[পর্ব-৩৮]
একদিকে প্রেমে স্পর্শে নতুন অনুভবের সোনালি সোনালি দিন, সঙ্গ লিপ্সায় স্বপ্ন স্বপ্ন রাত; অন্যদিকে ভীষণতর যাপিত জীবন। অস্থির চারপাশ। আমি চাকরি খুঁজছি শুনে সে নিষেধ করে।
—আর একটা বছর বাকি। এমএটা করেই চাকরি খোঁজো না কেন?
বরাবর সে স্বল্পভাষী। এর বেশি কিছু বলে না। আমিও কথা বলি না। এছাড়া নানাজনকে বলে রেখেছিলাম চাকরির জন্য। ভাইজান আমাকে হলে থাকতে দেবে না। আমাকে বাসায় থাকতে হবে। অন্যদিকে আমি তার টাকা নিতে চাই না। মাস্টার্সের এই একটা বছর নিজের মতো করেই নিজের খরচ চালাতে বদ্ধপরিকর। এ নিয়ে ভাইজানের সঙ্গে প্রতিদিন কুরুক্ষেত্র লেগেই আছে। যখন যা না তা বাড়িতে বলে বলে আমার মনোবল আর শক্তি সাহসকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। আমি তার মুখে তাকাতে পারি না। ক্রুদ্ধ মুখগুলো, দুর্বৃত্ত চোখগুলো আমার ঘৃণারও সব পথ রুদ্ধ করে রাখে। আমি কেবল অবাক হয়ে ভাবি, এই ভাই আমার বিদেশের মাটিতে পড়ালেখা করেছে। ঘুরেছে কত না দেশ। অলরেডি মাহিদুল ইসলাম আমার সিভিটা দিয়েছেন রুবেলকে। রুবেল তখনকার জনপ্রিয় সিঙ্গার হাসান আবিদুর রেজা জুয়েলের ছোট ভাই। জুয়েল ভাইয়ের সঙ্গে সখ্য আমাদের অনেক দিনের। স্রোত আবৃত্তি সংসদ ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরে নিহত বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না’ নামে যে প্রযোজনাটি করতো সেটাতে আবহ সঙ্গীতের কাজ করা দিয়ে তার সঙ্গে সখ্যের শুরু। কিন্তু রুবেল তার ছোট ভাই তা জানতাম না। চেনারও উপায় নেই। দুজনের চেহারায় কোনোই মিল নেই। মাহি ভাই আমাকে স্টার অ্যাডভার্টাইজার্স এর ঠিকানা দিয়ে দেখা করতে বললেন রুবেলের সঙ্গে। আমি কিছুই জানি না। কী কাজ করতে হবে জানি না। ইন্টারভিউ কী জিনিস বুঝি না। রুবেলকে চিনি না। চাকরির এক্সপেরিয়ান্স নেই কোনো। তবু, একদিন রওনা হয়ে যাই বনানী ১১ নম্বর রোডে স্টারের উদ্দেশে। রুবেল খুব লক্ষ্মী চেহারার ছেলে। খুব ভদ্র। আমাকে সোজা নিয়ে বসিয়ে দেয় ডিরেক্টর আজাদুল হকের রুমে। সেখানে ম্যানেজার এসএন ফেরদৌসীও ছিলেন। নানা রকম কথাবার্তার পর আমি হলে ফিরে আসি। তারপর আর কিছুই জানি না।
এসব কিছুই বলি না তাকে। কেবল বলি, আমি তো ইন্টারভিউ দিয়ে আসলাম একটা।
—চাকরি হবে? ওরা ডাকলে চাকরিটা করবে?
