পূর্ব প্রকাশে পর:
ছায়া আপা
তুমি তো বুকল দ্যাখো নি, পলাশ তোমার প্রিয়
ঘাসে, মাটিতে যদি রাখো চোখ, দেখো দিনরাত
ঝরে ঝরে বকুল, কাছাকাছি ঘন হয়ে, স্মৃতি বাড়িয়ে চলে।তুমি তো সূর্যাস্ত দ্যাখো নি, আকাশ ছোঁয়া ইমারত তোমার প্রিয়
তুলসী তলায় হিম হয়ে আসা দীপাবলী
জনারণ্যে একা পড়ে থাকা রাজপথ
হঠাৎ চলে আসা পড়শী বউ
আজকাল বড় বেশি ভূগোল বিষয়ে কথাবার্তা বলে।
(সীমান্তের ওপারে: মামুন রশীদ)
প্রায় প্রতি রাতেই ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার ওপর। যেন আমি যাদু জানি। কোন যাদুমন্ত্রবলে আমার সদ্য পৃথিবীকে চিনতে শেখা, চঞ্চল ছেলেকে সোনার কাঠি ছুঁইয়ে হ্রদের জলের মতো ঠাণ্ডা, শান্ত করে দিতে পারব। আর ছেলেও হয়েছে তেমন, অফিস থেকে ফেরার পর আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানুষ বাড়িতে আছে, তা সে মানতে চায় না। এখন তো প্রতিদিন ওর চোখের জল দেখে আমাকে পথে বেরুতে হয়। তাই আমিও এক ধরনের আলাদা টান অনুভব করি, ঘরে ফেরার জন্য আমার মনও ছটফট করে। কখনো কখনো খুব ক্লান্ত লাগলেও, ছেলেকে ঘুম পাড়ানোর দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করি না। ও আমার কোলে ওঠে, আমার পায়ে ঘরময় হেঁটে বেড়ায়। আকাশ পথে উড়োজাহাজ উড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে দুজনে দৌড়ে বারান্দায় চলে আসি, দূরের আকাশে শব্দ লক্ষ্য করে উড়োজাহাজের আলো দেখাই। কখনো তারাদের দেখিয়ে বলতে থাকি, বাবা ওটা তারা, নক্ষত্রও বলে ওকে। বারান্দা থেকে চাঁদও দেখা যেত, এই কদিন আগেও। এখন নতুন একটা বাড়ি উঠছে, তাতে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আমাদের আকাশ। আমাদের বাবা-ছেলের আর খোলা আকাশ দেখার সুযোগ নেই, যেটুকু ফাঁকা, ওরই ফাঁক দিয়ে উড়োজাহাজ দেখানোর চেষ্টা, আর দূরের আকাশের দুই একটা তারা। কিন্তু কি আশ্চর্য, যখন পুরো আকাশ দেখা যেত, তখন ওর উড়োজাহাজ দেখার আগ্রহ ছিল না। আমি বরং মাঝে মাঝে উড়ে যাওয়া হাওয়াই জাহাজ দেখাতাম, ও মুখ ফিরিয়ে নিত, এখন ও দেখতে চায়, আমি দেখাতে পারি না। আকাশ, রাতের তারা, দূরের বাড়িতে মিটিমিটি করে জ্বলা ইলেকট্রিকের আলো, আর উড়ে যাওয়া হাওয়াই জাহাজ দেখতে দেখতে ছেলে একসময় ক্লান্ত হয়ে আসে, আমারও চোখে নামে ক্লান্তি। তখন আমার দুই হাতের ওপর ও শুয়ে পড়ে। এসময় তাকে গান শোনাতে হয়। প্রতিটি মানুষেরই নাকি বাথরুম সিঙ্গার হিসেবে কিছু না কিছু সুনাম থাকে, আমার সে রকম সুনাম নেই। আমি কোনো গানই পুরো জানি না। তবে ছেলে নাছোড়, তাকে গান শোনাতেই হবে। গানের একই লাইন বারবার গেয়ে তাকে শোনালেও, আপত্তি নেই। তাই আমিও সুর ছাড়া গান গেয়ে শোনাই। আবার কখনো কখনো বিভিন্ন গানের এক লাইন দুই লাইন গাই। তবে প্রতিদিন সে এক গান শুনতে রাজি নয়। ওতো গান আমি কোথায় পাব, মাঝে মাঝে তাই বানিয়ে বানিয়েও গান শোনাই।
