেছেন।
বাসাটা একেবারে ফাঁকা। আব্দুল করিমকে আদরে আপ্যায়নে একান্ত সান্নিধ্যে ভুলিয়ে নিজের মতো করে নেয়ার এ সুযোগটা পুরোটাই যে নিতে হবে—ড. এলিনা রহমান তা ভালোই জানেন। এবং তা করার জন্য আয়োজনে আর মনে একটুও ঘাটতি রাখেননি।
সুভদ্র চ্যাটার্জি খুব মনোযোগ দিয়ে ড. অনিন্দ্য অর্ঘের কথা শুনছিলেন। বললেন, সিসির ফোন না? সুন্দরী করে ওই মেয়েটা—এলিনা নাম তাই না! তার ক্লাসের ব্যাপারে, না?
-জি স্যার।
এখানে কাজ করা খুব সমস্যা। সিসি খুব বাড়াবাড়ি করছে। আমার এখানেও জোর করে ওকে ক্লাস দিতে বাধ্য করেছে। তখন তো আবার ভিসি ছিলেন ড. শাহেদ জাহান—তুমি তো ছোট ভাইয়ের মতো কী আর বলি—বাজে একটা ভিসি ছিল। চরিত্র বলে কিচ্ছু ছিল না। ডন্ট মাইন্ড। কিছু মনে করো না। আর কিছু ফিমেল ফ্যাকাল্টিও দেখেছিরে ভাই, একটু সুবিধা নেয়ার জন্য ভিসির কাছে লাইন ধরে থাকত! ছিঃ!
-আপনি তো তাকে ক্লাস দিয়েছেন!
-ভিসি দিতে বললে, আমার না বলার ক্ষমতা আছে? তারপর যদি আবার সিসিও বলে—ডবল ক্ষমতা একসঙ্গে প্রয়োগ করলে, আমি সুভদ চ্যাটার্জি তা ঘাড়ে না নিলে, আমার ঘাড় থাকে! দেখলে না পাওয়ারফুল ডিন গোলাম রসুল কওয়া নেই বলা নেই কিভাবে কাট হয়ে গেলো! নিষ্পাপ মেয়েটার কথা ভাবো! ওর স্বামীকে ও কী অ্যানসার করবে! তাও এরকম একজন শক্তিমান ভিসি থাকাকালে! ভাবতে পারো!
ঠিকই স্যার। কঠিন অবস্থা। এলিনা ম্যাডাম কি এখনো আপনার এখানে ক্লাস নেন?
নেয় তো। তবে ভাবছি, সামনের সেমিস্টার থেকে বাদ দেবো। ভিসির সঙ্গে কথা বলেছি। জানি সিসি জ্বালাবে। জ্বালাক। ভিসি ঠিক থাকলে সিসি এখন আর কিছু করতে পারবে না। আর আমাদের ডিন ড. আব্দুল হামিদ পুরো একটা ক্রিমিন্যাল—তার থেকে খুব সাবধানে থাকবে। আর জানো, এই কয়দিন আগেও সিসি করিম ড. ফারজানা, তোমার আগে যে তোমার বিভাগের প্রধান ছিল, তার জন্য তো উন্মাদ ছিল। তার চেয়ে বেশি সুন্দরী নতুন একটা পেয়ে তাকে তো আউট করে দিলো। এখানকার খেলা কাটারমাস্টার মোস্তাফিজের বলের মতো। পেছন থেকে উইকেট হাওয়ায় ভাসে, ব্যাটসম্যান টেরও পান না।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য ভাবলেন, ভিসি স্যার তো ডিন আব্দুল হামিদের প্রশংসা করেন। কিন্তু সুভদ্র স্যার তো উল্টোটা বলছেন। আসলেই তো এখানে ঝামেলা আছে! সবকিছু বোঝা ভারি মুশকিল!
সুভদ্র চ্যাটার্জি বললেন, ডিন তো আমারই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিওটি অফিসের সঙ্গে ভাব করে আব্দুল হামিদ ডিন হয়ে গেলেন। আমার হওয়া ডিন হতে পারলাম না। এখানে তেল যে যতো বেশি মারতে পারে, পিছলা ততো বেশি হয়, কাজটা সহজ হয়ে যায়। আব্দুল হামিদ তো তাই করেই ডিন হয়ে গেলেন।
ড.অনিন্দ্য অর্ঘ্য ডিন আব্দুল হামিদের সঙ্গে সুভদ্র চ্যাটার্জির অপছন্দের মূল ব্যাপারটি বুঝতে পারলেন। কিন্তু এ প্রসঙ্গে কোন কথাই বললেন না। সিসি প্রসঙ্গে বললেন, স্যার, সিসি এরকম ডিস্টার্ব করলে তো এখানে কাজ করা বিপদ!
এখন অতোটা সমস্যা নেই। ভিসি স্যার ভালো মানুষ। মাথা উঁচু করে চলেন। নীতিবান মানুষ। তেজস্বী ব্যক্তিত্ব। কাজ করে যাও। আর সমস্যা সবখানেই আছে। তুমি আগে যেখানে ছিলে, সেখানে ছিল না? সেখানেও তো ছিল। চাকরি মানে গোলামি—কথাটা মনে রাখবে— সমস্যা থাকবেই।
এ সময় ড. এলিনা রহমান ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে ফোন করেন। সুভদ্র চ্যাটার্জিকে কল দেখিয়ে বললেন, দেখুন স্যার, একটু আগে তার হয়ে সিসি ফোন করলেন। এখন আবার তিনি নিজেই ফোন করেছেন। কী বলি বলুন তো!
সিসিকে যা বলেছ, তাকেও সেটাই জানিয়ে দাও।
ড. এলিনা বলুন।
ড. অনিন্দ্য, আমার ক্লাসের ব্যাপারে কি করলেন?
