যেখানেই যাও তুমি,
যেখানেই যাও সঙ্গে যায় আরো একজন
যদিও অদূরে তবু তার দূরত্ব ভীষণ
তোমার সম্মুখে তবে আমি এসে আবার দাঁড়াই?
(সৈয়দ শামসুল হক)
পেছনে ফেলে আসা পথের কথা কখনোই ভুলতে পারি না। যতই বলি স্মৃতির কাছে ফিরব না। ততই বারবার ফিরে যেতে হয়। সময়ে-অসময়ে স্মৃতি আমাদের তাড়া করে। সুখের স্মৃতি আবার দুঃখের স্মৃতি—দুই ধরনের স্মৃতিতেই আমাদের মন ক্রিয়াশীল। কিন্তু অনেকের কাছেই শুনি—দুঃখের স্মৃতিতেই তারা বেশি আক্রান্ত হন। কিন্তু আমার বেলায় দেখেছি সুখের স্মৃতি রোমন্থনেই বেশি সময় কেটে যায়। না, এর মানে এই নয় যে আমার সুখের স্মৃতির ভাণ্ডার খুব সমৃদ্ধ। বরং উল্টোটাই ঘটেছে। তবে এটা ঠিক—জীবনে এই সময় পর্যন্ত আসার পথে, আমি যত মানুষের অযাচিত উপদেশ, ভালোবাসা, স্নেহ পেয়েছি, তা মনে হয় খুব কম মানুষের ভাগ্যেই জোটে। এদিক থেকে সৃষ্টিকর্তা আমাকে অনেক অনেক বেশি দিয়েছেন। রাস্তাঘাটে সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষেরও ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি, যা আমার প্রত্যাশাতেও ছিল না। ফলে আমার চলার পথ অনেক মৃসণ হয়েছে।
রাতে খাবার টেবিলে বসে আমার মন হঠাৎ করেই চলে গেল পেছনে। এক থেকে দেড় দশক আগের ঘটনা। ওই সময় এক বাড়িতে গিয়েছি বেড়াতে। নিকট আত্মীয়। রাতে, সবাই খেতে বসেছি। টেবিলে ভাজা ইলিশ মাছ। দেখেই জিভে জল এলো। ইলিশ আমার খুবই পছন্দের মাছ। আর ভাজা হলে তো কথাই নেই। সেদিনের সেই রাতে, বাড়ির গৃহিণী আমাকে কোনো ভাজা মাছই দিলেন না। আর ছেলেকে একে একে চার-পাঁচ টুকরা মাছ তুলে দিলেন। সেও আমাকে অবাক করে অবলীলায় খেয়ে ফেললো কয়েক টুকরা মাছ। লজ্জায় আমিও চাইতে পারলাম না।
এই ঘটনার পর, তখন আমি বাড়ির বাইরে। মানে বগুড়ায় থাকতাম না। পড়ালেখা অথবা চাকরি কোনো এক কারণে বাড়ির বাইরে। মাসে এক-দুইবার বগুড়া যাই। সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে রওনা দিলে বাড়ি পৌঁছুতে পৌঁছুতে মধ্যরাত পেরিয়ে যেত। যেদিন আমি বাড়ি যাব, সবাই রাত জেগে অপেক্ষা করতেন। আমার আব্বাও জেগে থাকতেন। এশার নামাজের পর তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন। কিন্তু আমার বাড়ি ফেরার শব্দে তিনি জেগে উঠতেন। (এই, এখনো আমি যত রাতেই বাড়ি ফিরি, তিনি ঠিক জেগে ওঠেন)। আমি খেতে বসার পর একবার আমার খোঁজ নিয়ে যান। সেবারও যখন বাড়ি ফিরে, মধ্যরাতের পর খেতে বসে খাবার টেবিলে মা’র কাছে ইলিশ মাছ ভাজার গল্প করছি, আব্বা তখন টেবিলে ছিলেন না। পরদিন দুপুরে আমরা সবাই যখন খেতে বসেছি, মা আমার খাবারের থালায় আস্ত একটি ইলিশ মাছ ভাজা তুলে দিলেন। না না জাটকা ইলিশ না। সত্যিকারের ইলিশ। আমি অবাক, মা’কে বললাম, এত বড় মাছ খেতে পারব না। আব্বা বললেন, ভাত খেতে হবে না। তুমি আজ মাছটাই খাও।
ভালো লাগা, ভালোবাসায় আমার মন আর্দ্র হয়ে ওঠে। আমার চোখ ভিজে যেতে থাকে। এই এখনো ভিজে উঠছে আমার চোখ—ঠিক সেদিনের মতোই।
সোনার খাতায় ছড়ানো জীবন: পর্ব-১৬ ॥ মামুন রশীদ