পর্ব-১৩
ড. এলিনা রহমান ফোন না করেই ইংরেজি বিভাগে ক্লাস শেষ করে আব্দুল করিমের রুমে এলেন। মনটা একটু বিষণ্ন মনে হলো তার। অন্যান্য দিনের মতো প্রাণবন্ত নন। কথায়ও সেই উচ্ছ্বাস নেই। ড. এলিনা রহমান বললেন, করিম ভাই, কোন সমস্যা?
তার আগে বলেন কী খাবেন, কফি না চা?
কফি। সাথে একগ্লাস পানি। বলেই আবার বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে?
আরে বলেন না! নতুন ভিসি মানে সাদিক সাহেব, ড. সাদিক আহসান দেড় মাসও যায়নি, তিনি যা শুরু করেছেন! পাগল করে দেওয়ার মতো অবস্থা! এ নিয়ম সে নিয়ম, এ কাজ সে কাজ, রিসার্চ বাড়ান, কোয়ালিটি চিটচার নেন, বেতন বাড়ান, প্রমোশন দেন, কত কিছু যে শুরু করেছেন! লোকটা পাগল করে ফেললো!
আপনি চেয়ারম্যান স্যারকে তার নামে অভিযোগ করে দেন। আর আপনি না করতে চাইলে আমাকে বলেন, চেয়ারম্যানের সাথে আমার তো জানাশোনা আছে।
ভুলেও এসব বলতে যাবেন না। এই ভিসি আগের ভিসি নন। এর মেরুদণ্ড খুব শক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে চেয়ারম্যানকেও ছেড়ে কথা বলেন না। চেয়ারম্যানও খুব মানেন।
ড. এলিনা পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানিটা খেয়ে, কফির কাপে চুমুক না দিয়ে নিচুকণ্ঠে বললেন, তাহলে তো করিম ভাই আমার চাকরিটা এখানে আর হচ্ছে না!
আমি ভিসি স্যারকে বলেছি, বিভাগে নতুন কাউকে প্রধান করার। আপনার নামও বলেছি। চেয়ারম্যান স্যারকে পর্যন্তও এ কথা বলেছি। বাংলা বিভাগ দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ড. ফারজানাকে দিয়ে বাংলা বিভাগ চলবে না। তিনি তো এতদিনে কিছুই করতে পারলেন না। স্যার, শুনেছেন। কোনো উত্তর করেননি। দেখি! হাল তো ছাড়িনি। লেগে আছি।
বেশ সমস্যা কিন্তু, করিম ভাই।
সমস্যা তো বটেই। বাংলা বিভাগে আপনাকে খণ্ডকালীন ক্লাস দেওয়াও এখন কঠিন। বলেই সান্ত্বনা দিয়ে আবার বললেন, দেখা যাক কী হয়! দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
আসলে ড. ফারজানা ভালো মেয়ে নয়। আমি জানি ওর সম্পর্কে। বলি না। গিবত হয়ে যায়।
কী জানেন বলেন তো, ভাবি।
ফারজানা যখন কেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল, তখনো আমার বড় ক্ষতিটা তো সেই করেছে। হওয়া চাকরি হয়নি। আর ওর চরিত্র এত খারাপ, ও সব
পারে। টাকার জন্য স্বার্থের জন্য এমন কোনো নোংরা কাজ নেই, যা করতে পারে না।
বলেন কী!
জানি, সবই জানি করিম ভাই। এরাই তো বড় বড় চেয়ারে বসে আছেন! কী বলবো! ওখানে একজন ডিন ম্যাডাম ছিলেন। এখনো আছেন, ড. ছবি সায়ন্তি। আমি চিনি তাকে। খুব সুন্দরী।
আপনার থেকেও?
আমি তো তার কাছে কিছুই নই। তার সাথে তুষার পারভেজ নামে এক শিল্পপতির বিশেষ সম্পর্ক। প্রতি রাতে উত্তরার ডায়না ক্লাবে তাদের নিয়মিত মধু অভিসার চলে। ভদ্রলোকের প্রচুর টাকা। বয়সও কম। আমাদের বয়সী হবে। সায়ন্তি ম্যাডামও আমাদের বয়সীই। তবে বয়সটা একটুও বোঝা যায় না, অনার্সপড়া বালিকার মতো লাগে। ফিগারটা ঠিকই ধরে রেখেছেন। আর গায়ের রঙও সেই রকম, কাঁচা হলুদ আর কী। তার থেকেও তিনি বেশি কিছু।
তার স্বামী নেই?