সরি, ম্যাডাম। এ বিষয়ে আমি এখন আপনাকে কিছু বলতে পারছিনে।
তাই! সরিতেই কি সব শেষ হয়ে যাবে! আপনি কিন্তু আমাকে ক্লাস ঠিকই দেবেন। তবে জল হয়তো অনেক ঘোলা হবে। ফোন রেখে দিয়ে ড. এলিনা রহমান আব্দুল করিমের গলা জড়িয়ে ধরে বললেন, আপনি আমার জন্য এটুকু করতে পারছেন না! আর আমি আপনার জন্য তো সবটুকুই করছি। কোথাও কী একটু বাদ বা কমতি রেখেছি মাই ডিয়ার করিম! আপনার সারা শরীরে আমি কিন্তু ছন্দ মাত্র অলঙ্কারপূর্ণ কবিতার মতো আমার এই সুন্দর তন্বী শরীর আপনার করে দিয়েছি। আপনি ধ্যানীর মতো সন্ত্রমুগ্ধের মতো তা পান করছেন। আপনার কোথাও একটুও অতৃপ্ততা রাখিনি। শুধু আমি তো আপনার কাছে একটুখানিই চেয়েছি—আর তা দেয়ার ক্ষমতা আপনার আছে, ডিয়ার।
বাংলা বিভাগে ক্লাস—এই তো! বেশি কিছু তো চাননি। সামান্যই চেয়েছেন। দেবো। একটু অপেক্ষা করুন। পেয়ে যাবেন।
ড. এলিনা সশব্দে হাসলেন। তারপর আব্দুল করিমের ঘুমঘুম ক্লান্ত চোখে চুমুর মেঘ নামিয়ে বললেন, ঘুম আসছে! সুখের ঘুম! ক্লান্তির ঘুম! তৃপ্তির ঘুম! আমি এমন ঘুম আপনাকে বহুবার উপহার দেবো। বলেই তার মাথাটা বুকের উপর নিয়ে, মাথার চুলে আদর করতে করতে বললেন, আমি বাংলা বিভাগের খণ্ডকালীন নয়, স্থায়ী শিক্ষক হতে চাই। তারপর বিভাগের চেয়ারপারশন। ইটস মাই ড্রিম। হাঁ, তার আগে পার্টটাইমার হিসেবে দু এক সেমিস্টার থাকতে আমার অসুবিধে নেই। আপত্তি নেই। কিন্তু আমি আমার স্বপ্ন ছুঁতে চাই—নিজের মুঠোয় পুরতে চাই। আর সেজন্য আপনার পাওনাটা দিতে আমি কিন্তু একটুও দেরি করিনি—একটুও কার্পণ্য করিনি। আরও দেবো। আপনি যতটা নিতে পারেন—আমি উজাড় করে দেবো।
আপনার স্বপ্ন খুবই সামান্য ভাবী। শিগগিরই পূরণ হবে। জাস্ট ওয়েট ফর টাইম।
ভাবী! সবসময় সব পরিবেশে সেকেন্ডহ্যান্ডমার্কা এই সম্ভোধনটা ভালো লাগে না। মানায় না ডিয়ার। ওটা লোকের ভেতর বা অফিসের জন্য মানায়। ভাবী মানেই তো অন্যের, নিজের তো নয়। অই ডাকটা দিলে না নিজের শরীর থেকে ব্যবহৃত পুরনো একটা গন্ধ বের হয়ে আসে, মাদকতায় ঝাঁজটা ওরকম থাকে না। আমাদের সম্পর্ক এখন ওসবের অনেক উর্দ্ধে—যার উর্দ্ধে আর কিছু নেই—শুধুই বিলিন হওয়া। এমন কিছু ডাকেন—আমার নিজের কাছে নিজেকে ভোরের ভার্জিন মনে হবে—অফোটা গোলাপগুলো আমার হয়ে ফুটবে—আমার জন্য প্রথম ঘ্রাণময় হবে—আমিও..।
আব্দুল করিম ভাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামান্য একটা শিক্ষক হওয়ার জন্য— সামান্য এটুকুর জন্য এতো ধনী—এতো সুন্দরী রূপশ্রী একজন নারী কিভাবে অনায়াসে নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছে! কতরকম উপমায় কতরকম সৌন্দর্যে..!
ড. এলিনা রহমান বললেন, ডিয়ার করিম, ভাবতে হবে না। আমি জানি আপনি এটা আমার জন্য করবেন। ও ক্ষমতাটুকু আপনার আছে। বর্ষা দেখেছেন? বর্ষার পানিতে নদী কিভাবে ভরে যায়! একসময় নিজের বুক ভরে উপচে ওঠে। দুকূল প্লাবিত করে ভাসিয়ে দেয় দূর দিগন্ত মাঠ। তখন বর্ষাকে কতজন অভিসম্পাত করে—কারণ কেউ ঘর হারায়—কেউ পুকুরভরা মাছ হারায়—কেউ উঠতি ফসল হারায়—কেউ বিষধর সাপের কামড়ে জীবনও হারায়। তারপর বর্ষা যখন একদিন শেষ হয়ে যায়—জমিনে পলিমাটি রেখে যায়—উর্বরতা দিয়ে যায়। কৃষকের বুক ভরে মন ভরে স্বপ্ন বুনে যায়—মাঠের পর মাঠ সবুজ ফসলে ভরে ওঠে—প্রাণভরা সুখের হাসি দোল খেলে যায়। মনে করুন, আমিও আপনার জীবনে বর্ষার মতো এসেছি। আমি দেবো—নিজেকে বারবার নিঃস্ব করে আপনাকে সুখে ভাসাবো—কিন্তু আমার মনের বিরান জমিনে পলিমাটি চাই—উর্বরতা চাই—মনের জমিনে মাঠভরা সবুজ ফসল চাই।
আপনি এত সুন্দর করে বলেন কিভাবে! আপনার কণ্ঠসূধাও রাতভর পান করলে তৃষ্ণা মিটবে না।
পুরুষ মানুষের তৃষ্ণা! যখন যে বনে যায়। একটু খোঁচা দিয়ে বলেই কথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন,আপনার ঘরের চাবিটা কিন্তু এখন আমার হাতে!
