॥পর্ব-৪॥
আগের পর্বে আমার ভুল ছিল, ২০০২ সালে নয়, আর একবছর আগে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জামিয়া রাহমানিয়ায় আসি। এখানে বড় ভাই হাসান জুনাঈদ আমার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রাহমানিয়া মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস ও ইফতা ডিগ্রি অর্জন করেন। এখানে একবছর কাটিয়ে আমাকে চলে যেতে হয় মাদারীপুরে। ২০০৩ সালে আমি মাদারীপুরে যাই। জামিয়াতুস সুন্নাহ। ওখানেও অভিভাবক হন মাওলানা শিব্বির আহমদ, প্রথমপর্বে যার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। ওই বছর ক্রিকেট বিশ্বকাপ ছিল। যেখানে ভারত-পাকিস্তানের খেলা দেখতাম পাশের হিন্দু বাড়িতে। এই ঘটনাটি ঘটেছে আমার প্রথম মাদ্রাসা হরষপুরেও। সেখানেও মাদ্রাসার পাশেই কুলিদের বাড়িতে বসে ক্রিকেট খেলা দেখতাম। মাদারীপুরে এমনও হয়েছে, ক্রিকেট খেলা দেখতে গিয়ে রাতের খাবার মিস করেছি আর ওই হিন্দু বাড়ির দিদিদের ঘরেই খেয়েছি পেটপুরে। বিশেষ করে মাদ্রাসার পূর্ব-দক্ষিণ দিকে ওই বাড়িগুলো এখন আছে কি না, জানা নেই।
এই মাদ্রাসায় পড়ার সময় আমার অভিভাবক মাওলানা শিব্বির আহমদ। আর তার অনুপস্থিতি মাওলানা আবদুল্লাহ। সুদর্শন, ফর্সা আর গোলগাল চেহারার এই শিক্ষক কোথায় কাজ করছেন, জানা নেই। আমার একটি প্রেম হয়েছিল এই মাদ্রাসাতেই।
মাদারীপুর জেলার বাহাদুরপুর গ্রামেই মাদ্রাসার পশ্চিম দিকে একজন স্পেন প্রবাসী ব্যক্তির একটি খালি বাড়িতে আমার ফুফাত বোন তার সন্তানসহ বসবাস করতেন, এটা শিব্বির আহমদ পেয়েছিলেন। দোচালা কাঠের ঘর। ওই সময়টাতে মধ্যরাতে লাকির সঙ্গে দেখা করা ছিল প্রেমের একটি নিয়মিত কার্যক্রম। গোল চেহারার লাকি পড়াশোনায় তেমন ভালো ছিল না, যতখানি ফুফাত বোনের কাছে শোনা।
প্রতিদিন দুপুরবেলায় নিয়ম করে তলানিতে যাওয়া জলের পুকুরে গোসলের সময়, বিকালে ঘুরাফেরার সময়, সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় আর রাতে জানালার পাশে বসে পড়ার সময়—এসব সময়ে আমাকে টেনে-টেনে নিয়ে যেত লাকির কাছে। ওর সৌন্দর্যেই বেশি কাবু ছিলাম আমি। গোল অবয়ব, ফর্সা ত্বক, গলা আর নাকের ডানদিকে কালো তিলে, যে কেউই লাকির প্রেমে হাবুডুব খাবে আর এমনটাই ঘটছিল তখন। আমি লাকির কত নাম্বার প্রেমিক ছিলাম, এটা তখনো ঠাহর করতে পারিনি। তবে আমার প্রেম, আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বের ছিল। বিশেষ করে মধ্যরাতে জানালার পাশে বসার সময় লাকিকে ছুঁয়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল।
শিব্বির আহমদ দুলাভাই হওয়ায় এই সুযোগটি গ্রহণ করি, আমি আর ফুফাত ভাই মাহমুদুল হাসান দুজনেই ঘরের বারান্দার কোঠায় ঘুমাতাম। দুচালা ঘরের মূল অংশটায় বোন ও তার সন্তানেরা আর বাইরের অংশে আমি ও ফুফাত ভাই মাহমুদ।