আছে। না থাকার মতো, ধ্বজা। ডবলেরও বেশি বয়স। এক পা কবরে দিয়ে বসে আছে। আমেরিকায় তার আর একটা সংসার আছে। ইন্টারন্যাশনালি বিজনেসম্যান। কখনো আমেরিকা থাকেন, কখনো বাংলাদেশে থাকেন। এখানেও অনেক বিজনেস আছে। কিন্তু ভদ্রলোক বয়সের ভারে ক্লান্ত। তার অঢেল টাকা দেখেই সায়ন্তি ম্যাডাম বিয়ে করেছেন। চাকরিটাও ভদ্রলোকই দিয়েছেন। সামাজিক একটা স্ট্যাটাস আর কী! বিয়েটা লোকদেখানো। তুষার পারভেজের রিয়েল এস্টেট, গার্মেন্টস এসব ব্যবসা তো আছেই। গাজীপুরে কয়েকটা রিসোর্ট আছে। অনেক বড় বড় রিসোর্ট। নিজের বিশাল খামার আছে। ভালো ক্ষমতাও রাখে। একশ্রেণীর নেতার পেছনে পেছনে ঘোরায়। সায়ন্তি ম্যাডামকে নিয়ে গাজীপুরে নিজের রিসোর্টে কত দিন রাত কাটিয়েছেন। তা তো সবাই জানে। কিন্তু কারও বলার ক্ষমতা নেই। কেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও তার শেয়ার আছে, তিনি তো ট্রাস্টি বোর্ডের মেম্বার।
সায়ন্তি ম্যাডাম আগে কোথায় ছিলেন?
যতটুকু জানি, কোথাও ছিলেন না। ওখানেই সরাসরি প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেছেন। টাকার একটা ক্ষমতা আছে করিম ভাই। তারপর যদি থাকে ওরকম আগুন ধরানো রূপ। আর স্বামীও যদি হন অকেজো! তার জন্য তো কিছু করার জন্য গোটা পৃথিবীই হুমড়ি খেয়ে পড়বে! আমি তো বলি তার সৌন্দর্যআভা ছড়ানো শরীরটা একটা দামি চেক বই। ওরকম একটা চেক বই থাকলে আর কী প্রয়োজন হয়! এক একটা পাতায় এক একটা রাজ্য কেনা যায়!
সব মানলাম। কিন্তু কোথাও চাকরি না করে একবারে সরাসরি প্রফেসর! এটা কিভাবে সম্ভব?
কিভাবে সম্ভব জানি না। তবে তা তো হয়েছে। তিনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করেননি। একটা কলেজে বছর দুয়েক ছিলেন। তাও ওরকম কোনো কলেজ নয়, ইন্টারমিডিয়েট কলেজ। তারপর সরাসরি প্রফেসর! হয়তো কোথাও থেকে নকল অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট দিয়ে করে নিয়েছে। বা অন্য কোনোভাবে ম্যানেজ করেছেন। আমি অত কিছু জানি না। কিন্তু ঘটনা তো সত্য। পিএইচডিও তো করেছেন, একজনকে টাকা দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন, তাও আবার দেশের বাইরে থেকে করেছেন।
কিভাবে তা সম্ভব?
রাতে বুড়ো ভাতারের কাছে না শুয়ে হোটেলে শুতে যাস কেন? ভাবিস কেউ জানে না? সবাই জানে। বলেই পদত্যাগপত্রে সই করে, রেজিস্ট্রারের সামনে ছুড়ে দিয়ে ড. ফারজানা বেরিয়ে যায়।
আপনার বিশ্ববিদ্যালয়েও তো এরকম উদাহরণ আছে। প্রফেসর ফরিদুল ইসলাম, আপনাদের সায়েন্সের ডিন। তিনিও তো কোথাও পড়াননি। আপনাদের এখানেই প্রথম এবং সরাসরি প্রফেসর! আসলে সবারই সব হয়, আমারই শুধু হয় না দেখলাম! আমার আসলে ফাটা কপাল! কপালে কিছু থাকে না।
যা-ই বলেন, ভেরি ইন্টারেস্টিং কিন্তু!
ড. ফারজানা ওখান থেকে এখানে এলেন কেন? কেয়া তো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়।
এক বনে বাঘ যদি একটা হয়, আর বাঘিনি যদি দুটো থাকে, কেমন হয়! কেউ কারও অধিকার ছাড়ে? ছাড়তে চায়? সমস্যা তো সেখান থেকেই হয়েছে। আসলে সায়ন্তি ম্যাডাম ও ফারজানা, দুজনের কেউই জানতো না, তুষার পারভেজের সম্পর্ক তাদের দুজনের সাথেই।
আমি তো ভাবতেও পারছিনে, ভাবি।
কেন ভাবতে পারছেন না? দুদিন আগে তো আপনিও ড. ফারজানা বলতে পাগল ছিলেন। সারাদিন একসাথে থাকতেন। একসাথে খেতেন। বাইরে ঘুরতেন। কত কিছু করতেন। মিথ্যে বলছি! অস্বীকার করতে পারবেন? এখন একটু দূরে সরে এসেছেন। কেন এসেছেন, তাও আমি জানি। কিন্তু বলবো না।
কেন বলবেন না? আমি শুনতে চাই। এত কথা যখন বলতে পারছেন। এটুকু বলবেন না কেন?