মানে, আমার ঘরের চাবি, আপনার হাতে কিভাবে আসবে! বুঝলাম না।
বোঝাটা একদম সোজা। আপনার হাতে এখন যে দামি ঘড়িটা—দাম ষাট হাজার টাকা। ওটা কিন্তু আমি আপনাকে উপহার দিই নি। সাবিহা করিম—মানে আপনার সহজ সরলা স্ত্রী—আমি যাকে ভাবী ডাকি—তিনি জানেন, এটা আমি আপনাকে দিয়েছি।
রাইট। কিন্তু আপনি কি তাকে বলে দিয়েছেন?
না। বলিনি। তিনি আমাকে বলেছেন, ভাবী, আপনি আপনার ভাইকে যে ঘড়িটা দিয়েছেন, সেটা তো অনেক দামি—খুব সুন্দর। আমি তখুনি বুঝেছি—খেলাটা অন্য। ওটা ড. ফারজানার উপহার।
তারপর? বিস্ময়কণ্ঠে বললেন আব্দুল করিম।
-ভয় পাচ্ছেন? ভয়ের কিছু নেই। আমি কৌশলে উত্তর দিয়েছি—হ্যাঁ উপহারের জিনিস তো একটু দামিই হয়, দেখতেও সুন্দর হয়।
সাবিহা কি বললো? অস্থির চিত্তে আব্দুল করিম ড. এলিনার কোলের উপর থেকে উঠে সোফায় যেয়ে বসেন। ড. এলিনা রহমানের কথার তাপে আব্দুল করিমের আবেগ তখন পুড়ে ভেতরে অসহ্য গন্ধ ছড়াচ্ছে।
সাবিহা ভাবী শুনে হাসলেন। বললেন, তা ঠিক। কিন্তু আমি জীবনে এতো দামি কোনো কিছু উপহারের জন্য কখনো কিনিনি। করিমের জন্যও না।
-শুনুন করিম সাহেব, আপনার বউ এখন জানেন, ঘড়িটা আমিই আপনাকে দিয়েছি। আমি আপনাকে বাঁচিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আপনি আমাকে সেদিন মিথ্যে বলেছিলেন, ঘড়িটা ভাবীই আপনাকে উপহার দিয়েছেন। আসলে দুনিয়াটা খুবই রহস্যপূর্ণ! পুরুষ মানুষ বলে নারী রহস্যময়ী! স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও নাকি নারীর মন বোঝে না! আমার কাছে তো উল্টোটা মনে হয়। পুরুষকেই তো চেনা যায় না—যখন যার কাছে—তখন তার! আমি জানি ঘড়িটা আপনাকে কে দিয়েছে— বলতে পারতেন। বললেন না ড. ফারজানা দিয়েছেন। বুদ্ধিটাও তারই শিখিয়ে দেয়া। এখন কিন্তু আপনি আমার কব্জার ভেতর! ভবিষ্যতে আরও কারো বুকের ভেতর নিজেকে হারানোর ইচ্ছে আছে নাকি! রসিকতা করে বললেন ড. এলিনা রহমান।
এমন অসহায়ভাবে ড. এলিনার দিকে আব্দুল করিম তাকালেন, যেন নিজের অনেক সাধনায় গড়া রাজপ্রাসাদ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে! তার কিছুই করার নেই, অসহায়ের মতো শুধু দেখা ছাড়া।
আমি আপনার কোন ক্ষতি করবো না, করিম ভাই। আমি নিজেও আপনাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি—আমার জীবনে অনেক দুঃখ আছে—কষ্ট আছে—ভুল আছে। আমি ভুল করে একজনকে ভালোবেসেছিলাম। যিনি এখন আমার স্বামী—আকিজ রহমান—অবসরপ্রাপ্ত মেজর। তার বয়স আমার দ্বিগুণ। আগের স্ত্রী আছে—সন্তান আছে। সে আমাকে এসবের কিছুই বলেনি তখন। বলেছিল, একটা মেয়েকে ভালোবেসে তাকে পাননি বলে, আর বিয়েই করেননি। করতেও চান না। বাকি জীবনটা তার স্মৃতি মনে করেই কাটিয়ে দিতে চান! তার কথাটা আমার অন্তরে খুব গেঁথেছিল, ভেবেছিলাম, যে মানুষটা একজনকে ভালোবেসে তাকে না পেয়ে পুরো জীবনটাই এভাবে শূন্যে অর্থহীনভাবে ভাসিয়ে দিতে পারে, সে তো সত্যিকারের মানুষ। আমি তাকে ভালোবাসবো—থাক বয়সের অসমতা—জানেন, আমার বাবার থেকেও তার বয়স বেশি। তারপরও তার সুখবধু সবুজ জমিন হওয়ার জন্য আমিই বেশি পাগল হয়ে উঠেছিলাম। ফুলে ফলে তাকে ভরে দেবো বলে। আবেগ মোহ এমন একটা জিনিস—যা মানুষকে একদম অন্ধ করে দেয়, কোন কিছু বাছ-বিচার করার ক্ষমতা থাকে না। বুদ্ধি কাজ করে না।
বাস্তবতা আবেগের অন্ধকারে ডুবে যায়—দেখা যায় না। আমারও তাই হয়েছিল। আমাদের পরিবারের কেউই আজো আমার এই সম্পর্ক মেনে নেয়নি। একসময় মোহটা দূর হয়ে গেছে—আবেগটা কেটে গেছে—কিন্তু কোন কোন ভুল থেকে আর বের হয়ে আসা যায় না। ধর্মীয়-সামাজিক যে বন্ধনটা তার আমার হলো—তা তো বাঁধভাঙার মতো ভেঙে ভেসে গেলো না। ওরকম বন্যাও জীবনে আর আসেনি—যা ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারতো! যখন জেনেছি তার বউ আছে—বাচ্চা আছে—আমি যে কতদিন পাগলের মতো কেঁদেছি, সে হিসাব হারিয়ে যাওয়া সময়ের বুকেই লেখা আছে। তখুনি আমি এমএ করতে চেয়েছি— পিএইচডি করতে চেয়েছি। পিএইচডি করার কথা বলে একটু থামে—ভাবে এই মিথ্যাটা আমাকে সত্য করেই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। একটু পানি খেয়ে বললো, অনেক কষ্ট করে আমি পিএইচডিটা করেছি। সব সময় ভেবেছি, যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে, আমি মনের মতো একটা ছেলেকে আমার বর হিসেবে ঈশ্বরের কাছে চাবো—যাকে দেখে আমার চোখ-মন ভরে থাকবে। আমার শরীর ভোরের লাল টকটকে গোলাপের মতো ফুটে থাকবে। নিশিভর হাসনাহেনার ঘ্রাণে মুগ্ধ করবে। মধ্যরাত আমার তৃষ্ণায় আগুন হয়ে উঠবে। আপনাকে দেখে প্রথমেই আমার ওরকম কিছু মনে হয়েছিল। মন ভরে গিয়েছিল। কিন্তু দেখলাম অন্য এক নারীর দখলে আপনি— অথচ সেই নারী আপনার বউ নয়। খুব খারাপ লেগেছিল। আপনাকে যে আমার নিজের করে এভাবে এত দ্রুত আপন করে পাবো, তাও ভাবিনি। আমিই নিজের থেকেই প্রমত্ত নদীর মতো আপনার ওপর আছড়ে পড়েছি—এই স্বীকারে আমার কোনো অপরাধ নেই।
