॥পর্ব-আট॥
ছোটগল্পের বাইরে ইমদাদুল হক আরেক ধরনের গল্পের চর্চা করেছেন। আয়তনে ছোটগল্পের চেয়ে বড় কিন্তু উপন্যাসের চেয়ে ছোট। কিন্তু উপন্যাসিকা নয়। ইমদাদুল হক মিলনের কাছে এগুলো বড়গল্প হিসেবে চিহ্নিত হতে দেখা যায়। যেমন তার একটি গ্রন্থের নাম ‘সমস্ত বড়গল্প’। এই গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে কিছু কথা বলে নিতে হয়। ‘সমস্ত বড়গল্প’ বলতে সব বড়গল্পের সমাহার নয় গ্রন্থটি। সাহিত্যের সুদীর্ঘ যাত্রায় তিনি কিছু বড়গল্প লিখেছেন। সেগুলো থেকে বাছাই করে মলাটবন্দি করা হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘সমস্ত বড়গল্প’। এটি এ ধরনের প্রয়াসের প্রথম সংকলন।
মানুষের জীবন যাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার মনের উপযোগিতারও পরিবর্তন এসেছে। পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে। মানুষের ব্যস্ততা বেড়ে যাচ্ছে। মুহূর্তের যোগাযোগ কমিয়ে দিচ্ছে দূরত্ব। ব্যস্ততম সময় বাঁচিয়ে সাহিত্যের দীর্ঘ পারিসরিক যাত্রায় নিজেকে নিবেদন করার মতো সময়ের তাই বড়ই অভাব। কিন্তু জীবন তো কোনো ক্সুদ্র ঘেরাটোপের ডোবা বা খাল নয়। সাহিত্য অথবা জীবন হচ্ছে গগনবিস্তারি। সাহিত্য অথবা জীবন হচ্ছে সমুদ্রপ্রসারী। কিন্তু ব্যস্ততায় যখন আমরা জীবনকে ক্ষুদ্র করে তুলি তখন সাহিত্যের বৃহৎ কলেবরই স্মরণ করিয়ে দিতে পারে জীবনের বৃহৎ কলেবরকে। বোধকরি বড়গল্পের মাহাত্ম, উদ্দেশ্য এবং স্বার্থকতা এখানেই।
কিন্তু পাঠকের রুচির কাছে লেখক যদি নতজানুই হবেন, তাহলে তার দায়িত্ববোধের ঘাটতি কি চোখে পড়ে না? আজ সবাই যেখানের তাদের রচনার কলেবর ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র করে তুলছে পাঠকের চাহিদার কাছে নতি স্বীকার করে তখন ইমদাদুল হক মিলন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন জীবনের কলেবরের বিস্তৃতিকে। স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন জীবন এত ছোট নয়। জীবনের অনেক মাহাত্ম্য।
এ কাজটি করতে গিয়ে তিনি মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন বৃহৎ কলেবরের গল্পকে। আকারে আয়তনে ছোটগল্পের চেয়ে বড়। কিন্তু উপন্যাসের চেয়ে ছোট। প্রকরণে ছোপগল্পীয়। কাঠামোয় ছোটগল্পের ক্ষুদ্রায়তনিক অবয়ব ও উপন্যাসের বৃহদায়তনিক বিস্তারের মাঝামাঝি। লেখক এগুলোকে বড়গল্প হিসেবেই অভিহিত করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। যদিও আজকাল এ রকম প্রবণতা দেখা দিচ্ছে যে, এ রকম বৈশিষ্ট্যের লেখাগুলোকে উপন্যাস হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এরকম দশটি গল্পের সমাহার ‘সমস্ত বড়গল্প’ নামীয় গ্রন্থখানি। গল্পগুলো হলো, মর্মবেদনা, আহারি, শিশুদের মুখ, মাটির পিঞ্জিরা, কালো রঙের দিন, মাটির বিছানা, গুনাই বিবির কেচ্ছা, নেংটি ইঁদুরের জীবন, ঘা ও নয়মাস। গল্পগুলোর শেষে এর রচনাকাল উল্লিখিত হয়েছে। প্রথম গল্পটির রচনাকাল উনিশ শত ছিয়াত্তর সাল। শেষ গল্পটির রচনাকাল দুই হাজার ষোল সাল। বোঝা যাচ্ছে যে, চর্চা তিনি সত্তরের দশকে শুরু করেছিলেন আজ অব্দি তা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এ রকম রচনাকাল দেওয়ার মাধ্যমে লেখকের চর্চার ধারাবাহিকতা যেমন জানা যায় তেমনি জানা যায় তার গল্প বলার বিবর্তনের দিকটিও। রচনাকাল সন্নিবেশের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।
