॥পর্ব-২॥
আব্বার হাত ধরে দীর্ঘ প্রায় আড়াই কিলোমিটার হেঁটে কালিরবাজার-এ এসে রিকশা করে পৌঁছলাম হরষপুর মাদ্রাসায়। ঠিকানা মাদ্রাসার কিতাববিভাগ। ভর্তি হলাম জামাতে তাঈসিরে। এটা এখন কোন শ্রেণী, জানি না। তবে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক পরিবারে জন্ম নেওয়ায় আরবি পড়া, কোরআন তেলাওয়াত–এসব আম্মার কাছেই রপ্ত করেছি। আমি, চাচাতো ভাই রকিব, চাচাতো বোন মিতালী, লাবনী—সবাই মিলে আমাদের পুরনো বাড়ির একটি কক্ষেই পড়তাম। আম্মা রাঁধতে-রাঁধতে আমাদের পড়াতেন।
এই হরষপুর মাদ্রাসায় আব্বা আমার পড়াশোনার সার্বিক দায়িত্ব দিয়েছিলেন মুফতি এনামের কাছে। আব্বার রুদ্রমূর্তি দেখি যতটা, তার চেয়ে বেশি দেখি তার। হরষপুরেই একটি গ্রামে তার বাড়ি। বাইরে কোনো বড় মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা করে এসে হরষপুর দারুল উলুম ইসলামিয়ায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি।
প্রথম দিকে মুফতি এনামকে খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও দিনে-দিনে তার রাগ চেপে বসে আমাদের কয়েকজনের ওপর। তার কক্ষে আমরা আরও কয়েকজন ছাত্ররা পড়াশোনা করতাম। মাঝখানে দুর্বাঘেঁষা সবুজ মাঠ আর চারপাশে সারি-সারি নারিকেল গাছের ভেতর দিয়ে হরষপুর মাদ্রাসাটি গড়ে উঠেছে। দক্ষিণ দিকটি খোলা রেখে উত্তর দিকে ভেতরের অংশে হেফজ বিভাগ, যার পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আব্বা। এখনো এই বিভাগের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন তিনি। হেফজ বিভাগের সামনে আবার বাহারি ফুলের বাগান। গোলাপ, রজনীগন্ধা, বেলী, হাসনাহেনাসহ নাম অজানা অনেক প্রজাতির গাছ চাষ হতো এই বাগানে। এখন কী অবস্থা জানি না।মাদ্রাসায় বাৎসরিক ওয়াজ মাহফিল হলে এই বাগানেই নারীরা বসে আগত আলেমদের বয়ান শুনতেন। এই বাগানেই বসেই তিন দিনব্যাপী ওয়াজ মাহফিলের শেষদিনে প্রধান অতিথি আলেমের সঙ্গে দোয়ায় হাত তুলে কাঁদতেন নারীরা। যখন স্কুলে পড়ি, তখনো আম্মা, চাচি আম্মারাসহ দলবেঁধে নারীরা ধর্মঘর থেকে হরষপুর মাদ্রাসায় এসে ওয়াজ শুনতেন। এখন আম্মা যান কি না, জানি না।