আব্দুল করিম বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে ড. এলিনা রহমানকে। কেন যেন তাকে একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, আচ্ছা এলিনা, আপনি আমার সঙ্গে ক’দিনের পরিচয়ে যেভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করলেন, এরকম কি আরও করেছেন? —না, প্রশ্নটা আর করলেন না আব্দুল করিম। কিন্তু কেমন যেন তাকে নিয়ে এলোমেলো একটা ভাবনা মাথার ভেতর থেকেই গেলো। স্বার্থের জন্য যে নিজেকে এতো সহজে এভাবে বিলাতে পারে, এতোটা জীবন পথে সে কী নিষ্কণ্টক পুষ্পের মতো থেকেছে! নাকি স্বার্থের কাছে প্রতিদিনের ভোরের ফুলের মতো নতুন হয়ে ফুটে ওঠে! এলিনাকে কিছুই বললেন না, ভাবলেন এবার নিজেকে। আমার সামান্য যে ক্ষমতা—এই ক্ষমতাটুকু দিয়ে আমি যেভাবে ফারজানা এলিনাদের ব্যবহার করি তা কি কম অপরাধ! আমার মতো যারা চেয়ারের ক্ষমতা খাটিয়ে অনায়াসে এসব পেয়ে যাচ্ছে—এসব করছে—তাদের কজনকে এই সমাজ চেনে! পরিবার কতটুকু চেনে! ভগবানের মতো কী সুন্দর সম্মান নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি!
এলিনা রহমান তার ভাবনার কিছুই অনুধাবন করতে পারলেন না। আর্দ্রকণ্ঠে আবার বললো, দেখেন, সবাই আমার লেখাপড়ার ডিসিপ্লিন নিয়ে কথা বলে। এজন্য আমাকে ক্লাস দিতে হাজারটা সমস্যা! আচ্ছা, আপনি আমাকে বলুন তো, কেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি ভিসি আছেন, তিনি কি কোনদিন অধ্যাপনা করেছেন? করেননি। তিনি ব্যবসা করতেন। হ্যাঁ, তিনি আমেরিকা থেকে পিএইচডি করেছেন। তিনি কি করে সরাসরি প্রফেসর হন? আচ্ছা প্রফেসর না হয় হলেন! ভাইস চ্যান্সেলর হন কিভাবে? তাও তো হয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে নিয়মের প্রয়োজন নেই? আমার পড়ালেখায় ডিসিপ্লিনে একটু সমস্যা আছে, আমি মানছি। তাই বলে কি এত দূর!
আব্দুল করিম ড. এলিনা রহমানকে বললেন, ভাবী, আপনার চাকরি বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়েই হবে, আমি কথা দিচ্ছি। আপনি বিভাগের চেয়ারপারশনও হবেন। এটা করার দায়িত্ব আমার। ড. অনিন্দ্যকে কিভাবে বের করে দিতে হয়, তা আমি জানি। এটা আমার জন্য খুবই সামান্য একটা কাজ। আজ কিভাবে ডিনের মতো পাওয়ারফুল ব্যক্তি এবং তার বিভাগের ড. তৌহিদাকে বের করে দিলাম, গতকালও কেউ বুঝতে পারেনি—রাত পোহালেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কি ঘটতে যাচ্ছে!। ভাইস চ্যান্সেলরকেও বুঝতে দেয়া হয়নি—এমনভাবে ম্যাকানিজম করেছি। ড. সাদিক আহসান কিন্তু খুব পাওয়ারফুল ভিসি। বোর্ডও তাকে হিসেব করে চলে। মাথানত করা লোক নন তিনি। শতভাগ সততার সঙ্গে চলেন। প্ল্যান করে এগুতে হবে। তাড়াহুড়ো করা যাবে না। একটু সময় হয়তো লাগবে, আপনার স্বপ্নপূরণ আমি করে দেবো।
আবেগে ড. এলিনা রহমান আব্দুল করিমকে বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন, এ মুহূর্তে পৃথিবীতে আমার থেকে সুখি মানুষ আর কেউ নেই। আমার ভাগ্য আপনাকে আমি জীবনে পেয়েছি।
আগে কাজটা শেষ করি। স্বপ্নটা পূরণ হোক। ড. অনিন্দ্যকে আগে সরানোর ব্যবস্থা করি। জানেন, ডিন গোলাম রসুল আমাকে মানতে চাইতো না—দেখা হলে সালামও দিতো না। নিজেকে বিরাট লাটবাহাদুর মনে করতেন। অনেকদিন ধরেই এটা করে আসছিল। অনেকদিন ধরেই পরিকল্পনা করছিলাম—কিভাবে তাকে তাড়াই! তিনি ড. তৌহিদার সঙ্গে গবেষণার কিছু কাজকর্ম করতেন। যে কারণে তার রুমে তৌহিদাকে বেশি থাকতে হতো। বেশ! তৌহিদার সঙ্গে ডিনকে পেঁচিয়ে দিয়ে একসঙ্গে দুজনকেই বিদায়! তৌহিদা কিন্তু ভালো মেয়ে ছিল—আমাকে সম্মানও করতো। কিন্তু ড. গোলাম রসুলকে তাড়াতে হলে কাউকে তো বলির পাঁঠা বানাতেই হবে। ড. তৌহিদা এখানে তাই হয়েছে।
