(পর্ব-১৮)
বাংলা বিভাগের উন্নতি যে এতো দ্রুততার ঘটবে, তা কেউই ভাবেননি। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। প্রাণবন্ত একটি বিভাগ হয়ে ওঠে—শিক্ষার্থীর সংখ্যাও এমনভাবে বেড়ে চলেছে—আগের কোন হিসেবের সাথেও তা একটুও মিলছে না। যে বিভাগে সেমিস্টারে দুজন পাঁচজন ভর্তি হলেই খুশি, সেই বিভাগে প্রতি সেমিস্টারে ত্রিশ চল্লিশজন করে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। একটার পর একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। পত্রিকা বেরুচ্ছে। কতো রকমের আনন্দ কর্মযজ্ঞে মৃতপ্রায় বিভাগটি নতুন প্রাণে জেগে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ড. সাদিক আহসানও খুশি হন। ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে আদর করে শুধু ‘অনিন্দ্য’ সম্ভোধন করে ডাকেন। পুরো বিভাগে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান দারুণ হয়েছে। বিভিন্ন টেলিভিশনে ও পত্রিকায় নিউজ হয়েছে।
ড. সাদিক আহসান বললেন, অনিন্দ্য, স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান তুমি যেভাবে চ্যালেঞ্জ নিয়ে করলে, আমি জানতাম তুমি সফল হবে, তোমার সাংগঠনিক ক্ষমতা আমি আগেই বুঝেছিলাম। কিন্তু এতো বেশি ভালো করবে তা কিন্তু সত্যি ভাবিনি। তুমি সবচেয়ে ভালো কাজ করেছ অল্প সময়ের মধ্যেই স্টুডেন্টরা তোমার অনুগত হয়ে গেছে। এটা একটা কঠিন কাজ ছিল। নতুনকে কেউ সহজে মেনে নিতে চায় না। তুমি অনায়াসেই তা করতে পেরেছ। আচ্ছা বলো তো, জার্নালের কাজটা কতো দূর?
স্যার, আইএসএসএন নম্বর পেয়ে গেছি।
গুড। আর্টিকেল কয়টা পেয়েছ?
বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ও জুনিয়র শিক্ষক মিলে প্রায় পনের জনের আর্টিকেল পেয়েছি। বিভিন্ন কলেজে অনেক ভালো শিক্ষক আছেন—গবেষক হিসেবেও পরিচিতি, তাদের কাছ থেকেও কিছু আর্টিকেল নিয়েছি। এসব আর্টিকেল আশা করি সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই রিভিউয়ের জন্য পাঠিয়ে দেবো। পাঠানোর প্রক্রিয়ার কাজ চলছে। আশা করছি তিন থেকে চার মাসের মধ্যে আপনার হাতে জার্নাল তুলে দিতে পারবো।
সে ভরসা তোমার প্রতি আমার আছে। তোমার জয়েন করার আগেই তা জন্মেছে।
জয়েন করার আগেই! তা কিভাবে সম্ভব স্যার?
