আমার বন্ধু তাহের
হঠাৎ চায়ের প্লেট শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে বলি, ‘এই দ্যাখো,
. ফ্লাইং সসার’
ছেলেকে দেখাই। কিন্তু ততক্ষণে ছেলের মায়ের
কান ঘেঁষে সেই প্লেট উড়ে যায় চকিত সন্ত্রাসে
ছবি ও আয়নার ফাঁকে রুদ্ধশ্বাস বাঁক নিয়ে
ঘরের দুর্গম অংশে খানখান হয়ে ভেঙে পড়ে।
ছেলে উল্লসিত। তার মা স্তব্ধ, আতঙ্কিত। পরিণাম ভয়ে
আমি নিজেও উদ্বিগ্ন।
তখন, ছেলেকে আমি কানে কানে বলি,
‘ফ্লাইং সসার এলে গ্রহের প্রাণীরা ঠিক এরকমই আচরণ করে।’
(মন্তেশ্বরী মেথড: রণজিৎ দাশ)
তাহের, আমার বন্ধু। ছেলেবেলার এই বন্ধুটির কথা নানা কারণে আমার মনে পড়ে। সময়ে অসময়ে মনে পড়ে। খুব বেশি দিনের বন্ধুত্ব না। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। নতুন স্কুল, তখনই পরিচয়। ষষ্ঠ ও সপ্তম—এই দুই শ্রেণীতে এক সঙ্গে পড়েছি। এ সময়ে আমাদের যা দেখা-কথা, তার বেশিরভাগ স্কুলের সময়েই। স্কুলের বাইরে তাহেরের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ কম ছিল। এই সময় বাবার চাকরিস্থল বগুড়া জেলার একটি উপজেলা— ধুপচাচিয়াতে থাকতাম আমরা। আমাদের স্কুলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শান্ত নাগর নদ। এই নদ উপজেলা শহরটিকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। আমাদের স্কুল যে পাশে, সে পাশেই মূল শহর। আর নদের ওপর পাড়ের সঙ্গে মূল অংশের যোগাযোগও তখনো বাঁশের সাঁকো। তাহের থাকতো নাগর নদের অন্য অংশে। তাই স্কুল ছুটির পর আমাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ ওর কম ছিল। স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে আমরা বইখাতা রেখে, কিছু খেয়ে চলে যেতাম স্কুলের মাঠে। ফুটবল খেলতাম। কখনো এমনি বসে থাকতাম। এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতাম। অষ্টম শ্রেণীতে উঠে স্কুল পাল্টালাম। তাহেরের সঙ্গে দেখা প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। মাধ্যমিকের পর, ধুপচাচিয়া ছেড়ে চলে এলাম আমরা। তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো।
তাহেরের কথা আমার মনে পড়ে। স্কুলে পড়ার সময়েই গাছ থেকে পড়ে গিয়ে ওর ডান হাত ভেঙে যায়। ডাক্তার প্লাস্টার করে দেয়। হাড় জোড়া লাগে। নির্ধারিত সময়ে প্লাস্টার খোলার পর দেখা যায়, কব্জির কাছটা বাঁকা। হয়তো যেমন করে ভেঙেছিল, প্লাস্টারটা ওভাবেই করা হয়েছিল। ওই বাঁকা হাতের কারণেই, ওর প্রতি আলাদা নজর যেত সবার। যখন আমাদের সঙ্গে হাত মেলাতো, তখন ওর ডান হাতের কব্জির বাঁকাটা চোখে পড়তো।
সেই তাহেরের সঙ্গে আমার আবার দেখা হলো। দেখা হলো প্রায় পঁচিশ বছর পর। জীবন গিয়াছে চলি আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পর—জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো। তবে কুড়ি বছর না, তারও পাঁচ বছর পর, সত্যিকারের দেখা হলো। আমাদের যে বছর দেখা হলো, তখন গ্রেগরিয়ার ক্যালেন্ডার বলছে, সেটা ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ। পঁচিশ বছর পর, দেখা। সেও একবারের জন্যই। এরপর আর দেখা হয়নি। এত বছর দেখা নেই, যোগাযোগ নেই। জীবন থেকে পঁচিশ বছর হারিয়ে যাওয়ার পর কেন দেখা হলো? না হলেই ভালো হতো। দেখা হওয়ার পর থেকে, যতবার মনে পড়ে তাহেরকে, আমার কষ্ট বাড়ে। অস্থিরতা তৈরি হয়। বুকের ভেতরে বাতাস মোচড় দিয়ে ওঠে।