ড. এলিনা কিছু একটা ভাবলেন। বলতে গিয়ে আবার ভাবলেন, থাক, না বলি। সরাসরি বলাটা ঠিক হবে না। সময় পরিবেশ বুঝে, একদিন বাস্তবেই বুঝিয়ে দেবো।
ড. ছবি সায়ন্তি ও ড. ফারজানার সাথে তুষার পারভেজের সম্পর্কটা কিভাবে প্রকাশ হয়ে গেলো, ড. এলিনা রহমান তা বলতে শুরু করলেন, শোনেন, আসল কথাটা বলি। আমাকে আবার একটু তাড়াতাড়ি উঠতেও হবে। দেরি হয়ে গেছে। তারপরও বলেই উঠি। একদিন দুপুরে মানে বারোটার দিকে ড. ছবি সায়ন্তি ফোন করলেন ড. ফারজানাকে। বললেন, ম্যাডাম, আপনি কোথায় আছেন?
ড. ফারজানা মিথ্যে করে বললেন, ডিপার্টমেন্টের একটু বাইরে এসেছি। কেন ম্যাডাম? কোনো জরুরি কিছু?
না না। ওরকম কিছু নয়। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। একজন ভদ্রলোক আসবেন, তিনি সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। বাংলার। আমাদের এখানে পার্টটাইম ক্লাস নিতে চান। আমার ঘনিষ্ঠ একজন সচিব মহোদয় তার জন্য সুপারিশ করেছেন। তিনি এলে আপনি একটু কথা বলবেন। তার বায়োডাটাটা রেখে দেবেন। আগামীকাল আপনার সাথে এ বিষয়ে কথা বলবো।
ড. ফারজানার তো এ কথা শুনে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম, কী করবেন এখন! সায়ন্তি ম্যাডাম যে কখন কী ঝামেলায় ফেলে দেয়! নিজে তো কাজ করেই না, নিজের কাজ অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেন। তুষার পারভেজের বুকের ওপর মাথা রেখে যখন অনাবিল এক শান্তিতে ডুবে ড. ফারজানা অপার্থিব সুখ ভোগ করছেন, ঠিক এসময় ড. সায়ন্তির ফোনটা সব এলোমেলো করে দিলো। উঠে বসে বললো, বলো তো এখন কী করি!
কী হয়েছে তা আগে বলো!
ডিন ম্যাডাম সায়ন্তি ফোন করে বললেন, কে একজন শিক্ষক ডিপার্টমেন্টে আসবেন, তার সাথে কথা বলে বায়োডাটাটা রেখে দেওয়ার জন্য। আমি তো তাকে বলেছি, ডিপার্টমেন্টের একটু বাইরে! একটু মানে যে এত দূরে তা তো বলিনি। আমি তো এখন অফিস থেকে কত মাইল দূরে, তা উনি কী করে বুঝবেন! উনাকে তো আবার এটা বলাও সম্ভব নয়। আগুন ধরে যাবে। তোমার সাথেও তো আবার তার পিরিতের আইকা-আঠা লাগানো!
হা, তার সাথে আমার অনেক আগে থেকেই বন্ধুত্বের একটা সম্পর্ক আছে। তার সাথে সম্পর্ক ছিল বলেই তো তোমার সাথে দেখা হয়েছে। সম্পর্ক হয়েছে। ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। রিসোর্টে মধু অভিসারে কত বৃষ্টি হয়েছে। এজন্য বরং সায়ন্তি ম্যাডামকে তোমার কৃতিত্ব দেওয়া উচিত।
তা না হয় দিলাম! সায়ন্তি ম্যাডামের সাথে কি তোমার শুধুই বন্ধুত্ব! না কি তার সাথেও মধু অভিসারের বৃষ্টি নামাও!
সব মেয়েই এরকম সম্পর্কে একটা সন্দেহ করবেই!
সন্দেহটা কিন্তু অমূলক থাকে না। একসময় ঠিকই তা সত্যি হয়ে যায়। এটা কিন্তু বাস্তব।
আচ্ছা শোনো, সায়ন্তি ম্যাডামের বিষয়টা এখন বাদ দাও তো। ওকে আমি দেখবো। ওকে কী দিয়ে কিভাবে খেলাতে হয়, কিভাবে শান্ত করতে হয়, আমার ওপর ছেড়ে দাও। দেখো না ওঝা বিষধর গোখরাকে কিভাবে খেলায়! কিভাবে শান্ত করে আবার বাক্সবন্দি করে ফেলে!
পাকা ওঝাও কিন্তু সেই সাপের কামড়েও মরে!