প্রয়োজনে এসব তো কিছু করতেই হয়। এসব না করলে স্বার্থ উদ্ধার হবে কিভাবে! নিজের পথ পরিষ্কার থাকবে কি করে! ড. অনিন্দ্যকেও এভাবেই গিলে খেতে হবে। কোনো ফিমেল ফ্যাকাল্টি বা তার প্রোগ্রাম অফিসারও তো ফিমেল। এদের কারো সঙ্গে একটা বদনাম বের করে বরখাস্ত করে দেন। আর এদের সঙ্গে এটা করতে সমস্যা মনে হলে, ডিপার্টমেন্টে কত সুন্দরী ছাত্রী আছে—কোন একজনের নামের সঙ্গে অনিন্দের নাম জড়িয়ে ফেসবুকে একটা ভূয়া আইডি থেকে ছেড়ে দিলেই তো খেলা খতম! আমার পথটা পরিষ্কার হয়ে যায়।
ভাবেন না। ড. অনিন্দ্যও এখানে ডিন গোলাম রসুলের নিয়তি বরণ করবে। অপেক্ষা করেন। তবে ছেলেটা অনেক ট্যালেন্ট। প্রচুর কাজ জানে। ডিপার্টমেন্ট বোঝে। ভিসি খুব পছন্দ করেন। আমার সঙ্গেও সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলে। ফলে এটার জন্য পরিকল্পনাটা অন্যরকম করতে হবে।
কি করবেন না করবেন আমি কিচ্ছু জানিনে। আমার জীবনের এই স্বপ্ন আপনি পূরণ করে দিবেন—এটুকুই আমার চাই।
কথা তো দিয়েছি। আর তা যদি না হয় বাংলা বিভাগই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে না। বলেই আব্দুল করিম বেরুরোর জন্য উঠে দাঁড়ায়।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য কিন্তু অনেক ত্যাড়া আছে। সহজে নত হওয়া ছেলে নয়। আমি কথা বলে বুঝেছি।
সেটা আমি দেখবো। বলেই, ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে আবার কল করলেন। অনিন্দ্য হ্যালো বলতেই, আব্দুল করিম বললেন, আপনি কোথায় এখন?
অফিসে। বিশেষ কোন দরকার করিম ভাই?
আগামীকাল আপনার ফ্রি এক টাইমে আমার রুমে একটু আসবেন। বলেই মোবাইল রেখে দেন।
সিসির সঙ্গে কথা বলার পর ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য ভাবলেন, সিসি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছেন কেন! সকালে একবার কথা বললেন, তখনো তার কথার ভাব ভালো লাগেনি!
এসময় তিনি ফারিয়াকে নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসের উপস্থিতির সব খাতা দেখছিলেন। ফারিয়া হিসাব করে বোঝাচ্ছিলেন কোন কোর্সে কোন শিক্ষকের ক্লাসে কত শতাংশ শিক্ষার্থীরা ক্লাস করে। শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাস নেন কিনা—সেসবও দেখছিলেন।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য সিসির ফোন রাখার পর কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে যান। তার কথাগুলো নিজের কাছে কেমন যেন একটু অপমান লাগে। ড. এলিনার ক্লাসের জন্য তিনি এতো বাড়াবাড়ি করছেন কেন! এটা তো বিভাগের বিষয়!
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে চিন্তিত দেখে ফারিয়া বললো, স্যার, কোন সমস্যা?
না, কোনো সমস্যা নয়। সিসি সাহেব ফোন করেছিলেন। আগামীকাল দেখা করতে বললেন। সকালে ফোন করে ড. এলিনার ক্লাসের বিষয়ে বলেছেন।
স্যার, একটা কথা বলবো? অবশ্য আমার বলাটা ঠিক হবে কি না—তাও বুঝতে পারছি না। এ বিভাগে অনেক ঝামেলা আছে। বিওটি অফিসও বাংলা বিভাগ পছন্দ করে না। লোকসান ডিপার্টমেন্ট। আপনি আসার পরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, ঝামেলা কিন্তু আরও বেড়েছে। যে সব খণ্ডকালীন টিচার বাদ হয়ে গেছে, তারা দূর থেকে ছাত্রদের দিয়ে খেলাচ্ছে। ডিপার্টমেন্টের পরিবেশটা খারাপ করতে চাচ্ছে। এর আগে বিওটি কয়েকবার ডিপার্টমেন্ট বন্ধ করে দিয়েছিল। আপনি স্যার শুধু বলবেন কি করতে হবে, আমিই সব করতে পারবো। আমরা দুজন যদি ঠিক থাকি স্যার, সব ঠিক। ডিপার্টমেন্ট নিয়ে কেউ কোন খেলা খেলতে পারবে না। আমি সব বুঝি। ডিপার্টমেন্ট কিন্তু এতোদিন আমিই চালিয়েছি। ম্যাডাম তো সারাদিন প্রশাসনিক বিল্ডিংয়েই পড়ে থাকতেন।
জানি। কি বলতে চাচ্ছিলেন যেন?
আজ বিজনেসের ডিন গোলাম রসুল স্যার আর তৌহিদা ম্যাডামের চাকরি চলে গেছে, শুনেছেন তো?
শুনেছি।
এখানে সিসি স্যার খুব পাওয়ারফুল। এখনকার ভিসি স্যারও খুব পাওয়ারফুল। কিন্তু কতদিন তিনি পাওয়ার খাটায়ে কাজ করতে পারবেন বলা কঠিন। এখানে কখন যে কি হয় বোঝা যায় না! এর আগের ভিসি স্যার, তার আগের ভিসি স্যার—দুজনের চাকরিই কিন্তু একঘণ্টার নোটিশে চলে গিয়েছিল।
কী জন্য গিয়েছিল?
