ষোলো
বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য চেয়ারম্যান হিসাবে যোগদান করে বিভাগে এসে প্রথম দিনেই বৈরি পরিবেশের শিকার হন। কেউ কল্পনাও করেননি তিনি চেয়ারম্যান হয়ে আসবেন; ধারণা ছিল হয়তো কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত কোন নামিদামি প্রফেসর চেয়ারম্যান হবেন। যদি তা না হয়, তাহলে অবধারিতভাবে ড. এলিনা রহমান চেয়ারম্যান হবেন। কিন্তু এর বাইরে কেউ চেয়ারম্যান হয়ে আসবেন, এটা ভুল করেও কেউ ভাবেনি। তার নামও এখানে কেউ শোনেনি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সব শিক্ষক এখানে খণ্ডকালীন হিসেবে পড়ান, তাদের চোখেমুখে বিবর্ণ ভাব ফুটে ওঠে, যখন তারা জানলেন নতুন চেয়ারম্যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। স্থায়ী শিক্ষকেরাও মন খারাপ করে বসে আছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্রের এখানে চেয়ারম্যান হয়ে আসা এ যেন তাদের কাছে অষ্টম আশ্চর্যের চেয়েও বেশি কিছু! কারণ ঢাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখানকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা থাকবে, এটাই তাদের কাছে প্রত্যাশিত। এর একটু ব্যতিক্রম হলেই তাদের কাছে তা মেনে নেওয়াটা বেশ খানিকটা মনোকষ্টের কারণ হয়ে যায়। কারণ তাদের ধারণা, ঢাকার বাইরের কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেউ এলে নিজেদের অবস্থানটা সেভাবে শক্ত থাকে না। বিভাগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাদের যুক্ত থাকার বাসনা খানিকটা হলেও দুর্বল হয়ে যায়; এ রকম ভাবনা তাদের কারও কারও মধ্যে কাজ করে। ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য তা গগন হরকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই খুব ভালো করে বুঝেছেন। সেটাও তার হিসেবের মধ্যে আছে; কতটা সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলতে হবে! প্রোগ্রাম অফিসার ফারিয়া ভেজাচোখে রুম বন্ধ করে আছে; ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে মেনে নিতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্রভাব; আনন্দ-বেদনার বালুচরের মতো অবস্থা বিরাজ করছে।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য ফারিয়াকে রুমে ডাকলেন। সে ভারী পায়ে সহস্র্র বছরের বেদনা যেন চোখেমুখে মেখে নিয়ে এলো। কষ্টে নতুন চেয়ারম্যানের দিকে তাকাতে পারছে না। ভাবছে, ডিপার্টমেন্ট তো আমার কথায় চলতো; আমি যেভাবে চালিয়েছি, সেভাবে চলেছে। সবাই আমাকে মান্য করে চলেছে। আমার সেসব ক্ষমতা এখন তো খাটবে না। দেখে যা মনে হচ্ছে কাজ তো কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নেওয়া লোক তিনি। আর সবকিছুতেই যেভাবে সতর্ক; সচেতন; তারপর স্মার্ট; এখন এখানে চাকরিতে হিসাব করে চলতে হবে। প্রথমেই যদি তাকে বিদায় করে দেওয়া যায়, তবেই কল্যাণ। নাহলে বিপদ আছে। তার বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেপিয়ে তুলতে হবে। তার নামে বিভিন্ন অভিযোগ রেজিস্ট্রার অফিসে পাঠাতে হবে। অতিষ্ঠ করে তুলতে হবে। ডিপার্টমেন্টে একটা অস্থিরতা তৈরি করতে হবে। যেন এখানে ঝামেলায় পড়েন। থাকতে না পেরে বাধ্য হয়ে চলে যায়।
অফিসে ফারিয়ার নিজের একটা অবস্থান আছে। ড. ফারজানা আগে অফিসে নিয়মিত না থাকায়, সবকিছু ছিল ফারিয়ানির্ভর। সব শিক্ষক শিক্ষার্থী তাকে কদর করে চলতো। খণ্ডকালীন দামি শিক্ষকেরা যতক্ষণ থাকতেন, তার টেবিলের সামনে বসে গল্প করতেন। নিজেদের স্বার্থে চা-সমুচা কখনো লাঞ্চ পর্যন্ত করাতেন। যেন কোর্সটা ঠিকমতো পায়; ক্লাসে অনিয়ম হলেও কোনো সমস্যা না হয়। বিলটা ঠিকমতো পাওয়া যায়। তার একটা বিশেষ ক্ষমতা সবার কাছেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
বিভাগের শিক্ষক শাহিদা শাহেদ ও সুমাইয়া সুলতানা; ফারিয়াকে যেয়ে বললো, ফারিয়া আপু, নতুন চেয়ারম্যান স্যারকে কি আমরা বিভাগের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেবো?