তা তো দুচারজন মরবেই। ওসব বাদ দাও। আনন্দ করতে এসেছি, আনন্দ করি। আজ তোমার জন্মদিনে আমার পুরো রিসোর্ট সাজিয়েছি। শিল্পী এনেছি। গান শুনবো। তোমার গা-ভর্তি সোনার গহনা এনেছি। দেখো সবচেয়ে দামি দামি শাড়ি এনেছি। তুমি এখন মুহূর্তে মুহূর্তে এগুলো পরবে, রূপের রঙ ছড়াবে! রামধনু মেঘের মতো। আমার রানি হয়ে মধুযামিনি করবে।
তুমি যেমন করে আমাকে চাও, তেমন করেই আমাকে তোমার করে দেবো। তার থেকেও বেশি করে দেবো। তুমি যে আমার প্রেমের দেবতা। ড. ফারজানা তুষার পারভেজকে দুবাহুর ভেতর বেঁধে নিয়ে বললেন, তুষার, আমি জনম জনম এমন করে তোমাকে চাই। আমার মনটা ভরে দিয়েছ। মনে মনে ভাবলেন, ড. সায়ন্তিকে নিয়ে অযথা তর্ক করে এমন মধুর সময় নষ্ট করা মানে নিজেরই ক্ষতি। সায়ন্তির সাথে ওর যা থাকে থাক! তার সাথে তো আগে থেকেই সম্পর্ক। আমার সাথে তো পরে হয়েছে। হিসেবে আমি তো তার গোপন খেলার ছোট বউ! বেশি খোঁড়াখুড়ি করতে গেলে আমারই ক্ষতি। আর সায়ন্তি ম্যাডামের ক্ষমতাও আমার থেকে অনেক বেশি। টাকা-পয়সার জোরও অনেক। বিত্তশালী বৃদ্ধ পুরুষের বউ। সমাজের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সাথে তার প্রতিদিনের সম্পর্ক। তাকে রাতে ঘুমের ঔষুধ খাইয়ে, নিজে রাতভর হোটেল ডায়নায় পড়ে থাকে। আমি তো তাদের এক ফুঁতেই ছিটকে যাবো। বরং আদর সোহাগ দিয়ে তুষারকে নিজের দখলে যতটা রাখতে পারি, যতটা সুবিধা নিতে পারি, সেটাই আমার লাভ।
ড. ছবি সায়ন্তি জানতেন, তুষার পারভেজ আজ গাজীপুরে সোনার তরী রিসোর্টে থাকবে। তার পিএসকে ফোন করে আগেই জেনে নিয়েছেন। পিএসটা সায়ন্তি ম্যাডামের খুব ভক্ত। কারণ তাকে ড. সায়ন্তি নিয়মিত বড় অঙ্কের বখশিস দেন, যেন তুষার পারভেজের প্রতিদিনের রুটিনটা ঠিকমতো পান। কিন্তু তারপরও পিএসটা তুষার পারভেজের পুরো রুটিন তাকে দেয় না। কারণ সে জানে, স্যার জানলে সাথে সাথে চাকরি শেষ। যতটা সম্ভব তথ্য দেয়, না দিতেই বেশি চেষ্টা করে। তুষার পারভেজের সাথে আজ ড. ফারজানা আছেন, পিএস তা জানতেন।কিন্তু সে তথ্য তাকে দেয়নি। আবার ড. সায়ন্তিও যে গাজীপুরে না বলে-কয়ে যাবেন, তাও তাকে বলেনি।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ড. সায়ন্তি চমৎকার করে নিজে সাজলেন। তুষার পারভেজের পছন্দের শাড়ি পরলেন। তুষারের দেওয়া গহনায় নিজেকে আলিয়া ভাটের মতো করে সাজালেন। তারপর নীরবে সোনার তরী রিসোর্টের উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন। তুষার পারভেজকে বড় ধরনের সারপ্রাইজ দেবেন বলে নিজের মন পেখম মেলে খুশির পালে উড়তে থাকে।
রিসোর্টে ঢুকেই গাড়ি থেকে নেমেই ম্যানেজারকে বললেন, তোমার স্যার কোথায়?
স্যার তো প্রমোদতরীতে। বলেই ভাবলেন, আজ কী যে ঝামেলা হয়, দুই রানিরই তো এখন একসাথে দেখা হয়ে যাবে! আবার ভাবলেন, স্যারের রানির তো আর অভাব নেই! টাইয়ের মতো কখন কোনটা গলায় ঝুলিয়ে রাখেন, কখন কোনটা ফেলে দেন!
ড. সায়ন্তি প্রমোদতরীর পাশে গাড়ি রেখে প্রমোদ তরীতে ঢুকতে ঢুকতে ভাবেন, তুষার, আজ তোমাকে অনেক বেশি চমকে দেবো! রিসোর্টটা অনেক সুন্দর করে সাজিয়েছ। শিল্পীদের গানের সুরে বাতাসে যেন প্রাণের মুগ্ধতা ঢেউ হয়ে ভেসে খেলা করছে। তুমি কি আমার জন্যই সাজিয়েছ! কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। তুমি তো জানো না আমি আসবো! হয়তো কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান! আমার আত্মা আমাকে তোমার কাছে এমন অপার্থিব সৌন্দর্য পান করার জন্যই হয়তো টেনে এনেছে! হৃদয়ে হৃদয়, মনে মন, শরীরে শরীর বোধ হয় এমন করেই ঈশ্বর বেঁধে দেন। তোমার আমার আত্মাটাও ঠিক এমন করেই বাঁধা। তোমার কাছে এলেই পৃথিবীর সব শান্তি আমার দেহ মনে অন্তরে কী এক অদ্ভুত মুগ্ধতায় ভরে যায়। আমি যে কোথায় কোন সুন্দরের অতলে হারিয়ে যাই। আমি নিজেও তা জানি না।
প্রমোদতরীর ভেতরে ঢুকে তুষার পারভেজের বিশেষ রুমের দিকে তাকাতেই আঁতকে ওঠে ড. সায়ন্তি! তুষারের বুকের ভেতর কে অমন করে জড়িয়ে আছে! একটু গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করে, ওর বউ আসেনি তো! ওর বউ হলে তো মহাবিপদ হয়ে যাবে! আমাকে দেখলেই তো ওর মাথায় খুন চড়ে বসবে! মহিলা তো আমার নামই সহ্য করতে পারে না। একবার ভাবে, আর না এগোই, কেউ কাউকে না দেখার আগেই ফিরে যাই! তুষার বিব্রত অবস্থার ভেতর পড়ে যাবে। এখানকার পুরো পরিবেশটা নষ্ট হয়ে যাবে! আমার সম্মানও মাটি হবে। ফিরে যাওয়ার জন্য মনস্থির করে আবার ভাবে সতর্কচোখে দেখি না, কে তিনি অমন করে আমার তুষারের বুকের ভেতর! চোখ দুটো অনুবীক্ষণ যন্ত্রের মতো গেঁথে এটুকু বুঝলেন তিনি, উনি তুষারের স্ত্রী নয়, অন্য কেউ। আরও গভীর হয়ে লক্ষ করতেই আঁতকে উঠলেন, ফারজানা! ড. ফারজানা!