হরষপুর মাদ্রাসায় প্রবেশের আগে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে বিশাল একটি মিনারসহ একটি ভবন রয়েছে। মাদ্রাসার মসজিদের আজান দেওয়া হত এই মিনার থেকেই। তালগাছের মতো লম্বা এই ভবনটিতে মাঝে-মাঝে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আমি আর ক্লাসমেট আব্বাস বসে গল্প করেছি। খাঁড়া সিড়ি বেয়ে উঠে একেবারে মিনারের চূড়ায় উঠে পাশঘেঁষে বয়ে যাওয়া ঢাকা-সিলেট রেললাইনের ওপর আমাদের চোখের ঘেরাফেরা ছিল। কড়া রোদে, নারিকেল গাছের ছায়ায় মিনারের চূড়ায় বসে কত-কত নাতিদীর্ঘ আলোচনা ছিল আমাদের কণ্ঠে; বেশিরভাগই সিনেমা নিয়ে। ইতোমধ্যেই হরষপুর রেল বাজারে দুটি ভিডিও’র দোকানে ৫ টাকা দিয়ে বাংলা সিনেমা দেখানো শুরু হয়েছে। টিনের দোকানের ফুটো দিয়ে রঙিন টিভিতে চোখ লাগিয়ে কত-কত দুপুর আর জোহরের নামাজ কামাই দিয়েছি, এর ইয়ত্বা নেই।
মিনারের মতো উঁচু আর সিনেমার মতো রঙিন দিনলিপিতে অনেকটাই ভিলেনের চরিত্র ছিলেন এনাম হুজুর। দেখতে-শুনতে খাটো-কালো দাঁড়িঅলা মানুষটিই সকাল-সন্ধ্যা আমার জীবনকে তেজপাতা করে দিয়েছেন। সকালে ক্লাসের পড়া ঝালাই, সন্ধেয় নিজের তরফে এই কিতাব-সেই কিতাব ঘেঁটে আরবি-উর্দু-ফার্সি শিক্ষা কোনোভাবেই স্কুলের বইয়ের চেয়ে বহুলপাঠ্য হয়ে ওঠেনি। এমনকী এমনও হয়েছিল ঘরে, ক্লাস ফাইভের পরীক্ষার আগে-আগে; বিদ্যুৎ চলে গেলে গায়ে ঘাম ঝরিয়ে পড়ছি তো পড়ছিই, আর পাশের রুম থেকে আম্মা কাজের মেয়েটিকে পাঠিয়ে দিয়েছেন ফাংকা (পাখা) দিয়ে বাতাস করতে। আমি এই পাখার বাতাস দিতে অস্বীকার করেও মধ্যরাত অবধি শরীর দুলিয়েছি বইয়ের ওপর। কোনো বিরক্তি আসেনি, কোনো ক্লান্তিও ভর করেনি শরীরে। কিন্তু কি আজব, আরবি-ফার্সি আর উর্দু বইয়ে আমার মনই বসে না। আর এই থেকে শুরু হলো আমার রোল নম্বরের পতন। ফাইভের এক থেকে নামতে থাকি নিচে। চার নম্বর থেকে ক্রমশ নিচে-নিচে নামতে-নামতে জামাতে জালালাইনের বছর ফেলও করলাম এক বিষয়ে।
এনাম হুজুরের সঙ্গে আব্বার ছিল উস্তাদ-বড় ভাইসুলভ সম্পর্ক। আমাদের দিক থেকে অনেকটা পরিবারের মতোও। আমরা ডাকি এনাম কাকা নামে। তাদের বাড়িতেই আব্বা লজিং ছিলেন প্রায় তিন যুগ। এনাম কাকাদের বাড়ির সকাল-দুপুর আর রাতের খাবার খেয়েই আব্বার শিক্ষকজীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে। এনাম কাকার আম্মার হাতে গোড়া মাছের ঝোল অথবা মেস্টা দিয়ে পুঁটি মাছের ঝোল; আব্বার প্রিয় না হলেও সপ্তাহে বৃহস্পতিবার বাড়ি গিয়ে আম্মার কাছে শুনিয়ে দিতাম; তোমার হাতের চেয়ে এনাম কাকার আম্মার তরকারিই বেশি মজা। গোড়া মাছের রান্না আম্মার চেয়ে বেশিরভাগ চাচিআম্মা বা লজিং বাড়িরটাই বেশি সুস্বাদু ছিলো ওই সময়।
ওই বছরই পুলিশ লাইনের একটি বাসায় প্রতি বিকালে বেজে উঠতো আসিফের ‘ও প্রিয়া ও প্রিয়া তুমি কোথায়?’