ফারিয়া তাদের দুজনের থেকে বয়সে একটু বড়; সে কারণে দুজনই তাকে সম্মান করে কথা বলে। তারাও মনে করে ফারিয়াই বিভাগের সবকিছু। যেহেতু তারা নিজেরা দেখেছে ড. ফারজানা পর্যন্ত তার ওপর দিয়ে কথা বলতেন না, সে কারণে তারাও তাকে মেনে চলে। আবার যখন দেখেন তাদেরই শিক্ষকরা খণ্ডকালীন শিক্ষক হয়ে, তার টেবিলের সামনেই বসে থাকেন। ফলে বাংলা বিভাগ যে পুরোটাই ফারিয়ানির্ভর তা সবাই এখানে বোঝে ও জানে। শাহিদা ও সুমাইয়া ম্যাডামের প্রস্তাবকে সঙ্গে সঙ্গে অগ্রাহ্য করে বললো, কাকে ফুল দেবেন? কিসের ফুল? চুপ করে থাকেন। দেখবেন দুদিন পরে হাওয়া হয়ে গেছে! খুঁজেও পাবেন না।
ঠিক আছে আপু, তাহলে আর দরকার নেই। ফারিয়া বললো, আরিফুল ম্যাডামদের কফি খাওয়াও। ফারিয়া আবার বললো, আপনারা তো বেশিদিন আসেননি। বছরখানেক বিশ্ববিদ্যালয়টা ঠিকমতো চলছে।
সাদিক আহসান ভিসি স্যার হয়ে আসার পর থেকে একটা নিয়মে এসেছে। তার আগে কত কিছু দেখলাম এখানে। সকালে জয়েন করে; বিকালে চাকরি নেই। এখানে কত রকমের খেলা চলে! এখন অবশ্য খেলাটা বোঝা যাচ্ছে না। শোনেন, অই ব্যাটাকে এখানে রাখা যাবে না। বিদায় করে দিতে হবে। আপনারা আমার সাথে থাকলেই হবে। যা করার আমি করবো।
সুমাইয়া সুলতানা বললো, চেয়ারম্যান স্যার যদি ভালো হয়, তাহলে সমস্যা কি?
ফারিয়া বললো, ম্যাডাম, এখন অত ভালো সাজেন না। টিকে গেলে তখন ঠ্যালা সামলাতে পারবেন না। শচীন টেন্ডুলকারকে দেখেছেন ক্রিজে টিকে গেলে বোলারদের কিভাবে তুলোধুনো করে ছাড়ে, এ ব্যাটাও কিন্তু আমাদের তাই করবে। এ ব্যাটা কিন্তু প্রচুর কাজ জানে। ডিপার্টমেন্ট কিভাবে চালাতে হয় ভালো করে জানে। ভাব দেখে বুঝতেছেন না! আমাদের দরকার ফারজানামার্কা চেয়ারম্যান; যে কাজ জানে না; বোঝেও না। একে আগে থেকেই আউট করতে হবে। এর থেকে এলিনা ম্যাডাম ডিপার্টমেন্টের প্রধান হলে ভালো হতো।
আমাদের দায়িত্ব তোমাদের সঠিক দিক-নির্দেশনা দেওয়া; সততা আদর্শে ন্যায়বোধে গড়ে তোলা।
সুমাইয়া সুলতানা কথা বাড়ালো না। শাহিদা শাহেদ সুমাইয়াকে বললো, আপু যেভাবে বলে সেভাবেই চলতে হবে। এখানে আপুর অভিজ্ঞতা অনেক বেশি।
দুই-একদিনের ভেতরেই কয়েকজন ছেলেমেয়েকে দিয়ে নতুন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ লেখায়ে রেজিস্ট্রার স্যারের কাছে পাঠাতে হবে।
আরিফুল তিন কাফ কফি দেয়। রুম বন্ধ করে মজা করে কফি খেতে খেতে কম্পিউটারে হিন্দি সিনেমার গান ছাড়ে ফারিয়া।
নতুন চেয়ারম্যানকে স্বাগত জানানো তো দূরের কথা, কেউ তার রুমেই গেলো না। ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য পিয়ন আরিফুলকে বললেন, ফারিয়াকে ক্লাসরুটিন নিয়ে আসতে বলো।
আরিফুল প্রোগ্রাম অফিসারের রুমে ঢুকেই ফারিয়াকে বললো, ম্যাডাম, চেয়ারম্যান স্যার আপনাকে সালাম দিয়েছেন। ক্লাসরুটিন নিয়ে যেতে বলেছেন।
দেখলেন তো আসতে না আসতেই ডাক পড়ে গেছে! পুরুষ মানুষ তো! আমার চেহারা একটু ভালো দেখছে। দেরি সহ্য হচ্ছে না! পুরুষ মানুষ বস হলে এই এক সমস্যা!