নিজেরও চোখকে অবিশ্বাস মনে হয় তার। মনে হলো গোটা পৃথিবীকেই ভুল দেখছেন ড. সায়ন্তি। যেন কোত্থেকে মুঠো মুঠো আগুন তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। চিতার আগুনের মতো মন দাউ দাউ করে জ্বলছে।
ড. ফারজানাকে আদর করতে করতে হঠাৎ বাইরে তাকাতেই তুষার পারভেজের চোখ দুটো একবারে ড. সায়ন্তির চোখে গিয়েই গাঁথে।
ড. ছবি সায়ন্তি মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত পায়ে, পারলে একরকম দৌড়ে প্রমোদতরী থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে ওঠে। ড্রাইভারকে বললেন, সোজা বাসায় যাও।
সর্বনাশ! সায়ন্তি এসেছিল! ও তো তোমাকে আর আমাকে এভাবে দেখে ফেলেছে!
এ কথা শুনেই চমকে উঠলেন ড. ফারজানা।
ও তো আমাদের দুজনকে এভাবে দেখে এক নিঃশ্বাসও দেরি না করে চলে গেলো। কেমন যেন ভীতসন্ত্রস্ত হরিণীর জীবনবাঁচানো মরণ দৌড়ের মতো চলে গেলো!
সায়ন্তি ম্যাডাম রুমের ভেতরই ঢুকতে পারতেন! যা দেখার তা তো দেখেই ফেলেছেন। তুমি কার কতটা, তাও প্রমাণ হয়ে যেতো!
তুমি ওকে চেনো না ফারজানা! আর কোনো কথাই বলতে পারলেন না তুষার পারভেজ। তখন সব আলো ভেদ করে আকাশের কোণে কালো মেঘ জমে উঠেছে। ভাবলেন, জ্বালাটা ভালোই তৈরি হলো! কত কিছু দিয়ে যে এই মান ভাঙাতে হবে, হিসেবেও এখন তা ধরবে না!
রাত বারোটায় তুষার পারভেজকে ফোন করলেন ড. ছবি সায়ন্তি। বললেন, হোটেল ডায়নায় আসো। আমি ৪০৪ নং সাইটে আছি।
দ্বিধাগ্রস্ত নতকণ্ঠে তুষার পারভেজ বললেন, এখুনি?
হ্যাঁ, এখুনি।
আগামীকাল দেখা করলে হয় না!
তুমি এখন আসতে না পারলে, আমি নিজেই এখন তোমার বাসায় আসবো। আর তাও যদি নিষেধ করো, আজ রাতে আমি এখানে সুইসাইড করবো। সুইসাইড করার জন্য জায়গাটা কিন্তু স্বর্গীয়!
ঠিক আছে। আমি আসছি।
তুষার পারভেজ বেরুচ্ছিল, এ সময় তার স্ত্রী তৃষিকা বললেন, এই মাত্র তো এলে! আধাঘণ্টাও হয়নি। আবার এখুনি বেরুচ্ছো! রাত বারোটার বেশি বাজে!