আমি ট্যালেন্ট চিনতে খুব বেশি ভুল করি না, অনিন্দ্য। তোমাকে যখন ভাইভার জন্য প্রথম কল করা হয়েছিল, যে দিনটা ভাইভার জন্য নির্ধারিত ছিল, তুমি সেদিন ভাইভা দিতে রাজি হওনি। সেদিন তোমার শিক্ষার্থীদের ভাইভা ছিল। সেটাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলে। এটা আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে। তোমার প্রতি আস্থা বিশ্বাস ভরসা স্নেহবোধ মূলত অদৃশ্যভাবে হলেও সেদিনই তৈরি হয়ে গিয়েছে। তোমাকে বাংলা বিভাগকে অনেক দূর নিয়ে যেতে হবে। দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর তোমাকে একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হবে। শান্তি নিকেতন ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাথেও একটা সম্পর্ক তৈরি করে ফেলো । সেখানকার নামিদামি প্রফেসরদের এখানে বিভিন্ন সেমিনারে নিয়ে আসো। আমাদের এখান থেকেও সেখানকার বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ করবে। বিভাগটাকে আন্তর্জাতিকমানের করে তোলো। হয়তো সময় একটু লাগবে। কিন্তু ইচ্ছেশক্তি যদি প্রবল হয়, কেউ তা রোধ করতে পারে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বাঘা যতীন , সুভাষচন্দ্র বসু এদের ইচ্ছেশক্তিটা দেখো—কী অবিশ্বাস্য! সেটাকে নিজের ভেতর ধারণ করতে হবে। কাজ করতে গেলে অনেক সমস্যা আসবে—নানারকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে—বুদ্ধি দিয়ে কৌশল দিয়ে, কখনো আবার অদম্য সাহসে প্রবল প্রপাতের মতো সব ঠেলে ভাসিয়ে দিয়ে সত্য কে সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। তোমার জন্যও এরকম অনেক বাধা এখানে আসবে। অলরেডি, সেসব কিছুটা হলেও তৈরি হয়েছে। দেখো—বলেই একটা অভিযোগপত্র ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে দিয়ে বললেন, এটা পড়।
আমি ভেবেছিলাম কথাগুলো আপনার মিটিংয়ে বলবো, কিন্তু আমার মনে হয়েছে, আপনার সাথে আমার আগেই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।
অনিন্দ্য পড়তে পড়তে এক দুই করে যতটা লাইন এগোয়, ততই তার কপালে ভাঁজ বাড়তে থাকে—পুরো চেহারাটা পরিবর্তন হয়ে আসে, পরিষ্কার মেঘে হঠাৎ কালো মেঘ জমে ওঠার মতো।
পড়া শেষে ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য বিস্ময় চোখে উপাচার্য মহোদয়ের দিকে তাকালেন। বাকশক্তি যেন রোধ হয়ে আসে তার।
অনিন্দ্য, ভয় পেয়ে গেলে?
না স্যার, ভয় নয়। ভাবছি, এতোসব অভিযোগ আমার নামে! আমি তো এসবের কিছু জানিও না।
তোমাকে এখান থেকে বের করে দেয়ার জন্য একটা অপশক্তি লেগে আছে। আমার পেছনেও আছে। সব প্রতিষ্ঠানেই কমবেশি আছে। তোমার বিভাগ থেকেই অভিযোগপত্রটা এসেছে। কিন্তু নির্দেশনাটা আরো উপরের। পুরোটা বিভাগের নয়। তবে বিভাগের কেউ কেই এই অপপ্রক্রিয়ার সাথে রয়েছে। আমি এতে বিচলিত হইনি। খুশিই হয়েছি। কাজ করলেই তো অভিযোগ আসে। না করলে তো আসে না।
স্যার, আমাকে চীফ কোঅর্ডিনেটর ডেকেছিলেন, ড. এলিনা রহমানকে ক্লাস দেবার জন্য। তিনি খুব শক্ত করে বললেন, এটা বোর্ডের নির্দেশ—তাকে বিভাগে ক্লাস দিতে হবে। ড. এলিনা আমার কাছেও গিয়েছিলেন। তিনি পাস কোর্সে বিএসসি পাস করে, পরে ভাষাতত্ত্বে দুবছরের এমএ করেছেন। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। এসব বললেন। আমি বললাম, আপনার পড়ালেখার ডিসিপ্লিন ঠিক নেই। দ্বিতীয়ত আপনি যে পিএইচডি করেছেন, সেন্ডিকেটে যে এটা অনুমোদন হয়েছে, সেই পেপারটা আমাকে দেবেন, সাথে সনদটা নিয়ে আসবেন। আর অবশ্যই থিসিস পেপার।
আমার কথাতে তিনি খুশি তো হলেনই না। রেগে লালমুখ আরো লাল করে বললেন, আমি কিন্তু আর দশজনের মতো সাধারণ কোন নারী নই। আমার ক্ষমতা কিন্তু বহুদূর। দেখেন, এখানে আমার সাথে ড. ফারজানাও বাড়াবাড়ি করেছিল, সে কিন্তু এখন নেই।
তুমি কি বললে, উপাচার্য মহোদয় জানতে চাইলেন।
আমি বললাম, ম্যাডাম, আমিই খুবই সাধারণ। আমি ক্ষমতাটমতা বুঝি না। আমি দায়িত্বগত কারণেই ক্লাস দেবার আগেই এসব এইচ আর ডিপার্টমেন্টকে দিয়ে দেখিয়ে নিতে চাই। আপনি পেপারগুলো দিলে এইচআর ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দেবো—তারাই এটা দেখবেন।
তিনি তো আরো ক্ষেপে আগুন। বললেন, আমার পিএইচডি নিয়ে আপনার সন্দেহ আছে? আমার জন্য এটা কত বড় অপমান, আপনি তা বোঝেন?