কাপ রেখে বললো, কী আর করা একটু ফ্রেশ হয়েই যাই। তারপর সাজগোজ করে, ঠোঁটে লাল লিপিস্টিক লাগিয়ে, চুলগুলো পিঠের ওপর ছড়িয়ে, ওড়নাটা গলার সঙ্গে লাগিয়ে পেছনে ফেলে, রুটিন হাতে নিয়ে হাসিমুখে চেয়ারম্যানের রুমে ঢোকে।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য রুটিন হাতে নিয়ে দেখলেন; এখন অনার্সের তিনটা ক্লাস আছে। আচ্ছা ফারিয়া, ক্লাসগুলো কি চলছে?
স্টুডেন্টরা জানিয়ে দিয়েছে, ফারজানা ম্যাডামকে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ক্লাস করবেন না। টিচাররা রুমে বসে আছেন। শিক্ষার্থীরা বাইরে যে যার মতো ঘুরছে।
ফারিয়াকে বললেন, সব ছাত্র-ছাত্রীকে হলরুমে যেতে বলেন। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
ফারিয়া বললো, স্যার, ছাত্র-ছাত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। তারা আপনাকে মানতে পারছেন না। তারা ম্যাডামকে ফিরিয়ে আনার জন্য মানববন্ধন করবে। তারা তা করতেই পারে। এটা দেখার দায়িত্ব ম্যানেজমেন্টের। আমার আপনার নয়।ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য বললেন, আপনি বা শিক্ষকেরা কি ছাত্রদের ক্লাসরুমে যেতে বলেছেন? না। বলিনি স্যার। বলে কোনো লাভ নেই। এখানে ছাত্ররা যা বলে তাই হয়। আমাদের কথায় কোনো কাজ হয় না।
ঠিক আছে আপনি রুমে যান। রুটিন হাতে খণ্ডকালীন শিক্ষকদের রুমে গেলেন ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য। নিজের পরিচয় নিজেই দিলেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন খণ্ডকালীন শিক্ষক তার দিকে অগুরুত্বের সঙ্গে না তাকানোর মতো তাকালেন। বললেন, আপনি তো রাজশাহীতে পড়ালেখা করেছেন?
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য বললেন, জি। আচ্ছা, এরপর যেদিন মানে রবিবারে আপনাদের ক্লাস আছে, সেদিন ক্লাসের পরে আপনারা আমার রুমে চা খেতে এলে খুশি হবো। আর বিভাগটা নিয়েও কিছু আলোচনা করবো। আপনাদের তিন জনেরই এখন রুটিনে তিনটা ক্লাস আছে। ক্লাসটাইমের আধা ঘণ্টা পার হয়ে গেছে।
ওদের ক্লাসের কথা বলেছি। ওরা ক্লাস করবে না। মানববন্ধন না কী যেন করবে; বললো সবাই।
আপনারা ওদের বুঝিয়ে ক্লাসে নিতে পারতেন। না গেলেও চেষ্টাটা তো করতে পারতেন। আপনাদের কথা ওরা নিশ্চয় অমান্য করতে পারতো না। ঠিক আছে, আমি নিজেই দেখছি ব্যাপারটা!
