॥পর্ব-৩॥
ইমদাদুল হক মিলনের আরেকটি কালজয়ী উপন্যাস ‘পরাধীনতা’। এই উপন্যাস ইমদাদুল হক মিলনকে দেশজুড়ে বিপুল খ্যাতি এনে দেয়। এত প্রভাবী যে উপন্যাস, কী আছে তাতে? এক কথায় যদি বলতে বলা হয়, তাহলে বলতে হবে এই উপন্যাসে আছে কতিপয় মানুষের কথা, যারা নিছক গরিব দেশের নৈ-নাগরিক।
জীবন বদলের আশায় আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকরা পাড়ি জমায় উন্নত বিশ্বে। অর্থসংকটে পড়ে থাকা আমাদের অগাধ বিশ্বাস—উন্নত বিশ্বে ঢুকতে পারলেই কাড়ি কাড়ি টাকা। তাই আমরা লক্ষ্য স্থির করি যেকোনো মূল্যে আমাদের ঢুকতে হবে হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো ওইসব টাকার দেশে। করিও তাই।
কিন্তু টাকা কখনো হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় না। এই স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে যায় সেই অচিরেই। ধূলিস্যাতের কণা থেকে বেরিয়ে আসে শুধুই নিদারুণ বাস্তবতা। এই বাস্তবতা নির্মম, নিষ্ঠুর, ধ্বংসী। কিন্তু উপায় থাকে না ওইসব নাগরিকের যারা বুঝে না-বুঝে হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো টাকার দেশে টাকার জন্য চলে যায়। ফলে তাদের সংগ্রাম করতে হয়ে অধিকতর নির্মমতার সঙ্গে, তাদের মোকাবিলা করতে হয় নিষ্ঠুরতার আগ্রাসের সঙ্গে, তাদের টিকে থাকতে হয় ধ্বংসী সব পরিস্থিতির সঙ্গে। ইমদাদুল হক মিলনের হাত দিয়েই এই চরম বাস্তবতা ও স্বপ্নভঙ্গের করুণ ইতিবৃত্ত পাওয়া যায় ‘পরাধীনতা’ গ্রন্থে।
‘পরাধীনতা’ গ্রন্থটির দু’টি অংশ। ‘পরাধীনতা’ ও ‘পরবাস’। দু’টিই উপন্যাস। বিন্যাস ও প্রকরণে কাছাকাছি। পটভূমি জার্মান।
‘পরাধীনতা’ অংশে লেখক আত্মকথন বা উত্তম পুরুষে লেখেন। বন্ধু মুনিমের সঙ্গে তার মাঝে মাঝে দেখা হয়। আরও দেখা হয় প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে। মুনিমের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতার রেশ ধরেই বের হয়ে আসে তার মনস্তত্ব। মুনিমেরও। জানা হয় তাদের পারিবারিক প্রেক্ষাপট। দেশান্তরী হওয়ার প্রেক্ষাপট।
প্রায় সবারই প্রেক্ষাপট কাছাকাছি। দারিদ্র্য। টাকার হাতছানি। এমনকি দেশে ফেলে আসা স্বজনরাও শুধু টাকাই বুঝে। বোঝে না বাস্তবতা। একদিকে ভিন্ন দেশে ভিন্ন সংস্কৃতিতে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বর্ণবাদী আচরণে, আবাসনের সংকটে, চাকরি হারানোর আতঙ্কে, অসহনীয় খাটুনিতে প্রবাসীদের অবস্থা ধ্বংসের কাছাকাছি। অন্যদিকে দেশ থেকে উত্তরোত্তর বিভিন্ন চাহিদা ও পরিকল্পনার ফিরিস্তি।