আমি বললাম তাকে, ম্যাডাম, আপনি অযথাই আমাকে রাগ করছেন। আসলে স্যার, আমি যতটুকু জানি, তিনি পিএইচডি করেন নি—আমার কাছে এরকম নির্ভরযোগ্য একটা রিপোর্ট আছে। নামের সাথে চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ তো আর তা দেখতে চান না।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য আরো বললেন, স্যার, আপনার কাছে আমার নামে আরও অভিযোগ আসবে। আমাদের বিভাগে আশি-নব্বইজন শিক্ষার্থীদের জন্য আঠাশ উনত্রিশটি কোর্স অফার করা হতো। নয়জন খণ্ডকালীন শিক্ষক পড়াতেন। দীর্ঘদিন এরকম হয়ে আসছে। এক একটা কোর্সে মাত্র দুজন চারজন করে ছাত্র। সেমিস্টার শেষে শুধু তাদেরই প্রায় দশ লাখ টাকা করে বিল দিতে হয়। আমি এটা বন্ধ করে দিয়েছি। প্রত্যেক কোর্সে ন্যূনতম পনেরজন করে শিক্ষার্থী থাকতে হবে। এখন খণ্ডকালীন শিক্ষক মাত্র তিন জন। আবার শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও একশ বিশ ত্রিশ জন হয়ে গেছে। সামনে এক দু সেমিস্টার পরে আর একজন ফ্যাকাল্টি নিলে খণ্ডকালীন শিক্ষকের কোন প্রয়োজন পড়বে না। বিভাগের ভাবমূর্তিও বাড়বে। ব্যয়ও কমে আসবে।
ওসব বড় বড় প্রফেসররা তো তোমার পেছনে লাগবে। তোমাকে সমস্যায় ফেলতে চেষ্টা করবে। দু চারজন নামকরা ফ্যাকাল্টি ডিপার্টমেন্টে রাখো এতে বিভাগের ভাবমূর্তি তো বৃদ্ধি পায়।
ওরকম নামকরা স্যাররা তো তিনজন আছেন। তাদের ক্লাস দিয়েছি, স্যার। কিন্থু আমার ডিপার্টমেন্টে আরও অনেক স্টুডেন্ট বাড়াতে হবে। খণ্ডকালীন শিক্ষকেরা ক্লাস আর টাকা—এর বাইরে কিচ্ছু বোঝেন না। ডিপার্টমেন্টের কোন অনুষ্ঠানেও থাকেন না। এদের ক্লাস দিলে, এদের কাছে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান নায়ক, ক্লাস না দিলে চেয়ারম্যান ভিলেন। চেয়ারম্যানের নামে বিশ্রি কথাবার্তা ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা এভাবে পড়িয়ে বেড়ান।
প্রফেসর সাদিক আহসান মনোযোগ দিয়ে ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যরে কথা শোনেন।
স্যার, আমাদের এখানে এভাবে চলতে থাকলে বিভাগ তো সারাজীবনই পরনির্ভরশীল হয়ে থাকবে। কোনোদিন মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবে না। আর একটা মারাত্মক সমস্যা আছে স্যার, শিক্ষার্থীরা তো খণ্ডকালিন আর স্থায়ী শিক্ষক এতসব বোঝে না—বুঝতে চায়ও না। একজন খণ্ডকালিন শিক্ষককে তো এক সেমিস্টারের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি হয়তো এক সেমিস্টার বা দুই সেমিস্টার পড়িয়ে চলে গেলেন বা তাকে আমাদের ক্লাস দেয়া সম্ভব হলো না, তখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আমাদের শিক্ষার্থীরা আমাদেরই ভুল বোঝে। শিক্ষার্থীদেও ধারণা, আমরা বোধ হয় তাদের বের করে দিয়েছি। আবার খণ্ডকালিন সেই সব স্যারদেরও অনেকেই শিক্ষার্থীদের সাথে পরিকল্পিতভাবে এমন মধুর অঅন্তরিক সম্পর্ক তৈরি করে নেন, ডিপার্টমেন্ট নিয়ে তারা তখন খেলতে থাকেন। ছেলেমেয়েদের ভুল মেসেজ দেন। যে কারণে খণ্ডকালিন শিক্ষকমুক্ত বিভাগ তৈরি করা প্রয়োজন আমাদের। হয়তো হুট করে হবে না—সময় লাগবে। কিন্তু এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পরিকল্পনায় তা থাকার দরকার রয়েছে।