নারীঘটিত ব্যাপারে। ড. শাহেদ জাহান স্যারের আগে যিনি ভিসি ছিলেন, তার নাম প্রফেসর সোহরাব হোসেন। তখনকার ডেপুটি রেজিস্ট্রার সাবিকুন সাহানার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। খুব স্মার্ট ছিলেন—সুন্দরীও সেইরকম। তার নির্দেশেই এখানে তখন সব কিছু হতো। ভিসি স্যার তার কথামতো চলতেন। একদিন হুট করেই দুজনেইর চাকরি চলে যায়। আর শাহেদ জাহান স্যারের চাকরি তো গেলো আপনি জয়েন করার কয়েক দিন আগে। তিনি নাকি হোটেলে বিভিন্ন ফিমেল ফ্যাকাল্টি নিয়ে যেতেন। আমাদের ফারজানা ম্যাডামকেও নিতে যেতেন। এসবই তো শুনি। সত্যমিথ্য জানি না, স্যার।
এখনকার ভিসি স্যার কেমন?
বর্তমান ভিসি স্যারের তো অনেক প্রশংসা। আগেকার ভিসি স্যারদের চেয়ে পাওয়ারও ভিসি। মানুষও আলাদা। এখন কতদিন এটা ধরে রাখতে পারেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। মেয়েদের যদি পছন্দ করা শুরু করা শুরু করা—তাহলেই শেষ। অতীতে তো এখানে তাই ঘটেছে। তবে বর্তমান ভিীস স্যার অনৈক কঠিন চরিত্রের মানুষ। সবাই হিসাব করে চলে।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য কথাগুলো শুনে কিছুই বললেন না। চুপ করে কিছু একটা ভাবলেন। এখানকার ভেতরের পরিবেশটা কেমন! ফারিয়াইবা আমাকে এসব কেন বলছে! সে নিজেইবা কেমন মেয়ে! নিজের থেকে অকপটে এসব বলে যাচ্ছে—আমি তো শুনতে চাইনে।
ফারিয়া আবার বললো, স্যার, এখানে তাল মিলে না চললেও বিপদ! কোন ফিমেল ফ্যাকাল্টি কারো নামে কোন অভিযোগ করলে কেয়ামত থেকে কেয়ামত হয়ে যায়! বিন্দুমাত্র বিচার-বিবেচনা করে না। এখানে কত কিছু যে দেখেছি! আপনি আমার বস—আপনাকে আগে থেকেই সবকিছু জানানো আমার দায়িত্ব। আরও আগেই জানাতে চেয়েছিলাম—কিন্তু ওরকম পরিবেশ হয়ে ওঠেনি। আর আপনিও তো আমার সঙ্গে ওরকম কথা বলেন না। সারাক্ষণ অন্যদের নিয়ে কী সব কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কখনো ফ্রি হলেও ডাকেন না। ডিপার্টমেন্টের সব কাজ কিন্তু আপনাকে আর অঅমাকেই করতে হবে।
ও রকম প্রয়োজন না হলে আপনাকে কেন ডাকবো? আর আপনার উপরও ডিপার্টমেন্টের কোন কাজ। একটা মিনিটেরও অনেক মূল্য আছে।
তা তো অবশ্যই স্যার। একটা কথা বলে রাখি, ড. এলিনা ম্যাডামের কিন্তু সিসি স্যারের সঙ্গে অন্য সম্পর্ক আছে। ফলে তাকে পারলে ক্লাস দেয়াই ভালো। ড. ফারজানা ম্যাডামের চাকরি যাওয়ার প্রধান কারণ কিন্তু এলিনা ম্যাডাম।
এখানকার পরিবেশটা একটু কেমনই যেন মনে হয়!
স্যার, ডিপার্টমেন্টের ম্যাডামদেরর বেশি পাত্তা দিয়েন না। যতোটা পারেন দূরে রাখবেন। আমি তো আছি। সব আমি দেখবো। আপনি ভিসি বিল্ডিংয়ে মিটিং সেমিনার এ সব নিয়ে থাকবেন। আর ডিপার্টমেন্টের সব কাজ আমি গুছিয়ে রাখবো। আপনি ডিপার্টামেন্টে যখন আসবেন, তখন তো আমি নিজেই আপনার রুমে এসে সব কাজ বুঝিয়ে দেবো।
স্যার, আর একটা কথা বলি?
বলেন।
আমার কাছে ঘরের থেকে অফিসটাই বেশি প্রিয় হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন এখানে আছি। একটা মায়া পড়ে গেছে। আপনার গুরুত্বও আমার কাছে ঠিক ওরকমই। আপনি আমার প্রতি যাতে খুশি থাকেন, আমাকে যখনই যে কাজে প্রয়োজন মনে করবেন, কোন দ্বিধা বা কোন সংকোচ না করে জানাবেন।
আপনি অনেক সুন্দর। আমিও কম নই। আমার প্রেমে আমি নিজেই পড়ি—কতবার পড়ি—যতবার নিজেকে দেখি—ততবার নিজের প্রেমে পড়ি—আমি এত সুন্দর! স্যারের চোখে আমার এ সুন্দর পড়ে না! পড়িয়েই ছাড়বো আপনাকে। আমার রূপের বড়শিতে আপনাকে গাঁথবোই।
দেখুন, ঘর ঘরই, অফিস অফিসই। একটার সঙ্গে আর একটা মেলাতে যাবেন না। তাহলে বড় বেশি ভুল করে ফেলবেন। যা হোক, আপনি তো সহযোগিতা করছেনই। আপনি নিজেও অনেক আন্তরিক মানুষ। ভালো অফিসার। পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া কোন কিছুই সফল হয় না। আপনার আরও বেশি সহযোগিতা চাই। এ বিভাগকে দাঁড় করানো আমার চ্যালেঞ্জ। কোন চ্যালেঞ্জেই তো একার পক্ষে জয়ী হওয়া কঠিন। সবাই মিলেই কঠেঅর শ্রমে সাধরায় জয়ী হতে হয়।
আমি আপনার সঙ্গে আছি, স্যার। আমাকে যেভাবে আপনি চাবেন, সেভাবেই পাবেন। ফারিয়া কৌশলে ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে বুঝিয়ে দেয় তার ব্যক্তিগত থেকে শুরু করে যেকোন ইচ্ছে বা সাধ পূরণ করার জন্য সে তৈরি আছে। যে কোনভাবেই হোক ড. অনিন্দ্য অর্ঘকে সে নিজের অনুগত করে রাখতে চায়।
খুশি হলাম। তো ঠিক আছে ফারিয়া আপনি রুমে যান। কাজ করেন। ভিসি স্যারের সঙ্গে আমার জরুরি কাজ আছে। আমি বেরুচ্ছি।
স্যার, ছোট্ট একটা কাজ আছে। কাল সকালেই এটা এইচ আর বিভাগে পাঠাতে হবে।
কি কাজ?