আগে বিজনেস। একটা পার্টির সাথে ঝামেলা হয়েছে। ফিরতে দেরি হতে পারে। বলেই হনহন্ করে বের হয়ে গেলেন তুষার পারভেজ। তৃষিকাকে কোনো কথা বলার সুযোগই দিলেন না।
ড. ছবি সায়ন্তি সোফার ক্লান্ত শরীর ছেড়ে দিয়ে আধাশোয়ার মতো বসে আছেন। চোখেমুখে বিধ্বস্ত অবস্থা। মনে হচ্ছে সারা শরীরে মনে বিশাল বৈশাখের নিষ্ঠুর ঝড় বয়ে গেছে।
তুষার পারভেজ ঢুকেই কেমন যেন বিব্রতভাবে তার পাশের একটা সোফায় বসলেন। কিন্তু কিছুই বললেন না। বলতে পারলেন না। বেশখানিকটা সময় দুজনের পিনপতন শব্দহীনভাবে কেটে যায়।
ড. ছবি সায়ন্তি কোনো রাগ নয়, কোনো ক্ষোভ নয়, কোনো কৈফিয়ত নয়, কোনো অভিযোগ নয়, একেবারে শান্ত নদীর মতো চোখভরা পানি চোখে, ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বললেন, তুষার, তুমি আমাদের দুজনের যেকোনো একজকে বেছে নাও। যদি মনে হয় তুমি ড. ফারজানার সাথে সম্পর্ক রাখবে, আমি একটুও বাধা দেবো না। আমি নীরবে তোমার জীবন থেকে সরে যাবো। তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটাও ছেড়ে দেবো। আর যদি আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাও তাহলে ড. ফারজানাকে চিরকালের মতো তোমাকে ভুলে যেতে হবে। তোমাকে জোর করছিনে। তুমি এখুনি এটা আমাকে জানাবে। আমি এ জন্যই তোমাকে আসতে অনুরোধ করেছি। দুহাতে মুখ ঢেকে সশব্দে কেঁদে ফেলে ড. ছবি সায়ন্তি।
তুষার পারভেজ মুখে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর ড. সায়ন্তির দিকে তাকান। ড. সায়ন্তি তখনো দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছেন।
তুষার পারভেজ সোফা থেকে উঠে ড. সায়ন্তির সামনে বসে বললেন, সায়ন্তি, আমি সত্যি সরি। তোমার সাথে আমার খুব বড় অন্যায় হয়ে গেছে।
যদি তাই মানো, তাহলে তোমাকে আরও একটা কাজ করতে হবে। তুমি তো ট্রাস্টিবোর্ডের মেম্বার। কাল সকাল ন’টায় তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজে এসে রেজিস্ট্রারকে বলবে, ড. ফারজানার পদত্যাগপত্র তৈরি করতে। ড. ফারজানা কাল যখন অফিসে আসবে, তখুনি রেজিস্ট্রার তাকে ডেকে নিয়ে পদত্যাগ করাবে।
কোনো কথা না বাড়িয়ে বিনাবাক্য ব্যয়ে তুষার পারভেজ ড. ছবি সায়ন্তির শর্ত মেনে নিয়ে বললেন, তাই হবে, সায়ন্তি।
আজ আমার বুকটা ভেঙে গেছে, তুষার। এখানে এসে আমি রুম বন্ধ করে পাগলের মতো কেঁদেছি। আমার তুষার, যাকে আমি এত ভালোবাসি, সেই তুষার আমার সাথে এটা করতে পারলো! আমার বারবার মনে হচ্ছিল, আমি ভুল দেখেছি! আমি মিথ্যে দেখেছি! আমার তুষার তো এরকম নয়! আমি বাসাতেও যাইনি। এখানে এসে বসে আছি। তুমি যদি আমার কথায় এখন না আসতে, কাল সকালে এখান থেকে আমার লাশ বেরুতো। আমি সুইসাইড করতাম। বলেই ড. ছবি সায়ন্তি তুষার পারভেজের বুকের ভেতর মুখগুঁজে পাগলের মতো কাঁদতে থাকে।
বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে ড. এলিনার কাছে ড. ছবি সায়ন্তি, ড. ফারজানা আর তুষার পারভেজের ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনি শুনছিলেন আব্দুল করিম। বললেন, পরের দিনই ড. ফারজানার চাকরিটা চলে গেলো?
হ্যাঁ। সেই চাকরিটা ছাড়া নিয়েও তো ড. সায়ন্তি আর ড. ফারজানার মধ্যে কী যে অশ্লীল বাক্য বিনিময় হয়, তা ভাবাও যায় না।
আমি এ সব জানি। কী কথা হয়েছিল, অতসব বলা যায় নাকি! শুধু এটুকু শোনেন, ড. সায়ন্তি যখন ড. ফারজানাকে বললেন, এই শহরে আর পুরুষ মানুষ নেই! তুই আমার নাগর নিয়ে টানাটানি করিস কেন!
ড. ফারজানাও উত্তরটা শক্ত করেই দিয়েছিল, তোর নাগর না কার নাগর, তা কি সিল মেরে রেখেছিস! তোর নাগরের কি অভাব আছে! আধমরা বুড়ো স্বামীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে, সারারাত বেহুঁশ করে হোটেল ডায়নায় তুই কি করিস আমি জানি না! সব জানি। তোর কতজন তুষার পারভেজ আছে, তাও আমি জানি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব। আর শোন, আমার কাছে যখন তুষার পারভেজ আসে, ও তখন শুধুই আমার নাগর। পারলে তুই ধরে রাখিস!
তুই তো একটা বেশ্যা, আমি তো জানতাম না। আধুনিক ভদ্র শিক্ষিতা ভেবে তোকে আমার এখানে চাকরি দিয়েছিলাম। কিন্তু জানতাম না বেশ্যাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দিয়েছি! টাকার লোভে তুই তো সব করতে পারিস। টাকার গন্ধে তুই তো একটা উন্মাদিনী!