‘পরাধীনতা’র লালন তবু সংগ্রাম চালিয়েই যায়। উইকএন্ডের আয়তন সে ছেঁটে ফেলে অন্য কাজ হাতে নেয়। উদ্দেশ্য বাড়তি পাওনা। সেটা করতে গিয়ে শরীরের ওপর বয়ে যায় অসহ্য ঝড়। তবু সে দমে না। সংগ্রাম চালিয়েই যায়। এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে যায় সে।
অহিদ নামের এক যুবকের সঙ্গে দেখা হয় লালনের। অহিদ তাকে আক্ষেপ করে বলে সে নয় মাস হলে এসেছে। কিন্তু নয়দিনও সে ভাত খেতে পারেনি। মনে হয় না সে এ জীবনে আর ভাত খেতে পারবে।
এভাবেই চলে তাদের। চাকরি ধরা, চাকরি ছাড়া, বেকার ভাতা, উইকএন্ডে গলা পর্যন্ত মদ খাওয়া, ভিসিআরে সিনেমা দেখা ইত্যাদি। আর দেশের জন্য নিদারূণ অশ্রুপাত। দেশ থেকে কোনো স্বজনের একটু ভালোবাসামাখা এক টুকরো কথার জন্য আক্ষেপ। তাও জোটে না তাদের।
এই চক্রের ভেতরেই কমবেশি সবাই বদ্ধ হয়ে যায়। অতিরিক্ত কাজ নিয়ে লালন এক পর্যায়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে যায়। ছুটি নিয়ে বিশ্রাম নেয় সে। বন্ধু মুনিম যথারীতি তাকে উইকএন্ডে দেখতে আসে। দু’জনে গল্প করে। তারপর কাছেই এক বাঙালীর বাসায় ভিসিআর এ সিনেমা দেখতে যাবে বলে স্থির করে। তারা যায়ও। সিনেমা চলা অবস্থায় হুড়মুড় করে কয়েকজন বাঙালি সেখানে ঢুকে পড়ে। আয়োজক ওয়ালী ভাই জানান, আমাদের এক বাঙালি ভাই মারা গেছেন। সেজন্য তারা এসেছেন। যে যা পারেন দান করেন।
লালন জানতে চান কোন বাঙালি। তারা বলে ওহিদ নামের এক যুবক। বলার সঙ্গে সঙ্গেই লালন চিনতে পারে। স্বাস্থ্য প্রায় ভেঙে যাওয়া, ভাত খেতে না পারার আক্ষেপ করা সেই যুবকটি। মুহূর্তেই লালনের চেতনবিশ্ব অস্থির হয়ে ওঠে। বন্ধু মুনিমের কাছ থেকে ধার করা একশত মার্কের নোটটাই সে দান করে দিয়ে আসর ছেড়ে উঠে আসে।
ওহিদের মৃত্যু তাকে খুব ব্যথিত ও বিহ্বল করে তোলে। রুমে ফিরে এসে সে শুয়ে পড়ে বিছানায়। কিন্তু ‘দেখি চারদিকের নিরেট দেয়াল আস্তে ধীরে চেপে আসছে আমার দিকে। প্রথমে আমি কিছু বুঝতে পারি না।…দেয়াল কিচ্ছু পরোয়া করে না। চারদিক থেকে এগিয়ে আসে। এগিয়ে আসে। সামনের দেয়াল ছেড়ে আমি তারপর পেছনের দেয়াল ঠেলে ধরি। তারপর ডানদিকের দেয়াল, বাঁ দিকের দেয়াল। শরীরের শক্তি দিয়েও দেয়াল ঠেকিয়ে রাখতে পারি না আমি। বুক ফেটে যায়, চোখ ফেঠে বেরিয়ে আসতে চায় রক্ত। পারি না, আমি আর পারি না। শরীর ভেঙে আসে, হাত পা অবশ হয়ে আসে। আমি তারপর অসহায়ের মতো দুহাতে নিরেট দেয়ালে ঘুসি মারতে মারতে ভাঙাচোরা গলায় চেঁচিয়ে বলতে থাকে, মুক্তি দাও, আমাকে তুমি মুক্তি দাও। আমার কোনও রাজনৈতিক বিশ্বাস নেই।’