প্রচুর গাছগাছালিতে ভরপুর বাড়িটিতে আরও একটি ঘর ছিলো, তবে কার সেটি মনে করতে পারছি না। এটিও ভুলে গেছি, ঠিক কী-কী বৃ্ক্ষ ছিল বাড়িটিতে। কাঠাল, নারিকেল, জলপাই, ঝোপঝাড় তো ছিলই। লাকির সঙ্গে প্রেম করার খবরটি প্রথমে মাহমুদই দেয় ওর আপাকে। আর আপার কাছ থেকে শিব্বির দুলাভাই। পরে মাদ্রাসা থেকে বাড়িতে যাওয়া বন্ধ হলে গেলো, রাতে থাকা তো দূরের ব্যাপার। এরপরও অনেক দিন অব্দি মধ্যরাতে মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে লাকিকে দেখতে এসেছি, ততদিনে লাকির জানালায় খিল পড়েছে। এমনকী ওই সময় দিব্বি মাদারীপুরের অনেক বাড়িতে রাতে দরোজা খুলেই ঘুমাতে যেত স্থানীয়রা, এখন কী পরিস্থিতি কে জানে? এটা বিস্ময়করও বটে, রাতে চোরের কোনও ভয় ছিল না, কিন্তু পরিশেষে প্রেমিকের ভয়ে লাকির বাড়িতে দরোজা ও জানালায় খিল পড়তে থাকে নিয়মিত। ওই বছরের শেষদিকে লাকির বিয়ের আলোচনা শুরু হয়। কানে আসে আমাদেরও। মাদ্রাসায় আমি, ইকরাম, মাহমুদ, জুবায়েরদের আড্ডায় লাকির প্রসঙ্গ কতরাতে এসেছে, কতরাতে ওর সৌন্দর্যের নানামুখ নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তা কেবল ওই রাতের তারারাই বলতে পারবে। সুবিশাল মাদ্রাসার মসজিদের ছাদে উঠে মধ্যরাতে কিশোরদের আলোচনায় তন্বীর সুন্দর আর অভিব্যক্তির সমস্ত ব্যকুলতা উন্মূল হয়ে ছড়িয়ে পড়ত আশেপাশের আকাশেও। আমাদের আলোচনার পাশাপাশি আমার লেখায় নিয়মিত প্রসঙ্গ হয়ে উঠতো, আনকোরা কৈশোরের পদাবলি বা গল্প হলুদখামে এসে রাজধানীতে আজকের কাগজে ছাপা হতো। আড্ডাপর্বে কত যে লেখা প্রকাশিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। নামে-বেনামে আজকের কাগজের আড্ডাপর্বে আমার লেখার বিষয়বস্তু হয়ে লাকি এসেছে বহুদিন।
আমার এত-এত প্রতিষ্ঠান ও নিয়মের বিরোধিতা সত্তেও শিব্বির দুলাভাইয়ের কাছে আমি সস্নেহের, আদরের। মুগ্ধতার। আমার গান, কণ্ঠে নাতে রাসূল আর হামদের স্তুতি নিয়তই ছড়িয়ে পড়তো মাদ্রাসার শিক্ষক আর ছাত্রদের মধ্যে। কোনও অনুষ্ঠান মানেই সালমান তারেক গাইবে। নিয়মিত পড়াশোনায় একেবারে পিছিয়ে পড়া ছাত্র থাকলেও গানে আমি বরাবরই সব প্রতিষ্ঠানে সবার ওপরে। এটা ছিল রাহমানিয়া মাদ্রাসায়ও। রাজধানীর মাদ্রাসা হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বী বহু গায়ককে আমি পিছিয়ে দিয়েছি সুরে-সুরে। এই গানের বেলায় একটি গান যেটি প্রয়াত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হককে নিয়ে রচিত লও সালাম লও সালাম, লেখা ও সুর করেছিলেন মাওলানা সুলায়মান; তার কোনও অবস্থান জানা নেই। ওই সময় থেকেই তাকে পাইনি। যদিও এই গানেই আমার বহুধা পরিচিতি এসেছে ধর্মভিত্তি দল খেলাফত মজলিসেও। অবিভক্ত মজলিসের আমিরের নামে গান গেয়ে তখন আমি সুপরিচিত। শুনেছি, পরে কেউ জানিয়ে-না জানিয়ে এই গানটি কোনো কোনো অ্যালবামেও যুক্ত করেছে।
গানের কারণে অনেকটাই বিশেষ ছাড় আদায় করেছিলাম শিব্বির দুলাভাই থেকে। দারুল আরকাম থেকে জামিয়াতুস সুন্নাহ। এরপর ২০০৭ সালে এসে ভর্তি হয় মিশকাত জামাতে বড় কাটারা মাদ্রাসায়। ফাইনাল পরীক্ষা আমার দেওয়া হয়নি, না দিয়েছিলাম, ফেলও করেছিলাম সম্ভবত। এখানে তিনি নাজেমে দারুল ইক্বামা, আবাসিক পরিচালক হিসেবে তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন মুফতি আমিনী। শিব্বির আহমদের ভাই মুফতি আমিনীর মাদ্রাসার শিক্ষক হওয়ায় বিষয়টি তরান্বিত হয়েছিল। মানে আমার বন্ধু মুজাহিদের বাবা, শিব্বির আহমদের বড় ভাই। ওই বছরই আমার দাখিল পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ হওয়ায় ভর্তি হই ঢাকা কলেজে। কিন্তু এর মধ্যে রয়েছে ২০০৪, ২০০৫ ও ২০০৬ সাল। এই তিন বছর আমি রাজধানীর মিরপুর ছয় নাম্বার মাদ্রাসা, মিরপুর ১৩ নাম্বার মাদ্রাসা, মৌলভীবাজার দারুল উলুম ইসলামিয়া ও বিশেষ কারণে বন্ধ হয়ে গেছে মাঝপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাহবাজপুর মাদ্রাসায় ভর্তি হই। ওই বছরই আমি দাখিলের প্রস্তুতি গ্রহণ করি। ওই সময় আমার লেখালেখির নতুন জায়গা হয়ে ওঠে আজকের কাগজের আড্ডাপর্ব ও সূবর্ণসভা, নয়া দিগন্তের প্রিয়জন।
