দুই মাথাওয়ালা রাজা
শিশুদের আজকের বাহারি খেলনার কাছে আমার সময়ের কৈশোরের সংগ্রহকে তুলনা করা যাবে না। প্রতিটি সময়েরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা। নিজস্ব সংগ্রহ। যেমন আমার সঙ্গে আমার বাবার কৈশোরের চিত্র মেলানো সম্ভব না। বা আমার পিতামহের কৈশোর। আজকের এই করোনাকালে মুক্ত বাতাস বলতে খোলা ছাদ। এর বাইরে আমার কাছে মুক্ত পৃথিবী নেই। স্বাভাবিক জীবনে খোলা ছাদের সেই সুফলও পাওয়া হয় না। ওই সময় মেলে না। এখন রাজধানীর আকাশে রোজ বিকেলে চোখে পড়ে অসংখ্য ঘুড়ি। যে শিশু কখনোই দেখেনি মুক্ত আকাশ, যার মনে মুক্ত আকাশের ধারনাই আমরা তৈরি করতে দেইনি, সেই শিশুও এখন আকাশের বিশালতা দেখছে। ছেলেকে দেখাই মুক্ত আকাশ। ধারণা দেই আমার শৈশব, কৈশোরের। খোলা মাঠে, আদিগন্ত মাঠের কোনে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর স্বাদ আমার ঘরবন্দি ছেলে হয়তো কখনোই পাবে না। ওর বেড়ে ওঠা পরিবেশই শিখিয়েছে, শিশির ভেজা মাঠে খালি পায়ে দৌড়ানো অযৌক্তিক ও নোংরা কাজ। খোলা পায়ে দৌড়ালে পায়ে জুড়ে যাবে রাজ্যের ময়লা।
অসংখ্য ঘুড়ির মাঝ থেকে কোনো একটি কেটে উড়ে চলে যাওয়ার সময় তার পেছনে হৈচৈ করতে করতে আমাদের ছুটে চলা, হঠাৎ কারো পেয়ে যাওয়া সেই কাঙ্ক্ষিত ঘুড়ির যে রাজ্য জয়ের আনন্দ এনে দিতো, এই অনুভূতি আজকের শহরের কোনো শিশুরই হয়তো হবে না। তাদের কাছে এ অন্যের জিনিস নেওয়ার অপরাধ। তা তারা করবে কেন? এও তো যুক্তিরই কথা। আকাশের গায়ে ঘুরে বেড়ানো ঘুড়ি দেখতে দেখতে মনে পড়ে শৈশব। প্রতিভা বসুর কথাটি মনে পড়ে, স্মৃতি সব সময়ই মধুর। মুক্ত বাতাসে, যতদূর চোখ যায়-সবুজ আর নীলের সাগরের ভেতরে ঘুড়ি কেমন করে ওড়ে, ভোঁ কেটে যাওয়া ঘুড়ির পেছনে হৈচৈ করতে করতে শিশুদের দল কেমন উল্লাসে ছুটে ফেরে, তাও না জানলেও আমার স্মৃতি উসকে দিতে থাকে সুখ সময়। প্রতিটি সময়েরই আলাদা ভাষা থাকে, থাকে তার নিজস্বতা।
বেশ বড়-সড় প্যাকেট। প্যাকেটের গায়ের একপাশে থাকতো রাজার মাথা। অবাক করা ব্যাপার হলো, এই রাজার মাথা ছিল দুটো। একটা গলায় দুটো মাথা বসানো। ওপর-নিচ যেখাবেই ধরি, রাজার মুখ স্পষ্ট।
শৈশব থেকে ক্রমশ কৈশোরের দিকে ছুটে চলা পুত্রকে যখন এসবের কথা বলি, কতটুকু বোঝে নিজেও বুঝি না। ওরাও ধীরে ধীরে তৈরি করে নিচ্ছে নিজস্ব জগৎ। সে জগতে একা থাকাই আনন্দের। সঙ্গীর প্রয়োজন হয় না। বন্ধুর প্রয়োজন হয় না। ভার্চুয়াল জগতকে ওরাও চিনে নিচ্ছে খুব দ্রুত। মুক্ত আকাশের চেয়ে মুক্ত অন্তর্জালই তাই প্রিয় হয়ে উঠছে। রক্ত মাংসের বন্ধুর চেয়ে বোকাবাক্সের ভেতরে ভেসে ওঠা সিনচন