এভাবেই পরাধীনতা শেষ হয়। পরাধীনতা শেষ হয় এক যুবকের চারিদিক থেকে ধেয়ে আসা দেয়াল থেকে নিজেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে।
অন্যদিকে ‘পরবাস’-এর আবদুল্লাহর অবস্থা ‘পরাধীনতা’র লালনের চেয়েও করুণ। লালন দেশে বেকারই ছিল। কিন্তু আবদুল্লাহ ছিল একটি কলেজের প্রিন্সিপাল। ষড়যন্ত্র করে তাকে অর্থ আত্মসাতের মামলায় ফাঁসানো হয়। জেল খাটাকে এড়ানোর জন্য তার বড় ভাই জার্মান দেশে পাঠিয়ে দেয়। পরাধীনতার লালন তুলনামুলক শক্তিশালী পক্ষান্তরে পরবাসের আবদুল্লাহ অত শক্ত সামর্থ নয়। তার ঘন ঘন চাকরি যায়। পাঁচ পাঞ্জাবের সঙ্গে সে থাকে। যারা তাকে বিভিন্নভাবে হেনস্থা করে, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে। নিরন্তর এইসব গঞ্জনা সহ্য করে সে বিদেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকে একটি ভালো চাকরির আশায়। এক সময় সে পেয়েও যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে একুশদিনের মাথায় সে চাকরিটিও চলে যায় তার। তাকে খুব অপমানজনকভাবে বের করে দেওয়া হয়। মুহূর্তেই তার থাকার জায়গাটাও বাতিল হয়ে যায়। তখন কী জানি হয় আবদুল্লাহর। তার ভেতরের প্রকৃত স্বাধীনচেতা আত্মবিশ্বাসী একজন জেগে ওঠে। সে স্থির, আর নয় এই দাসত্ব। ‘বরং যে কয়দিন জার্মান দেশে আছি ততদিন এদের ওপরই ছড়ি ঘোরাব।’ রুম থেকে বের হয়ে তার বসের দিকে চাবি ছুড়ে মারে সে প্রথমে। তারপর বড় হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে তাদের কর্মকর্তাকে একটি ট্যক্সি ডাকতে বলে। তারা বলে এতে অনেক খরচ পড়বে। আব্দুল্লাহ তাকে ধমক দিয়ে কাজ করতে বলে। সুখে-দুঃখে জার্মান ফ্রাউম্যানের কাছে যায় আব্দুল্লাহ। এবারও তার ব্যতিক্রম করলো না। গিয়ে ফ্রাউম্যানকে অনুরোধ করলো তার আগের কর্মক্ষেত্র হোটেলের রুম বুক করতে। ফ্রাউম্যান বলে, ওটার অনেক খরচ। ওই খরচে তুমি অন্য হোটেলে চারদিন থাকতে পারবে। আব্দুল্লাহ দৃঢ়। তার ইচ্ছে একদিনের জন্য হলেও সে ওখানেই থাকবে। কর্মকর্তাদের চাকরের মতো খাটাবে।
ফ্রাউম্যান সবই জানতো আব্দুল্লাহর। বলে, দেশে গেলেই তো জেলে যেতে হবে তোমাকে। আব্দুল্লাহ মৃদু হোসে বললো, হোক। তবু দেশে ফিরব আমি। আমার দেশের জেলখানাও ভালো।’
এভাবে শেষ হয় ‘পরবাস’ ।
‘পরাধীনতা’র লালন যেখানে হাঁসফাঁস করছে মুক্তির জন্য, চিৎকার করছে মুক্তি দাও মুক্তি দাও সেখানে পরবাসের আব্দুল্লাহ নিজেই নিজের মুক্তির পথ রচনা করেছে। এই পথ ও মুক্তির আনন্দ দিয়ে ইমদাদুল হক মিলন আমাদের যে বার্তা দিলেন তা প্রকৃত স্বাধীনতার।
চলবে…