এই এনাম হুজুর যখন পড়াতেন, বুঝিয়ে দিতেন। মনোযোগ না থাকায় তার বেতের বাড়ি অনেকটা প্রতিদিনই নিশ্চিত ছিল। তবু ভয়ে, অন্তত লালচোখ আর লুঙ্গি গুছিয়ে মারের যে ভঙ্গিমা; এর থেকে বাঁচতে মাঝে-মাঝে পড়া শিখে নিতাম। তবে সেটা খুব কমদিনই ভাগ্যে জুটেছে। নিয়মিত ক্লাসের হুজুররা বেশি মারধর না করায় আমার ক্লাস ছিলো অনেকটাই ফজরের পর আর মাগরিবের পর। এই দুটি সময় দারুল উলুম হরষপুর মাদ্রাসার দুই বছরে আমাকে বেশি শ্রান্ত করেছে। বিয়ের পর এনাম হুজুর কখনো-কখনো মাদ্রাসায় আসতে সময় নিতেন রাত নয়টার পর, ব্যস; সেদিন তো প্রায় বিয়ে বাড়ির আনন্দ লেগে যেত মনে মনে। যদিও হুজুরের স্পাই ছিল এক জামাত ওপরের একটি ছাত্র; নাম খেয়ালে নেই; তার মাতবরি অনেকটাই কুঁড়েখ্যাত। এরপর এনাম হুজুর এলে তার রিপোর্ট। সালমান পড়েছে, না পড়েনি, বা বের হয়ে ঘুরেছে বা পড়েনি, শুধু গল্প করেছে ইত্যাদি। যদিও মাদ্রাসার দ্বিতীয় বছরে, মানে জামাতে মিজানের বছর শেষে চলে আসার ছয়মাস বা তারও আগ থেকে ওই স্পাইয়ের সঙ্গে আমারও সম্পর্ক ভালো হয়ে যায়।
দুই বছরের শেষ দিকে এসে ভালো লাগতে থাকে এনাম হুজুরকেও। তখনো জানি না, হরষপুর মাদ্রাসা ছেড়ে দিচ্ছি কিছুদিন পর। কিন্তু ভালো লাগতো। এরই মধ্যেই হরষপুর মাদ্রাসার বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলে গজল গেয়ে সুনাম-সুখ্যাতি অর্জন করেছি। ডায়েরিতে ছোট আপার হাতে গুটি-গুটি লেখা গজল গেয়ে আমি স্থানীয়ভাবে প্রসিদ্ধ। আর এই গজলের গুণে প্রিয় হতে থাকি এনাম হুজুরের কাছেও। যদিও আব্বার বিশেষ নির্দেশেই তিনি আমার প্রতি সন্তানতুল্য নজরদারি করেছিলেন দুটো বছর। কিন্তু যখন মাদ্রাসা ছেড়ে আসি, তখন মনে হতে থাকে, এই মাদ্রাসায় আব্বার পর এনাম কাকারই মনোযোগ পেয়েছিলাম। তার রাগ-ক্ষোভ আর ভালোবাসা—তিন মিলে আমি আমার শৈশবের গুরুত্বপূর্ণ দুটি বছর চিহ্নিত করতে পারি এখনো। এনাম কাকার সঙ্গে আরও একজন শিক্ষক-যিনি মাওলানা সিরাজুল ইসলাম; একইসঙ্গে তিনি হরষপুর পোস্ট মাস্টারও। দেখতে আব্বার মতো, বয়সে তার চেয়ে খানিকটা বেশি হলেও প্রাণবন্ত আর সজীব। আব্বার কাছ থেকে ধমক খেলেও তার কাছে পেয়েছি লাই। পোস্ট মাস্টার হওয়ার কারণে তার কাছেই আমার তৎকালীন মাসিক রহমত, জাগো মুজাহিদ (পরবর্তী সময়ে নিষিদ্ধ), মাসিক মদীনা, আদর্শ নারী, মাসিক রাহমানী পয়গাম, মাসিক মঈনুল ইসলামের প্রথম পাঠ। ডাকে আসা এসব পত্রিকার সবগুলো বিক্রি না হলেও মাদ্রাসার অফিসকক্ষে রাখা আলমিরা থেকে গোপনে বের করে এনে পড়া ছিল তৎকালে আমার ছবি দেখার মতোই প্রিয় একটি কাজ। এই সিরাজ সাহেব হুজুরের সঙ্গে ওই সময়ের মাসিকে লেখা নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়। আবার আব্বাকে আসতে দেখলে উঠে পড়ে নিজের কিতাবের দিকে মনোযোগ দেওয়া। বাপ-ছেলের কান্ড দেখে মুচকি-গালে হাসতেন সিরাজ সাহেব হুজুর। হরষপুর মাদ্রাসা ছেড়ে আসার সময় এই দুজন শিক্ষকের ভূমিকা নিজের সঙ্গে স্মৃতি করে বেরিয়ে পড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পশ্চিম মেড্ডায় স্থাপিত নতুন মাদ্রাসা দারুল আরকামের উদ্দেশে।