উপাচার্য মহোদয় খুব মনোযোগ দিয়ে ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যর কথাগুলো শুনছিলেন। বললেন, আসলে বোর্ড মনে করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক এনে পড়ালে, বিশ্বদ্যিালয়ের নাম দ্রæত বেড়ে যাবে। ছাত্ররা ঝাঁকে ঝাঁকে এসে ভর্তি হবে। আসলে এ ধারণাটাও যথার্থ নয়। বিভাগের একজন নিয়মিত শিক্ষক যে দরদ দিয়ে বিভাগে কাজ করবেন, তা অন্যদের কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। আমি তোমার সাথে সম্পূর্ণভাবে একমত পোষণ করি, অনিন্দ্য।
অনেক ধন্যবাদ, স্যার। স্যার, ড. এলিনা বিষয়ে সিসি সাহেব আমাকে তো খুব করে এবেলা ওবেলা নির্দেশ জারি করছেন—বাংলা বিভাগেই তাকে ক্লাস দিতে হবে—তাও একটা নয় দুটো ক্লাস!
তুমি কি করতে চাও?
আমি তো তাকে ক্লাস দিতে চাই না। আমার বিভাগে যারা পড়াবেন—তাদের শিক্ষাগত ডিসিপ্লিন পরিষ্কার থাকতে হবে এবং অবশ্যই ট্যালেন্ট চাই। আমার তো ইচ্ছে পরবর্তী সেমিস্টারে ড. সেলিনা খাতুনকেও বাদ দেবো। উনি তো ক্লাসে বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংবাদ উপস্থাপকের মতো রেডিং পড়েন।
তোমার সিদ্ধান্ত ঠিক আছে। তোমার বিভাগের উন্নতির জন্য যা ভালো মনে করবে, তাই করবে। তবে নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থেকো। সঠিকভাবেনিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করবে।
স্যার, আপনি অনুমতি দিলে আর একটা বিষয়ে কথা বলতে চাই। বিষয়টা খুব স্পর্শকাতর। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ।
বলো।
স্যার, বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের বেতন তো খুব কম। ইংরেজি বিভাগে একজন প্রভাষক যেখানে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা বেতন পান, সেখানে বাংলা বিভাগের একজন প্রভাষকের বেতন পঁচিশ হাজার টাকা। আমার নিজের কথা যদি বলি একই যোগ্যতায় অন্য বিভাগের শিক্ষক আমার থেকে তিনগুণ বেশি বেতন পান। আমি যখন এখানে ভাইভা পরীক্ষা দিয়েছিলাম, তখন এখানে যে এতো বেতনবৈষম্য, তা আমার জানা ছিল না। আমার ধারণা ছিল, অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট অবকাঠামো আছে। আমি বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেখানে পাঁচ হাজার টাকা পাই, অন্য বিভাগের চেয়ারম্যান সেখানে পান দশ থেকে পনের হাজার। এটা তো অদ্ভুত একটা নিয়ম! আমি ভেবেছিলাম কথাগুলো আপনার মিটিংয়ে বলবো, কিন্তু আমার মনে হয়েছে, আপনার সাথে আমার আগেই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।
তোমার কথাগুলো যৌক্তিক ও যথার্থ। আমি নিজেও যখন এখানে আসি, তখন এতসব জানতাম না। যখন জেনেছি, তারপর থেকে আমি কাজ শুরু করেছি। আমি চেষ্টা করছি একটা নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো দাঁড় করানোর। বোর্ডের সাথেও কথা হয়েছে। তারা রাজি-অরাজি দুটোর ভেতরই আছেন। কতোটা কী হবে বুঝতে পারছিনে। বোর্ডের সবাই তো আর একরকম নন। অনিন্দ্য, আমি এখানে শুধু চাকরিটা করার জন্য আসিনি। এটা আমার কাছে একটা ব্রত। ব্রত নিয়ে এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয়টা আমি অনেক উপরে নিয়ে যেতে চাই। আমি চিরকাল এখানে থাকবো না, কিন্তু সবাই যেন বলে সাদিক আহসান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে ন্যূনতম হলেও অবদান রেখেছেন। এখানকার সমস্ত শিক্ষক-কর্মকর্তা আমার নিজের পরিবারের সদস্যদের মতো। আমি সবারই কল্যাণ করতে চাই।