বার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন। ফ্যাকাল্টি অফিসার পিয়ন সবারই বার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন দিতে হয়। আমার আর আরিফুলেরটা আগামীকালের ভেতরই দিতে হবে। আর ফ্যাকাল্টিদেরটা আরও পনের দিন পর্যন্ত সময় আছে। এটা আরও আগে বলেননি কেন?
স্যার, আপনি তো সবসময় ব্যস্ত থাকেন। আপনার রুমে তো আসার পরিবেশই পাই না।
দেখি। ফরমটা হাতে নিয়ে দেখে ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য। বিভন্নি ধরণের কাজের উপর পয়েন্ট। মোট ষাট নম্বর। ছয়টা বিষয়ে নম্বর দিতে হবে। ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য আগে এরকম কোন মূল্যায়ন করেননি। ভালো করে জিনিসটা বুঝলেনও না। এটার গুরুত্বও অনুধাবন করতে পারলেন না। বললেন, এখানে তো গুড ভেরিগুড এক্সেিলন্ট আউটস্ট্যান্ডিং আছে। আপনাকে কোনটা দিলে ভালো হয়?
আমার কাজ যদি আপনার ভালো লাগে—আমার আচার আচরণ ব্যবহার এসব যদি ভালো লাগে, তাহলে যেটা ভালো সেটাই দেবেন। কিন্তু এটা আপনার নিজস্ব মূল্যায়ন হবে।
ঠিক আছে রেখে দেন। কাল সকালে আমি এটা সম্পর্কে আগে জানি—বুঝি। তারপর করে দেবো। বিকেলে দিলেও তো হবে।
ফারিয়া কিছু একটা ভেবে বললো, স্যার, আমাকে মনে হয় আপনার পছন্দ নয়! আমার কাজে মনে হয় আপনি খুশি নন।
তা কেন?
তাহলে আবার কাল করতে চাচ্ছেন কেন? কেউ তো জানছে না—এটা আপনার আর আমার ভেতরে থাকবে। স্যার, আমাকে আউটস্ট্যান্ডিং দিয়ে দেন স্যার। সব চেয়ারম্যান স্যারই তো তাদের প্রোগ্রাম অফিসারকে দেন। আপনি চান না স্যার আমি ভালো থাকি!
ঠিক আছে বলেই ফরমটা পূরণ করে শতকরা আশি ভাগ নম্বর দিয়ে আউটস্ট্যান্ডিং রিপোর্ট দিয়ে ফরমটা খামে ভরলেন। এরপর বললেন, আরিফুলের রিপোর্টটা কেমন দেয়া উচিত?
ফারিয়া বললো, স্যার, ভেরি গুড দিয়ে দেন।
আপনার আউটস্ট্যান্ডিং আর আরিফুলের ভেরি গুড কেন?
তাহলে এক্সিসিলেন্ট দেন।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য ব্যাপারটা আসলে অতো ভালো বোঝেন না। আগে কখনো এর রকম পরিস্থিতির মুখে পড়েন নি। কারো কাছে জানতে চাওয়াটাও বোকামি হয়ে যায় কিনা! ফারিয়ার কথা অনুযায়ী দুজনের রিপোর্ট করে খামে আটকিয়ে এইচ আর বিভাগে পাঠিয়ে দিলেন।
ফারিয়া ভাবে, ড. অনিন্দ্য, আপনি রিয়েলি ভালো মানুষ। কিন্তু অফিসটা কি জিনিস তা আপনি একটুও বোঝেন না। আপনি সরল মনে না বুঝে আজ আমাকে যা করে দিলেন, তা আমার চাকরিজীবনে এর থেকে মূল্যবান আর কিছু নেই। কোন চেয়ারম্যানই তার প্রোগ্রাম অফিসারকে আউটস্ট্যঅন্ডিং দেন না। আপনাকে মিথ্যে বলে আপনার কাছ থেকে আমি তা করিয়ে নিলাম। আপনি ভবিষ্যতে কোন কারণে আমার নামে কোন অভিযোগ করলে তা টিকবে না। কারণ আউটস্ট্যান্ডিং পারফরমেন্স করা একজন অফিসার কখনো অফিসে ফাঁকি বা অফিসের কোন কাজে গাফিলতি করে না—এটিই ধ্রুব সত্য হয়ে থাকে। আপনার কাছ থেকে প্রথম রিপোর্টেই তা করিয়ে নিলাম। আবার এটাও ঠিক আপনাকে আমার অনেক পছন্দ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে স্মার্ট চেয়ারম্যান আপনি— আমার বস! যে দিনের অধিকাংশ সময় আমার সঙ্গে থাকবে! ড. ফারজানার বিদায়ে যে কষ্ট পেয়েছিলাম, এখন আমার আনন্দটা তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি।
নিজের রুমে ঢুকেই ফারিয়া খুশিকণ্ঠে আরিফুলকে বললো, খুব সুন্দর করে আমাকে এক কাফ কফি দিয়ে, এইচ আর বিভাগে খাম দুটো দিয়ে আসো। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি। ফ্রেশ হতে হতে ভাবে, স্যার তো আসলেই ভালো। আমি নিজের থেকে কেন স্যারের সঙ্গে বাধাতে যাই! স্যার তো সব সময়ই আমার সঙ্গে ভালো আচরণ করেন। আসলে ভয়টা আমার নিজেরই ছিল। নতুন স্যার কেমন হবে—তার সঙ্গে কাজ করতে পারবো কিনা—আমার অবস্থা কি হবে! আমাকে পছন্দ করবে কিনা! কতকিছু যে ভেবেছি! অথচ ভাবতে ভাবতে বছর প্রায় হয়ে গেলো—অথচ আমি স্যারের বিরুদ্ধেই লেগে আছি! নিজেই নিজেকে চিনি না! আচ্ছা চেয়ারম্যান স্যারকে একদিন বাসায় নিমন্ত্রণ করলে কেমন হয়! যেদিন দবির বাসায় থাকবে না। তাহলে তো আরও ঘনিষ্ঠ হওয়া যাবে। নদীর নতুন চর দখলের মতো তাকেও দখল করে নেয়া যাবে। কিন্তু তিনি কি আমার বাসায় যেতে সম্মত হবেন! না হলে নারীর ষাল কলার এক কলা দু কলা করে যে কয় কলঅ দেখানো লাগে, দেখাবো। পরিবেশ বুঝে তাকে প্রস্তাবটা দিতে হবে।