নামের শিশুর উপস্থিতিই জরুরি। সিনচন থাকলে আর কাউকে প্রয়োজন নেই। মধ্যবিত্ত শব্দটি প্রথম কবে জেনেছিলাম মনে নেই। সেই মধ্যবিত্তেরও যে আবার রয়েছে নানান ভাগ, তা তো ছিল আরও দূরের। অথচ বোকা বাক্সের বন্ধু সিনচন সাত বছরের শিশুকেই শিখিয়ে দিয়েছে মধ্যবিত্তের ভেতরেই রয়েছে নিম্নমধ্যবিত্ত। যাদের সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য নেই। ব্যক্তিগত গাড়ি এখন বিলাস দ্রব্য নয়, বরং মধ্যবিত্তের প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হলেও তা নিম্নমধ্যবিত্তের সাধ্যের এখনও বাইরে। সাত বছরের শিশুর কাছে অর্থনীতির এ রকম নানান সমীকরণ জানতে জানতে মনের কোনে উঁকি দিতে থাকে আমার কৈশোর।
টিনের বাক্স ভর্তি কাঁচের মার্বেল, টিনের চাকতি, লোহার গোল চাকা, রিকশার বেয়ারিং দিয়ে বানানো ত্রিভুজাকৃতির ঠেলা গাড়ি, নানারকম সিগারেট আর ম্যাচবাক্সের খোলস, লাটিম, গুলতি, বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি শর্টগান, যার গুলি ছিল পিপলটি গাছের বিচি, কেরোসিন তেলে চলা লঞ্চ, লাটাই, ঘুড়ির বাইরে তালিকায় যোগ হওয়ার সরঞ্জামের কথা মনে নেই। কিন্তু এ সবই আমাদের আনন্দে মাতিয়ে রাখতো। ছেলেবেলার নানান খেলনার মাঝে আরও একটি খেলনার সামগ্রীর কথা মনে পড়ে। যাকে শিশুর খেলনা বলা যায় না। কিন্তু আমাদের কাছে হয়ে উঠেছিল খেলনার সামগ্রী। আজকের শিশুদের কেউই একা স্কুলে যায় না। বাবা-মা সঙ্গে নিয়ে যায়, স্কুল ছুটি হলে নিয়ে আসে। প্রথম শ্রেণীর ছাত্র হলেও, তখন আমরা একাই রওনা দিতাম। কিন্তু বাসা থেকে বেরুনোর পরেই ধীরে ধীরে আমাদের দল ভারি হয়ে উঠতো। কখনো কখনো আমাদের পরে যাদের বাসা, তারা রাস্তা থেকেই ডাক দিতো, সঙ্গী পেয়ে যেতাম। না হলে চলা শুরু করলেই একজন দুজন করে পথে যোগ হতো, স্কুলের কাছকাছি গিয়ে দেখা যেতো বেশ বড় সড় একটি দল। পথে ছোট ছোট দোকান পড়তো। সেই দোকানগুলো ছিল বিভিন্ন বাড়ির ভেতরে। জানালা থাকতো বড়, খুলে রাখা হতো, জানালার রডের সঙ্গে ঝোলানো থাকতো নানান জিনিস।
আমরা প্রয়োজন মতো কিনে নিতাম। দশ পয়সায় পাওয়া যেতো হজমি। কালো, সঙ্গে লবন মেশানো, মুখে দেওয়ার পরেই কেঁপে উঠতো সারা শরীর। টকটক স্বাদ, আজকের দিনের হজমলার মতো নয়। ওর স্বাদই আলাদা। কাঠি লজেন্স ছিল, সেও দশ পয়সা। স্কুলে যাবার সময় বাড়ি থেকে অধিকাংশ সময় দেওয়া হতো চার আনা। আট আনা পেয়েছি, আরও বড় হয়েছে। বাড়ির দোকানের জানালায় ঝোলানো থাকতো সারিবদ্ধ বেলুন। বেশ বড়-সড় প্যাকেট। প্যাকেটের গায়ের একপাশে থাকতো রাজার মাথা। অবাক করা ব্যাপার হলো, এই রাজার মাথা ছিল দুটো। একটা গলায় দুটো মাথা বসানো। ওপর-নিচ যেখাবেই ধরি, রাজার মুখ স্পষ্ট। চার আনা দিলে, রাজার মাথাওয়ালা তিনটা বেলুন পাওয়া যেতো।