রাজধানীতে আসার পর থেকে প্রতিমাসে একদিনের জন্য হলেও বগুড়া ফেরা আমার রুটিন হয়ে গেছে। সেবারও গিয়েছি। প্রতিবারের মতো সন্ধ্যাবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। উদ্দেশ্য শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথায় যাওয়া। ওখানে বন্ধুরা আসে, আড্ডা মারি। বাড়ি থেকে বেরুনোর আগেই বন্ধু সাজ্জাদ কল দিয়ে জানায়, ও রাস্তায় অপেক্ষা করছে। ওর সঙ্গে দেখা হলো। কথা-বার্তার মাঝেই সাজ্জাদ সাতমাথায় যাওয়ার জন্য রিকশা ভাড়া করে। আমরা দু’জনে উঠে পড়ি। নানান গল্পে মাঝের পথটুকু পেরিয়ে আসি। মাত্র কয়েক মিনিটের দূরত্ব। গন্তব্যে পৌঁছে নেমে পড়ি দুজনে। সাজ্জাদ ভাড়া মিটিয়ে দিচ্ছে, সে সময় রিকশার চালক হঠাৎ করেই আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনার নাম কি মো. মামুনুর রশীদ?’ আমি চমকে উঠে হ্যাঁ (মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট অনুযায়ী এটাই আমার নাম) বলি। সে আবার প্রশ্ন করে, ‘আপনি কি কখনো ধুপচাচিয়াতে ছিলেন?’ আমি আবারও হ্যাঁ বলি। তখনও আমার মাথায় কেউ নেই, কারও কথা মনে আসেনি। এরপর সে আমাকে আমার বাবার নাম জানিয়ে বলে, ‘উনি আপনার বাবা?’ এবারও আমি হ্যাঁ বলতেই, সে আচ্ছা বলে রিকশা নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়। আমি তাকে থামাই। বলি, আপনাকে তো চিনতে পারছি না। আমার মনে পড়ছে না। কিন্তু আপনি তো আমাকে চেনেন। আপনিও কি ধুপচাঁচিয়াতে ছিলেন? তখন সে আমাকে বলে, ‘আমার বাড়ি ধুপচাচিয়া। আমি তোমার সঙ্গে স্কুলে পড়েছি।’ আমি তখনো তাকে চিনতে পারি না। নাম জানতে চাই। বলে, ‘তাহের, আমাকে মনে নেই?’
আমার সারাশরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আমি নির্বাক হয়ে যাই। তাহের আমার বন্ধু। তাকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছা, হয়তো আমার অবচেতন মন বাধা দেয়। আমি তাহেরের হাত ধরি। কত বছর পর দেখা। চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করি। ওর হাত ধরে বলি, ‘তোর হাত তো সেই ভাঙাই আছে রে।’ তাহের বলে ওঠে, ‘যাক, তুই আমাক তাহলে ভুলে যাসনি।’ এরপর আমি কোথায় থাকি, কী করি ঝটপট শুনে নিয়েই যেন পালিয়ে যায়। ওর কোনো কথাই আমার জানা হয় না। ওর সঙ্গে যোগাযোগেরও আর কোনো পথ থাকে না।
এখনো প্রতি মাসে বগুড়া যাই। প্রয়োজন ছাড়া রিকশায় ওঠা হয় না। তাহেরের সঙ্গেও আর দেখা হয় না। তবু তাহেরকে আমি খুঁজি। কেন খুঁজি, জানি না। দেখা হলে কী বলব, তাও জানি না। তবু খুঁজে ফিরি জীবনের জটিল গোলক ধাঁধায় পিছিয়ে পড়া আমার বন্ধু তাহেরকে। আর বেদনায় ক্ষত-বিক্ষত হই।
চলবে…