আব্বার সিদ্ধান্ত, ফুফাতো বোন জামাই মুফতি শিব্বির আহমদের কাছেই আমার দ্বিতীয় পাঠ শুরু হবে। নানার শহরে এসে নিজের মধ্যে আদর-আহ্লাদের ছোঁয়া খুঁজে পাই। ভাবি, সপ্তাহান্তে নিজের বাড়ি যাওয়ার চেয়ে নানার বাড়ি যাওয়া উত্তম। শহরের একেবারে দক্ষিণ দিকে কুরুলিয়া খালবর্তী কাউতলী মসজিদের উত্তর পাশে তখন নতুন নির্মিত নানা বাড়ি। চাইলেই এখন সপ্তাহে দুবার মধ্যরাতে দূরদর্শনে ভারতীয় সিনেমা আর শুক্রবার বিকাল ৩.২০ এ দেখা যাবে বাংলা ছায়াছবি। এই আনন্দে আব্বা-আম্মার কাছ থেকে দূরে এলেও সুখের শব্দ মনের ভেতরে বীণ বাজিয়ে তোলে। কিন্তু এই সুখের বীণ, খুব বেশিদিন টেকেনি। এনাম হুজুরের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে এবার নতুন আজরাইলের হাতে পড়লাম বৈকি। এত দেখি দিনে-রাতে চব্বিশ ঘণ্টাই পেটায়। দারুল আরকামের তখন একটি ভবন। আর সামনে বিশাল পরিধির মসজিদ। এই মসজিদে আরও-আরও ছাত্ররা হেফজ পড়ে, আর দিনের বেলা বারান্দায় বসে কয়েকটি ক্লাস। খুব সম্ভব দুটি ক্লাস হত বারান্দায়। একটি, নাহবেমীর, দ্বিতীয়টি হেদায়েতুন্নাহু বা অন্য কিছু।
মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব দিকেই এই জামাতে একটি ক্লাস নিতেন আমার ফুফাতো বোনজামাই শিব্বির আহমদ। বেয়াড়া রাগী আর পানমুখে মিশ্রশব্দ বের করে পেটাতেন ছাত্রদের। এখনো মনে আছে; কী নিয়ে একবার রেগে গিয়ে নারীদের ওপর, বলেছিলেন; এখনকার নারীরা শিশুকে দুধ না খাইয়ে ফিডার খাওয়ায়। কেন বলেছিলেন, তা স্মরণে নেই। হাফেজ শিব্বির আহমদ তার রাগের ওপরে জায়গা দিয়েছিলেন আমার প্রতি দুর্লভ ভালোবাসা। সে হচ্ছে, চা খাওয়ানোর ভালোবাসা। আমার হাতে বানানো চা তার খুব ভালো লেগেছিল এবং পরবর্তী সময়ে অনেকবারই তিনি স্মরণ করেছেন।
প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার আছরের পর ছুটি হয়ে যাওয়ায় আমিও দারুল আরকাম ছেড়ে লোকাল বাসে চড়ে সোজা কাওতলী নানার বাড়ি। সপ্তাহের এই দিনটির অপেক্ষা করে-করে পুরো পাঁচটি দিন অতিক্রান্ত হতো। আর ওই সময়টিতেই ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া শহরটি ইটপাকা দালানে বড় হচ্ছে, মনে পড়ে কাওতলীতে স্টেডিয়ামের পূর্ব দিকে একটিমাত্র ছয়তলা ভবন ছিল। পুরো শহরে অট্রালিকা বলতে মেহগণি, জাম, কড়ুইসহ বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় গাছ। সেই শহর এখন অট্রালিকার বাজার। এই সিলেট যেতে রাতের বেলা চোখে পড়ল রেলক্রসিংয়ের ওপর দুতলা ওভার ব্রিজ। ব্রিজে আমি উঠেছি, শহরের এক বন্ধুকে নিয়ে কুরুলিয়া খালের ওপর রেলব্রিজে। নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া আল মাহমুদের নদী, আর ওপরে ছুটে চলে বাড়ির ট্রেন জয়ন্তিকা। এই জয়ন্তিকাই হরষপুর ছুঁয়ে সিলেট যায়, ট্রেনেও কেমন বাড়ির গন্ধ পাই তখন, ছুটে চলা রেলের গায়ে জয়ন্তিকা বা উপবন লেখা থাকলেই মনের ভেতরে উচ্ছাস। এই ট্রেন বাড়ি ছুঁয়ে যায়।