দোকানে দোকানে তারই জ্ঞাতিভাইদের এখন উজ্জ্বল উপস্থিতি, তাদের এত যে প্রচার, এত যে উন্নতি কিন্তু রাজা নেই। যেন বেমালুম মিশে গেছে-আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া বেলুনের সঙ্গে।
ছুটির দিনগুলোর আগে আগে, আমরা ওই বেলুন কিনে এনে খুব ভালো করে সাবান দিয়ে নিতাম। কারণ বেলুনের গা ছিল তেলতেলে, সেই তেল হাতে লেগে গেলে উঠতো না সহজে। ধোয়া বেলুনগুলোকে আগে থেকে জোগাড় করা বোতলের মুখে খুব শক্ত করে সুতো দিয়ে বাঁধতাম। কোথা থেকে শিখেছিলাম, মনে নেই, কিন্তু সেই বেলুনগুলো বোতলের মুখের সঙ্গে বাঁধার আগেই বোতলের ভেতরে দিতাম চুন, সিগারেটের প্যাকেটের ভেতরের রাংতা এবং অল্প পানি। এরপর রেখে দিতাম রোদে, খোলা জায়গায়। কিছু পর পর এসে দেখতাম, বেলুন কতটা ফুলেছে। চুন, পানি আর রাংতা সূর্যের তাপে বিক্রিয়া করে তৈরি করতো গ্যাস, সেই গ্যাসে ফুলে উঠতো বেলুনগুলো। যথেষ্ট পরিমানে ফুলে উঠলে, বেলুনগুলো খুলে নিতাম বোতল থেকে। কখনও কখনও সময়ের হেরফেরে বেশি ফুলে ফেটেও যেতো। তারপর তিনটা বেলুন এক করে বেঁধে, তার সঙ্গে কাগজে লিখে দিতাম নানান কথা ও নাম। মনে করতাম, আকাশের উঁচুতে মেঘ পেরিয়ে বেলুনগুলো বার্তা নিয়ে যাবে ভিনগ্রহে। ওখানের কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
এলিয়েন শব্দটা আমার তখন জানা ছিল না। কিন্তু ভিনগ্রহের প্রাণীর বিষয়ে গল্প শুনেছি অনেক। সেই ভিনগ্রহের প্রাণীদের সন্ধানে পরিচালিত অভিযানের বেলুনগুলোকে বড় হয়ে জানলাম তাকে বেলুন বলে না, তারও রয়েছে আলাদা নাম। ব্যবহারও ভিন্ন। আজকের মতো আমার শৈশবে, কৈশোরে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, পাড়ায় পাড়ায় ওষুধের দোকান ছিল না। সাধারণত বড় রাস্তার পাশে বাজারেই দেখা মিলতো ওষুধের দোকানের। আজ রাস্তার মোড়ে পাঁচটা দোকান থাকলে তার একটা ওষুধের। পাড়ায় কয়েকটা দোকানের একটা ওষুধের। মুদিখানারও অন্ত নেই। শৈশব-কৈশোরের গ্রামের সেই মেঠোপথ নেই, সেখানে এখন পাকা সড়ক। বাড়ির ভেতর থেকে পরিচালিত দোকানও নেই। সবকিছু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে দুই মাথাওয়ালা রাজাও। দোকানে দোকানে তারই জ্ঞাতিভাইদের এখন উজ্জ্বল উপস্থিতি, তাদের এত যে প্রচার, এত যে উন্নতি কিন্তু রাজা নেই। যেন বেমালুম মিশে গেছে-আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া বেলুনের সঙ্গে।
চলবে…
সোনার খাতায় ছড়ানো জীবন-২২॥ মামুন রশীদ