তিন জনের কেউ খুশি হলেন না। মুখে তির্যক একটা ভাব করে বের হয়ে যাওয়ার সময় প্রোগ্রাম অফিসারের রুমে মুখ খানিকটা ঢুকিয়ে বললেন, তোমাদের নতুন চেয়ারম্যানের তো ভাব ভালো না!
ঠোঁট বেঁকিয়ে ফারিয়া বললো, নতুন নতুন সবাই এরকম ভাব দেখায়। এখানে কত ডিপার্টমেন্টে এরকম দেখলাম! আপনারা তো বড় স্যার। আপনারা তো তার নামে ভিসি স্যারকে অভিযোগ করতে পারেন! তাহলে দুদিন পরেই দেখবেন খোঁজ নেই।
ফারিয়ার কথায় সুখের ছোঁয়া অনুভব করলেন তিনজনেই। সুমাইয়া সুলতানা বললেন, ফারিয়া আপু, নতুন চেয়ারম্যান স্যারকে যা মনে করছেন অত সহজে কিন্তু হবে না। আপনি জানেন বোর্ডে জাদরেল সব প্রফেসরদের সঙ্গে ফাইট করেই কিন্তু তিনি চেয়ারম্যান হয়ে এসেছেন।
আগের মতো এখন কিন্তু এখানে অনেক কিছুই হবে না, তা কিন্তু বোঝা যাচ্ছে। বিনাকারণে স্যারের পেছনে লাগেন না। এতে ক্ষতিই হবে।
শাহিদা শাহেদও তাতে হ্যাঁসূচক ঘাড় নাড়লেন। বললেন, ঠিকই আপু। সুমাইয়া ঠিকই বলেছে।
আরে অপেক্ষা করো না; এমন দরখাস্ত লিখবো; স্টুডেন্টরা সিগনেচার করে রেজিস্ট্রারকে পাঠিয়ে দিলেই খেলা খতম। এখানে স্টুডেন্টরাই সব। অনার্সের স্টুডেন্ট লাবণী আর সীমান্তকে দিয়ে পাঠাবো। ওদের সবাই পছন্দ করে। আবার ওদের দুজনের একটা গোপন সম্পর্কও আছে, তা কাজে লাগাতে হবে। বোঝাতে হবে, এই চেয়ারম্যান থাকলে আর দিনদুপুরে ওরকম মেলামেশা করা হবে না। উল্টা বিপদে পড়তে হবে। তখন ওরাই ওদের স্বার্থে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে খেলবে। আমি শুধু প্ল্যান করে গুটিটা চেলে দেবো। ওরা যা বলবে সবাই বিশ্বাস করবে। আর বললাম তো দরখাস্ত লিখবো তো আমি নিজে। কিভাবে কী লিখলে কী হয়, তা তো আমি জানি।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য রুম থেকে বের হয়ে বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছেলেমেয়েদের বললেন, আমি শুনেছি তোমরা ক্লাস করবে না। মানববন্ধন করবে। তোমাদের এসবে আমি কোনো বাধা দিচ্ছি না। আমি শুধু তোমাদের কাছে একটা অনুরোধ রাখবো। তোমাদের সাথে আমি পাঁচ মিনিট কথা বলতে চাই। আমি মনে করি শিক্ষকের প্রতি তোমাদের সেই সম্মান শ্রদ্ধাবোধ আছে। তোমরা খুবই লক্ষ্মী ছেলেমেয়ে আমি আগে থেকেই তা জানি। আমার কথা শোনো, আমি কী বলতে চাই! যদি ভালো না লাগে, যদি আমার কথা পছন্দ না হয়; তোমরা রুম থেকে বের হয়ে চলে যেয়ো; আমি কিচ্ছু মনে করবো না।
ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সবাই হলরুমে ঢুকলো। কেউ মুখ নিচু করে বসে আছে। কেউ বিরক্ত নিয়ে তাকিয়ে আছে। কারও কপালে ভাঁজ। কেউ বিস্ময় চোখে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ যে নতুন চেয়ারম্যান পেয়ে খুশি; তাও বোঝা যাচ্ছে।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য বললেন, আমি ঠিক পাঁচ মিনিট কথা বলবো। যদি বলতে চাও, পাঁচ মিনিট পরে বলবে। আমার বলার পরে। মাত্র পাঁচ মিনিটই তো, বেশি তো নয়!