দারুল আরকাম ছেড়ে পুরো শহরের এফোঁড়-ওফোঁড় করেই চলতো প্রতি সপ্তাহ। এ সপ্তাহে অবকাশ তো, শুক্রবার এলজিআরডির সরকারি আবাসিক একটি কলোনিতে বসে টেস্ট খেলা দেখা। কোনো মামা একবার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এই যে, এটাও তোর একজন মামার ঘর। ব্যস, মামা বা মামি, বাসায় থাকুক বা বাইরে, দরোজা খুলে রঙিন টিভিতে সাদা জার্সির খেলা। কখনো টিভি ছেড়েই ঘুম, বেমক্কা কেটে গেলো দুপুর থেকে এশার নামাজ অবধি। এভাবে কখনো মধ্যরাতে টিভি দেখে, রাতের নাটক শেষ করে নানার বাসায় ফিরে দরোজায় টোকা দিতেই নানির গরজ, ‘ওই আইছে। তোরে আজ ঢুকতে দিমু না। খাটে শুয়ে থেকে নানা মাওলানা আবদুন নূরের খেদোক্তি—আলো আইতে দেও, খায় নাই। নানাবাড়ির এই প্রশ্রয়ে ভনিতা শুনিয়ে-শুনিয়ে কখনো শনিবার সকালে মাদ্রাসায় না গিয়ে গা এলিয়ে দেওয়া হতো নানা ফাঁকে। শিব্বির হুজুরের মারের ভয় থাকায় এবার পরদিন রবিবার সকালে নানাকে নিয়ে রিকশায় করে রওয়ানা হয়ে ঘণ্টাখানেক পর মাদ্রাসায় পৌঁছলে ক্লাস ফেলে ছুটে আসতেন হাফেজ শিব্বির আহমদ। পানলাল মুখে হাসতে-হাসতে আমার গালে টিপে দিয়ে বলতেন, মাইর থেকে বাঁচতে নানাকে নিয়ে মাদ্রাসা আসছো। কষ্ট দিছো উনাকে।
গল্প এবার চেঞ্জ। বয়সে তরুণ সব শিক্ষকই নানার ছাত্র। শহরের সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা জামিয়া ইউনুছিয়ার প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের শিক্ষা সচিব নানা আবদুন নূর (কোকিলের হুজুর)। অনেক দূর থেকে দেখেও আমার শিক্ষকেরা নানার কাছে ছুটে আসতেন, মোসাফা করে দফতরে বসিয়ে চা খাইয়ে, পরিবার ও মাদ্রাসার খোঁজ-খবর নিয়েই তবে ছাড়তেন প্রবীণ এই আলেমকে।
যতদিন নানা আমাকে নিয়ে মাদ্রাসায় গেছেন, শিব্বির আহমদ ওই দিন মারেননি। শুধু হেসে-হেসে দোষত্রুটি গোপন করে চায়ের গল্পে ফেরত আসতেন। আমি বিদ্যুৎচালিত হিটারে তার জন্যও চা বানাতাম, সঙ্গে আমার জন্যই এক কাপ। এক বছর পর শিব্বির আহমদ প্রমোশন পেয়ে চলে যান মাদারীপুর জামিয়া সুন্নিয়ায়। আর আমার দেখভালের দায়িত্ব পড়ে মাওলানা মুফতি মাজহারুল ইসলামের উপর। একাধারে মুফতি আমিনীর রাজনীতি, অন্যদিকে তেজস্বী বক্তা। মাঝে-মাঝে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ লাভ করি। সে বছর মুফতি মাজহার বসেন বিয়ে পিঁড়িতে। তার অজানা ব্যস্ততা আমাকে দেয় অফুরন্ত অবসর; পুলিশ লাইনে গিয়ে ছবি ও ক্রিকেট খেলা দেখার অবারিত সুযোগ। নির্জন দুপুরে এই পুলিশ লাইনেই সবচেয়ে পেটমোটা অফিসারটি ডেকেছিলেন হাস্যোরসাত্মক ইঙ্গিতে তার কোয়ার্টারে যেতে, ওই বছরই পুলিশ লাইনের একটি বাসায় প্রতি বিকালে বেজে উঠতো আসিফের ‘ও প্রিয়া ও প্রিয়া তুমি কোথায়?’
চলবে…