দবির মালিথা ফারিয়ার স্বামী। ব্যাংকে চাকরি করেন। পাবনা শহরে বাড়ি। বাবা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মারা গেছেন। অসুস্থ মা একা থাকেন। একমাত্র সন্তান সে। মাকে ঢাকায় নিজের বাসায় অনেকবার অঅনার চেষ।টা করলে দ্বিমুখী সমস্যার কারণে আনতে পারেনি। মা নিজেও আসতে চান না। স্বামীর ভিটিতেই শেষনিঃশ্বাস ফেলতে চান। আবার ফারিয়ারও এককথা তোমার মাকে অনলে আমি এখানে থাকবো না।
আলাদা বাসা নেবো। তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে থাকবে। প্রয়োজন মনে করলে মাঝেমধ্যে আমার কাছে যেতে পারবে। আপত্তি করবো না। কিন্তু তোমার মায়ের সঙ্গে এক বাসায় আমার পক্ষে থাকা সম্ভব হবে না। যে কারণে দবির মালিথা প্রায় প্রতি মাসেই বৃহস্পতিবার অফিস শেষ করেই পাবনায় মায়ের কাছে চলে যায়। শনিবাওে ঢাকায় ফেরে। এসব বিষয় নিয়ে দুজনের মধ্যে মানসিক দূরত্ব যতখানি, শারীরিক দূরত্ব যেন আরও বেশি। দবির মালিথার চেহারা তার একদমই পছন্দ নয়। যে কারণে সে নিজের থেকেই কৃত্রিম সমস্যা সৃষ্টি করে, দূরত্ব তৈরি করে রাখে। কারণে অকারণে অশান্তি বাঁধায়। ইচ্ছে করেই দবির মালিথাকে দিয়ে রান্না পর্যন্ত করায়। ঘর পরিষ্কার করায়। সে প্রথমে প্রথমে এসব নিয়ে আপত্তি করলে বিশ্রিরকমের চিৎকার চেঁচামেচি হতো। কথায় কথায় ডিভোর্সের কথা উঠতো। দবির মালিথা এখন এসব মেনে নিয়েই থাকে। নিজের ঘরে যেন পরবাসি—স্ত্রী থাকতেও ভিন্ন রুমে বাস। ফারিয়া কখনো দয়া করে রাতে তার রুমে গেলে—হঠাৎ মেঘের বৃষ্টির মতো মনে হতো। দবির মালিথার মায়ের অনেক ইচ্ছে ছেলে-বৌয়ের ঘরে ছোট্ট পুতুলের মতো একটা বাচ্চা আসুক। দবির মালিথা অনেকবার ফারিয়াকে তা বলেছেও।
ফারিয়ার এক জবাব, এখন বাচ্চা নিয়ে আমার সুন্দর বডিটার গঠন নষ্ট করতে পারবো না। মেয়েমানুষের বডি যতদিন সুন্দর থাকে, ততদিনই তার দাম। আর তোমার যে চেহারা-সুরত—পেটের ভেতর থেকে তো ওই একই জিনিস বেরুবে! তার চেয়ে ওসব হাউস না করাই ভালো।
ফারিয়ার কথার পিঠে দবির মালিথার কথা বলার সাহস কোনোদিনই হয়নি। এখনো হয় না। যে কারণে অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়ার তাড়না তার যতোটা, ফারিয়ার থেকে দূরে থাকার জন্য মায়ের কাছে ছুটে যাওয়ার তাড়নাও কম নয়।
আউটস্ট্যান্ডিং রিপোর্টটা কৌশলে ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারায়, তার মন ভরে সুখ উড়তে থাকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে স্ফীত হাসিতে নিজেই নিজেকে দেখে। মনে মনে বলে, আজ যেভাবে আপনাকে দিয়ে আমার অফিসের পারফরমেন্সের আউটস্ট্যান্ডিং রিপোর্টটা করিয়ে নিলাম, একদিন আপনাকে দিয়েই আমার ব্যক্তিগত জীবনটাও আউটস্ট্যান্ডিং করে নেবো। আপনি অনেক সুন্দর। আমিও কম নই। আমার প্রেমে আমি নিজেই পড়ি—কতবার পড়ি—যতোবার নিজেকে দেখি—ততবার নিজের প্রেমে পড়ি—আমি এত সুন্দর! স্যারের চোখে আমার এ সুন্দর পড়ে না! পড়িয়েই ছাড়বো আপনাকে। আমার রূপের বড়শিতে আপনাকে গাঁথবোই।
হুট করে নিজেকে নিজেই আবার শক্ত চোখে দেখে—নিজেই নিজেকে বলে—ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য এতো সহজ মানুষ নন। সহজেই তাকে পাওয়া যাবে না। হয়তো কোনদিনই নয়!
যদি না পাই তবে তার জন্য নাগিনীর বিষছোবল!
চলবে…
ঈশ্বর ও শয়তান-১৮॥ রকিবুল হাসান