তারপরও গান শোনানোর সময় প্রায়ই মনে হয় কোন গানটা শোনাই। বেশিরভাগ দিনই মনে আসে একটা বাংলা ছবির গান। গানের প্রথম অংশটা বাদ দিয়ে ওকে শোনাই। প্রথম অংশটা ওর জন্য নয়। কিন্তু পরের অংশটার সঙ্গে ওকে আমি ঠিক মিলিয়ে নিতে পারি। ছেলে আমার বড় হচ্ছে, মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে মুচড়ে ওঠে। আর কয়েকদিন পরেই ইচ্ছে থাকলেও এভাবে কোলে নিয়ে গান শোনাতে পারব না। ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াতে পারব না। ও যত বড় হবে, হয়তো ততই একটা দূরত্ব তৈরি হবে। আস্তে আস্তে আমার কাছ থেকে সরে যাবে। ঘর ছেড়ে বেরুনোর সময়, ওর গালে ঠোট না ছুঁয়ে এলে যেমন স্বস্তি মেলে না, আর কদিন পরেই হয়তো এতে বিব্রত হবে। বলে উঠবে, বাবা, তুমি ছোটদের মতো কেন আমাকে এভাবে ধরে আদর করো। এইসব ভাবতে ভাবতেই হয়তো গানের দ্বিতীয় অংশটাকে আমি অজান্তে মিলিয়ে নিয়েছি— আমাদের বাবা-ছেলের মাঝে। তাই আমি যখন গাইতে থাকি, ‘কত দিন আমায় ভালোবাসবে, ভালোবাসবে/ যত দিন চন্দ্র সূর্য থাকবে/ যদি ঘর ভাঙা ঝড় আসে, আসে/ তবে সেদিনও আমি রইব তোমার পাশে।’এই একই কথা বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গাইতে থাকি। আর আমার ছেলে একটু একটু করে এলিয়ে পড়ে, ঘুমের দেশে চলে যায়। কিন্তু ওর হাত, হাতের আঙুল আমাকে জড়িয়ে রাখে, যেন সত্যিই আমি ওকে ছেড়ে কোথাও যেতে না পারি। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে একসময় লক্ষ্য করি আমাকে জাগিয়ে রেখে ও গভীর ঘুমের দেশে চলে গেছে। তখন নির্ঘুম রাতের নানান ভাবনা আমার মাথায় উঁকি দিতে থাকে। যে গানের কিছু অংশ আমার ছেলেকে প্রায়ই শোনাই, তার প্রথম অংশ হলো—‘যদি বউ সাজো গো, বড় সুন্দর লাগবে গো। বলো বলো আরো বলো জীবনের এই স্বপ্ন যেন সত্যি মনে হয়।’ সত্যিই জীবনের কত কত ভাবনা কত কত অপূর্ণতা, আমাদের জীবনে। ফেলে আসা জীবনের সেই অপূর্ণতা, সেই অসম্পূর্ণতা কখনো কখনো বড় হাস্যকর মনে হয়। কখনো কখনো সেই স্মৃতি মনে করে লাজুক হয়ে উঠতে হয়।
বউ বা বিয়ে শব্দটির মানে বোঝার মতো বয়স তখন আমার না। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি। আমাদের স্কুলে বেশ কয়েকজন টিচারের মাঝে, ছায়া আপা ছিলেন আমাদের ক্লাশের। সম্ভবত উনি ছিলেন আমাদের ক্লাস টিচার। আমরা ওনার ভয়ে তটস্ত থাকতাম। এত ভয়ঙ্কর এবং নির্দয়ভাবে উনি আমাদের পেটাতেন, আজকের দিনে তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। শুধু আমাদের ক্লাস না, ওপরের ক্লাসেরও সবাই ওনাকে দেখে ভয়ে কাঁপতো। উনি স্কুল ক্যাম্পাসে ঢুকলে পারতো পক্ষে ওনার সামনে আমরা কেউ পরতাম না। এড়িয়ে চলার বা বোঝার মতো সচেতন মন তখন তৈরি হয়েছিল কি না মনে করতে না পারলেও, আমরা তার ধারে কাছে যে যেতাম না, এটা বেশ মনে আছে। স্কুলের শুরুতে অ্যাসেম্বলিতে তার হাতে মাইর না খাওয়া ছাত্রের সংখ্যা কমই ছিল। শার্টের কলার ঠিক নেই, শার্ট ইন করা নেই, বোতাম লাগানো নেই, পায়ে জুতো ঠিক নেই, পিটি করার সময়— হাত, পা সবার সঙ্গে মিলছে না, জাতীয় সঙ্গীত হয়তো অন্যদের চেয়ে আগে অথবা পরে গেয়ে ফেলেছি, এগুলো উনি ঠিক ধরে ফেলতেন। তারপর স্কুলের মাঠে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। সবাই ক্লাশে চলে যাবার পর, কয়েক ঘা কষিয়ে দিতেন। যার দাগ থেকে যেতো পরবর্তী কয়েকদিন।