—হুম। করবো।
আমি তার অভিমতের জায়গা রাখি না।
সে আবার বলে, রেজাল্টটা খারাপ করো না চাকরি করতে গিয়ে। একটা বছর মাত্র বাকি।
আমি নতমুখে বসে থাকি। এ নিয়ে আমাদের কোনো মতোবিরোধ কিংবা মতদ্বৈততাও আর বেশিদূর গড়ায় না। সে চলে যায় খঞ্জনপুর। যথাসময়ে ডাক আসে আমার স্টার অ্যাডভার্টাইজার্স লিমিটেড থেকে। ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে জয়েন করি ফোনকল রিসেপশনিস্ট হিসেবে। এমডি সাহেব দারুণ ভদ্র, উচ্চশিক্ষিত, মার্জিত রুচির মানুষ। তাকে সব বলা আছে। এমএ পরীক্ষার সময় তিনি আমাকে ছুটি দেবেন। আর অফিসে কাজের ফাঁকে আমার লেখাপড়া আমি করে নিতে পারবো। জানতেন সেটা ম্যানেজার এসএন ফেরদৌসীও। এমডির চেয়ে বয়সে ঢের বড় তিনি। অসাধারণ একজন নারী আর পুরুষের সান্নিধ্য পাই আমি এখানে এসে। যতক্ষণ অফিসে কাজ করি, ততক্ষণ সবই আনন্দের। ভাইজান ভাবীর তৈরি করা প্রাত্যহিক যাতনা ভুলে থাকার। আমি যেদিন জয়েন করি সেদিন থেকেই আমার ডেক্সে একটি পুরনো আমলের কম্পিউটার পড়ে রয়েছে। বিশাল তার মনিটর। আমি সহজে তাতে হাত লাগাই না। সত্যি বলতে তখন আমি কম্পিউটার বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞ। তিনি প্রথম আমাকে কম্পিউটার ধরালেন।
—কাজ তো খুব বেশি নেই এখানে। সময়গুলো নষ্ট না করে তুমি অবসর সময়ে এখানে টাইপ শিখবে।
—আচ্ছা।
—কিভাবে শিখবে?
—জানি না স্যার।
তিনি আমাকে কম্পিউটার ওপেন করা দেখান। তারপর বন্ধ করে আমাকে ওপেন করতে বলেন। বিজয় কি-বোর্ড ওপেন করে দেন। আমাকে সেটা মুখস্থ করতে বলে নিজের কাজে চলে যান। আমি সেটা পারি না। কি-বোর্ড দেখে দেখে দুই আঙুলে টাইপ করার চেষ্টা করি। যেতে আসতে তিনি সেটা খেয়াল করেন আমি বুঝতে পারিনি। তিনিই শিখিয়ে দিয়েছিলেন পত্রিকা দেখে দেখে প্রতিদিন এক দেড়শো শব্দ টাইপ করতে। সেদিনও তাই করছিলাম। বাইরে একটা কাজে গেছিলেন বোধ করি। নিজের রুমে ঢোকার পথে আমার ডেস্কে দাঁড়ান।
—তুমি এভাবে টাইপ করছো?
আমি লজ্জা পাই। কথা বলি না। মাথা নিচু করে থাকি।
—কি-বোর্ড দেখবে না। মনিটরে তাকাও।
আমি মনিটরে তাকিয়ে থাকি। আমার হাত চলে না। তিনি রেগে যান—ওঠো?
আমি আমার চেয়ার ছেড়ে দেই। পুরো অফিসে ২০/২২ জন স্টাফের মধ্যে পিওনের ঠিক ওপরের একটি পদে আমি চাকরি করি। আর সেখানে চেয়ারটিও পদ অনুসারে রাখা। তাই আমি পিওনকে ডাকি।
—এই সালাম ভাই, চেয়ার দিন স্যারকে।
তার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি আমার চেয়ারটিতেই বসে পড়েন। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি। স্যারের রুম থেকে চেয়ার এনে সালাম দাঁড়িয়ে থাকেন। কে শোনে কার কথা! দ্রুত টাইপ করতে থাকেন স্টার অ্যাডভার্টাইজার্সের এমডি আজাদুল হক। দেখিয়ে দেন আমাকে, কিভাবে কোনো আঙুল কোথায় রেখে বাকিগুলো কিভাবে মুখস্ত রাখবো। আমি মুগ্ধ হয়ে তার ঝড়ের গতিতে টাইপ করা দেখি। বিদেশে উচ্চশিক্ষিত, অসাধারণ সুন্দর, পৌরুষে দীপ্ত, উচ্ছ্বল দীর্ঘাঙ্গী এক পুরুষ তিনি। উজ্জ্বল তার গায়ের রঙ। মাথার সামনে খানিক চুল কম। তবু তাকে দারুণ দেখায়। বিত্তশালী পরিবারের ছেলে। কম্পিউটার সায়েন্স পড়েছেন আমেরিকার কোনো এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দেশে ফিরেছেন। তার টাইপ করার কী দরকার থাকতে পারে, বুঝে পারি না। নিশ্চয়ই টাইপ করেন। না হলে এত স্পিড কী করে সম্ভব! তিনি আমাকে পরামর্শ দেন।