তুই তাহলে আমার থেকেও বড় বেশ্যা। তোকে তো তুষার এখানে চাকরি দিয়ে নিজের রক্ষিতা বানিয়ে রেখেছে! রাতে বুড়ো ভাতারের কাছে না শুয়ে হোটেলে শুতে যাস কেন? ভাবিস কেউ জানে না? সবাই জানে। বলেই পদত্যাগপত্রে সই করে, রেজিস্ট্রারের সামনে ছুড়ে দিয়ে ড. ফারজানা বেরিয়ে যায়।
কিন্তু ভিসি স্যার যে কঠিন মানুষ, সিসি আদৌ কোনো পাত্তা পাবে কি না, কে জানে! একরকম হতাশা নিয়েই আব্দুল করিমের রুম থেকে ড. এলিনা বেরিয়ে গেলেন।
জানেন করিম ভাই, দুজনের কথার ভেতর আপনি তুমি এসবের বিন্দুও ছিল না। তুই তুকারি। কী সব বাজে ভাষা! যার যা মুখে আসে!
ভাবি, আপনি তো দেখছি এসবের এ টু জেড জানেন। কিভাবে?
ড. এলিনা রহমান বললেন, আমার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু ড. সায়ন্তির পিএস ছিল। এখন অবশ্য নেই। ও একটু আড়াল থেকে এসব মোবাইলে ভিডিও করেছিল। আমাকে দেখিয়েছে। আমি নিতে চেয়েছিলাম। দেবো দেবো করে আর দেয়নি। পরে ও নিজেও বিদেশ চলে গেছে। আগের মতো যোগাযোগও নেই। দেখি, আবার কখনো কথা হলে, ভিডিওটা চাইবো। পেলে, আপনাকে দেখাবো।
এটার একটা কপি এখন থাকলে খুব ভালো হতো। দেখেন, যোগাযোগ করে নিতে পারেন কি না! আব্দুল করিমের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়, ড. এলিনা রহমান এতকিছু জানেন! আরও আগে এসে যদি জানাতেন! কিন্তু তিনি তা আর বললেন না। শুধু ভাবলেন, ড. ফারজানার গাড়িটা তাহলে কি এই তুষার পারভেজেরই কিনে দেওয়া! সম্পর্কটা তাহলে গোপনে এখনো ঠিকই আছে! না, আমার ভাবনা ভুলও হতে পারে! সে তো আর নামটা আমাকে বলেনি। পৃথিবীকে জানা তো বহু দূরের কথা। এই ঢাকা শহরেরই কতটুকু জানি্ কিছুই জানি না। এই আলোখেলার ভেতরে কতো অন্ধকার, যে অন্ধকারে আমিও কি নেই! ড. ফারজানা কিংবা ড. সায়ন্তি সবাই তো দেখছি অন্ধকারের মানুষরূপী পুতুল! বাইরে এরা আলোকিত মানুষের ছবি। কেউ বিশ্বাস করবে না কতটা অন্ধকারের বীভৎস শাড়িতে তাদের শরীর মন জড়ানো। ড. এলিনা রহমানও কি তাদের মতোই; একই রকম! প্রশ্ন তৈরি হয় আব্দুল করিমের ভেতর। যেকোনোভাবেই হোক ড. ফারজানাকে বাংলা বিভাগ থেকে সরাতে হবে। ড. এলিনাকেও বিভাগে প্রধান করা যাবে না। স্থায়ীভাবেও নিয়োগ দেওয়া যাবে না। আরও গভীরভাবে ড. এলিনাকে নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে।
ড. এলিনা রহমান বললেন, অনেক ভাবছেন! আসলে ভাবার মতোই ব্যাপার। আচ্ছা, এরকম একটা বাজে মেয়ে আপনাদের এখানে ঢুকলো কিভাবে! বাইরে তো এটা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নাম হয়।
আগের ভিসি এটা করে গেছেন। তিনি এরকম আরও কিছু পচা জিনিস ঢুকিয়ে রেখে গেছেন। নিজের একটা সখীকূল বানিয়ে রাখতেন। তিনি ভিসি তো নয়, কৃষ্ণ ছিলেন। এসব নিয়ে আমরা বেশ সমস্যায় ছিলাম। আপনি আরও বছরখানেক আগে এলে ভালো হতো। তখন আপনাকে চিন্তা করা যেতো। এখন তো নদীর জল অনেক গড়িয়ে গেছে!
চেষ্টা করলে সব হয়। এখন সরিয়ে দেন। না হলে তো দিন দিন আরও দুর্গন্ধ ছড়াবে। আর একটা কথা বলি, আপনার বাংলা বিভাগে ড. তপোবন বিশ্বাস নামে একজন স্যার ক্লাস নেন না?
হা, নেন তো। তিনি তো ন্যাশনাল ফিগার।
ড. ফারজানার সাথে তার কী সম্পর্ক জানেন! জানেন তো শিক্ষক-ছাত্রী। ঠিক না?
হা, তাই তো জানি। বিখ্যাত একজন ব্যক্তি। সারাদেশ এক নামে তাকে চেনে। অনেক সম্মাননা পেয়েছেন।
বিখ্যাত। সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি তো ড. ফারজানার কৃষ্ণস্যার। সবাই তো তা জানেন। আপনি জানেন না?