তবে গল্পগুলোর বিশেষত্ব হলো এগুলো ভিন্ন সময়ে বিরচিত হলেও এর সমসাময়িকতা কিংবা দার্শনিক দিক কিংবা সংকটের চিত্রে খুব একটার পরিবর্তন নেই। ত্রিশ বছর আগের যে সমসাময়িকতা এবং সংকট, আজও সেই সমসাময়িকতা ও সংকটের উল্লেখ পাওয়া যায়। আমরা যে খুব বেশিদূর এগুতে পারিনি মানবিকতায়, এ গল্পগুলোর সঙ্গে সমসাময়িক সংকটের চিত্র তুলনা করলেই তা বোঝা যায়। পাশাপাশি এ বিষয়টি লেখকের কালজয়ের বিষয়টিও প্রমাণ করে। বর্তমানকে যখন ভবিষ্যতের কিংবা অতীত যখন বর্তমানের সমসাময়িক হয়ে ওঠে তখনই তো সে-শিল্পের গায়ে কালজয়ীর তকমা গেঁথে যায়।
একদিন হয়তো এরকম আঙ্গিকের বড়গল্প লেখা হবে না জনরুচির কথা ভেবে। কিন্তু এই আঙ্গিকের রয়েছে আলাদা মর্যাদা। আজ হয়তো এর চর্চাও নেই। ইমদাদুল হক মিলন তার অন্যান্য সাহিত্য কর্মের মতো এরকম একটি চর্চার ক্ষেত্রের জন্যও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
এ সবের বাহিরেও তিনি নানারকম রচনা লিখেছেন। স্মৃতিকথা লিখেছেন। এরকম একটি চমকপ্রদ গ্রন্থ ‘অ্যালবামে কত ছবি’। এ যেন নিছক একটি গ্রন্থ নয়। এ যেন বাঙ্ময় স্মৃতিধারা।
ছবি যেমন শুধুই ছবি হয়ে থাকে না তেমনি আক্ষরিক অর্থে ছবি না থাকলেও ছবি আঁকা হয়ে যায়। সেই না-আঁকা ছবিতেও ভেসে ওঠে ব্যক্তিত্বের নানাদিক। একটি গ্রন্থ যেখানে আক্ষরিক অর্থে কোনো ছবি নেই। কিন্তু আঁকা হয়ে গেছে কতসব বিখ্যাত ছবি।
কিভাবে? লেখক কি চিত্রকর হয়ে উঠলেন? কলমের জায়গায় চলে এলো রঙ তুলি? না। লেখকের হাতের কলম বদল হয়নি। কলমটিই হয়ে উঠেছে নিপুণ তুলি। কলমের কালি হয়ে হয়ে উঠেছে বহুবিধ ছটার রঙ। সেই কলমে সেই কালিতে রচিত হলো এমন এক গ্রন্থ, যা আক্ষরিক অর্থে ছবি না হয়েও চিত্রিত করেছে এমন সব ব্যক্তিত্বের যারা স্বমহিমায় উজ্জ্বল। লেখকের অভিব্যক্তি আর ভাবনা মিশে তা হয়ে উঠেছে মনোমুগ্ধকর।
মূলত লেখকের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পর্কের একটা চিত্র এ গ্রন্থখানি। লেখকের বাক্যাত্মক ভঙ্গিতে যারা চিত্রিত হয়েছেন, তারা সবাই বিখ্যাত উজ্জ্বল মানুষ। তাদের সঙ্গে লেখকের সম্পর্কের কথা যখন জানা যায়, জানা হয়ে যায় বিভিন্ন ঘটনা, তখন যেমন ওই ব্যক্তিত্বের কায়া এবং ছায়া জানা যায় নতুন করে, জানা যায় আরেক লেখক ইমদাদুল হক মিলনের আরশিতে, তখন দুয়ে দুয়ে চারের মিলমিশ হয়ে যায়। ভেসে ওঠে এক পূর্ণাঙ্গ চিত্র। জানা হয়ে যায় লেখকের অভিব্যক্তিও।
বিভিন্ন জনের সান্নিধ্যে আসার মাধ্যমে যেমন সরল ঘটনাগুলো জানা হয়ে যায় তেমনি জানা হয়ে যায় তার সংগ্রামের কথাও। কারণ একজন ব্যক্তি ইমদাদুল হক মিলন তো একজন ব্যক্তিমাত্র নন। তিনি দুই বাংলার জনপ্রিয়তম লেখকদেরও অন্যতম। তাকে জানা এবং তার জানা, তার মতো করে জানা মানুষগুলোকে জানার ভেতরে সুপ্ত থাকে অনেক কিছু। গ্রন্থপাঠই সে আস্বাদ দিতে পারে বৈকি।
একইসঙ্গে জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ লেখক হওয়ার বিরল কৃতিত্ব খুব কম সংখ্যক লেখকেরই হয়ে থাকে। ইমদাদুল হক মিলন সেই বিরলতমদের একজন যিনি একই সঙ্গে এই দুই সত্তা ধারণ করেন।
শেষ
ইমদাদুল হক মিলনের কথাসাহিত্য-৭॥ এমরান কবির