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য বললেন, তোমরা আমার অনেক স্নেহের, অনেক আদরের; তোমরা আমার অভিনন্দন গ্রহণ করো। আমি নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করায় অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছ; কষ্ট পেয়েছ। ক্লাস বর্জন করেছ। মানববন্ধন করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছ। ড. ফারজানার এভাবে চলে যাওয়াকে অনেকেই মেনে নিতে পারোনি। তোমরা আজ যা যা করেছ; যা যা করতে চাইছ; একদম ঠিক আছে। তোমাদের অবস্থানে আমি থাকলে, আমিও আজ এই কাজটিই করতাম। এটিই বয়সের ধর্ম ও সৌন্দর্য।
তোমাদের ম্যাডাম, ড. ফারজানা, অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ, ভালো শিক্ষক। আমরা একসঙ্গে একসময় কাজ করেছি; ভালো সহকর্মী ছিলাম। তোমরা তার জন্য যে কষ্ট পাচ্ছ, আমার নিজেরও তার জন্য খারাপ লাগছে। বেদনা অনুভব করছি।
পৃথিবীর নিয়ম এরকরমই; তোমরা ইতোমধ্যে জেনেছ, আমি গগন হরকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে তোমাদের এখানে এসেছি, সেখানেও তোমাদের মতো কোমলমতি ছেলেমেয়েরা আছে, যারা আমাকে ভালোবাসে; সম্মান করে; শ্রদ্ধা করে। বিশ্বাস করো, আমি তাদের বলে আসতে পারিনি। তাদের চোখের দিকে তাকাতে পারবো না বলে। তারাও সেখানে তোমাদের মতোই ক্ষুব্ধ; আন্দোলন করছে; আমি কেন চলে এসেছি! আমাকে ফেরানোর জন্য।
কেউ কোথাও সারাজীবন থাকে না। জীবনের নির্দিষ্ট লক্ষে পৌঁছুতে হলে অনেককিছুই ছিন্ন হয়ে যায়, ভালোবাসা বুকে ধারণ করে নতুন ভালোবাসায় সাফল্যের আকাশে উড়তে শেখাটাই জীবন। এটাই জীবনের প্রকৃত ধর্ম। যে যেখানে যত দূরেই যাক অন্তর থেকে ভালোবাসাটা কখনোই হারায় না। আমি গগন হরকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কো-অর্ডিনেটর ছিলাম; এখানে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে চেয়ারম্যান হয়ে এসেছি। এটা যদি তোমাদের কোনো ভাই বা বাবা বা আপন কোনজন হতেন, তোমরা বুকে হাত দিয়ে বলো তো খুশি হতে না! অবশ্যই খুশি হতে। মনে করো, আমি তোমাদেরই সে রকম কোনো এক আপনজন।
আজ তোমরা এখানে আছ। তোমাদের আগেও আরও অনেকেই ছিল। তারা নেই। তারা শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করে চলে গেছে। তোমরাও একদিন চলে যাবে; তোমাদের ছোট ভাইবোনেরা তখন চোখের পানি ফেলবে। আমরাও অনেক কষ্ট পাবো। খুশিও হবো, যখন দেখবো তোমরা বড় কোন অফিসে বড় কোন চেয়ারে বসে আছো। তারকাখ্যাতি পেয়েছ; গর্বে বুক ভরে যাবে। আবার তোমাদের কেউ এদেশের বড় শিল্পপতি হবে; শত শত মানুষের কর্মসংস্থান হবে তোমার প্রতিষ্ঠানে; তখন আনন্দের কান্নায় আমার চোখ ভিজে উঠবে।
জীবন একটা যুদ্ধক্ষেত্র। যুদ্ধে জয়ী হওয়াই সাফল্য। আমি এখানে এসেছি অনেক যুদ্ধ করে; যে যুদ্ধটা আগামীতে তোমরাও করবে। আর সে কারণেই এখানে অধ্যয়ন করতে এসেছ; নিজেদের তৈরি করতে এসেছ। আমাদের দায়িত্ব তোমাদের সঠিক দিক-নির্দেশনা দেওয়া; সততা আদর্শে ন্যায়বোধে গড়ে তোলা।
স্যার, আমরা না বুঝে ভুল করতে যাচ্ছিলাম; আপনি আমাদের সামনে এখন আলো; এই আলোতেই আমরা আমাদের জীবনের পথ হাঁটতে চাই।
