॥কিস্তি-চার॥
তুফানের স্টমাক ওয়াশ শেষ হয়। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায় না। ডাক্তার নিবিড় পরিচর্যায় রেখেছেন তাকে। এখনো কাউকে কিছু বলছেন না। ডাক্তারের কাছে আশার বাণী শোনার প্রতীক্ষায় তুফানের বাড়ির বাকি চারটি মুখ বসে আছে পোস্টঅপারেটিভ রুমের সামনে। তাদের যেতে দেওয়া হচ্ছে না তুফানের কাছে। ওদিকে পুলিশ মানিককে নিয়ে ছুটছে এখান থেকে সেখানে। তারা ইনফরমেশন পেয়েছে—মানিকের কাছে আরও একটি পিস্তল রয়েছে। সেটা খুঁজে দিতে হবে মানিককেই। আমি বিদেশি সিনেমায় দেখেছি আসামিকে খুঁজে বের করার জন্য কুকুরকে গলায় রশি বেঁধে ছেড়ে দেয় পুলিশ। কিন্তু মানুষকে হাতকড়া বেঁধে এমন করে পুলিশ ধরে নিয়ে ছুটে চলছে জীবনে এই প্রথম দেখছি। মানুষ! হ্যাঁ, মানুষই মানুষের এমন সর্বনাশের কারণ! মানুষই মানুষকে মানব থেকে পশুতে নামিয়ে নিতে পারে। আবার মানুষই উঠে যেতে পারে মানবতার উচ্চ শিখরে নিজের কাজের মাধ্যমে। হায় মানব জন্ম! হায় মানুষ! মানুষ আর পশু দুই-ই জন্মায় পশু হয়ে। পশুর বাচ্চাটি দিন দিন পশুই হয়। অথচ মানুষের ঘরে জন্ম নেওয়া পশুটি দিনে দিনে মানুষ হয়ে ওঠে। এটাই তো ঘটার কথা। কিন্তু মানুষের ঘরে জন্ম নেওয়া সব পশুই কি মানবে উত্তীর্ণ হতে পারে! আমি ধন্দে পড়ে যাই মাঝে মাঝেই।
আমি এক তুচ্ছ ক্ষুদ্র মানুষ। তাকিয়ে রয়েছি কোনো এক অজানা আলোর দিকে। একদিন ঝলকে উঠবে সে আলো। আলোয় ভরে উঠবে মানিকের বুকের ভেতরটা। সে বুঝতে পারবে জন্মদাত্রীর মা হয়ে ওঠবার যন্ত্রণা। সে আলো রিফাতের বাবার বুকের অন্ধ চোখটাকে পুড়িয়ে দেবে। টাকার নেশায় অন্ধ যিনি। নেশার দ্রব্য সাপ্লাই করে যে যুব সমাজকে আজ পঙ্গু বানিয়ে রাখছেন যিনি একদিন সেই পঙ্গুত্বকে তার নিজের সন্তানটিও ভেসে যেতে পারে, এই আলো একদিন জানিয়ে দেবে তার ছেলে সন্তানটিও বয়ঃসন্ধিকালে হয়ে উঠতে পারে নেশাসক্ত। সে আলো আমার ঘরেও জ্বলে উঠবে। আমার গৃহকর্তার কর্মবিমুখ আরাম আয়েসী বিবেকহীন মনটাতে জ্বেলে দেবে আলো। সে আলোতে সে দেখতে পাবে সন্তানের বিষণ্ন জীবনের যাতনার ক্লেদ। দেখবে সে আলোতে নিজের স্ত্রীর বছরের পর বছরের একাকিত্ব। একলা সংসার টেনে চলার অপমান আর কষ্ট। সেই আলোর প্রত্যাশী আমি একবার মানিকদের বারান্দায় গিয়ে উঁকিঝুঁকি দেই পিউ আর পাপিয়ার সঙ্গে। পিউ-পাপিয়ার দুই চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ছে জল। ভাইকে কুকুরের মতো হাতকড়া বেঁধে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। এলাকার সব মানুষ দেখছে। এতক্ষণে জানা হয়ে গেছে সব। এ-ওর জানালা গলে দেখছে ওদের ভাই দৌড়ে যাচ্ছে। গন্তব্য জানে না। ঘরে নিয়ে এসেছিল যে পিস্তলটি, রেখে দিয়েছিল গোপনে রুনুর কাপড়ের আলমারিতে। সেটি সে নিজেই বের করে দিয়েছে। বাড়ির কেউই জানতো না সে কথা। কিন্তু কোথায় আছে আর একটি পিস্তল? আদৌ কি পুলিশের কাছে আর একটি পিস্তলের খবর আছে? কিন্তু পিস্তল তো বের করে দিতে হবে। মানিক কি আদৌ জানে আর একটি পিস্তল কোথায়? না কি এ এক প্রহসন? পেছনে আছে কোনো জটিল কুটিল পাশা খেলার চাল! তবু মানিক উদ্দেশ্যহীন চলছে। তাকে ছুটিয়ে নিয়ে চলছে ওসিসহ পুলিশের চার সদস্যের একটি দল। মাঝে মাঝেই পুলিশ লাঠি দিয়ে তার হাঁটুতে বাড়ি দিচ্ছে। এবারের বাড়িটা খুব জোরে লেগেছে
—উফ
শুধু এই একটি শব্দ বোধ করি বের হয়ে আসে প্রথমবারের মতো মানিকের মুখে। পাঁচতলার বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে বেশ দূরে নিচের রাস্তায় ঘটতে থাকা ঘটনার সব শব্দ কিংবা কথা শোনা যায় না। কেবল দেখতে পাই, লাঠির বাড়িটা খেয়েই মানিক বসে পড়েছে মাটিতে। তার হাতকড়ায় বাঁধা হাতদুটো জোর হাতে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে উঠে থাকে পুলিশের হাতে টেনে রাখা রশিটাতে। সঙ্গে পুলিশের ওসি বুটপরা পায়ে কষে একটা লাথি লাগায় মানিকের ঠিক বুক বরাবর। আমি দেখতে পারি না আর। পিউ-পাপিয়ার বুকের ভেতর আরও অনেক বেশি চোট লাগে। ওই দৃশ্য থেকে ওরা দুজনেরই জলভরা চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ওদের ঠিক পেছনেই আমাকে দেখতে পায়। আমার ঘাড়েই মুখ গুঁজে দেয়। আমি ওদের পিঠেও হাত রাখার সাহস পাই না। ওতে কি শান্ত করা যাবে একজন কিশোরী পিউয়ের মন। একজন সদ্য কৈশোরউত্তীর্ণ পাপিয়ার মন! মানিকের মায়ের ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসে বারান্দার বাতাসে। ভেসে ভেসে চলে গেছে কি মানিকেরও কানে? তাতে কি গলবে মানিকের মন! না কি তেমনি লাশের মতো শুয়ে থাকা মানিকের দেহ-মনে পাথরের মতো বাধা খেয়ে ফিরে আসবে আবার মায়েরই বুকের পাঁজরে। কে বলবে!
চলবে…