॥কিস্তি-ছয়॥
বেশি সময় শান্ত থাকতে পারি না। মেয়েদের খাইয়ে গোসল সেরে তাদের সঙ্গে নিয়ে শুয়ে পড়ি। আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকি। রাতে কী হবে? এভাবে চলবে? কিছু একটা করতেই হবে এবার আমাকে। কী করবো? কার কাছে যাবো? কে দেবে এই সময়ে আমাকে চাকরি? দিলেই বা চাকরি করবো কী করে? এইটুকু তিন বছরের বাচ্চা মেয়ে আর সাড়ে ছয় বছরের মেয়েদের স্কুলের পর একা ঘরে রাখবো কী করে? এতটা ভরসা মেয়ের বাবার ওপর করতে পারি না, সে মেয়েদের নিয়ে থাকবে আর আমি চাকরি করবো। তবু ভাবি। আবার ভাবি। ভাবতেই থাকি। চোখের জল ধরে রাখতে পারি না। ভেসে যাই চোখের জলে। জলে ভেসে ভেসে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি, মাগরেবের আজানের সুরে ঘুমটা ভেঙেও যায়। ঘুমটা ভাঙবার সঙ্গে সঙ্গে কী এক গভীর যন্ত্রণায় বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কী যেন হারিয়ে গেছে। সব শূন্য শূন্য লাগে। একদম খা খা মনে হয় চরাচর। কোথাও কেউ নেই। আমার ঘর নেই। আমার বর নেই। ভাইবোন কিচ্ছু নেই জগৎসংসারে। আমি একা। আমার খাবার নেই। আমার পরনে কাপড় নেই। আমার কোথাও কিচ্ছু নেই। কেবল আছে দুটি সন্তান। ওদের পেটে ভাত নেই। ওদের মাথায় ছাদ নেই। ওদের ভবিষ্যৎ নেই। নিজেকে পৃথিবীর ব্যর্থতম মা মনে হয়। এমন মায়ের পৃথিবীতে বেঁচে থাকবার অধিকার নেই। আমি আত্মহত্যার কথা ভাবি। কিন্তু আমি মরে গেলে আমার মেয়েদের কী হবে? যে বাবা মা বেঁচে থাকতে কেবল সন্তানের খাবার বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে না, সে কি মা মরে গেলে সন্তানদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারবে? আমি শঙ্কিত হই।
রাস্তার কুকুর বিড়ালের মতো জীবন দেখতে পাই আমার অনুপুস্থিতিতে আমার মেয়েদের। তারপর ভাবি, নাহ আমার একা মরলে চলবে না। আমার মেয়েদের নিয়েই মরতে হবে। তারপর খুব পাকা লেখকের মতো উপন্যাসের প্লট সাজাই। সিন টু সিন প্লট সাজাই। দক্ষ ফিল্ম ডিরেক্টরের মতো শট ডিভিশন করি। প্রথমে একটা জগের মধ্যে বিষ মেশাবো। প্রথমে দুই মেয়েকে খাওয়াবো। তারপর আমি খাবো। সামনে পেছনে ভাবি। তারপর নিজেকেই প্রশ্ন করি—আচ্ছা, মেয়েদের বিষের জল খাইয়ে দিলাম। তারপরেরর ঘটনাগুলো সহ্য করতে পারবো তো?
ছটফট করতে করতে আমার আদরের মেয়েরা মরছে। আমার চোখের সামনে মা মা বুকটা জ্বলে যাচ্ছে, মা কী খাওয়ালে বলে মাটিতে পড়ে তড়পাচ্ছে। ওদের চোখ ঠেলে বের হয়ে আসছে। ঠাণ্ডা জলের জন্য জিহবা বের করে লম্বা শ্বাস নিতে চেষ্টা করছে। ওরা মরছে। ওরা মরছে। আহা…হা হা হা।
আমি একা ঘরে চিৎকার করে কেঁদে উঠি। কিন্তু এ ছাড়া আমার কী করার আছে? বাড়িওয়ালা যদি ঘর থেকে বের করে দেয়। কী করবো। ওদের নিয়ে কোথায় যাব আমি? ভাইবোনের বাড়িতে আশ্রয় নেবো। না কি বাবার বাড়ি ফিরে যাবো? আচ্ছা ভিক্ষা করা কি সম্ভব হবে আমার? এসব ভাবতে ভাবতে চোখের জলে বালিশ ভিজে যায়। এতক্ষণ যে ঘরে আলো জ্বালিনি তার খেয়ালই নেই। মাগরেবের পর বেশ সময় গেছে। অন্ধকার হয়ে এসেছে চারপাশ। আমার বোধে নেই। অন্ধকারে মেয়েদেরও মুখ দেখা যায় না। হঠাৎ দেখি জয়শ্রী আমার গলা জড়িয়ে ধরে। চোখের জল মুছে দিয়ে বলে—মা কেঁদো না।
আমি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠি। আমার বিধ্বস্ত মন অসহায় নারীত্ব আর বিপর্যস্ত মাতৃত্ব একটি সান্ত্বনার বাণী শোনার জন্য প্রতীক্ষায় ছিল—বুঝতে পারি এতদিনে। একটি মাথায় রাখার মতো হাত খুঁজছিল। একটি সান্ত্বনার বাণী খুঁজছিল—ভেবো না, আমিতো আছি। কোনো সমস্যা নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না অমন আমি পাইনি। ওই দুঃসময়ে কেউ আমার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। ঠিক এমন সময় মেয়ের ওই হাত আমার বুকে শান্তির পরশ এনে দেয়। আর আমি ঘুরে দাঁড়াই।
—না। আমাকে বেঁচে থাকতেই হবে। আমার এই অমূল্য দুই সন্তানের জন্য আমাকে বেঁচে থাকতেই হবে। আমি সুস্থভাবে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকবো। আমি শিক্ষিত। আমি সুস্থ। যেকোনো কাজ করতে আমার কোনো লজ্জা নেই। আমি আমার মেধার সবোচ্চ ব্যবহারে প্রস্তুত। আর তা না হলে এই বিল্ডিংটাতেই আমি বুয়ার কাজ করবো। কোনো আপত্তি নেই। পারতে আমাকে হবেই। যে করেই হোক। তাই বিষের কৌটা আমি বন্ধ করে রেখে দেই সেদিনই।
চলবে…