স্যার, আপনার প্রতি আমার সে আস্থা ও শ্রদ্ধা প্রবলভাবে আছে।
তুমি তো লেখালেখি করো। দেশের বিভিন্ন কলেজের সাথেও তোমার ভালো যোগাযোগ আছে। এদের সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করো। মনে করে নাও প্রত্যেক সেমিস্টারে চৌষট্টিটা জেলা থেকে একজন করে ছাত্র তুমি বাংলায় ভর্তি করবে। তাহলেও এক সেমিস্টারে তোমার ডিপার্টমেন্টে চৌষট্টিজন ছেলেমেয়ে ভর্তি হবে। তাহলে তোমার ডিপার্টমেন্ট এক দু বছরের ভেতর বড় একটা ডিপার্টমেন্ট হয়ে উঠবে। এবং তুমি তা পারবে। আর একটা ব্যাপার তো আছেই, সরকার তো বলে দিয়েছে, ইউজিসি থেকে নোটিশ এসেছে, এ বিষয়ে ইউজিসি বইও প্রকাশ করেছে—প্রত্যেক বিভাগে বাধ্যতামূলকভাবে ‘বাংল ভাষা ও সাহিত্য’ এবং ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’—এ দুটো কোর্স পড়াতে হবে। এটা একসময় প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াতে হবে। তখন কিন্তু তোমার বাংলা বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বড় ডিপার্টমেন্ট হয়ে যাবে। অনেক শিক্ষক প্রয়োজন হবে।
ড. সাদিক আহসান আমার কাছে ‘পথের দাবি’র সব্যসাচী—সত্যের সাধক। তার আদর্শে বহু পথ হাঁটতে হবে আমাকে —সবে তো হাঁটা শুরু!
কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয় তো এ কোর্স দুটো চালু করেছে। আমাদের এখানে কি অবস্থা, স্যার?
চেষ্টা করছি। দেখা যাক। যে সব সাবজেক্টে টাকা কম, বোর্ড সেসব সাবজেক্টে খুব বেশি আগ্রহ দেখায় না। কিন্তু এটা তো সরকারি নির্দেশ—দুদিন আগে পরে তো চালু করতেই হবে। আচ্ছা, অনিন্দ্য, তুমি ছাত্র রাজনীতি করতে?
জি স্যার।
সুস্থ ছাত্র রাজনীতি আমাদের দেশে খুব দরকার। দেখো, তুমি যেভাবে নিজের বিভাগের জন্য কথা বলছো, আর একজনও এরকম করে বলে না। শুধু চাকরিটা কিভাবে বাঁচিয়ে চলবে, সেই চিন্তা করে, সেই কায়দা করে চলে। এ তো মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর মতো বেঁচে থাকা। ছাত্র রাজনীতি না করলে মেরুদণ্ড শক্ত হয় না। এখন মেরুদণ্ড শক্ত হওয়ার ওষুধটাই তো ভেজাল হয়ে গেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তো আবার এ ভেজালটুকুও বন্ধ। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও তো ছাত্র রাজনীতি নেই—যা আছে তাকে আদর্শিক ছাত্র রাজনীতি কি বলা যায়, বলো। কীভাবে যে ছাত্র রাজনীতিটা নষ্ট হয়ে গেলো! আমি নিজেও ছাত্র রাজনীতি করেছি। তখন তো মেধাবী ছেলেমেয়েরা রাজনীতি করতো—প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়—সবসময় একটা সুস্থ্য চর্চার ভেতর থাকতে হতো—নৈতিক আদর্শ ও মূল্যবোধ ছিল।
সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিবোধ ছিল। কোথায় যে সে-সব হারালো! যা হোক আমাদের কাজ করতে হবে—একটা নির্দিষ্ট লক্ষ ও উদ্দেশ্য নিয়ে। আমরা অনেকখানি এগিয়ে এসেছি। আরো বহু পথ যেতে হবে।
জি স্যার। স্যার, আমি উঠবো, কিন্তু বেতনের বিষয়টা বিশেষভাবে দেখবেন। আমাদের শিক্ষকরা এটা নিয়ে একধরণের হীনমন্যতায় ভোগে। এমনকি আমার কাছেও এটা চরম অপমানের। এখন তো মনে হয় বাংলা পড়েই বড় পাপ করে ফেলেছি!