আমি তো যা শুনছি, কল্পনাও করতে পারছিনে।
ড. ফারজানার পিএইচডির ভেতর কিছু নেই। সস্তা একটা বিষয় নিয়ে, ড. তপোবনের আশীর্বাদে ওটা হয়ে গেছে। আমরা এরকম পিএইচডিকে বিছানার পিএইচডি বলি। এক পৃষ্ঠা গদ্য শুদ্ধ করে লিখতে বলবেন তো, তারপর দেখবেন টেনশনে ঘামে মুখের মেকাপ কাদামাটির মতো কেমন এবড়োখেবড়ো হয়ে যায়। আমি পিএইচডি করেছি, ভারত থেকে। আমি জানি পিএইচডি করা কতটা কষ্টের। আর আমি তো পেপারে নিয়মিত লিখি। টিভিতে টক শোতে যাই। আমাকে মানুষ চেনে। শোনেন করিম ভাই, তপোবন স্যার এখানে ক্লাস নেন যতটুকু, দেহের পূজো নেন তার চেয়ে অনেক বেশি। যেদিন তপোবন স্যারের ক্লাস থাকে, ক্লাসের পরে ড. ফারজানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজের রুম বন্ধ করে তার সাথে কিসের এত জরুরি আলাপ করেন! একদিন হুট করে যান না! নিজের চোখে দেখেন, হাতেনাতে আমার কথার প্রমাণ পেয়ে যাবেন।
ভাবি, আমি সত্যি ভাবতে পারছিনে! উনি কেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যা করে এসেছেন, এখানেও তো তাই করছেন। আচ্ছা, আপনার জানার ভেতর বাংলার ভালো কোনো ফ্যাকাল্টি আছে, যাকে আমরা এখানে বাংলা বিভাগে চেয়ারম্যান করে আনার কথা ভাবতে পারি। যদিও তাকেও এখানে বোর্ডে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে আসতে হবে। এখানে নিয়োগ পাওয়া খুব কঠিন।
আব্দুল করিমের কথায় ড. এলিনা রহমান একটু হোঁচট খেলেন। বুঝতে পারলেন, বিভাগের প্রধান হিসেবে তাকে ভাবছেন না। ফলে নিজের থেকে নিজের কথা আর বললেন না। একটু চিন্তা করে বললেন, গগন হরকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় একজন ভালো শিক্ষক আছেন। তবে আমার সাথে ওরকম পরিচয় নেই। একবার কী দুবার দেখা হয়েছে। উনি ওখানকার চেয়ারম্যান নন। কোঅর্ডিনেটর। লেখালেখি করেন। তার লেখা অনেক বই আছে। পেপারে নিয়মিত তার লেখা দেখি। গবেষণা-প্রবন্ধ-উপন্যাস-কবিতা-ছোটগল্প; সবশাখাতেই লেখেন। লেখক হিসেবে তিনি মোটামুটি পরিচিত, ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য। আপনি বললে, আমি তার সাথে কথা বলতে পারি। তবে তিনি আসবেন কি না, তা নিশ্চিত নই।
আপনি তার সাথে কথা বলেন। বিজ্ঞাপন হওয়ার পরে আবেদন করতে বলেন।
ওটুকু বলতে পারবো।
আমি ভিসি সাহেবের সাথে বাংলার চেয়ারম্যান নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে দ্রুতই আলাপ করবো। রেজিস্ট্রারকেও জানাতে হবে। বোর্ডকে আগেই ড. ফারজানা সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া আছে। এটার একটা বিজ্ঞাপন জারি হবে। আবেদনপত্র আসবে। বোর্ড বসবে। ট্রাস্টিবোর্ডের মেম্বাররা থাকবেন। এক্সপার্ট থাকবেন। পরীক্ষা হবে। অনেক প্রক্রিয়ার ব্যাপার আছে।
তা তো অবশ্যই। ড. এলিনা রহমান ভাবলেন, এত প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আমার চাকরি জীবনেও হবে না। অত যোগ্যতা আমার নেই। আমার যা করতে হবে, তেল-তদবির আর দেহকাব্য কাজে লাগিয়ে যদি কিছু হয়! যতই বড় বড় বুলি আওড়াই, আমার যোগ্যতা কতটুকু আমি নিজে তো জানি! বলেই উঠে গেলেন ড. এলিনা রহমান। ভাবেন, আর যা-ই হোক এখানে আমি চেয়ারপারশন হতে পারছিনে, এটা এখন পরিষ্কার। এখন স্থায়ী শিক্ষক কিভাবে হওয়া যায়, সেই চেষ্টাটাই করতে হবে। তবে সিসিকে ব্যবহার করেই আমার কাজ উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু ভিসি স্যার যে কঠিন মানুষ, সিসি আদৌ কোনো পাত্তা পাবে কি না, কে জানে! একরকম হতাশা নিয়েই আব্দুল করিমের রুম থেকে ড. এলিনা বেরিয়ে গেলেন।
চলবে…
ঈশ্বর ও শয়তান-১২॥ রকিবুল হাসান