—যে টাইপিস্ট বেশি বেশি মাউস ইউজ করে, সে ভালো অপরেটর নয়।
—আচ্ছা।
—যে টাইপিস্টের টাইপ করতে গেলে আঙুল দেখা যায়, সে কোনো টাইপিস্টই নয়।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি তার দিকে। আমার প্রশ্নচোখ দেখে তিনি হেসে ফেলেন।
—হা হা হা। অবশ্য সেটা আমার মত। হা হা হা।
হাসতে হাসতে নিজের রূমে চলে যান তিনি। আমি মনে মনে শপথ করি।
—আমিও টাইপ করবো। আর আমারও আঙুল দেখা যাবে না্। ঠিক এই বিদ্যাটি কাজে লাগানো শুরু করি ২০০১ সালে, যখন বাংলাদেশ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন প্রোগামস্-এর অ্যাডোলসসেন্ট রিপ্রোডাক্টিভ হ্যালথ প্রজেক্টে প্যানেল রাইটার হিসেবে কাজ করতে আসি। সবাই যখন হাতে স্ক্রিপ্ট লেখে। টাইপ করতে দেয়। আমি ততক্ষণে লিখে টাইপ করে সারা। সরাসরি মাথা টু কি-বোর্ড। আজও উপন্যাস লিখতে বসি, কবিতা লিখি, রিভিউ কিংবা কোনো বইয়ের আলোচনা, প্রতিরাতে কমপক্ষে ২০০০ শব্দ লিখি, আর মনে করি, আজাদ সাহেবের সেই কথা ক’টি।
তারপর খুব দ্রুত আমার বিজয় কি-বোর্ড মুখস্থ হয়ে যায়। ফেরদৌসী ম্যাডাম অসম্ভব সুন্দরী। ফর্সা দীর্ঘাঙ্গী অপ্সরা যেন এক। পড়ন্ত যৌবনা। কিন্তু আমি তাকে মুগ্ধ চোখে দেখি। তার রূপ নয় শুধু, আমি মু্গ্ধ হই তার মেধার দীপ্তি দেখে, বিস্মিত হই তার লিডারশিপ দেখে। ১২ জন পুরুষ মানুষের মাঝে একাকী একজন নারী অসাধারণ দক্ষতায় কাজ করে চলেছেন। কোনো প্রতাপ নেই, কোনো অকারণ নির্দেশ শাসন নেই। তার বাক্য মধুর। তার আদেশ নম্র। নীল শাড়ি পরে লাল টুকটুকে প্রোটনসাগাতে বসে তার গাড়ি ড্রাইভ করার দৃশ্য তখন আমার কাছে নারীর রুদ্র রূপের অরূপ। প্রায়ই কোনো কাজ না থাকলে তিনি আমাকে তিনটে সাড়ে তিনটেতেও বাড়ি চলে আসতে বলেন। সেদিনও আজাদুল হক সাহেব অফিসে আর ফিরবেন না। ফেরদৌসী আপাও বাড়ি চলে আসবেন। আমার কাজের অবস্থা জানতে চাইলেন। বললাম, সব কাজ শেষ। আর কিছু বাকি নেই। তিনি বললেন, চলো। আমি তোমাকে পৌঁছে দেই।
গাড়ি ছুটছে। বনানী ১১ নম্বর রোড থেকে মোহাম্মদপুরের দিকে। তিনি থাকেন মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটিতে। আমি যাবো আজিমপুর, বিডিআর তিন নম্বর হলের কাছে বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে। পথে যেতে যেতে কথা হয় অনেক।
—পড়ালেখার সাথে সাথে চাকরি করছ, ভালো। কিন্তু খেয়াল রেখো। পড়ার ক্ষতি যেন না হয়। রেজাল্ট ভালো করতে হবে। না হলে কিন্তু আমার কাছে তোমার আসতে হবে।
মায়াঝরা কথাগুলো আমি নতমুখে শুনে চলি। মানুষের বুকেও এত ভালোবাসা থাকে। নারীর বুকে! নারীর মনে! মায়ের পরে আর অমন আদরে কাউকে কথা বলতে শুনিনি আমি। তাও দু’দিনের পরিচয়। তার ওপর আবার তিনি আমার বস। আমি অনভিজ্ঞ, ছোট, তুচ্ছ একটা চাকরি করি তার অধীনে। আমি চোখে কান্নার জল লুকাই। মনে পড়ে মায়ের মুখ। মনে পড়ে ভাবীর অসংস্কৃত ভাষা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভাইয়ের ক্রোধে রক্তাক্ত