আমার প্রতি যে আস্থা তোমার আছে, সেটা রাখো। আচ্ছা, অনিন্দ্য, আগামী সপ্তাহে তো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে বিপ্লবী বীর বাঘা যতীনের ভাস্কর্য স্খাপন কররা হবে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে একজন বিখ্যাত শিল্পী এটা তৈরি করে দিচ্ছেন। তুমি অবাক হবে, তিনি একটা টাকাও এ বাবদ নিচ্ছেন না। তিনি কী বলেছেন জানো, বাঘা যতীনের মূর্তি তৈরি করে টাকা নিলে সে তো আমার মহাপাপ হবে। বাঘা যতীনরাই তো আমাদের দেশটা জীবনদিয়ে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। তাদের দেয়া দেশে বসে—তাদের রক্তের উপর বসে—তাদের ভাস্কর্য তৈরি করে টাকা নেবো! এর চেয়ে বড় অধর্ম আর কি আছে! অনিন্দ্য, পৃথিবীতে এখনো অনেক দেশপ্রেমিক মানুষ আছেন। আমরা যদি তাদের সামান্য আদর্শও অনুসরণ করতে পারি, মানতে পারি—আমাদের শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয়টা নয়, গোটা দেশটাই সুন্দর একটা দেশ হয়ে উঠতে পারে।
একদম সত্য স্যার।
জানো, আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন এসেছি, আমার আরো অনেক বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অফার ছিল, শুধু এই নামটার জন্য—বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়। আর তুমি তাকে নিয়ে এতো কাজ করেছ, তোমাকেও আমার সে জন্য বেশি পছন্দ। কোনদিন অন্যায়ের সাথে আপস করবে না। মাথা উঁচু করে চলবে। চলার পথে দেখবে কতো সহস্র্ররকমের প্রতিবন্ধকতা! সব তুচ্ছ ভেবে সত্যের সাধক হয়ে এগিয়ে যাবে, ঠিক বাঘা যতীনের মতো—সুভাষ বসুর মতো—বঙ্গবন্ধুর মতো।
আপনার এই কথাগুলো আমার মনে থাকবে স্যার। বিভাগের যে কোন কাজ কর্মে তোমার ডিন স্যার প্রফেসর আব্দুল হামিদের সাথে আলোচনা করে নেবে। উনি খুব ভালো মানুষ। নির্লোভ নির্মোহ মানুষ। অনিন্দ্য, আমি দেখতে চাই, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে কেউ পড়ে না—বাংলা বিভাগকে কেউ চেনে না—বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানের কোন গুরুত্ব নেই—এসব মিথ্যা করে দিয়েছো তুমি।
দোয়া করবেন স্যার। ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য উপাচার্য মহোদয়কে স্যালাম দিয়ে বের হতে হতে ভাবে, আমি এখানে চাকরি করি না—এটা আমার বিশ্ববিদ্যালয়—বাংলা আমার নিজের বিভাগ—এটাকে প্রতিষ্ঠিত করা আমার সাধনা। ড. সাদিক আহসান আমার কাছে ‘পথের দাবি’র সব্যসাচী—সত্যের সাধক। তার আদর্শে বহু পথ হাঁটতে হবে আমাকে —সবে তো হাঁটা শুরু!
চলবে…
ঈশ্বর ও শয়তান-১৭॥ রকিবুল হাসান