স্কুলে তখন— মাঝে মাঝে আমাদের গুঁড়ো দুধ খেতে দেওয়া হতো, বিস্কুট খেতে দেওয়া হতো। বাড়ি থেকে কাগজে মুড়িয়ে আমরা চিনি নিয়ে যেতাম। গুঁড়ো দুধের সঙ্গে মিশিয়ে সেই চিনি, আহা কি যে অপূর্ব, তাকে আজকের দিনে আমার অমৃত বলেই মনে হয়। ক্লাসে যেদিন অন্য টিচার থাকতেন, ওদিন আমরা গুঁড়ো দুধ পেলে, বাড়িতে নিয়ে আসতাম। রাস্তায় সবাই মিলে পাল্লা দিয়ে চেটে চেটে খেতাম। গুঁড়ো দুধে মিলিয়ে খাবার জন্যই আসলে আমরা লুকিয়ে চিনি নিয়ে যেতাম। কিন্তু ছায়া আপা থাকলে ক্লাসের বাইরে বেরুনোর উপায় নেই। ক্লাসে বসেই খেতে হবে। একবার স্কুলে সবাইকে একটি প্যান্ট-শার্টও দেওয়া হয়েছিল। কারা দিয়েছিল, সেই শার্ট-প্যান্ট মনে নেই। তবে টিচাররাও পেয়েছিলেন। সেই শার্ট আমার হাঁটুর নিচে নেমে গিয়েছিল। আর প্যান্টের কোমরের মধ্যে দিয়ে আমি যাওয়া-আসা করতে পারতাম। দৈর্ঘ্যে তা ফুলপ্যান্টকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ছায়া আপা, সেই শার্ট-প্যান্ট দেওয়ার সময় সবাইকে বারবার করে বলে দিয়েছিলেন, এটা অন্য কাউকে দিলে, পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে নেবেন।
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়। এই প্রবাদ তখন না জানলেও এখন বুঝি। একদিন অংক ক্লাসে, আমার খাতায় করা অংকটায় ভুল থাকার পরও আপা অসতর্ক মুহূর্তে রাইট চিহ্ন দিয়ে দেন। বাড়ি ফিরলে, রাতে পড়তে বসার পর মা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন স্কুলের খাতা। মায়ের চোখ গেল, সেই ভুল অংকের দিকে। সঙ্গে-সঙ্গে মা ওই খাতার পরের পাতায়, ছায়া আপার উদ্দেশে একটি চিঠি লিখে দিলেন। আমাকে বললেন, পরদিন যেন উনাকে দেখাই। আমার তো অবস্থা খারাপ। চিঠি পাওয়ার পর, আপা যে আমাকে আস্ত রাখবেন না, তা আমি নিশ্চিত। ভয়ে ভয়ে মাকে বললাম, এই চিঠি দিতে পারব না। বলা শেষ হওয়ার আগেই আমার ওপর দিয়ে মা নিজে একহাত নিয়ে নিলেন। কী আর করা, পরদিন যথারীতি স্কুলে যাওয়ার পর ক্লাসে আপা এলে, আমি কী করব সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন ব্যাকুল, তখন আপা নিজেই আমাকে ডাকলেন, খাতাটা দিতে বললেন। উনি জানলেন কী করে, ভেবে ঘামতে ঘামতে উঠে যাই উনার কাছে, উনি আমার মায়ের উদ্দেশে ওখানেই একটি চিঠি লিখে দেন। (আমাদের পাশের বাড়িতে স্কুলের অন্য একজন শিক্ষক থাকতেন, আমি স্কুলে আসার আগেই মা উনাকে বলে রেখেছিলেন। আর উনিও স্কুলে এসেই আপাকে জানিয়ে দেন, তাই, আমার এই ডাক। এটা পরে মায়ের কাছে আমি শুনেছি।)
বাড়ি ফিরে মাকে দেখালাম চিঠিটা। পড়লেন। এরপর থেকে ছায়া আপার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠলো। মায়ের সঙ্গে উনার বাড়িতে গিয়েছি। আপার বাড়ি ভর্তি ছিল নানারকম গাছ। উনি নিজেও এসেছেন, ছেলে-মেয়ে নিয়ে। ওরা কতটুকু ছিল, মনে নেই। তবে এরপর থেকে স্কুলে, ক্লাসে আমার দিকে উনার বাড়তি নজর লক্ষ্য করেছি। তৃতীয় শ্রেণীতে ওঠার আগেই আমরা উল্লাপাড়া ছাড়লাম। এরপর আর কখনোই উনার সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে স্কুল থেকে বিদায় নিলেও আমি সঙ্গে নিয়ে গেলাম ছায়া আপার স্মৃতি। অনেক দিন পর্যন্ত আমার মনে হয়েছে, বড় হয়ে আমি ছায়া আপাকে বিয়ে করব। কিন্তু ঠিক কেন, উনার প্রতি আমার এই আগ্রহ, তা আজও জানি না। বিয়ে বিষয়ে, তখন আমার কোনো ধারণা না থাকলেও, তাকে বিয়ের কথা কেন যে ভেবেছি—মনে করতে পারি না। এজন্যই মনে হয়, ছেলেকে গানটা শোনাতে গিয়ে মনে পড়েছিল ছায়া আপাকে। উনার মুখ মনে করতে পারি না। উনি কেমন ছিলেন দেখতে, আজ তার কিছুই মনে নেই। স্মৃতির অলি-গলি খুঁজে এত ঘটনা, এত মুখ মনে পড়লেও উনার মুখ মনে পড়ে না। তবু তার প্রতি আমার এই মুগ্ধতা হয়তো রয়ে যাবে। লাজুক শৈশবের, কৈশোরের আগের এই ভালোবাসা থেকে যাবে। কোনোদিনই হয়তো ভুলে যাব না।
চলবে…