হয়ে ওঠা দুই চোখ। আমার যত দোষ ভাবী ভাইয়ের চোখে পড়েছে। আমি প্রেম করেছি। আমি পরিবারের মানসম্মান ডোবাচ্ছি। এই বিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আমি কোনো ছেলে বন্ধুর সঙ্গে রিকশায় উঠলে খারাপ হয়ে যাই। নাটকের গ্রুপের রিহার্সেল শেষে কোনো ছেলে সহকর্মী বাড়ি পৌঁছে দিলে আমি হয়ে পড়ি অস্পৃশ্য। ছায়ানটে গানের ক্লাসে আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে গেলেও তার অন্য নাম হয়—মায়ের কাছে বাড়িতে খবর যায়, আমি ছুটির দিনে শাড়ি পরে সেজেগুজে প্রেম করতে বের হই। অথচ তাদের অনুভূত হয়নি কোনোদিন লেখাপড়া করার জন্য এই একটি বছর ছোট বোনটিকে আমাদের সঠিক পরিবেশ দেওয়া দরকার। আমার মাথায় কেবল একটি বিষয় ঘুরে ঘুরে পাক খায়—প্রেম করেছে বলেই কি বাড়ির প্রায় কনিষ্ঠ সদস্যটি জ্যেষ্ঠ সদস্য দ্বারা সকল মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে! তার ঘরে মানসিকভাবে নির্যাতিত হতেই থাকবে! নারী জটিল নারী কুটিল নারী স্বার্থপর। যাবতীয় সংকীর্ণতা নিয়ে আমার জীবনের প্রতি পদক্ষেপে এভাবেই প্রতিভাত হতে থাকে নারী। সংসারে নারীর পথ চলায় কাঁটা বিছায় নারী। যত যত বিষ আছে তাই মেখে বিষাক্ত করে তোলে সূচাগ্র আর সময় মতো বের করে আনে তুনের থেকে তীর। ক্লাসে ঠিকঠাক পারসেন্টিজ নেই বলে ভীষ্মদেব ঘোষ আমাকে টিউটোরিয়াল পরীক্ষা দিতে দেবেন না। স্যারকে অনেক বুঝিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। ডিপার্টমেন্টে মামাদের ধরে কিভাবে উপস্থিত না হয়েও পারসেন্টিজ কাভার করতে হয়, সে বিদ্যা বন্ধুদের দেখে জানলেও আমার সুযোগ ছিল না। ভোর সাতটায় বন্ধুরা যখন কলাভবনে ক্লাসে যায়, আমি তখন দৌড়াই অফিস। যখন ফিরি, তখন সন্ধ্যা লাগো লাগো। অফিস টাইম শেষ। সানজিদা খাতুন রবীন্দ্রসংগীত যতই ভালো গান আর বাঙালিয়ানার চর্চা করেন, তাকে দেখলেই ভয়ে হাত-পা কেঁপে ওঠে। তার টিউটোরিয়াল ক্লাসে যাওয়ার সাহসই আমার হয়ে ওঠে না। প্রতি মুহূর্ত বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত বিমুখ। লুবনার সঙ্গে তখন কিছু কিছু করে কথা হয়। বাকি আর সব বন্ধুর সো কল্ড বন্ধুত্বে আমার শ্রদ্ধা কিংবা ভক্তি হয় না। সারাদিন অফিস। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আমি আবার ছাদে বসি। সন্ধ্যায় কিছু লেখাপড়া করি। আবার রাতে ছাদে উঠি। কখনো কখনো লুবনাও ওঠে। দুজনে আধোরাত আকাশের তারা দেখি। তার কথা ভাবি। আমি চাকরিতে জয়েন করাতে সেও একা হয়ে গেছে। সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে।
বিকেলে একটুখানি দেখা। হাতে হাত রাখা। বহুদূর হেঁটে যাওয়া। অকারণে ঢাকা কেন পড়ে আছে? অতএব প্রায় প্রায়ই তার খঞ্জনপুর চলে যাওয়া। সারাদিনের পর আমি তখন আবার একা। ভাইয়ের বাড়ি চলে আসি। শুরু হয় নরক যন্ত্রণা। সেদিন মনে আছে ভা্ইজান এত এত মারাত্মক দুর্ব্যবহার করতে থাকে। আমি বাড়ি থেকে না খেয়ে বের হই। বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখি একমুঠো ভাতও নেই। বুয়াকে জিজ্ঞেস করি। বুয়া বলে।
—ভাবী নিষেধ করেছে ভাত রাখতে।
—আমি এসে খাবো বলোনি ভাবীকে?