ধরো, তোমরা, সবাই এমএ পাস করেছ। এখানে একজন শিক্ষক নিয়োগ হবে। তোমাদের সবার যোগ্যতা আছে আবেদন করার এবং করেছ। তোমাদের কেউ একজন যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে নিয়োগলাভ করেছ। সেটা কি তার অপরাধ? অপরাধ নয়। সেটা তার কৃতিত্ব; তার অর্জন-তার সম্মান। আমি সেই যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে এখানে এসেছি, এটা তো আমি কোনো অপরাধ করিনি। আমাকে স্বাগত জানানোই তো তোমাদের প্রকৃত শিক্ষা।
আমি তোমাদের একথা স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমিও এখান থেকে একদিন চলে যাবো, সেদিন যদি তোমরা থাকো কষ্ট পাবে; কাঁদবে। আর তার আগেই যদি তোমরা শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করে চলে যাও, সেদিনও কাঁদবে। নদীর স্রোতের মতো এই বেদনা চিরকালীন বহমান থাকে। নদীর স্রোত মরে গেলে নদীও মরে যায়, একজন শিক্ষকের জীবনে ছাত্ররাও তাই, ছাত্ররা যদি তার জীবন থেকে হারিয়ে যায়, সেই শিক্ষকও অন্তরে ও মনে মৃত হয়ে যায়।
ড. ফারজানার আগে যিনি ছিলেন, তার বিদায়েও কেঁদেছ। কষ্ট পেয়েছ। বাস্তবতাকে মেনে নাও। আমরা সবাই এক হয়ে বিভাগটাকে ভালোবাসি; বিশ্ববিদ্যালয়টাকে ভালোবাসি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়। বাঘা যতীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য নিজের মহামূল্যবান জীবন উৎসর্গ করার সময় বলেছিলেন, বৃহৎ স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়।
আজ আমি এসেছি; কাল আমিও চলে যাবো। নতুন আবার কেউ আসবেন। তোমরাও চলে যাবে; ফুলের মতো নতুন ছেলেমেয়েরা আসবে। কিন্তু এই চলার পথেই আমরা তোমাদের ভেতর রেখে যেতে চাই আলোর ফোয়ারা; ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা; সত্যিকারের দেশপ্রেমের আলোকবর্তিকা।
আমার অনুরোধ, তোমরা ঠিকমতো ক্লাস করবে। পড়ালেখা করবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান করবে। তোমরা আমাকে সহযোগিতা করবে; আমরা সবাই মিলে বাংলা বিভাগকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করবো দেশের বহু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাছে এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার হয়ে উঠবে। পৃথিবীর সব বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ই বেসরকারি। আমরা কেন পারবো না? আমরা আমাদের বাংলা বিভাগকে দেশের সেরা বাংলা বিভাগ বানাতে চাই। আমি তোমাদের সাথে নিয়ে যেতে চাই সাফল্যের বহু পথ।
আর ড. ফারজানা ম্যাডাম যাকে তোমরা ভালোবাসো, শ্রদ্ধা করো, আমি নিজেও তাকে শ্রদ্ধা করি; সম্মান করি। তার জন্য জন্য আমারও শুভ কামনা নিরন্তর।
মনে রেখো, তোমারাই আমাদের আলো। আলো কখনোই অন্ধকার তৈরি করে না। অন্ধকারকে তাড়ায়। তোমরাও অন্ধকার তাড়াবে।
শেষ কথা, আমি থাকি বা না-থাকি, এটুকু আমি সারাজীবন বুকভরে গর্ব করে বলবো, তোমরা আমার ছাত্র ছিলে; আমি তোমাদের পাঁচ মিনিট হলেও একদিন পড়িয়েছিলাম। তোমাদের জন্য আমার শুভ কামনা নিরন্তর।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য বক্তব্য শেষ করেই বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সব শিক্ষার্থীরা তাকে ঘিরে ধরে, বলে, স্যার, আমরা না বুঝে ভুল করতে যাচ্ছিলাম; আপনি আমাদের সামনে এখন আলো; এই আলোতেই আমরা আমাদের জীবনের পথ হাঁটতে চাই।
সব শিক্ষার্থীর সামনে পরম মমত্বে দুহাত বাড়িয়ে দিলেন ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য।
আরও পড়ুন: ঈশ্বর ও শয়তান-১৫॥ রকিবুল হাসান