মিরপুর ৬ নম্বর মাদ্রাসা থেকে শুক্রবার জুতা চুরির করার পর বহিষ্কারের ভয়ে পালিয়ে আসি মৌলভীবাজারে, সেখানে আমার সবার ছোটমামা সাইফুল্লাহ নাছিম আমার দায়িত্ব পান। মৌলভীবাজারে পড়ার সময় দীর্ঘদিন আমি জণ্ডিসে আক্রান্ত থাকি। প্রায় ছয়মাস। মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল এক ছাত্রকে দিয়ে শিশ্নটেপানোর অপরাধে ছাত্ররা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। আমিও শুরুতে থাকি এবং অসুস্থ হওয়ায় বাড়িতে চলে আসি। কিশোরগঞ্জের বন্ধু মাওলানা হুমায়ুন এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এরপর ভর্তি হই মিরপুর ১৩ নম্বরে। জামাতে জালালাইন। ওই বছর প্রয়াত প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক এখন এ ‘মোল্লাদের দলে শুনি ভাঙনের গান’ শিরোনামে ছড়া লেখার অপরাধে বহিষ্কার হই। কয়েকবার ঘুরেও বহিষ্কারাদেশ বাতিল না করতে পেরে মাঝপথে ভর্তি হই শাহবাজপুর মাদ্রাসায়। ওই বছরের জুনে সারাদেশে ঘটে বোমা বিস্ফোরণ। আর আমার সন্দেহের তালিকায় পড়ে যায় ওপরের ক্লাসের এক ছাত্র। যার কথা এক শিক্ষককে বলতে গিয়ে ঝাড়ির মুখে পড়ি, জানি না, কেন তিনি ঝাড়ি দিয়েছিলেন? ওই বছরটিই আমার জীবনের নতুন দিগন্তের সূচনার সময়, যে সময়টিতে আমি নিজের বাড়িতে বসে প্রস্তুতি নেই দাখিল পরীক্ষা দেওয়ার। আর বাড়ির লিটন কাকা ভুলক্রমে রেজিস্ট্রেশনে আমার নাম ও আম্মার নাম ভুল করে লিখে দেন, যা এখনো ঠিক করতে পারিনি। তবে আমার নতুন দিগন্তের সূচনার প্রথম সহযোগিতাটি করেছিলেন আম্মা রায়হানা আখতার, আর দ্বিতীয়টি লিটন কাকা, যার উৎসাহেই স্থানীয় আলিয়া মাদ্রাসায় নিজের নামটি লিখিয়ে নেই। লিটন কাকার উৎসাহ না থাকলে আমি হয়তো কোনো মাদ্রাসার শিক্ষক হয়ে থাকতাম এখন। আর ওই সময়টিতে বাড়িতে গণিত পড়তে গিয়ে কালন ভাই, ইংরেজি পড়তে বিশ্বজিৎ স্যারের সংলগ্ন হয়ে যাই। আর পড়াশোনার পুরো চ্যালেঞ্জটি নিতে মনের ভেতরের পুরো ভয় দূর করেছিলেন সাউথ কাশিম নগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রয়াত প্রধান শিক্ষক তাজুল ইসলাম ওরফে তাজন কাকা। হাঁটুর বয়সী ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে একইক্লাসের বই নিয়ে পড়তে যাওয়াটা যে কত কাঁপাকাঁপা ভয়ে, দ্বিধা, উদ্বেগের—সেটি কেবল তাজন কাকাই টের পেয়েছিলেন। সঙ্গে আমার আম্মাও। ততদিনে আমার স্কুলের সহপাঠীরা অনার্সের ক্লাস শুরু করে দিয়েছে। আর আমি পড়ে গিয়েছিলাম তাদের আট বছর পেছনে। আম্মার ভয় একটাই ছিলো, পরীক্ষা দেওয়ার সময়ও বলতেন, কাউকে বলিস না, তুই দাখিল দিবি। কারণ, আম্মার ভয় ছিল, আমি ফেল করে বসি। কিন্তু কী করে ফেল করি, আমাকে দিয়ে যে, নতুন করে দিনলিপি লেখানোর মাঠ প্রস্তত করছিল ইতিহাস! কী সৌভাগ্য, কী দারুণ শুরুর গল্পটা আমি বুনেছিলাম গোবিন্দপুর গ্রামের মনুরবাড়িতে বসে।
চলবে…