—বলেছিলাম। তিনি নিষেধ করেছেন।
আমি চুপচাপ শুয়ে পড়ি। ভাইজান তখন দৈনিক বাংলার বাণীতে চাকরি করে। রাত বারোটা নাগাদ বাড়ি ফেরে। দিনে প্রায় বেলা বারোটা নাগাদ তাদের বেডরুমের দরজা বন্ধ থাকে। দুপুরের খাবার হয়তো বিকেলে খেয়ে ভাইজান অফিসে যায়। তাই রাতের রান্না করতে ভাবী যায় রাত দশটা এগারোটায়। আমি ঘরের কোনো কিছুতে হাত দিতেও ভয় পাই। কখন কী নিয়ে লেগে যায়্। ভাবীর রুদ্রমূর্তি আমাকে অপরাধী করে দেয়। আমি না খেয়ে বের হই তাতে দোষ। রাতে ভাবী রান্নার করতে করতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। তাতেও আমার দোষ। সকালে ঘুম ভেঙে অফিস গিয়ে পিওনকে দিয়ে খাবার আনিয়ে খাই। দুপুরে ভাত অফিসে খাই। বিকেলে বাড়ি ফিরে কোনো নাস্তা নেই। রাতের ভাত খেতে অনেক দেরি। আমি ক্ষুধার্ত, বিষণ্ন। বেঁচে থাকবো কী করে, কাজ করবো কী করে, ভেবে ভেবে দিশেহারা। ৩০০০ টাকা বেতনের চাকরি করি। মাসে ১০০০ টাকা ভাইয়ের হাতে দিয়ে যা থাকে, তাতে কোনো মতে মাস চলে। আমি আরও আরও জটিলতার মাঝখানে এসে পড়ি।
সেদিনও বাড়ি ফিরে খাবার পাই না। তারপর ঠিক করি আর বিকেল বিকেল বাড়ি ফিরবো না। আমি টিএসসিতে রাত আটটা অবধি আড্ডা দেই গ্রুপের আবৃত্তিকার বন্ধুদের সঙ্গে। তখন রাতের বেলা পিজি হসপিটালের নিচে পরোটা ভাজা হতো। তাই খেয়ে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে থাকি। ব্যস। আমি নষ্টা, আমি ভ্রষ্টা্। আমি রাতবিরেতে বাড়ি ফিরি। কোথায় কী করি কেউ জানে না। আমি আর সইতে পারি না। কাউকে এসব কথাও বলতে পারি না। নিজের হাতে নিজের রুমের সিনিয়র আপাকে নিজের বড় ভাইয়ের বউ করে নিয়ে আসার মাশুল দিতে থাকি। নিকট অতীতের সেই দিন থেকে নিকট বর্তমান অবধি। সে মাশুল দিয়ে চলেছি বাবার মৃত্যু পর তার লাশের সামনে বসে থেকেও।
চলবে…
অ্যা হান্ড্রেড ফেসেস অব উইমেন-৩৭॥ শাপলা সপর্যিতা